প্রচ্ছদ রচনা-ধ্রুপদ সাহিত্যের কথক জুলিয়ান বার্নেস by এম এ মোমেন

জুলিয়ান বার্নেস ইংরেজি সাহিত্যে এবং ইংরেজিভাষী কমনওয়েলথ দেশগুলোর সাহিত্যে কোনো আকস্মিক আগন্তুক নন। আরো গুরুত্বপূর্ণ তথ্যটি হচ্ছে, সাহিত্য ও সংস্কৃতির নাক উঁচু দেশ ফ্রান্সে গত তিন দশকে জুলিয়ানের মতো সমাদৃত কোনো ইংরেজ লেখকের নাম শোনা যায়নি। তাঁর একটি স্মরণীয় উপন্যাস 'ফ্লবেয়রের তোতা পাখি' (ফ্লবেয়রস প্যারোট) ১৯৮৪ সালে মান বুকার ফিকশন পুরস্কারের জন্য হ্রস্ব তালিকায় অন্তর্ভুক্ত ছিল।


কিন্তু পুরস্কৃত হলো অনিতা ব্রুকনারের 'হোটেল দ্যু লাক'; আর 'ফ্লবেয়রের তোতা পাখি'র জন্য তিনি পেলেন দুটি সেরা ফরাসি সাহিত্য পুরস্কার।
১৪ বছর পর ১৯৯৮ সালে জুলিয়ান বার্নেসের 'ইংল্যান্ড ইংল্যান্ড' উপন্যাসটি অনেক বাছাইয়ের পর হ্রস্ব তালিকাভুক্ত হলো। ১৯৮৪ সালের উপেক্ষা এবার কিছুটা হলেও লাঘব হবে বলে অনেকেই মনে করলেন; কিন্তু পুরস্কৃত হলো আয়ার্ন ম্যাক ইভানের উপন্যাস 'আমস্টারডাম'।
২০০৫ সালে আবার হ্রস্ব তালিকাভুক্ত হলো তাঁর উপন্যাস 'আর্থার অ্যান্ড জর্জ'; কিন্তু পুরস্কৃত হলো জন ক্যালভিলের 'দ্য সি'; অবশ্য 'দ্য সি' বছরের সেরা উপন্যাস বলে অনেকেই মেনে নিয়েছেন।
বুকার যখন অধরাই থেকে যাবে বলে মনে হচ্ছিল, সে সময় প্রকাশিত 'দ্য সেন্স অব অ্যান এন্ডিং' চলতি বছরের হ্রস্ব তালিকায় উঠল এবং সংবাদপত্রের অনুমান, বাজিকর ন্যাডব্রুকের অনুমান সঠিক প্রমাণ করে এই উপন্যাসটির জন্য জুলিয়াস বার্নেসকে পুরস্কৃত করা হলো।
বুকার ফিকশন পুরস্কারের জুরিবোর্ডের যোগ্যতা নিয়ে অনেক প্রশ্ন উঠলেও জুলিয়াস বার্নেসকে বেছে নিতে পারায় অভিযোগের অনেকটাই এখন চাপা পড়ে যাবে। জুলিয়াসকে এবার যাঁদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হয়েছে, তাঁদের মধ্যে ছিলেন ক্যারোল বার্চ, প্যাট্রিক ডি-উইট, এসি এদুগায়ান, স্টেফেন কোলম্যান এবং এ ডি মিলার। ২০১১ সালের পুরস্কারের জন্য হ্রস্ব তালিকাটি প্রকাশিত হওয়ার পরই একে 'ভুল তালিকা' আখ্যা দেওয়া হলো। আর পুরস্কার ঘোষণার পর বলা হচ্ছে, 'ভুল তালিকা থেকে সঠিক বাছাই' জুলিয়ান বার্নেস। জুলিয়ান প্যাট্রিক বার্নেসের বয়স ৬৫ বছর। তাঁর জন্ম ইংল্যান্ডের লেস্টারে ১৯৪৬ সালে। তাঁর জন্মের পরপরই গোটা পরিবার চলে আসে লন্ডনে। মা-বাবা দুজনই ফরাসি ভাষার শিক্ষক হওয়ায় তাঁর বাড়িতে ইংরেজির পাশাপাশি একটি ফরাসি সাংস্কৃতিক আবহও বিরাজমান ছিল। ফলে বৃহত্তর ও বিচিত্র প্রেক্ষাপটে তাঁর মানস গঠিত হয়েছে। তাঁর প্রথম গ্রন্থ_অনেকটা আত্মজৈবনিক উপন্যাস 'মেট্রোল্যান্ড' উপশহর থেকে উঠে আসা তাঁরই মতো এক যুবক ক্রিস্টোফারের প্যারিস গমন এবং লন্ডনে ফিরে আসার কাহিনী। আর শেষ উপন্যাস (গ্রন্থ সমালোচকরা ঢাউস উপন্যাসের বাজারে মাত্র ১৫০ পৃষ্ঠার হওয়ায় একে বরং নভেলেটই বলছেন) 'দ্য সেন্স অব অ্যান এন্ডিং' টনি ওয়েবস্টারের কাহিনী। তাঁর বয়স ষাটের কিছু ওপরে। তাঁর মনে হয় জীবন শেষ হয়ে আসছে। সুতরাং একবার পেছনে তাকাচ্ছেন, একবার সামনে। উপন্যাসের প্রথম অধ্যায়ের একটি অংশ :
'আমি এখন অবসরপ্রাপ্ত। নিজ অধিকারে আমার একটি ফ্ল্যাট আছে। আমার সঙ্গে মদ্যপান করে এমন কয়জন বন্ধুর সঙ্গে আমার সুসম্পর্ক রয়েছে; কয়জন মহিলা বন্ধুও আছেন_তাঁদের সঙ্গে সম্পর্কটা নিষ্কাম (তা ছাড়া তাঁরা তো এই গল্পের অংশও নন)। আমি স্থানীয় ইতিহাস সমিতির একজন সদস্য; মেটাল ডিটেক্টরের অনুসন্ধানী যন্ত্র যা বের করতে পারে, তা দেখে যারা উত্তেজিত, আমার সে উত্তেজনাও নেই। কিছু দিন আগে আমাদের স্থানীয় হাসপাতালের পাঠাগারটি পরিচালনার দায়িত্ব নিই। বই বিতরণ করে, বই সংগ্রহ করে এবং বই পড়ার সুপারিশ করে আমি ওয়ার্ড থেকে ওয়ার্ডে ঘুরে বেড়াই। এতে আমার বাইরে যাওয়া হয় এবং একটা ভালো কিছুও করা হয়; নতুন মানুষের সঙ্গেও দেখা হয়। তারা অবশ্যই অসুস্থ, কেউ কেউ মৃত্যুশয্যায় শায়িত। যখন আমার সময় আসবে, আমি অন্তত জানতে পারব হাসপাতালে আসার পথ কোনটি।
জীবন এমনই, তাই না? কিছু অর্জন এবং কিছু হতাশা।' এই অনুচ্ছেদটি কি বলে দেয় না, তিনি কী নিয়ে উপন্যাসটি লিখেছেন_শেষ হয়ে যাওয়া নিয়ে। সে জন্যই শেষ হয়ে যাওয়ার অনুভূতি 'দ্য সেন্স অব অ্যান এন্ডিং'।
চতুর্থবার ভাগ্য প্রসন্ন হলো জুলিয়ান বার্নেসের। বুকার কর্তৃপক্ষ মন্তব্য করেছে, বইটিতে ধ্রুপদ সাহিত্যের গুণাগুণ রয়েছে, প্রতি পঠনেই নতুন গভীরতা আবিষ্কৃত হয়।
পুরস্কার পাওয়ার পরপরই জুলিয়ান বলেন, তিনি বিশেষ স্বস্তি পেয়েছেন। কারণ তিনি কবরে গিয়ে বুকার পেতে চাননি।
পাঁচবার হ্রস্ব তালিকায় এসেও বেইনব্রিজ বুকার পাননি। পেয়েছেন মরণোত্তর বুকার।
একালের বিখ্যাত উপন্যাসগুলোর ব্যাপারে পুরস্কারপ্রাপ্ত এবং পুরস্কারের জন্য তালিকাভুক্ত যে প্রশ্নটি সবার আগে আসে তা হচ্ছে, পাঠযোগ্য হতে হবে, সাহিত্যও থাকতে হবে।
আবার অধিক পাঠযোগ্য হলেও এই প্রশ্নটাও আসে_এতে সাহিত্য আছে তো? ভালো হলে পাঠযোগ্য হতে হবে, সাহিত্যও থাকবে। এই প্রত্যাশাটি জুলিয়ান বার্নেস পূরণ করেছেন বলে মনে করা হচ্ছে।
তাঁর হাতে প্রবহমান গদ্য আছে, কায়দাটা ভালো রপ্ত করেছেন ভ্যান কাভানাগ ছদ্মনামে ক্রাইম ফিকশন লিখে। ১৫০ পৃষ্ঠার উপন্যাস আমাদের ঈদ সংখ্যার উপন্যাসের বিবেচনায় বড়ই মনে হতে পারে_ভাগ্যিস ব্রিটেনে ক্রিসমাস সংখ্যার উপন্যাস ছাপা হয় না। তাহলে ৪০০ থেকে ৯০০ পৃষ্ঠার উপন্যাস আর লেখা হতো না।
জুলিয়ান বার্নেসের উপন্যাসই বুকার পাওয়া সবচেয়ে ছোট উপন্যাস নয়; ১৯৭৯ সালের বুকারজয়ী পেনিলাপ ফিটজেরাল্ডের অফশোরের পৃষ্ঠাসংখ্যা এক শরও কম।
জুলিয়ান বার্নেস পেছনে তাকিয়ে কেবল স্মৃতির কথা লিখবেন কেন_তিনি বিস্মৃতির কথাও লেখেন। বিস্মৃতিকে টেনে বের করে নিয়ে আসেন উপন্যাসের পাতায়। ভবিষ্যৎকেও।
তাঁর উপন্যাসগুলো হচ্ছে 'মেট্রোল্যান্ড' (১৯৮০), 'বিফোর শি মেট মি' (১৯৮২), 'ফ্রবেয়রস প্যারোট' (১৯৮৪), 'স্টেয়ারিং অ্যাট দ্য সান' (১৯৮৬), 'এ হিস্ট্রি অব ওয়ার্ল্ড ইন টেন অ্যান্ড হাফ চ্যাপ্টার' (১৯৮৯), 'টকিং ইট ওভার' (১৯৯১), 'দ্য পরকিউপাইন' (১৯৯২), 'ইংল্যান্ড ইংল্যান্ড' (১৯৯৮), 'লাভ এটসেট্রা' (২০০০), 'আর্থার অ্যান্ড জর্জ' (২০০৫) ও 'দ্য সেন্স অব অ্যান এন্ডিং' (২০১১)।
তাঁর ছোটগল্পের বই তিনটি_'ক্রস চ্যানেল' (১৯৯৬), 'লেমন টেবল' (২০০৪) ও 'পালস' (২০১১)।
স্মৃতিকথা : 'নাথিং টু বি ফরগটেন' (২০০৮)।
ভ্যান কাভানাগ ছন্দনামে লিখেছেন চারটি ক্রাইম ফিকশন। আর জুলিয়ান বার্নেসকে নিয়ে ম্যানচেস্টার, মিসিসিপি ও সাউথ ক্যারোলাইনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গবেষণা গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। ফ্রান্স ও আমেরিকায় তাঁর একটি শক্তিশালী বোদ্ধা পাঠকগোষ্ঠী রয়েছে।
বুকার বিজয়ী উপন্যাসটিতে যদিও মৃত্যুর ইশারা রয়েছে, তবু বার্ধক্য সম্পর্কে বলছেন : 'আপনি নিজের কাছে প্রথম বৃদ্ধ হন না, হন অন্যের চোখে, ধীরে ধীরে। আর একসময় তাঁদের মতামতটাই আপনি মেনে নেন।' জুলিয়ান বার্নেসকে অভিনন্দন।

বুকার বাছাই : হ্রস্ব তালিকা

একই জুরিবোর্ড আরেক দফা যাচাই-বাছাই ও বাতিল করে দীর্ঘ তালিকা ছয়ে নামিয়ে আনে। হ্রস্ব তালিকায় অন্তর্ভুক্তিই একটি পুরস্কার। এ তালিকা লেখকের জন্য পরিচিতির দিগন্ত বাড়িয়ে দেয়, বইয়ের বিক্রি বাড়ে আর পুরস্কার ঘোষণার আগ পর্যন্ত মান বুকার ফিকশন পুরস্কার পাওয়ার সম্ভাবনা তো জাগ্রত থাকেই। হ্রস্ব তালিকার উপন্যাসগুলো হচ্ছে :
'দ্য সেন্স অব অ্যান এন্ডিং'_জুলিয়ান বার্নেস
'জামরাখস মিনাজারি'_ক্যারোল বার্চ
'দ্য সিস্টারস ব্রাদারস'_প্যাট্রিক ডি-উইট
'হাফ ব্লাড ব্লুজ'_এ সি এদুগায়ান
'পিজিয়ন ইংলিশ'_স্টেফেন কেলম্যান
'স্নোড্রপম'_এ ডি মিলার

পাঁচ বিচারক ভালো উপন্যাস চিনবেন তো?

গ্যাবি উড : (সাংবাদিক ও সাহিত্যিক, ডেইলি টেলিগ্রাফের গ্রন্থ বিভাগের প্রধান, এডিসনস ইভ তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাস)
ক্রিস কুলিন : (লেখক, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ, সাবেক সংসদ সদস্য এবং মন্ত্রী। তাঁর ডায়েরির দুই খণ্ড প্রকাশিত হয়েছে, তৃতীয় খণ্ড প্রকাশের পথে, এরর অব জাজমেন্ট উল্লেখযোগ্য বই।
সুসান হিল : (লেখক, প্রকাশক ও বইপত্র আলোচক, উপন্যাসের সংখ্যা ৫৩; সমারসেট মম পুরস্কার ও হুইটব্রেড পুরস্কার পেয়েছেন। একবার বুকারের হ্রস তালিকায় এসেছিলেন। তাঁর 'দ্য ওমেন ইন ব্যাক' নাটক লন্ডনের ওয়েস্ট এন্ড থিয়েটারে টানা ২১ বছর ধরে চলে আসছে)।
ম্যাথু ডি অ্যাঙ্কোনা : (স্পেকটেটর পত্রিকার সম্পাদক, তিনটি উপন্যাস লিখেছেন। সাংবাদিকতা ও লেখালেখির জন্য পুরস্কার পেয়েছেন)।
স্টেলা রিমিংটন : (নিরাপত্তা সংস্থা এম ১৫-র প্রথম মহিলা মহাপরিচালক, আত্মজীবনী আর লিজ কার্লাইল সিরিজের পাঁচটি উপন্যাস লিখেছেন)।

No comments

Powered by Blogger.