হেলেন কেলারঃ প্রতিবন্ধীদের পথপ্রদর্শক by আবু সাঈদ চৌধুরী
হেলেন কেলার একজন সুস্থ এবং স্বাভাবিক শিশু হিসেবে জন্মগ্রহণ করেন ১৮৮০ সালের ২৭ জুন আমেরিকার তাসকামবিয়ায়। তার বাবা অবসরপ্রাপ্ত সেনা অধ্যক্ষ আর্থার কেলার ছিলেন দি নর্থ অ্যালবামিয়ান পত্রিকার সম্পাদক। আর্থার কেলার ছিলেন ভীষণ জনপ্রিয় এবং সুপরিচিত। দেড় বছর বয়সে হেলেন কেলার স্কারলেট জ্বরে আক্রান্ত হন।
এই জ্বর এমনই ভয়াবহ, রোগী সেরে উঠলেও তার দেহে রোগের কোনো না কোনো নিদর্শন থেকে যায়। ফলে হেলেন কেলার হারান সম্পূর্ণ দৃষ্টি এবং শ্রবণশক্তি। অর্থাত্ তিনি চোখে দেখতেন না এবং কানেও কম শুনতে পেতেন।
তারপর থেকে কয়েক বছর দারুণ নিঃসঙ্গতায় কাটে হেলেনের। তার প্রকৃত জীবন শুরু হয় ১৮৮৭-এর মার্চে, তখন তার বয়স প্রায় সাত বছর। এই দিনটিকেই তিনি তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং স্মরণীয় দিন মনে করতেন। কারণ, ওইদিন অ্যানসালিভান নামে একজন শিক্ষয়িত্রী তাসকামবিয়ায় এসে হেলেন কেলারকে ছাত্রী হিসেবে গ্রহণ করেন। বিশ বছর বয়স্ক গ্র্যাজুয়েট স্যালিভানও ছিলেন দৃষ্টিহীন। তবে অপারেশনের মাধ্যমে তিনি তার দৃষ্টিশক্তি ফিরে পান। কিন্তু হেলেন কেলারের দৃষ্টিশক্তি কোনো চিকিত্সাতেই ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। অ্যানসালিভান টেলিফোন আবিষ্কারক আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেলের মাধ্যমে হেলেন কেলারের শিক্ষয়িত্রী হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। সেই সৌভাগ্যময় দিন থেকেই স্যালিভান ১৯৩৬ সালে তার মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত প্রিয় ছাত্রী হেলেন কেলারের পাশে ছিলেন।
দৃষ্টিহীন এবং বধির হেলেন কেলারকে স্যালিভান যেভাবে একজন স্বনামখ্যাত ব্যক্তি হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন সে কাহিনী উইলিয়াম গিবসনের নাটক ও চলচ্চিত্র ‘দি মিরাকল ওয়ার্কার’ এবং হেলেন কেলারের নিজের লেখা ‘দি স্টোরি অফ মাই লাইফ’ বইটিতে সম্পূর্ণ বর্ণনা করা হয়েছে। স্যালিভান একটি পুতুল দিয়ে শিক্ষকতার কাজ শুরু করেন। পুতুলটি পারকিন্স স্কুলের দৃষ্টিহীন ছাত্রছাত্রীরা তৈরি করে দিয়েছিলেন। হেলেনকে উ-ঙ-খ-খ হাতে লিখতে শেখাতে পেরে স্যালিভান আশাবাদী এবং সত্যি সত্যিই কৃতকার্য হলেন। হেলেন মাত্র অল্প কয়েক দিনেই অনেক শব্দ শিখে ফেলেন। একদিন হেলেন এবং স্যালিভান ঘরের বাইরে পানির কলের কাছে গেলেন। স্যালিভান হেলেনের এক হাতে পানি দিয়ে অন্য হাতে লিখলেন ড-অ-ঞ-ঊ-জ (ওয়াটার)। হেলেনের মনে ওয়াটারের অর্থ গাঁথা হয়ে গেল। তিনি বুঝতে পারলেন ওয়াটার হচ্ছে এক প্রকার তরল পদার্থ। তিনি পানি থেকে হাত উঠিয়ে মাটিতে রেখে স্যালিভানের কাছে সেটার নাম জানতে চাইলেন। এমনিভাবে একের পর এক সন্ধ্যার আগেই হেলেন ৩০টি শব্দ লিখে ফেলতেন। এভাবেই হেলেনের শিক্ষাজীবন শুরু। তিনি দ্রুত ম্যানুয়ালি এবং ব্রেইল পদ্ধতিতে বর্ণমালা লিখতে লাগলেন। তারপর তিনি ব্রেইল পদ্ধতিতে পড়া এবং লেখাও শিখলেন। ১৮৯০ সালে তখন তার বয়স ১০, তিনি ইচ্ছা প্রকাশ করলেন বক্তৃতা দেয়া শিখবেন। তিনি জানতে পেরেছিলেন নরওয়ের এক বধির এবং দৃষ্টিহীন মেয়ে বক্তৃতা দিতে পারে। হরেস ম্যান স্কুলের সারাহ ফুলার ছিলেন হেলেনের প্রথম বক্তৃতার শিক্ষয়িত্রী। হেলেন বলতেন, আমি কলেজেও পড়ালেখা করব। তার আশা পূরণ হয়েছিল। ১৮৮৯ সালে তিনি ক্যামব্রিজ স্কুল ফর ইয়ং রেডিসে ভর্তি হন র্যাডক্লিফ কলেজে ভর্তির প্রস্তুতি নিতে। ১৯০০ সালের শুরুতে তিনি র্যাডক্লিফ কলেজে ভর্তি হন এবং বিএ পাস করেন ১৯০৪ সালে।
হেলেন কেলারের আনুষ্ঠানিক শিক্ষা শেষ হয় তার বিএ ডিগ্রি অর্জনের পর। তবে সারা জীবনই তিনি লেখাপড়া চালিয়ে গেছেন। পাশাপাশি আধুনিক বিশ্বমানুষ সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যও সংগ্রহ করেছেন। অগাধ পাণ্ডিত্য এবং সৃষ্টিশীল কর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করে। উল্লেখযোগ্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হচ্ছে—টেম্পল ইউনিভার্সিটি, হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি, স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো ইউনিভার্সিটি, জার্মানির বার্লিন, ইন্ডিয়ার দিল্লি এবং দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গের ইউট ওয়াটার স্ট্র্যান্ড। তিনি স্কটল্যান্ডের এডুকেশনাল ইনস্টিটিউটের সম্মানিত সদস্যও নির্বাচিত হন। ১৯০৫ সালে স্যালিভানের বিয়ে হয় বিখ্যাত সমালোচক এবং সোশ্যালিস্ট জন ম্যাকির সঙ্গে। কিন্তু বিয়ের পরও স্যালিভান ও হেলেনের শিক্ষয়িত্রী-ছাত্রী সম্পর্ক এবং কাজের কোনো অবনতি ঘটেনি। এমনকি হেলেন ম্যাকি পরিবারের সঙ্গে বাস করেন সুদীর্ঘকাল। স্যালিভান ও জন ম্যাকি উভয়েই তাদের সময় ভাগাভাগি করে হেলেনকে পড়ালেখা ও অন্যান্য কাজে সহযোগিতা করেছেন। হেলেন যখন র্যাডক্লিফ কলেজের ছাত্রী তখন থেকেই তিনি লেখিকা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। পরে ৫০ বছর পর্যন্ত তিনি লেখালেখি চালিয়ে গেছেন। ১৯০২ সালে ‘দি স্টোরি অফ মাই লাইফ’ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ হয় লেডিস হোম জার্নালে। তার পরপরই সেটা বই আকারেও প্রকাশ হয়। বইটি তার জনপ্রিয় রচনাগুলোর একটি। পরবর্তী সময়ে মারাঠি, পাশতু, তাগালগ, ভেদু ইত্যাদি ভাষাসহ ৫০টিরও বেশি ভাষায় বইটি অনূদিত হয়। আমেরিকায় পেপারব্যাক সংস্করণও প্রকাশিত হয়েছে। হেলেন কেলারের লেখা অপটিমিজম, অ্যান এসে, দি স্টোনওয়াল, আউট অফ দি সং, অফ দি ওয়ার্ল্ড, দি ডার্ক, মাই রিলিজিওন, মিডস্ট্রিম, মাই লেটার লাইফ, পিস অ্যাট ইভেন টাইড, হেলেন কেলার ইন স্কটল্যান্ড, হেলেন কেলার জার্নাল, লেট আস হ্যাভ ফেইথ, টিচার অ্যান স্যালিভান ম্যাকি, ওপেন ডোর ইত্যাদি রচনাও প্রকাশ হয়েছে। তাছাড়া তিনি বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় অন্ধত্ব, শ্রবণ প্রতিবন্ধিত্ব, সমাজতন্ত্র, সামাজিক, নারী অধিকার ইত্যাদি বিষয়ে নিয়মিত লিখেছেন। হেলেন প্রথমে ব্রেইল টাইপরাইটারে পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করতেন। পরে সেটাকে সাধারণ টাইপরাইটারে কপি করতেন। তিনি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে অনেক নামি দামি পুরস্কারও পেয়েছেন। ১৯৩৩ সালে তিনি ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ আর্টস অ্যান্ড লেটার্সের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৫২ সালে লুই ব্রেইল (ব্রেইল বর্ণমালার আবিষ্কারক)-এর জন্মশতবার্ষিকী উত্সবে হেলেন কেলারকে অশ্বারোহী সৈনিক সাজানো হয়। ঘোড়ায় চড়ে বেড়ানো ছিল হেলেনের প্রিয় শখগুলোর একটি। হেলেন কেলারের গ্রাজুয়েশনের ৫০তম বার্ষিকীতে র্যাডক্লিফ কলেজ হেলেনের প্রতি শ্রদ্ধাস্বরূপ কলেজের বাগানের নামকরণ করেন হেলেন কেলার গার্ডেন। বাগানের ঝরনাটির নামকরণ করা হয় তার শিক্ষয়িত্রী স্যালিভানের নামে অ্যান স্যালিভান ফাউন্টেন। হেলেন কেলার একদিকে যেমন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে পুরস্কৃত হয়েছেন, অপরদিকে তার সময় অনেক বিখ্যাত ব্যক্তির সঙ্গেও তার সখ্য গড়ে উঠেছিল। তাদের মধ্যে আছেন গ্রোবার ক্লিভলেন্ড থেকে শুরু করে চার্লি চ্যাপলিন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জওহরলাল নেহরু, জন এফ কেনেডি প্রমুখ। ক্যাথরিন কর্নেল, ভ্যান উইকব্রুকস, আলেকজান্ডার গ্রাহামবেল, জো-ডেভিডসনের মতো ব্যক্তিদের সঙ্গেও তার বন্ধুত্ব ছিল। দু’জন তো শৈশব থেকেই তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। একজন মার্ক টোয়েন, অপরজন উইলিয়াম জেমস। উভয়েই হেলেন কেলার সম্পর্কে সুন্দর মন্তব্য করছেন। মার্ক টোয়েন বলেছেন, ‘উনিশ শতকের সবচেয়ে আশ্চর্য চরিত্র দুটি হচ্ছে নেপোলিয়ন এবং হেলেন কেলার।’
১৯৬১ সালের পর থেকে হেলেন কেলার নিরিবিলি জীবনযাপন শুরু করেন। তবে অধিকাংশ সময়ই তিনি পড়ালেখায় ব্যয় করতেন। বাইবেল, কবিতা এবং দর্শন ছিল তার পড়ার প্রিয় বিষয়। ১৯৬৫ সালে নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত বিশ্বমেলায় তিনি বিশ্বের নামকরা ২০ জন মহিলার একজন নির্বাচিত হন। হেলেন কেলার এবং রুজভেল্ট ১০০ জন নমিনির মধ্যে বেশি ভোট পান। হেলেন কেলার বলেছেন, ‘আমরা কখনও সত্যিকারের সুখী নই, যতক্ষণ না অন্য মানুষের জীবন আলোকিত করার চেষ্টা করি।’
আগামী ২০১০ সালের ১ জুন বিশ্বনন্দিত মহীয়সী নারী দৃষ্টি প্রতিবন্ধী হেলেন কেলারের ৪২তম মৃত্যুবার্ষিকী এবং ২৭ জুন তার ১৩০তম জন্মবার্ষিকী। দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের আদর্শ হেলেন কেলারের নাম বিশ্বে সুপরিচিত এবং অনুসরণীয়। কারণ, অনেক চড়াই-উত্রাই ও প্রতিবন্ধিতা পেরিয়ে তিনি বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বে পরিণত হতে পেরেছিলেন। তার গড়া প্রতিষ্ঠান হেলেন কেলার ইন্টারন্যাশনাল ১৯১৫ সাল থেকে বিশ্বের প্রায় ২৫টি দেশে হতদরিদ্রদের দৃষ্টিশক্তি ও জীবনরক্ষার কাজ করে চলেছে। আজ ৩ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস—এই দিনটিতে তাকে আমরা গভীরভাবে স্মরণ করছি।
তারপর থেকে কয়েক বছর দারুণ নিঃসঙ্গতায় কাটে হেলেনের। তার প্রকৃত জীবন শুরু হয় ১৮৮৭-এর মার্চে, তখন তার বয়স প্রায় সাত বছর। এই দিনটিকেই তিনি তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং স্মরণীয় দিন মনে করতেন। কারণ, ওইদিন অ্যানসালিভান নামে একজন শিক্ষয়িত্রী তাসকামবিয়ায় এসে হেলেন কেলারকে ছাত্রী হিসেবে গ্রহণ করেন। বিশ বছর বয়স্ক গ্র্যাজুয়েট স্যালিভানও ছিলেন দৃষ্টিহীন। তবে অপারেশনের মাধ্যমে তিনি তার দৃষ্টিশক্তি ফিরে পান। কিন্তু হেলেন কেলারের দৃষ্টিশক্তি কোনো চিকিত্সাতেই ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। অ্যানসালিভান টেলিফোন আবিষ্কারক আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেলের মাধ্যমে হেলেন কেলারের শিক্ষয়িত্রী হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। সেই সৌভাগ্যময় দিন থেকেই স্যালিভান ১৯৩৬ সালে তার মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত প্রিয় ছাত্রী হেলেন কেলারের পাশে ছিলেন।
দৃষ্টিহীন এবং বধির হেলেন কেলারকে স্যালিভান যেভাবে একজন স্বনামখ্যাত ব্যক্তি হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন সে কাহিনী উইলিয়াম গিবসনের নাটক ও চলচ্চিত্র ‘দি মিরাকল ওয়ার্কার’ এবং হেলেন কেলারের নিজের লেখা ‘দি স্টোরি অফ মাই লাইফ’ বইটিতে সম্পূর্ণ বর্ণনা করা হয়েছে। স্যালিভান একটি পুতুল দিয়ে শিক্ষকতার কাজ শুরু করেন। পুতুলটি পারকিন্স স্কুলের দৃষ্টিহীন ছাত্রছাত্রীরা তৈরি করে দিয়েছিলেন। হেলেনকে উ-ঙ-খ-খ হাতে লিখতে শেখাতে পেরে স্যালিভান আশাবাদী এবং সত্যি সত্যিই কৃতকার্য হলেন। হেলেন মাত্র অল্প কয়েক দিনেই অনেক শব্দ শিখে ফেলেন। একদিন হেলেন এবং স্যালিভান ঘরের বাইরে পানির কলের কাছে গেলেন। স্যালিভান হেলেনের এক হাতে পানি দিয়ে অন্য হাতে লিখলেন ড-অ-ঞ-ঊ-জ (ওয়াটার)। হেলেনের মনে ওয়াটারের অর্থ গাঁথা হয়ে গেল। তিনি বুঝতে পারলেন ওয়াটার হচ্ছে এক প্রকার তরল পদার্থ। তিনি পানি থেকে হাত উঠিয়ে মাটিতে রেখে স্যালিভানের কাছে সেটার নাম জানতে চাইলেন। এমনিভাবে একের পর এক সন্ধ্যার আগেই হেলেন ৩০টি শব্দ লিখে ফেলতেন। এভাবেই হেলেনের শিক্ষাজীবন শুরু। তিনি দ্রুত ম্যানুয়ালি এবং ব্রেইল পদ্ধতিতে বর্ণমালা লিখতে লাগলেন। তারপর তিনি ব্রেইল পদ্ধতিতে পড়া এবং লেখাও শিখলেন। ১৮৯০ সালে তখন তার বয়স ১০, তিনি ইচ্ছা প্রকাশ করলেন বক্তৃতা দেয়া শিখবেন। তিনি জানতে পেরেছিলেন নরওয়ের এক বধির এবং দৃষ্টিহীন মেয়ে বক্তৃতা দিতে পারে। হরেস ম্যান স্কুলের সারাহ ফুলার ছিলেন হেলেনের প্রথম বক্তৃতার শিক্ষয়িত্রী। হেলেন বলতেন, আমি কলেজেও পড়ালেখা করব। তার আশা পূরণ হয়েছিল। ১৮৮৯ সালে তিনি ক্যামব্রিজ স্কুল ফর ইয়ং রেডিসে ভর্তি হন র্যাডক্লিফ কলেজে ভর্তির প্রস্তুতি নিতে। ১৯০০ সালের শুরুতে তিনি র্যাডক্লিফ কলেজে ভর্তি হন এবং বিএ পাস করেন ১৯০৪ সালে।
হেলেন কেলারের আনুষ্ঠানিক শিক্ষা শেষ হয় তার বিএ ডিগ্রি অর্জনের পর। তবে সারা জীবনই তিনি লেখাপড়া চালিয়ে গেছেন। পাশাপাশি আধুনিক বিশ্বমানুষ সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যও সংগ্রহ করেছেন। অগাধ পাণ্ডিত্য এবং সৃষ্টিশীল কর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করে। উল্লেখযোগ্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হচ্ছে—টেম্পল ইউনিভার্সিটি, হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি, স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো ইউনিভার্সিটি, জার্মানির বার্লিন, ইন্ডিয়ার দিল্লি এবং দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গের ইউট ওয়াটার স্ট্র্যান্ড। তিনি স্কটল্যান্ডের এডুকেশনাল ইনস্টিটিউটের সম্মানিত সদস্যও নির্বাচিত হন। ১৯০৫ সালে স্যালিভানের বিয়ে হয় বিখ্যাত সমালোচক এবং সোশ্যালিস্ট জন ম্যাকির সঙ্গে। কিন্তু বিয়ের পরও স্যালিভান ও হেলেনের শিক্ষয়িত্রী-ছাত্রী সম্পর্ক এবং কাজের কোনো অবনতি ঘটেনি। এমনকি হেলেন ম্যাকি পরিবারের সঙ্গে বাস করেন সুদীর্ঘকাল। স্যালিভান ও জন ম্যাকি উভয়েই তাদের সময় ভাগাভাগি করে হেলেনকে পড়ালেখা ও অন্যান্য কাজে সহযোগিতা করেছেন। হেলেন যখন র্যাডক্লিফ কলেজের ছাত্রী তখন থেকেই তিনি লেখিকা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। পরে ৫০ বছর পর্যন্ত তিনি লেখালেখি চালিয়ে গেছেন। ১৯০২ সালে ‘দি স্টোরি অফ মাই লাইফ’ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ হয় লেডিস হোম জার্নালে। তার পরপরই সেটা বই আকারেও প্রকাশ হয়। বইটি তার জনপ্রিয় রচনাগুলোর একটি। পরবর্তী সময়ে মারাঠি, পাশতু, তাগালগ, ভেদু ইত্যাদি ভাষাসহ ৫০টিরও বেশি ভাষায় বইটি অনূদিত হয়। আমেরিকায় পেপারব্যাক সংস্করণও প্রকাশিত হয়েছে। হেলেন কেলারের লেখা অপটিমিজম, অ্যান এসে, দি স্টোনওয়াল, আউট অফ দি সং, অফ দি ওয়ার্ল্ড, দি ডার্ক, মাই রিলিজিওন, মিডস্ট্রিম, মাই লেটার লাইফ, পিস অ্যাট ইভেন টাইড, হেলেন কেলার ইন স্কটল্যান্ড, হেলেন কেলার জার্নাল, লেট আস হ্যাভ ফেইথ, টিচার অ্যান স্যালিভান ম্যাকি, ওপেন ডোর ইত্যাদি রচনাও প্রকাশ হয়েছে। তাছাড়া তিনি বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় অন্ধত্ব, শ্রবণ প্রতিবন্ধিত্ব, সমাজতন্ত্র, সামাজিক, নারী অধিকার ইত্যাদি বিষয়ে নিয়মিত লিখেছেন। হেলেন প্রথমে ব্রেইল টাইপরাইটারে পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করতেন। পরে সেটাকে সাধারণ টাইপরাইটারে কপি করতেন। তিনি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে অনেক নামি দামি পুরস্কারও পেয়েছেন। ১৯৩৩ সালে তিনি ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ আর্টস অ্যান্ড লেটার্সের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৫২ সালে লুই ব্রেইল (ব্রেইল বর্ণমালার আবিষ্কারক)-এর জন্মশতবার্ষিকী উত্সবে হেলেন কেলারকে অশ্বারোহী সৈনিক সাজানো হয়। ঘোড়ায় চড়ে বেড়ানো ছিল হেলেনের প্রিয় শখগুলোর একটি। হেলেন কেলারের গ্রাজুয়েশনের ৫০তম বার্ষিকীতে র্যাডক্লিফ কলেজ হেলেনের প্রতি শ্রদ্ধাস্বরূপ কলেজের বাগানের নামকরণ করেন হেলেন কেলার গার্ডেন। বাগানের ঝরনাটির নামকরণ করা হয় তার শিক্ষয়িত্রী স্যালিভানের নামে অ্যান স্যালিভান ফাউন্টেন। হেলেন কেলার একদিকে যেমন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে পুরস্কৃত হয়েছেন, অপরদিকে তার সময় অনেক বিখ্যাত ব্যক্তির সঙ্গেও তার সখ্য গড়ে উঠেছিল। তাদের মধ্যে আছেন গ্রোবার ক্লিভলেন্ড থেকে শুরু করে চার্লি চ্যাপলিন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জওহরলাল নেহরু, জন এফ কেনেডি প্রমুখ। ক্যাথরিন কর্নেল, ভ্যান উইকব্রুকস, আলেকজান্ডার গ্রাহামবেল, জো-ডেভিডসনের মতো ব্যক্তিদের সঙ্গেও তার বন্ধুত্ব ছিল। দু’জন তো শৈশব থেকেই তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। একজন মার্ক টোয়েন, অপরজন উইলিয়াম জেমস। উভয়েই হেলেন কেলার সম্পর্কে সুন্দর মন্তব্য করছেন। মার্ক টোয়েন বলেছেন, ‘উনিশ শতকের সবচেয়ে আশ্চর্য চরিত্র দুটি হচ্ছে নেপোলিয়ন এবং হেলেন কেলার।’
১৯৬১ সালের পর থেকে হেলেন কেলার নিরিবিলি জীবনযাপন শুরু করেন। তবে অধিকাংশ সময়ই তিনি পড়ালেখায় ব্যয় করতেন। বাইবেল, কবিতা এবং দর্শন ছিল তার পড়ার প্রিয় বিষয়। ১৯৬৫ সালে নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত বিশ্বমেলায় তিনি বিশ্বের নামকরা ২০ জন মহিলার একজন নির্বাচিত হন। হেলেন কেলার এবং রুজভেল্ট ১০০ জন নমিনির মধ্যে বেশি ভোট পান। হেলেন কেলার বলেছেন, ‘আমরা কখনও সত্যিকারের সুখী নই, যতক্ষণ না অন্য মানুষের জীবন আলোকিত করার চেষ্টা করি।’
আগামী ২০১০ সালের ১ জুন বিশ্বনন্দিত মহীয়সী নারী দৃষ্টি প্রতিবন্ধী হেলেন কেলারের ৪২তম মৃত্যুবার্ষিকী এবং ২৭ জুন তার ১৩০তম জন্মবার্ষিকী। দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের আদর্শ হেলেন কেলারের নাম বিশ্বে সুপরিচিত এবং অনুসরণীয়। কারণ, অনেক চড়াই-উত্রাই ও প্রতিবন্ধিতা পেরিয়ে তিনি বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বে পরিণত হতে পেরেছিলেন। তার গড়া প্রতিষ্ঠান হেলেন কেলার ইন্টারন্যাশনাল ১৯১৫ সাল থেকে বিশ্বের প্রায় ২৫টি দেশে হতদরিদ্রদের দৃষ্টিশক্তি ও জীবনরক্ষার কাজ করে চলেছে। আজ ৩ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস—এই দিনটিতে তাকে আমরা গভীরভাবে স্মরণ করছি।
No comments