জীবনানন্দ দাশ-ভেঙেছ দুয়ার, এসেছ জ্যোতির্ময় by শাহাবুদ্দীন নাগরী

বিশ শতকে আধুনিক বাংলা কবিতার ভেতর দিয়ে উত্থান ঘটে কবি ও লেখক জীবনানন্দ দাশের (১৮৯৯-১৯৫০)। বাংলা কবিতা যখন মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৮২৪-৭৩) থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ (১৮৬১-১৯৪১) পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করে একটি পর্যায়ে এসে পেঁৗছেছে, তখনো বিশ শতকীয় পশ্চিমা আধুনিক বাংলা কবিতাকে তদর্থে আবাহন করতে পারেনি।


রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর শেষ বয়সে এসে এই আধুনিকতার পরিবেশে পড়ে গেলেও তখন আর তাঁর সময় ছিল না এই আধুনিক কাব্যশৈলীর তরুণদের মিছিলে শামিল হয়ে যাওয়ার। কারো কারো কবিতা তাঁর ভালো লেগেছে, প্রশংসাও করেছেন। কিন্তু নোবেলের ছাতা দিয়ে যিনি বাংলা সাহিত্যের পুরো জগৎকে ঢেকে রেখেছিলেন, সেই থেকে সম্পূর্ণ নতুন বাকভঙ্গি, বিশ্বাস এবং তেজি মন্ত্র নিয়ে বেরিয়ে আসাও এই আধুনিক কবিগোষ্ঠীর কাছে সহজ ছিল না। সাহিত্য ও শিল্পকলায় এটা সব সময়ই ঘটেছে। বিগত দুই শতাব্দীর ইউরোপীয় ও লাতিন আমেরিকার শিল্পকলায় এবং পাশাপাশি সাহিত্যেও ফভিজম, এঙ্প্রেশনিজম, ফিউচারিজম, কিউবিজম, ডাডাইজম ও সুররিয়ালিজম যখন একের পর এক নতুন মাত্রা ও বিশ্বাস নিয়ে উল্টে দিয়েছে বিশ্বাস ও চেতনার ধারাকে, তখন এসব শিল্প-আন্দোলনের রূপকার এবং চর্চাকারীকে সমাজের মূল শক্তির ওপর আঘাত হেনেই এগিয়ে যেতে হয়েছে। সুররিয়ালিস্ট ব্রেতোঁ (১৮৯৬-১৯৬৬) ঘোষণা করেছিলেন : 'বিস্ময় সর্বক্ষণ সুন্দর। যা কিছু বিস্ময়কর, তা-ই সুন্দর। আর শুধুমাত্র বিস্ময়ই সুন্দর।' পরাবাস্তববাদের বা সুররিয়ালিজমের প্রধান লক্ষ্যই ছিল ব্যাঘাত সৃষ্টি করা, প্রচলকে ভেঙে ফেলা, শৃঙ্খলাকে বিচলিত করা। সাহিত্যের এমনই একটি যুগসন্ধিক্ষণে বাংলা কবিতা পরাবাস্ততার পথ ধরে আধুনিকতার যুগে প্রবেশ করে। এবং এটা সবাই জানেন, বাংলা কবিতায় এর উদ্যোক্তা ছিলেন জীবনানন্দ দাশ, অমিয় চক্রবর্তী (১৯০১-৮৬), সুধীন্দ্রনাথ দত্ত (১৯০১-৬০), বুদ্ধদেব বসু (১৯০৮-৭৪) ও বিষ্ণু দে (১৯১৯-৮২)। ইংরেজি এবং বিদেশি সাহিত্যের এই পড়ুয়ারা কবিতার প্রচল ভেঙে একটি নবকাব্যশৈলীর মাধ্যমে আধুনিক বাংলা কবিতার বীজ বপন করে দেন।
জীবনানন্দ দাশ এই আধুনিক কবিদের একজন, যাঁর কবিতা সম্পর্কে গবেষক বলছেন : 'The haunting rhythm, the rich imagery, the magic of proper names and the ethereal beauty of the concluding sestet have contributed to its immense popularity('বনলতা সেন' কবিতা সম্পর্কে বিশ্বভারতীর অধ্যাপক সোমদত্ত মণ্ডল)। জীবনানন্দ দাশ তাঁর কবিতায় যে জীবন ও প্রকৃতি রচনা করেছিলেন, বলা বোধ করি অসংগত তিনি রবীন্দ্রনাথ বা জসীমউদ্দীনের প্রকৃতি পরিচয়ের ধারে কাছেও যাননি। আধুনিকতা তখন তাঁর মজ্জায়-মেধায়-মননে। কবিতার আকাশ তাঁর কাছে বিশেষ চিত্রকল্প নিয়ে প্রতিভাত হয়েছে। বিশ শতকের বিস্ময়কর প্রযুক্তিনির্ভর অর্থনীতি ও আন্তর্জাতিকতাবাদ এবং বিশ্বব্যাপী নগরায়ণের এই রূপ ও চরিত্রের আত্মপ্রকাশ তাঁকেও আলোড়িত করে। তাই তাঁর কবিতা প্রকৃতি ও জীবনের ওপর ভর করে হাঁটলেও নগরজীবন এবং তার নানারূপ দ্বন্দ্ব থেকে তিনিও মুক্ত হতে পারেননি। জীবনানন্দ তাঁর জীবদ্দশায় তাঁর কবিতার অন্তর্নিহিত শক্তি এবং হৃদয়স্পর্শী প্রকৃতিচেতনার প্রতি পাঠকের মনোযোগ পাননি_এটা যেমন সত্য, তেমনি তাঁর আধুনিকতার সঙ্গে তাঁর সমসাময়িক কবিদেরও সুদৃষ্টি তাঁর মেলেনি। তাঁকে বৃহত্তর অর্থে শুধু চিনেছিলেন বুদ্ধদেব বসু; তাঁর একটি লেখায় বলেছিলেন, 'জীবনানন্দ বাবু বাংলা কাব্যসাহিত্যে একটি অজ্ঞাতপূর্ব ধারা আবিষ্কার করেছেন বলে আমার মনে হয়। তিনি এ পর্যন্ত মোটেই popularity অর্জন করতে পারেননি। বরং তাঁর রচনার প্রতি অনেকেই বোধ হয় বিমুখ; অচিন্ত্য বাবুর মতো তাঁর এরি মধ্যে অসংখ্য Imitator জোটেনি। তার কারণ বোধ হয় এই যে, জীবনানন্দ বাবুর কাব্যরসের যথার্থ উপলব্ধি একটু সময়সাপেক্ষ;...তাঁর কবিতা একটু ধীরে-সুস্থে পড়তে হয়, আস্তে আস্তে বুঝতে হয়।' ('প্রগতি', আশ্বিন, ১৩৩৫)। জীবনানন্দ দাশের বহু কবিতা বুদ্ধদেব বসু তাঁর যৌথ সম্পাদনার 'প্রগতি' এবং একক সম্পাদনার 'কবিতা' পত্রিকায় প্রকাশ করেছিলেন। আসলে বাংলা কবিতার তৎকালীন ধারার বিপরীতে ১৯২৭ সালে 'ঝরা পালক' প্রকাশিত হলে জীবনানন্দ কাব্যরসিক আধুনিক পাঠকের কোনো মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারেননি। কবিতাগ্রন্থটি ছিল প্রধানত অন্ধকার, নির্জনতা ও গভীরতার পূজারি; স্মৃতি, ঐতিহ্য ও ইতিহাস-সচেতনতার ভেতর দিয়ে তিনি অবচেতন মনের রেখা অঙ্কন করেছিলেন। কিন্তু প্রত্যাখ্যাত হওয়ায় জীবনানন্দ নিজেও গ্রন্থটি থেকে তাঁর সব ভালোবাসা প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন। দীর্ঘদিন তিনি গ্রন্থ প্রকাশ থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন এবং প্রায় ৯ বছর পর প্রকাশিত হয় তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ 'ধূসর পাণ্ডুলিপি' (১৯৩৬)। এই নামকরণের ভেতর দিয়ে কবি কি তাঁর ক্ষোভ ও অভিমানের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছিলেন? অথচ পাশ্চাত্যের আধুনিকতার পথ ধরেই পরাবাস্তবতা তাঁকেও আলোড়িত ও বিমোহিত করেছিল। আবদুল মান্নান সৈয়দ (১৯৪৩-২০১০) তাঁর একটি লেখায় বলেছেন : 'কবিতায় জীবনানন্দ দাশ ও বিষ্ণু দে-কে মাঝে মাঝে পরাবাস্তবতা দখল করেছে। জীবনানন্দের বেশ কিছু কবিতা বিশুদ্ধ পরাবাস্তব, যেমন আরাগঁ-আক্রান্ত বিষ্ণু দের কবিতায় তাঁর অন্তর্জীবন-বহির্জীবন একাকার।' ('বিংশ শতাব্দীর শিল্প আন্দোলন', পাঠক সমাবেশ, ২০০৮)। হতেই পারে এবং হওয়াটাই স্বাভাবিক। জীবনানন্দ কবিতা লিখেছেন চিন্তার অবচেতন স্তরের ভেতর থেকে, যদিও চেতনা ছিল জাগ্রত। তিনি তাঁর চারপাশের প্রকৃতি ও মানুষকে বস্তুবাদী ভেবে নিয়ে যে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য কাব্যধ্বনি তুলেছেন, শব্দের ফাঁকে স্থান রেখে দিয়ে নতুন শব্দ বসিয়েছেন, জীবনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র হতাশার স্ফটিকস্বচ্ছ আকার-আয়তন নির্মাণ করেছেন, যার ইমেজের গভীরতা সন্ধান করতে আধুনিক কবিতাপাঠককে কসরত করতে হয়েছে, যা অতিবাস্তবের দেয়াল পেরিয়ে পরাবাস্তবতার আকাশ ছুঁয়েছে। জীবনানন্দ নির্জন কবি, নির্জনতার কবি। কেউ বলেছেন, 'আত্মঘাতী ক্লান্তি'তে পূর্ণ তাঁর কবিতা। ক্লান্তিই মানুষকে নীরব করে। তাই ক্লান্তির অপর নাম যদি নির্জনতাই হয়ে থাকে, তাহলে তো এ নিয়ে প্রশ্ন তোলা অবান্তর। বুদ্ধদেব বসু যেমনটি তাঁর কবিতা সম্পর্কে বলেছিলেন, '...যেখানে পতঙ্গের নিঃশ্বাস পতনের শব্দটুকুও শোনা যায়, মাছের পাখনার ক্ষণতম স্পন্দনে কল্পনার গভীর জল আন্দোলিত হয়ে ওঠে।'
এ বছর সাহিত্যে নোবেল পেয়েছেন সুইডিশ কবি টমাস ট্রান্সট্রোমার (জন্ম : ১৯৩১)। এক ভিন্ন ধারার কবি হিসেবে সুইডিশ কবিতাপাঠকদের মনোযোগ কেড়েছেন। ১৯৫৪ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত তাঁর ১১টি কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে সুইডিশ ভাষায়; এবং তা বিশ্বের অন্তত ৪২টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। তাঁর কবিতার এই অনুবাদের সুবাদে বিশ্ব চিনেছে ট্রান্সট্রোমারকে। আমাদের দুঃখ যেটা, আমাদের বাংলা কবিতা খুব কমই অনূদিত হয় অন্য ভাষায়। জীবনানন্দ যদি অনূদিত হতেন, তাহলে বিশ্ব অবশ্যই জানত, এই সুইডিশ কবির আগেই ভারতবর্ষে জন্মগ্রহণ করেছেন এমন এক কবি, যিনি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অবচেতন স্তরের প্রকৃতি, চিত্রকল্প, অন্ধকার আর নীরবতার কবিতা লিখে পাঠকনন্দিত হয়েছেন বেঁচে থাকাকালীন কিছুটা এবং মৃত্যুর পর পুরোটা। ট্রান্সট্রোমার সম্পর্কে তাঁর কবিতার বাঙালি গবেষক আজীজ রহমান বলেছেন (১৯৯৬) : 'তাঁর কবিতা মূলত ও প্রধানত চিত্রধর্মী ও চিত্রকল্পাশ্রয়ী। ... যেহেতু প্রকৃতিই ধারণ করে আসছে অনাদিকাল থেকে মহাজাগতিক ও মহাকালিক রূপ ও অন্তরাত্মা, তাই কোনো কোনো কবি চলে যান নিসর্গ সন্ধানে তাঁর নিভৃত যাত্রার মাধ্যমে।' ('শুভ সন্ধ্যা হে সুন্দর গভীরতা', পাঠক সমাবেশ সংস্করণ, ২০০৮)। চিত্রকল্প-প্রতীক-উপমা ব্যবহারে জীবনানন্দ যে কাব্যধারার প্রচল করেছিলেন বাংলা কবিতায়, নির্জনতা ও অন্ধকার, মৃত্যু ও জীবন, অভাব ও কষ্ট, প্রেম ও অভিমান যে বিশুদ্ধ মুগ্ধতা নিয়ে চর্চিত হয়েছিল তাঁর কবিতায়, তা ট্রান্সট্রোমারের প্রায় ৩৫ বছর আগেই রচিত হয়েছিল জীবনানন্দের পরাবাস্তববাদী কবিতার আচ্ছাদনে। টমাস ট্রান্সট্রোমারের আজকের এই নোবেলপ্রাপ্তি আমাদের আবার বুঝিয়ে দিল, জীবনানন্দ দাশ একজন বিশাল মাপের কবি ছিলেন, যাঁকে চিনতে আমাদের অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল।

No comments

Powered by Blogger.