এতশত চেতনার মিছিলে বাংলাদেশ by মোহাম্মদ নুরাল হক্

স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশে আমরা একাধিক চেতনাকে (Spirit) শুধুই মুখে মুখে বেশি বেশি প্রাধান্য দিয়ে প্রায় ৩৮ বছর পেরিয়ে এসেছি। কাঙ্ক্ষিত ফলাফল কী এবং কতদূর তা আমরা সবাই সচেতন এবং অবচেতন মন যথার্থই অবগত।
তবে চেতনাই যে মানুষের যথাযথ কর্মোদ্দীপনার চাবিকাঠি এতে কোনো সন্দেহ বা কোনো বিতর্কের অবকাশ নেই। আবার এও সত্য যে, কর্মোদ্দীপনাবিহীন চেতনা কাউকে কখনোই কোথাও পৌঁছে দিতেও পারেনি এবং ভবিষ্যতেও পারবে না। উভয় ক্ষেত্রেই সমাজে নানাবিধ জটিলতা ও বিশৃঙ্খলা অনিবার্য হয়ে দেখা দেয়। যেমন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মূল কথাই ছিল পাকিস্তানি শাসকদের কুশাসন-শোষণ, অন্যায়-অবিচার ও জুলুম-নির্যাতন থেকে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের মুক্তি। একই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় মুখ্য বিষয়গুলোও ছিল হতদরিদ্র জনগণের জন্য অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিত্সা ও শিক্ষার অধিকার নিশ্চিতকরণ। আর এই বিষয়গুলোতে পশ্চিম পাকিস্তানিদের দীর্ঘদিনের অবিচার, অন্যায় হস্তক্ষেপ ও বিমাতাসুলভ আচরণ থেকে তদানীন্তন পাকিস্তানের পূর্বাংশের বাঙালিদের আশু মুক্তিই ছিল সময়ের দাবি। অর্থাত্, মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা (Core spirit) ছিল দেশের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও সমাজপতিগণ কর্তৃক জনগণের মৌলিক অধিকার নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে জনগণের পক্ষে অবস্থান গ্রহণসহ জনগণের মাঝে কার্যকরভাবে প্রত্যাবর্তন।
অথচ, স্বাধীনতার ৩৮ বছর পর বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটিতে আজ আমরা কী প্রত্যক্ষ করছি? আমরা সবাই যখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অবগাহনের প্রাণান্ত প্রচেষ্টায় দিনের পর দিন ধরে গলদঘর্ম, তখন আমাদের অবস্থান কি প্রকৃতই জনগণের পক্ষে ও জনগণের মাঝে? অর্থাত্, আমরা কি বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণের ন্যূনতম চাহিদা অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিত্সা ও শিক্ষার অধিকার পেরিয়ে আসা এত বছরের মধ্যে নিশ্চিত করতে পেরেছি বা পারছি অথবা এখনও কার্যক্ষেত্রে কোনোরকম ফলপ্রসূ কর্মসূচি গ্রহণে সত্যিকার অর্থেই সমর্থ হচ্ছি? যে কোনো মানদণ্ডে ও বিবেচনায় সমস্বরে উত্তর হলো, বেশ বড় করে, ‘না...আ...আ...।’ কারণ, পরিসংখ্যান বলে, গত ৩৮ বছরে নীরব সংখ্যাগরিষ্ঠরা দরিদ্র থেকে আরও দরিদ্র হয়েছে। সামান্য ভূমির মালিকরা ভূমির মালিকানা হারিয়ে রাস্তাঘাট অথবা বেড়িবাঁধে অবস্থান নিয়েছে। আর ভূমিহীনদের অসংখ্য-অগণিত হাত রাস্তা-ঘাটে আমাদের সামনে প্রসারিত হয়ে অহরহ আমাদের ধৈর্যচ্যুতি ঘটিয়ে চলেছে এবং অদ্যাবধি এহেন অবস্থার ক্রমাগত অবনতি ছাড়া উন্নতির কোনো লক্ষণই দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না। অথচ, সরে অ থেকে ঙ পর্যন্ত নানাবিধ চেতনায় আকণ্ঠ নিমজ্জিত একশ্রেণীর ধ্বজাধারী নিজেরা কিন্তু এরই মধ্যে রাতারাতি ‘আঙুল ফুলে কলাগাছ’ হয়েছেন এবং এহেন হওয়ার মিছিলে অদ্যাবধি একের পর এক সরবে যুক্ত হয়েই চলেছেন।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনার যে বিষয়টি মৌলিক ভিত অথবা সংগ্রামের শুরু হিসেবে সর্বদাই বেশি করে আলোচিত হয় তা হলো ভাষা অন্দোলনের বিষয়টি—বাংলাভাষা তথা মাতৃভাষার জন্য আমাদের সর্বাত্মক লড়াই-সংগ্রামসহ অগণিত আত্মত্যাগ। সংখ্যাগরিষ্ঠের মতে, আমাদের মাতৃভাষা বাংলাভাষার সংগ্রামের ফলে এ অঞ্চলের বাঙালিদের শেষ পর্যন্ত রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করেছিল। অথচ, আজ স্বাধীন বাংলাদেশে এই আমরাই বাংলা ভাষার কী হাল করে চলেছি। শুরু থেকেই ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মরণে যে দিবসটি পালিত হয় সেই দিবসটিকে আমরা ৮ই ফাল্গুন না বলে ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ বলতেই গর্ববোধ করি। আমার জানামতে স্বনামধন্য বোদ্ধারা শহীদ দিবস সম্পর্কিত সব গান-কবিতায় ‘একুশে ফেব্রুয়ারিই’ বার বার উল্লেখ করেছেন। কখনও সেভাবে ৮ই ফাল্গুন বলেছেন বলে আমার জানা নেই। আর বাংলাভাষার মুরুব্বি হিসেবে সর্বজন স্বীকৃত কর্তৃত্ব এবং নৈতিকতার ভিত্তিতে সব দায়িত্ব যে প্রতিষ্ঠানটির ওপর ন্যস্ত করা হয়েছে তাদের নামকরণ করা হয়েছে, ‘বাংলা একাডেমী।’ ছোট মুখে আমার প্রশ্ন হলো, বাংলা ভাষায় আমাদের দীনতা কি এতই বেশি যে, এহেন শব্দগুলো ছাড়া অন্য কোনো উপায় আমাদের ছিল না? আর, ইদানীং যে কোনো কথোপকথনে অর্ধেক বাংলা আর অর্ধেক ইংরেজি মিশিয়ে আমরা যেভাবে দুর্বোধ্য ভাষায় কথা বলি তাতে আমাদের এহেন জগাখিচুড়ি ভাষাকে কেউ একজন ‘বাংলিশ’ নামকরণ করলে তা যথার্থ বলে আমি মনে করি।
অতীত ধারাবাহিকতায় আজও দেশের শিক্ষাঙ্গনগুলোতে সাধারণ মানুষের জন্য বাংলাভাষার উন্নয়নের ন্যূনতম কার্যকর উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয় না। কিন্তু বাংলাভাষার চেতনায় আকণ্ঠ ডুবিয়ে সরব সংখ্যালঘিষ্ঠরা যারা এ বিষয়ে নীতি-নির্ধারকও বটে, তাদের পরবর্তী প্রজন্ম অর্থাত্ উত্তরসূরিদের জন্য ইংরেজিই প্রথম ও একমাত্র পছন্দ হিসেবে বেছে নেন দেশে এবং বিদেশে। এই হলো আমাদের মাতৃভাষা বাংলাভাষার চেতনা নিয়ে আমাদের বর্তমানের অবস্থা তথা কিছু চালচিত্র।
এখন দেখা যাক, গণতন্ত্রের চেতনা, মানবাধিকারের চেতনা, নারী মুক্তি ও নারী ক্ষমতায়নের চেতনা ও অসাম্প্রদায়িক সমাজ ব্যবস্থার চেতনার কি অবস্থা। গণতন্ত্রের মূল চেতনাই হলো ভোটের মাধ্যমে মত প্রকাশের স্বাধীনতা। আর, এ ধরনের মত প্রকাশের স্বাধীনতার ধারক-বাহক ও অগ্রপথিক হতে হবে নিঃসন্দেহে দেশের মূল রাজনৈতিক দলগুলোকে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে একবাক্যে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। এখানে ছোট ছোট বিষয়ের অবতারণায় লেখা দীর্ঘায়িত না করে ইদানীং ঘটে যাওয়া একটি উদাহরণই যথেষ্ট। আওয়ামী লীগের বিগত কাউন্সিল অধিবেশনের কার্যক্রম কি গণতান্ত্রিক চেতনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ? আমার মতে, এহেন কার্যক্রমের মাধ্যমে ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ অনেকদিন পরে হলেও গণতান্ত্রিক চেতনার উজ্জ্বল একটি দৃষ্টান্ত জনসমক্ষে স্থাপনের সুবর্ণ সুযোগটি ইতোমধ্যেই হাতছাড়া করে ফেলেছে। অথচ, আওয়ামী লীগের সদ্য অনুষ্ঠিত কাউন্সিলে যদি গণতান্ত্রিক পদ্ধতি অনুসরণ করা হতো তাহলে ফলাফল এখন যা হয়েছে ঠিক তাই হতো। কিন্তু, কেন জানি বাংলাদেশে আমরা সব সময়ই অতীতের ধারাবাহিকতায় গণতন্ত্রের বুলি আউড়িয়ে গণতন্ত্রের ছদ্মাবরণে একনায়কতন্ত্রতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। আর ওদিকে, বিএনপির আগত কাউন্সিলে কি হবে তা ছকে বাঁধা ধরে নেয়া হলেও নিশ্চিতকরণের জন্য ৮ ডিসেম্বর ০৯ পর্যন্ত সময়ের অপেক্ষায় থাকতেই হবে।
মানবাধিকার, নারী মুক্তি ও নারী ক্ষমতায়ন এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনাগুলোর বিষয়ে দীর্ঘ বক্তব্যের প্রয়োজন আছে বলে আমার মনে হয় না। অতীতের ধারাবাহিকতায় আজ সমাজের এতসব অনাচার-অনিয়ম, অনৈতিক কার্যক্রমের রমরমা অবস্থা, দিনের পর দিন আইন-শৃঙ্খলার ক্রমাবনতি, সার্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার নড়বড়ে অবস্থা ও রাষ্ট্রের শাসন ব্যবস্থায় অস্থিরতাই এহেন চেতনাগুলোর মূল চাল-চিত্র অনুধাবনে যথেষ্ট বলে বিবেচিত হওয়া উচিত নয় কি? মানবাধিকার, নারী মুক্তি ও নারী ক্ষমতায়ন তো আজকাল আর দশটা লোভনীয় পণ্যের মতো বেসুমার বাজারজাত হচ্ছে। যেখানে মানবাধিকার বলতে অর্থ ও ক্ষমতার প্রতিপত্তিই সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে যাচ্ছে। আর পশ্চিমা ব্যবস্থাপত্র ভোগসুখবাদ অথবা প্রেয়বাদের (Hedonism) সুবাদে নারী মুক্তি ও নারী ক্ষমতায়নের হাওয়ায় নারীর মান, মর্যাদা ও সম্ভ্রমের কি হাল-হকিকত তা পত্রিকা ও ইলেক্ট্রনিক মাধ্যমগুলোর নানা রংয়ের ও নানা ঢংয়ের দৃষ্টিকটু উপস্থাপনায়ই যথেষ্ট নয় কি?
এদিকে আমেরিকার নেতৃত্বে পশ্চিমা বিশ্বের অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও ধর্মনিরপেক্ষতার গোলাপজলে আমরা যেভাবে ভেসে চলেছি তার দুই-একটা উদাহরণ এখানে টানা বোধ করি অসঙ্গত হবে বলে মনে হয় না। এই তো সেদিন, ইতালির পার্লামেন্টে একটি বিল উত্থাপন করা হয়েছে এই বলে যে, কেউ বোরখা পরলেই তাকে দুই বছরের জেল দেয়া হবে। এখন বিলটি আইনে পরিণত হওয়ার অপেক্ষায়। আরও তরতাজা নতুন খবর হলো, বিশ্বের স্বর্গ বলে বিবেচিত সুইজারল্যান্ডে মসজিদসহ মিনার নির্মাণের উপর সে দেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। তাহলে, বাংলাদেশসহ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোতে আমরা কি খ্রিস্টান, হিন্দু ও বৌদ্ধদের বিশেষ ধর্মীয় পোশাকগুলোর উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করব? নাকি, বাংলাদেশসহ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোতে চার্চ, মন্দির ও প্যাগোডা নির্মাণে বাধার সৃষ্টি করব?
থাক, বিরোধ ত্যাগ করে সমঝোতার মাধ্যমে সম্প্রীতি স্থাপনই হলো ইসলামের মূলমন্ত্র। ইসলাম হলো সার্বজনীন ধর্ম। সর্বকালেই বিশ্ব শান্তির প্রতীক। ইসলাম হলো বিশ্ব জগতের জন্য আল্লাহতা’য়ালার রহমতস্বরূপ। ইসলামের মূল বক্তব্যই হলো সহমর্মিতাসহ সহাবস্থান। তবে, সবচেয়ে দুঃখের বিষয় হলো, আই আর এ (Ireland Revolutionary Army) যখন শত শত মানুষ খুন করে অথবা আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণ ঘটায় তখন কিন্তু আমাদের দাদারা (দাতাগোষ্ঠীরা) এসব ঘটনাকে ‘ক্যাথলিক টেরোরিজম’ বলতে লজ্জা পায়। ভারতের গুজরাট ও দিল্লিতে যখন হাজার হাজার মুসলমান ও শিখ হত্যা করা হয়, তখন কিন্তু এগুলোকে ‘হিন্দু টেরোরিজম’ বলা হয় না। আফগানিস্তান ও ইরাকে যখন এক বিন লাদেন ও এক সাদ্দাম হোসেনের অজুহাতে হাজার হাজার আফগানি ও ইরাকিকে গণতন্ত্র উপহার দেয়ার নামে হত্যা করা হয় তখন কিন্তু গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের ঠিকাদার আমেরিকার নেতৃত্বে পশ্চিমা বিশ্ব এগুলোকে ‘খ্রিস্টান টেরোরিজম’ বলে না। কিন্তু, একজন মুসলমান দেশে অথবা বিদেশে একটি অসংলগ্ন ঘটনা ঘটালেই তোলপাড় শুরু হয়ে যায়, গদবাঁধা গালভরা বুলি ‘ইসলামিক টেরোরিজম’ নিয়ে।
এহেন প্রতিকূলতা ও এতসবের পরেও কোরআনের ‘সূরা- বাকস্ফারাহ্-২, আয়াত-২৫৬-এর শুরুতেই স্পষ্ট ভাষায় বলা হয়েছে, ‘লা ইক্রাহা ফিদ্দীনি’ (অর্থাত্, ‘দ্বীনে (ধর্মে) কোনো জবরদস্তি বা বাধ্যবাধকতা নেই’)। আবার, সূরা কাফিরুন-১০৯, আয়াত-৬ এ বলা হয়েছে, ‘লাকুম দীনুকুম ওয়ালিইয়া দীন্’ (অর্থাত্, ‘তোমাদের কর্ম ও কর্মফল তোমাদের জন্য এবং আমার কর্ম ও কর্মফল আমার জন্য’)। এই প্রেক্ষিতে সব রকমের বিবাদ-বিস্বাদ ও টানাপোড়ন দূরীভূত করার জন্য সূরা- আন্-না’হল-১৬, আয়াত-১২৫-এ’ আল্লাহ্ (সুঃ তাঃ) বিশেষ সতর্ক বাণীসহ নির্দেশ দিয়েছেন, ‘উদ্উ ইলা ছাবীলিরাব্বিকা বিল্ হিক্মাতি ওয়াল্ মাওই জোতিল্ হাছানাতি ওয়া জ্বাদিল্হুম্ বিল্লাতী হিয়া আহ্ছানু; ইন্না রাব্বাকা হুওয়া আ’লামু বিমান্ দ্বোল্লা আন্ ছাবীলিহী ওয়া হুওয়া আ’লামু বিল্মুহ্তাদীন’ (অর্থাত্, ‘আপন রবের প্রতি আহ্বান করুন হেকমত ও সত্ ও উপদেশ শুনিয়ে এবং তাদের সঙ্গে বিতর্ক করুন পছন্দসই পন্থায়। আপনার রব বিপথগামীকে চেনেন এবং তিনিই ভালো জানেন তাদের, যারা সঠিক পথে আছে)’।
আসলে, চেতনার শুধু অর্থ (Meaning) অনুসরণের মাধ্যমে উদ্বেলিত হয়ে কখনই কোনো কাঙ্ক্ষিত সুফল পাওয়া যাবে না। আমাদের নীতিনির্ধারকদের ও সমাজপতিগণকে অবশ্যই চেতনার অন্তর্নিহিত অর্থ (Connotation) অর্থাত্ মৌলিক অর্থের অতিরিক্ত তাত্পর্য অনুধাবন করতে হবে। এখানে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও ভাষা আন্দোলনের চেতনার মূল বিষয়ই ছিল চিন্তা, কথা ও কর্মে জনগণের মাঝে ফিরে যাওয়া। যাকে বলে জনমানুষের কাতারে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়ানো। আর, জনগণের মাঝে ফিরে যাওয়ার অর্থই হলো, বাংলাদেশের কোটি কোটি হতদরিদ্র নীরব সংখ্যাগরিষ্ঠের জন্য অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, স্বাস্থ্য ও শিক্ষার যথোপযুক্ত কার্যকরী ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ।
আজ এবড়ো-থেবড়ো এই পৃথিবীর যে কঠিন সময়ের মুখোমুখি আমরা দাঁড়িয়ে আছি সেখানে কথামালার ফুলঝুড়ি দিয়ে আর পার পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। যেমন, আমাদের সব সরকারই প্রতি বছর পরিসংখ্যান দিয়ে বলে থাকে যে, আমাদের জাতীয় প্রবৃদ্ধির হার প্রতি বছরই বাড়ছে। তাহলে, সঙ্গত প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর হার প্রতি বছর বেড়েই চলেছে কেন? এ বিষয়ে হাটে হাঁড়ি ভেঙে দিয়েছেন অধুনা ভারতের নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন। তিনি বলেছেন, ‘সরকারগুলো কর্তৃক সমাজে অর্থনৈতিক বৈষম্য চালু রেখে প্রতি বছর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পরিসংখ্যানের হিসাবের দোহাইয়ে কখনই দারিদ্য বিমোচন সম্ভব না।’ তাই, সত্যের মুখোমুখি হয়ে নানাবিধ অসত্য ও ঘটে যাওয়া দোষ-ত্রুটিকে শক্তিতে পরিণত করার প্রয়াসে নিবেদিতপ্রাণ হওয়ার কোনো বিকল্পই আজ বাকি নেই। মনে রাখতে হবে যে, নীরব সংখ্যাগরিষ্ঠের ধৈর্যের বাঁধ
ভেঙে যাওয়ার আগেই এ বিষয়ে আশু সিদ্ধান্তসহ কর্মপন্থা প্রয়োজন।
বাংলাদেশে উল্লিখিত চেতনাগুলো (Spirit) বাস্তবায়নের নিমিত্তে যে সত্যগুলো আমাদের রাজনৈতিক নেতা-নেত্রী ও সমাজপতিদের মূলধন হিসেবে বিবেচিত হতে হবে তা হলো, এক. জাতি-ধর্ম ও বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে বিশ্বে বাংলাদেশ নিঃসন্দেহে এখনও একটি দৃষ্টান্তমূলক সামাজিক সম্প্রীতির দেশ। যেখানে ৯৫ ভাগেরও বেশি মুসলমান। দুই. দেশের ৯৫ ভাগেরও বেশি মানুষ একই ভাষায় অর্থাত্ বাংলাভাষায় কথা বলে। তিন. বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের দৈনন্দিন চাহিদা আজও পৃথিবীতে বোধ করি ন্যূনতম। এই সত্যগুলোকে শক্তিতে পরিণত করার দায়িত্ব ও অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ আমাদের বিজ্ঞ রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীবৃন্দ ও সমাজপতিগণেরই।
শেষ করব, মাঠে-ময়দানে কাজের অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ একজন বিজ্ঞজনের উক্তি দিয়ে। বেশ কিছুদিন আগে, ভিয়েতনামের ‘দিয়েনবিয়েন ফু শহরের পতন দিবস’ উদযাপন উপলক্ষে
সে দেশের ভিয়েতনাম যুদ্ধকালীন ও তত্পরবর্তী অবিসংবাদিত নেতা জেনারেল গিয়াপকে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেছিল,
‘ইরাকে মার্কিন অগ্রাসনের ফলাফল কি হবে?’ বয়সের ভারে নুয়ে পড়া জেনারেল গিয়াপ ছোট করে বলেছিলেন, ÒNobody can win fighting against the ÔPeople’ of the land।” অর্থাত্, ‘দেশের জনগণের স্বার্থের বিপক্ষে যুদ্ধ করে কেউ কোনোদিন জয়লাভ করেনি।’ বয়োবৃদ্ধ অবিসংবাদিত নেতার এত ছোট এক লাইনের কথাগুলোর কত বিশাল অর্থ ও তাত্পর্য হতে পারে তা একটু ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে দেখার অনুরোধ রইল আমাদের স্বনামধন্য বিদগ্ধজন ও নেতা-নেত্রীদের কাছে।
লেখক : পেনশনার
haquenoor@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.