৫ ডিসেম্বর জাতীয় শিশু দিবসঃ কন্যাশিশুরা পরিবার থেকেই বৈষম্যের শিকার by অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর আলম সরকার
বাংলাদেশ প্রতি বছর ৫ ডিসেম্বর জাতীয় শিশু দিবস পালন করে। আমাদের দেশে জাতীয় পর্যায়ে শিশু দিবস পালন করা হয় বেশ কিছু আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে। শিশুরা জাতির ভবিষ্যত্, অথচ বাংলাদেশে পরিবার পর্যায়ে ছেলে ও মেয়েশিশুর মধ্যে বৈষম্য প্রদর্শন করা হয়।
ফলে মেয়েশিশুরা প্রতিনিয়ত পরিবারের অভ্যন্তর থেকেই জেন্ডার বৈষম্যের শিকার। অশিক্ষা ও কুসংস্কারের কারণে এ অঞ্চলে মেয়েশিশুরা প্রতিনিয়ত জেন্ডার বৈষম্যের শিকার। প্রায়ই কন্যাশিশু ছেলেশিশুর তুলনায় বেশি বৈষম্যের শিকার হয়। কন্যাশিশুরা মানব সন্তান হিসেবে জন্মগ্রহণ করার পর আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় কন্যা হিসেবে চিহ্নিত হয়। বেশিরভাগ পরিবারে উপেক্ষা, অবজ্ঞা, বৈষম্য, বঞ্চনা কন্যাশিশুর জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে। বহু ক্ষেত্রে লক্ষণীয়, কন্যাশিশুর জন্মই অনাকাঙ্ক্ষিত আমাদের পরিবার ব্যবস্থায়। এ জাতীয় বাস্তবতায় কন্যাশিশুর জীবন থেকে বৈষম্য হ্রাসের উদ্দেশ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে।
বাংলাদেশের সংবিধান মতে, শিক্ষা হলো সব শিশুর মৌলিক অধিকারগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি; তবু শিক্ষাক্ষেত্রে বাংলাদেশের কন্যাশিশুরা বৈষম্যের শিকার। শিশু বিশেষজ্ঞ, মনোবিজ্ঞানী এবং শিশুদের যৌন নির্যাতনবিরোধী বিশ্ব কংগ্রেস (স্টকহোম, ১৯৯৬) জাতীয় ও আন্তজার্তিক প্রস্তুতি কমিটিগুলোর সভাপতি লিসবেট পালমে মনে করেন, শিশুদের যে স্নেহ মমতা ও লালনপালন, খাদ্য, বাসস্থান, স্বাস্থ্য পরিচর্যার মতো জীবনের মৌলিক আবশ্যকীয় উপকরণের অধিকার রয়েছে এটা অনস্বীকার্য। বাংলাদেশের পরিসংখ্যান পকেট বই ২০০৮-এর তথ্যমতে, দেশের বর্তমান জনসংখ্যা ১৩৪.৮ মিলিয়ন। জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ অনুযায়ী, সংশ্লিষ্ট জাতীয় আইনে আরও কম বয়সে বয়ঃপ্রাপ্তির সীমা নির্ধারিত না হয়ে থাকলে শিশু অধিকার সনদ অনুযায়ী ১৮ বছরের কম বয়সী প্রত্যেককে শিশু হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।
জাতীয় আদম শুমারির তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশের মোট শিশুর সংখ্যা ৬ কোটি ১৭ লাখ ৫০ হাজার; অর্থাত্ মোট জনসংখ্যার ৪৯.৬ শতাংশ। ১৪ বছরের নিচে মোট শিশুর সংখ্যা ৫ কোটি ৫০ লাখ বা মোট জনসংখ্যার ৪০.৬ শতাংশ। এর মধ্যে কন্যাশিশুর সংখ্যা ২ কোটি ৪৫ লাখ ৩০ হাজার। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো পরিচালিত জাতীয় শিশুশ্রম জরিপ ২০০৩-এ দেখা যায়, দেশে ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিশুর সংখ্যা ৪ কোটি ২৪ লাখ। এদের মধ্যে ৫৪ ভাগ ছেলে এবং ৪৬ ভাগ কন্যাশিশু। প্রতিদিন দেশে শিশুর সংখ্যা বেড়েই চলেছে; বিগত দশকেও এত বেশি শিশু ছিল না। বাংলাদেশের পরিসংখ্যান ব্যুরো ১৯৯৮, সেম্বল ভাইটাল রেজিস্ট্রেশন সিস্টেমের (১৯৯৭ সালের জনসংখ্যা পরিসংখ্যান) পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১২ কোটি ৫৩ লাখ। এর মধ্যে কিশোর-কিশোরী ২ কোটি ৭৬ লাখ অর্থাত্ তারা জনসংখ্যার ২২ শতাংশ। ১৯৯১ সালে কিশোর-কিশোরীদের সংখ্যা ছিল মাত্র ২ কোটি ২৯ লাখ; অর্থাত্ তারা ছিল মোট জনসংখ্যার ২১ শতাংশ। তখন থেকে এ পর্যন্ত তাদের অনুপাত এক-পঞ্চমাংশ বেড়েছে। ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশে মোট কিশোরীর সংখ্যা ছিল ১ কেটি ৩৭ লাখ এবং মোট কিশোরের সংখ্যা ছিল ১ কোটি ৪০ লাখ। কিশোরীর সংখ্যা আরও দুটি স্তরে বিভক্ত করা যায়। এক, ১০-১৪ বছর বয়সী ৭৬ লাখ। দুই, ১৫-১৯ বছর বয়সী ৬১ লাখ। শহরে কিশোরীর তুলনায় গ্রামে কিশোরীর সংখ্যা পাঁচ জনেরও বেশি। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক বাস্তবতায় কন্যাশিশুরা কিছুটা হলেও বৈষম্যের শিকার। প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক পর্যায়ে ভর্তির ক্ষেত্রে মেয়ে ও ছেলে অনুপাত যেসব দেশে ০.৭৫-এরও কম, সেসব দেশের মোট জাতীয় উত্পাদন (জিএনপি) যে কোনো দেশের চেয়ে ২৫ শতাংশ কম। বিশেষ করে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ায় কন্যাশিশুদের শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্যই এখানকার জিএনপি কমের কারণ হিসেবে বিবেচিত।
মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোলে ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে সবার শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করার কথা বলা হলেও বাংলাদেশ সরকার আশানুরূপ উদ্যোগ নিতে পারেনি। জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান যথাযথই বলেছেন, মেয়েদের শিক্ষার চেয়ে উন্নয়নের অধিক কার্যকর আর কোনো হাতিয়ার নেই। পাশাপাশি আমাদের মনে রাখতে হবে, সার্বজনীন শিক্ষার প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অঙ্গীকার প্রথম নির্ধারণ করা হয় ১৯৪৮ সালের সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণায় এবং পরে তা পুনর্ব্যক্ত করা হয় ১৯৮৯ সালের শিশু অধিকার সনদে। ১৯৯০ সালে অনুষ্ঠিত বিশ্ব শিশু সম্মেলনে বিশ্ব নেতারা শুধু তাদের এ অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্তই করেননি যে, ছেলে ও মেয়ে উভয়েরই সমানভাবে মৌলিক শিক্ষা লাভের সুযোগ থাকা উচিত এবং তারা স্কুলে ভর্তির ক্ষেত্রে যুগ যুগ ধরে বিদ্যমান বৈষম্য কমানোর ওপর গুরুত্ব দেয়ার অঙ্গীকারও ঘোষণা করেন। বিশ্ব শিশু পরিস্থিতি ২০০৪ সালের তথ্য অনুযায়ী অগ্রগতি ত্বরান্বিত করার জন্য সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা বাঞ্ছনীয় এবং পশ্চিম আফ্রিকার ৮টি দেশে এ লক্ষ্য অর্জিত না হওয়ার ঝুঁকি প্রবল মনে করা হয়, সেগুলোর ব্যাপারে বিশেষ নজর দেয়া উচিত। যে ২৫টি দেশ বাছাই করা হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে ১০টিতে বিদ্যালয়ে না যাওয়া মেয়ের সংখ্যা ১০ লাখের উপরে, ৮টিতে কন্যাশিশুদের ভর্তির হার ৪০ শতাংশের কম এবং লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য ১০ শতাংশের বেশি এবং আর্শ্চযের বিষয় হলো, ক্রমানুসারে ২৫টি রাষ্ট্রের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। বিদ্যালয়ে নিরাপদ নয় কিংবা বিদ্যালয়ের পথটিও কন্যাশিশুদের জন্য ভয়াবহ বিপজ্জনক অথবা অত্যন্ত দীর্ঘ, যাতে কন্যাশিশুদের সম্ভ্রমের ওপর আক্রমণ বা অন্য কোনো ধরনের সহিংসতার ঝুঁকি থেকে যায়। বাংলাদেশে কন্যাশিশরা প্রতিনিয়ত হুমকির মুখে। কখনও অ্যাসিড ছুড়ে দিচ্ছে বিদ্যালয়গামী কন্যাশিশুদের মুখে, কখনওবা ইভ টিজিংয়ের শিকার কন্যাশিশুরা বেছে নিচ্ছে আত্মহননের পথ।
উন্নয়নশীল বিশ্বে শিশু দারিদ্র্যের বিস্মৃতি ও গভীরতা সম্পর্কিত এক রিপোর্ট যা The Distribution of Child Poverty in the Developing World : Report to UNICEF নামে পরিচিত। ব্রিস্টল বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত এ রিপোর্টে দেখা গেছে ৭ থেকে ১৮ বছর বয়সী ১৩ থেকে ৫০ লাখের মতো শিশু রয়েছে যাদের আদৌ কোনো শিক্ষা নেই। এদের মধ্যে শিক্ষাবঞ্চিত মেয়েদের সংখ্যা ছেলেদের চেয়ে শতকরা ৬০ ভাগ বেশি হতে পারে (শতকরা ১৬ ভাগ মেয়ের তুলনায় শতকরা ১০ ভাগ ছেলে)। মূলত শিক্ষাবঞ্চিত সব শিশু অন্যান্য বঞ্চনারও শিকার। এভাবে শিক্ষাক্ষেত্রে দুই লিঙ্গের মধ্যকার এই নিদারুণ বৈষম্য এটাই প্রমাণ করে যে, ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের দারিদ্র্যের নানা আঘাত বেশি সইতে হয়। যেমন খাদ্য, নিরাপদ পানি, স্যানিটেশন সুবিধা, স্বাস্থ্য, আশ্রয় বা তথ্য থেকে বঞ্চিত হওয়া। কন্যাশিশুরা প্রাথমিক বিদ্যালয় শেষ করার হার ছেলেদের তুলনায় এখনও পিছিয়ে রয়েছে যথাক্রমে ৭৬ শতাংশ এবং ৮৫ শতাংশ। এ জাতীয় পার্থক্যের অর্থ হচ্ছে, উন্নয়নশীল বিশ্বে ছেলেদের চেয়ে লাখ লাখ বেশি কন্যাশিশু প্রতিবছর বিদ্যালয় ছেড়ে দিচ্ছে। এর ফলে যেসব শিশু বিদ্যালয়ে নেই, তাদের বেশির ভাগই কন্যাশিশু। কন্যা শিশুদের বৈষম্যমুক্তভাবে শিক্ষা প্রদান করা এবং বিদ্যালয়ে তাদের ধরে রাখা আমাদের পারিবারিক, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব।
জাতিসংঘ শিশু তহবিল ইউনিসেফ তার ২০০৪ প্রকাশিত বিশ্ব শিশু পরিস্থিতিতে যেমনটা উল্লেখ করেছে; সমাজের সব পর্যায়ে নেতাদের যা অবশ্যই করতে হবে তা হলো, অগ্রগতির জন্য কন্যাশিশুদের প্রতি লক্ষ্য রেখে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা; যথা ১. মেয়েদের লেখাপড়াকে উন্নয়ন প্রচেষ্টার একটি অত্যাবশ্যকীয় অংশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে; ২.বাদ যাবে না কোনো কন্যাশিশু এই মর্মে মেয়েদের শিক্ষার জন্য একটি জাতীয় চেতনা সৃষ্টি করতে হবে; ৩. কোনো প্রকৃতির বিদ্যালয়ে বেতন নেয়া যাবে না; ৪. শিক্ষার ছকের ভেতর এসে এবং এর বাইরেও ভাবতে হবে, যেমন বৈষম্যবিরোধী আইন ও নীতি, যা মেয়ে ও মহিলাদের সুরক্ষা দেয় এবং প্রারম্ভিক শৈশব কর্মসূচি, যাতে মেয়ে ও ছেলেদের প্রতি সমানভাবে আচরণ করা হয় এবং লিঙ্গভিত্তিক ভূমিকা ও সম্পর্কের বিষয়টি নিরসন করা হয়; ৫. কর্মকৌশল সমন্বিত করতে হবে; ৬. শিক্ষার জন্য আন্তর্জাতিক তহবিল বৃদ্ধি করতে হবে। কন্যাশিশুদের শিক্ষার অধিকারকে সমর্থন করতে হবে। কমবয়সী মেয়েদের বিদ্যালয়ে ফিরে যেতে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা উচিত।
আমদের দেশের গ্রামাঞ্চলে বেশির ভাগ কন্যাশিশু বিদ্যালয়ে থাকাকালে বাল্যবিয়ের শিকার হয় এবং গর্ভধারণে বাধ্য হয়। এভাবেই তাদের লেখাপড়ার ইচ্ছা বাধাগ্রস্ত হয়। দি ফোরাম ফর আফ্রিকান উইমেন এডুকেশনালিস্ট এই নীতি যেমন পরিবর্তনের জন্য আফ্রিকার উপ-সাহারা অঞ্চলের সরকারগুলোকে প্রভাবিত করার কাজে বিশেষভাবে সক্রিয় রয়েছে, তেমনি বাংলাদেশের উদ্যোগ গ্রহণ করা উচিত বাধ্যতামূলকভাবে। পাশাপাশি বিদ্যালয়ের সুযোগ-সুবিধা সবচেয়ে সুবািবঞ্চিত কন্যাশিশুদের দোরগোড়ায় পৌঁছানোর জন্য বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ করা বাঞ্ছনীয়।
এছাড়াও প্রয়োজন বোধে আমাদের দেশের গ্রাম বা চরাঞ্চলে ছোট আকারে মাল্টিগ্রেড কিংবা বিভিন্ন বয়সের কন্যাশিশুদের জন্য স্কুল চালু করা যেতে পারে, যা স্যাটেলাইট বিদ্যালয় নামে পরিচিত বুরকিনা ফাসাতে। এসব বিদ্যালয়ের সুবিধা হলো কন্যাশিশুদের দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে বিদ্যালয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা কম এবং যাওয়া-আসার পথে তাদের নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে অন্তত অবহেলার চোখে না দেখে শিক্ষার এ অঙ্গীকার আমরা পূরণ করতে পারি। যদি এমনটা হয়, তবেই জাতীয় পর্যায়ে শিশু দিবস পালন করা সার্থক হবে।
লেখক : আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মী
বাংলাদেশের সংবিধান মতে, শিক্ষা হলো সব শিশুর মৌলিক অধিকারগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি; তবু শিক্ষাক্ষেত্রে বাংলাদেশের কন্যাশিশুরা বৈষম্যের শিকার। শিশু বিশেষজ্ঞ, মনোবিজ্ঞানী এবং শিশুদের যৌন নির্যাতনবিরোধী বিশ্ব কংগ্রেস (স্টকহোম, ১৯৯৬) জাতীয় ও আন্তজার্তিক প্রস্তুতি কমিটিগুলোর সভাপতি লিসবেট পালমে মনে করেন, শিশুদের যে স্নেহ মমতা ও লালনপালন, খাদ্য, বাসস্থান, স্বাস্থ্য পরিচর্যার মতো জীবনের মৌলিক আবশ্যকীয় উপকরণের অধিকার রয়েছে এটা অনস্বীকার্য। বাংলাদেশের পরিসংখ্যান পকেট বই ২০০৮-এর তথ্যমতে, দেশের বর্তমান জনসংখ্যা ১৩৪.৮ মিলিয়ন। জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ অনুযায়ী, সংশ্লিষ্ট জাতীয় আইনে আরও কম বয়সে বয়ঃপ্রাপ্তির সীমা নির্ধারিত না হয়ে থাকলে শিশু অধিকার সনদ অনুযায়ী ১৮ বছরের কম বয়সী প্রত্যেককে শিশু হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।
জাতীয় আদম শুমারির তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশের মোট শিশুর সংখ্যা ৬ কোটি ১৭ লাখ ৫০ হাজার; অর্থাত্ মোট জনসংখ্যার ৪৯.৬ শতাংশ। ১৪ বছরের নিচে মোট শিশুর সংখ্যা ৫ কোটি ৫০ লাখ বা মোট জনসংখ্যার ৪০.৬ শতাংশ। এর মধ্যে কন্যাশিশুর সংখ্যা ২ কোটি ৪৫ লাখ ৩০ হাজার। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো পরিচালিত জাতীয় শিশুশ্রম জরিপ ২০০৩-এ দেখা যায়, দেশে ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিশুর সংখ্যা ৪ কোটি ২৪ লাখ। এদের মধ্যে ৫৪ ভাগ ছেলে এবং ৪৬ ভাগ কন্যাশিশু। প্রতিদিন দেশে শিশুর সংখ্যা বেড়েই চলেছে; বিগত দশকেও এত বেশি শিশু ছিল না। বাংলাদেশের পরিসংখ্যান ব্যুরো ১৯৯৮, সেম্বল ভাইটাল রেজিস্ট্রেশন সিস্টেমের (১৯৯৭ সালের জনসংখ্যা পরিসংখ্যান) পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১২ কোটি ৫৩ লাখ। এর মধ্যে কিশোর-কিশোরী ২ কোটি ৭৬ লাখ অর্থাত্ তারা জনসংখ্যার ২২ শতাংশ। ১৯৯১ সালে কিশোর-কিশোরীদের সংখ্যা ছিল মাত্র ২ কোটি ২৯ লাখ; অর্থাত্ তারা ছিল মোট জনসংখ্যার ২১ শতাংশ। তখন থেকে এ পর্যন্ত তাদের অনুপাত এক-পঞ্চমাংশ বেড়েছে। ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশে মোট কিশোরীর সংখ্যা ছিল ১ কেটি ৩৭ লাখ এবং মোট কিশোরের সংখ্যা ছিল ১ কোটি ৪০ লাখ। কিশোরীর সংখ্যা আরও দুটি স্তরে বিভক্ত করা যায়। এক, ১০-১৪ বছর বয়সী ৭৬ লাখ। দুই, ১৫-১৯ বছর বয়সী ৬১ লাখ। শহরে কিশোরীর তুলনায় গ্রামে কিশোরীর সংখ্যা পাঁচ জনেরও বেশি। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক বাস্তবতায় কন্যাশিশুরা কিছুটা হলেও বৈষম্যের শিকার। প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক পর্যায়ে ভর্তির ক্ষেত্রে মেয়ে ও ছেলে অনুপাত যেসব দেশে ০.৭৫-এরও কম, সেসব দেশের মোট জাতীয় উত্পাদন (জিএনপি) যে কোনো দেশের চেয়ে ২৫ শতাংশ কম। বিশেষ করে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ায় কন্যাশিশুদের শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্যই এখানকার জিএনপি কমের কারণ হিসেবে বিবেচিত।
মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোলে ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে সবার শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করার কথা বলা হলেও বাংলাদেশ সরকার আশানুরূপ উদ্যোগ নিতে পারেনি। জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান যথাযথই বলেছেন, মেয়েদের শিক্ষার চেয়ে উন্নয়নের অধিক কার্যকর আর কোনো হাতিয়ার নেই। পাশাপাশি আমাদের মনে রাখতে হবে, সার্বজনীন শিক্ষার প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অঙ্গীকার প্রথম নির্ধারণ করা হয় ১৯৪৮ সালের সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণায় এবং পরে তা পুনর্ব্যক্ত করা হয় ১৯৮৯ সালের শিশু অধিকার সনদে। ১৯৯০ সালে অনুষ্ঠিত বিশ্ব শিশু সম্মেলনে বিশ্ব নেতারা শুধু তাদের এ অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্তই করেননি যে, ছেলে ও মেয়ে উভয়েরই সমানভাবে মৌলিক শিক্ষা লাভের সুযোগ থাকা উচিত এবং তারা স্কুলে ভর্তির ক্ষেত্রে যুগ যুগ ধরে বিদ্যমান বৈষম্য কমানোর ওপর গুরুত্ব দেয়ার অঙ্গীকারও ঘোষণা করেন। বিশ্ব শিশু পরিস্থিতি ২০০৪ সালের তথ্য অনুযায়ী অগ্রগতি ত্বরান্বিত করার জন্য সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা বাঞ্ছনীয় এবং পশ্চিম আফ্রিকার ৮টি দেশে এ লক্ষ্য অর্জিত না হওয়ার ঝুঁকি প্রবল মনে করা হয়, সেগুলোর ব্যাপারে বিশেষ নজর দেয়া উচিত। যে ২৫টি দেশ বাছাই করা হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে ১০টিতে বিদ্যালয়ে না যাওয়া মেয়ের সংখ্যা ১০ লাখের উপরে, ৮টিতে কন্যাশিশুদের ভর্তির হার ৪০ শতাংশের কম এবং লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য ১০ শতাংশের বেশি এবং আর্শ্চযের বিষয় হলো, ক্রমানুসারে ২৫টি রাষ্ট্রের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। বিদ্যালয়ে নিরাপদ নয় কিংবা বিদ্যালয়ের পথটিও কন্যাশিশুদের জন্য ভয়াবহ বিপজ্জনক অথবা অত্যন্ত দীর্ঘ, যাতে কন্যাশিশুদের সম্ভ্রমের ওপর আক্রমণ বা অন্য কোনো ধরনের সহিংসতার ঝুঁকি থেকে যায়। বাংলাদেশে কন্যাশিশরা প্রতিনিয়ত হুমকির মুখে। কখনও অ্যাসিড ছুড়ে দিচ্ছে বিদ্যালয়গামী কন্যাশিশুদের মুখে, কখনওবা ইভ টিজিংয়ের শিকার কন্যাশিশুরা বেছে নিচ্ছে আত্মহননের পথ।
উন্নয়নশীল বিশ্বে শিশু দারিদ্র্যের বিস্মৃতি ও গভীরতা সম্পর্কিত এক রিপোর্ট যা The Distribution of Child Poverty in the Developing World : Report to UNICEF নামে পরিচিত। ব্রিস্টল বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত এ রিপোর্টে দেখা গেছে ৭ থেকে ১৮ বছর বয়সী ১৩ থেকে ৫০ লাখের মতো শিশু রয়েছে যাদের আদৌ কোনো শিক্ষা নেই। এদের মধ্যে শিক্ষাবঞ্চিত মেয়েদের সংখ্যা ছেলেদের চেয়ে শতকরা ৬০ ভাগ বেশি হতে পারে (শতকরা ১৬ ভাগ মেয়ের তুলনায় শতকরা ১০ ভাগ ছেলে)। মূলত শিক্ষাবঞ্চিত সব শিশু অন্যান্য বঞ্চনারও শিকার। এভাবে শিক্ষাক্ষেত্রে দুই লিঙ্গের মধ্যকার এই নিদারুণ বৈষম্য এটাই প্রমাণ করে যে, ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের দারিদ্র্যের নানা আঘাত বেশি সইতে হয়। যেমন খাদ্য, নিরাপদ পানি, স্যানিটেশন সুবিধা, স্বাস্থ্য, আশ্রয় বা তথ্য থেকে বঞ্চিত হওয়া। কন্যাশিশুরা প্রাথমিক বিদ্যালয় শেষ করার হার ছেলেদের তুলনায় এখনও পিছিয়ে রয়েছে যথাক্রমে ৭৬ শতাংশ এবং ৮৫ শতাংশ। এ জাতীয় পার্থক্যের অর্থ হচ্ছে, উন্নয়নশীল বিশ্বে ছেলেদের চেয়ে লাখ লাখ বেশি কন্যাশিশু প্রতিবছর বিদ্যালয় ছেড়ে দিচ্ছে। এর ফলে যেসব শিশু বিদ্যালয়ে নেই, তাদের বেশির ভাগই কন্যাশিশু। কন্যা শিশুদের বৈষম্যমুক্তভাবে শিক্ষা প্রদান করা এবং বিদ্যালয়ে তাদের ধরে রাখা আমাদের পারিবারিক, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব।
জাতিসংঘ শিশু তহবিল ইউনিসেফ তার ২০০৪ প্রকাশিত বিশ্ব শিশু পরিস্থিতিতে যেমনটা উল্লেখ করেছে; সমাজের সব পর্যায়ে নেতাদের যা অবশ্যই করতে হবে তা হলো, অগ্রগতির জন্য কন্যাশিশুদের প্রতি লক্ষ্য রেখে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা; যথা ১. মেয়েদের লেখাপড়াকে উন্নয়ন প্রচেষ্টার একটি অত্যাবশ্যকীয় অংশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে; ২.বাদ যাবে না কোনো কন্যাশিশু এই মর্মে মেয়েদের শিক্ষার জন্য একটি জাতীয় চেতনা সৃষ্টি করতে হবে; ৩. কোনো প্রকৃতির বিদ্যালয়ে বেতন নেয়া যাবে না; ৪. শিক্ষার ছকের ভেতর এসে এবং এর বাইরেও ভাবতে হবে, যেমন বৈষম্যবিরোধী আইন ও নীতি, যা মেয়ে ও মহিলাদের সুরক্ষা দেয় এবং প্রারম্ভিক শৈশব কর্মসূচি, যাতে মেয়ে ও ছেলেদের প্রতি সমানভাবে আচরণ করা হয় এবং লিঙ্গভিত্তিক ভূমিকা ও সম্পর্কের বিষয়টি নিরসন করা হয়; ৫. কর্মকৌশল সমন্বিত করতে হবে; ৬. শিক্ষার জন্য আন্তর্জাতিক তহবিল বৃদ্ধি করতে হবে। কন্যাশিশুদের শিক্ষার অধিকারকে সমর্থন করতে হবে। কমবয়সী মেয়েদের বিদ্যালয়ে ফিরে যেতে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা উচিত।
আমদের দেশের গ্রামাঞ্চলে বেশির ভাগ কন্যাশিশু বিদ্যালয়ে থাকাকালে বাল্যবিয়ের শিকার হয় এবং গর্ভধারণে বাধ্য হয়। এভাবেই তাদের লেখাপড়ার ইচ্ছা বাধাগ্রস্ত হয়। দি ফোরাম ফর আফ্রিকান উইমেন এডুকেশনালিস্ট এই নীতি যেমন পরিবর্তনের জন্য আফ্রিকার উপ-সাহারা অঞ্চলের সরকারগুলোকে প্রভাবিত করার কাজে বিশেষভাবে সক্রিয় রয়েছে, তেমনি বাংলাদেশের উদ্যোগ গ্রহণ করা উচিত বাধ্যতামূলকভাবে। পাশাপাশি বিদ্যালয়ের সুযোগ-সুবিধা সবচেয়ে সুবািবঞ্চিত কন্যাশিশুদের দোরগোড়ায় পৌঁছানোর জন্য বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ করা বাঞ্ছনীয়।
এছাড়াও প্রয়োজন বোধে আমাদের দেশের গ্রাম বা চরাঞ্চলে ছোট আকারে মাল্টিগ্রেড কিংবা বিভিন্ন বয়সের কন্যাশিশুদের জন্য স্কুল চালু করা যেতে পারে, যা স্যাটেলাইট বিদ্যালয় নামে পরিচিত বুরকিনা ফাসাতে। এসব বিদ্যালয়ের সুবিধা হলো কন্যাশিশুদের দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে বিদ্যালয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা কম এবং যাওয়া-আসার পথে তাদের নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে অন্তত অবহেলার চোখে না দেখে শিক্ষার এ অঙ্গীকার আমরা পূরণ করতে পারি। যদি এমনটা হয়, তবেই জাতীয় পর্যায়ে শিশু দিবস পালন করা সার্থক হবে।
লেখক : আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মী
No comments