আলোকের এই ঝরনাধারায় (পর্ব-৫৮)-এমন এক অসম্ভব রাষ্ট্রে বসবাস সম্ভব নয় by আলী যাকের

পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে আসার পর আমি একাধিকবার পার্বত্য চট্টগ্রামে গিয়েছি। ঘনিষ্ঠ হয়েছি অনেক মানুষের সঙ্গে। বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকতে ছাত্র ইউনিয়নের কল্যাণে অনেক আদিবাসীর সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলাম। তাদের উত্তরসূরিরা আমাকে আপন বলে মনে করতেন। সেই সুবাদে আমাকে বেশ কিছু অনুষ্ঠানে বক্তা হিসেবে যেতে হয়েছে রাঙামাটি এবং চট্টগ্রামের আরো কিছু অনুষ্ঠানে। এমনকি স্বাধীন বাংলাদেশে যখন আদিবাসীবিরোধী একটি যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছিল, তখনো পাহাড়ি এলাকায় যেতে আমার কোনো ভয় করেনি।


ঢাকায় ফিরে এসে গুছিয়ে বসতে না বসতে বাংলাদেশের উত্তাল রাজনৈতিক আবহাওয়া আমাকে আবৃত করে ফেলল। প্রতিদিন নানাবিধ কাজে ব্যস্ত থাকি। এ কাজের ফাঁকে ফাঁকে বিভিন্ন সময় বন্ধুরা চা খেতে আসে এবং দেশ নিয়ে কথা হয়। এ সময়ই ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে আমার যোগাযোগ পুনঃ প্রতিষ্ঠিত হয়। তখনকার কিছু তরুণ ছাত্র ইউনিয়ন এবং সংস্কৃতি সংসদের কর্মী নিত্যই আমার কাছে আসত। তখনই বুঝতে শুরু করে দিয়েছি যে আমাদের তরুণ প্রজন্মের কাছেও সার্বিক মুক্তি ভিন্ন আর কোনো কিছু গ্রহণযোগ্য নয়। তবে বেশ কিছু বিষয় আছে, যা বলা সহজ কিন্তু করা শক্ত। আমরা তখনো, সেই '৬৯-এ পূর্ণ স্বাধীনতার কথা ভাবতে পারি কি না তা নিয়ে যখন আমার কিছু গুরুসম ব্যক্তির কাছে আমি প্রশ্ন করি, সেখান থেকে একটা ভিন্ন ধরনের চমকপ্রদ ধারণা আমি পাই এবং বুঝতে পারি যে স্বাধীনতার আগেও যে একটি বিষয় অর্জন করার আছে, সেটি হলো বুদ্ধির মুক্তি। আমি এখনো মনে করি যে আমাদের যুদ্ধে আমরা যদিও রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ভৌগোলিক স্বাধীনতা অর্জন করেছিলাম ১৯৭১-এ, অতএব একটি জাতির সবচেয়ে বড় পরিচয় যে সংস্কৃতি, সেই সংস্কৃতির মুক্তি কিন্তু আমরা এখনো সম্পূর্ণভাবে অর্জন করতে পারিনি। ভৌগোলিক স্বাধীনতা পেয়েছি বটে; কিন্তু ১৯৭৫ সালের আগস্ট মাসে বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর আমাদের জাতিসত্তার সামগ্রিক মুক্তি, যা ছিল মুক্তিযুদ্ধের একমাত্র নিয়ামক তা থেকে অনেক দূরে সরে এসেছি। বস্তুতপক্ষে এখন আমরা যুক্তি-বুদ্ধির অনেক দূরে এক গাঢ় অমানিশার মধ্যে প্রবেশ করেছি যেন। আমরা ভেবেছিলাম যে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র পাব, পাব একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, এ ব্যাপারটি পর পর সেনা শাসনের মাধ্যমে এবং আমাদের সংবিধান বিকৃত করার মাধ্যমে আমাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে।
ফিরে যাই '৬৯-এ। তখন পাকিস্তানের উভয় প্রদেশে সেনা শাসনের বিরুদ্ধে তুমুল আন্দোলন শুরু হয়ে গেছে। তবে বাংলাদেশে আন্দোলনের রূপ ছিল কিছু ভিন্ন। এখানে একাধারে যেমন আইয়ুববিরোধী আন্দোলন আমাদের সামরিক শাসন থেকে মুক্ত করার প্রয়াসে পরিচালিত হয়েছিল, তেমনি আমাদের সংস্কৃতির মুক্তির জন্যও একটি জোরদার আন্দোলন শুরু হয়েছিল। সমাজবিজ্ঞানের গভীরে প্রবেশ না করেও আমাদের সাধারণ মানুষ জানত যে আমরা ভাষায়, আচার-ব্যবহারে, খাদ্য-বস্ত্রে, সামগ্রিক জীবনযাত্রায় পশ্চিম পাকিস্তানিদের থেকে ভিন্ন। অতএব পূর্ব পাকিস্তানের ভিন্ন হওয়া ছাড়া আর কোনো গতি নেই। এ আন্দোলন তুঙ্গে উঠল যখন আইয়ুব খান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে আগরতলা ষড়যন্ত্রে আসামি করে জেলে পাঠাল। এই একটি ইস্যুকে ভিত্তি করে দলমত-নির্বিশেষে সব বাঙালি একাত্ম হয়ে সংগ্রাম শুরু করে। আমার এখনো স্পষ্ট মনে আছে, '৬৯-এর ২১ ফেব্রুয়ারিতে আমার এক ভাই, যার কলকাতায় বসবাস, শহীদ মিনারের জনতার ঢল দেখে বলেছিল, 'তোদের মনে হয় আর পাকিস্তানের ভেতরে রাখা গেল না।' ওই সময় আমার নতুন চাকরির প্রচণ্ড চাপ থাকা সত্ত্বেও বাঙালির উত্তাল রাজনৈতিক আন্দোলন আমাকে পথে টেনে নিয়েছিল। সেখানে যখনই সুযোগ পেতাম, জনতার ঢলের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়েছি। স্লোগানে মুখর বাঙালির সঙ্গে মিলিয়েছি কণ্ঠ। এ সময় অসংখ্যবার মিছিলের ওপর পাকিস্তানি পুলিশের গুলি চলে। আসাদ নামে এক তরুণ ছাত্র ইউনিয়ন কর্মীর মৃত্যু হয়। উত্তাল বিক্ষোভে ফেটে পড়ে বাংলাদেশের মানুষ। ওই সময় মোহাম্মদপুরের এক প্রধান সড়কের নাম আইয়ুব এভিনিউ থেকে আসাদ এভিনিউ রাখা হয়। এই আন্দোলনের তোড়ে তৎকালীন পাকিস্তানি সরকারের সব বিধিনিষেধ খড়কুটোর মতো উড়ে যায় এবং পূর্ব পাকিস্তানবাসীর দাবি স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতায় উন্নীত হয়। ঠিক এই সময় আমি আমার কম্পানির কাছ থেকে পয়সা ধার করে একটি ভঙ্ ওয়াগন বিটল্্ গাড়ি কিনি। এই গাড়িটি তখন অক্লান্ত পরিশ্রম করেছে। গাড়িভর্তি আমরা পাঁচ বন্ধু দ্রুত এখান থেকে সেখানে যাওয়া-আসা করতে পারতাম। এরপর এলো ১৯৭০-এর ঘূর্ণিঝড়। ওই ঝড়ের সময় আমরা সবাই কমবেশি ত্রাণ ও পুনর্বাসন কাজের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ি। দক্ষিণ-পশ্চিমের খুলনা অঞ্চল থেকে শুরু করে দক্ষিণ-পূর্বের সন্দ্বীপ পর্যন্ত প্রায় সব দ্বীপ ও উপকূলীয় এলাকায় লাখ লাখ মানুষকে ভাসিয়ে নিয়ে যায় ওই ঘূর্ণিঝড়। সে সময় বিপদসংকেত প্রচারের মাধ্যম ছিল অপ্রতুল এবং সম্ভাব্য ঝঞ্ঝা আক্রান্ত স্থানগুলোতে আঞ্চলিকভাবে যে কিছু করতে হবে, সে বিষয়ে পাকিস্তান সরকার ছিল সম্পূর্ণ ভাবলেশহীন। আমি ত্রাণের কাজ করতে গিয়ে নিজের চোখে দেখেছি নদীতে যেমন ভাসছে মৃত পশুপাখি, তেমনি ভেসে যাচ্ছে অসংখ্য মানুষের লাশ। এই অঞ্চলের ভয়াবহতম ঘূর্ণিঝড় ছিল ওইটি। পাঁচ লাখ লোক এই অপঘাতে মারা পড়ে সেবার। সাইক্লোন হয়ে যাওয়ার পর পাকিস্তান সরকার এতটাই নির্লিপ্ত থাকে যে কোনো ত্রাণ অথবা পুনর্বাসনের চেষ্টাই নেওয়া হয় না। এ সময় আমরা আরো একবার অনুধাবন করি যে এমন এক অসম্ভব রাষ্ট্রে আমাদের পক্ষে বসবাস কোনোমতেই সম্ভব নয়।
(চলবে...)

লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

No comments

Powered by Blogger.