মহাশ্বেতা দেবী দলিত জনগোষ্ঠীর সহযাত্রী by বদরুন নাহার

মি চিরকালই প্রতিবাদী লেখক। লেখা ও কাজের মাধ্যমেই প্রতিবাদ করে এসেছি আমি। ... জনমানুষের সাথে কাজ করেছি।' নিজের সম্পর্কে মহাশ্বেতা দেবী এভাবেই কথা বলেন বরাবর। বাংলা সাহিত্যে বিষয়ের বহুমাত্রিকতা ও দেশজ আখ্যানের অনুসন্ধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে মহাশ্বেতা দেবীর। তিনি ইতিহাস থেকে, রাজনীতি থেকে যে সাহিত্য রচনা শুরু করেন, তা শোষিতের আখ্যান নয়, বরং স্বদেশীয় প্রতিবাদী চরিত্রের সনি্নবেশ বলা যায়। প্রতিবাদী জীবন ও সাহিত্যের এক স্বতন্ত্র ঘরানার লেখক তিনি।


মহাশ্বেতা দেবীর জন্ম ১৪ জানুয়ারি ১৯২৬ সালে বাংলাদেশের এক খ্যাতনামা পরিবারে। তাঁর বাবা মনীশ ঘটক বিশিষ্ট সাহিত্যিক এবং কাকা ঋতি্বক ঘটক ভারতীয় চলচ্চিত্রের এক ব্যতিক্রমী প্রতিভার শ্রদ্ধেয়জন। ঢাকার ইডেন স্কুলের মন্টেসরিতে পড়াশোনা শুরু করেন। পরবর্তীকালে মেদিনীপুরে চতুর্থ শ্রেণীতে ভর্তি হন। ১৯৩৬ সালে তিনি পড়াশোনা করতে শান্তিনিকেতন যান। এ সময় মাত্র দুই বছর শান্তিনিকেতনে কাটালেও তা ছিল তাঁর জীবনের উল্লেখযোগ্য সময়। তখনই তাঁর লেখালেখির শুরু। ১৯৩৯ সালে তিনি যখন অষ্টম শ্রেণীতে পড়েন, তখন খগেন্দ্রনাথ সেন সম্পাদিত 'রংমশাল' পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয় তাঁর রবীন্দ্রনাথ-সম্পর্কিত রচনা 'ছেলেবেলা'। ১৯৩৯ সালে তিনি কলকাতায় চলে আসেন। সেখান থেকে ম্যাট্রিক পাস করে ১৯৪২ সালে আশুতোষ কলেজে ভর্তি হন।
১৯৪৩-এ পঞ্চাশের মন্বন্তরের সময় মহাশ্বেতা দেবী প্রথম বর্ষে পড়েন এবং কম্যুনিস্ট পার্টির ছাত্রী সংগঠন 'এরৎষং ঝঃঁফবহঃ অংংড়পরধঃরড়হ' এবং দুর্ভিক্ষ ত্রাণের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। তিনি কম্যুনিস্ট পার্টির মিটিংয়ে যোগ দিতেন। পার্টির মুখপত্র 'চবড়ঢ়ষব'ং ডধৎ', 'জনযুদ্ধ' বিক্রি করতেন। তবে পার্টির মেম্বার না হয়ে এভাবেই কম্যুনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। মূলত তখন থেকেই তাঁর কর্মিসত্তার বিকাশ, যা পরবর্তীকালে তাঁর জীবনে আরও প্রকট হয়ে ওঠে। ১৯৪৪ সালে মহাশ্বেতা ফিরে আসেন শান্তিনিকেতনে, বিএ পড়তে। ১৯৪৬ সালে আবার কলকাতায় ফিরে ইংরেজিতে অনার্সসহ বিএ পাস করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে এমএ ভর্তি হন। কিন্তু তখন রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে পড়াশোনা ব্যাহত হয়। ১৯৪৭ সালে তিনি বিশিষ্ট নাট্যকার এবং কম্যুনিস্ট পার্টির সদস্য বিজয় ভট্টাচার্যের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের সংসারজীবন ছিল দরিদ্রতায় পরিবেষ্টিত। এ সময় মহাশ্বেতা দেবী রঙ সাবান, রঙের গুঁড়ো ফেরি করেন, ছাত্র পড়ান। ১৯৪৮ সালে তাঁর একমাত্র পুত্র নবারুণের জন্ম হয়। মহাশ্বেতা দেবীর সংসার জীবন মাত্র ১৫ বছরের। এক সময় তিনি সুমিত্রা দেবী ছদ্মনামে 'সচিত্র ভারত' পত্রিকায় ফিচার এবং গল্প লেখা শুরু করেন। যদিও ১৯৪৯ সালে ইনকাম ট্যাক্সে কেরানির চাকরি পান, কিন্তু সে চাকরি তাঁর করা হয় না। এরপর তিনি কেন্দ্রীয় সরকারে পোস্টাল অডিটে আপার ডিভিশন ক্লার্কের চাকরি নেন। কিন্তু সেখানে রাজনৈতিক সন্দেহে চাকরি থেকে বরখাস্ত হন। পরবর্তীকালে পুনর্বার চাকরিতে বহাল হলেও তিনি বীতশ্রদ্ধ হয়ে সরকারি চাকরিতে ফেরেননি।
পড়াশোনায় দীর্ঘ বিরতির পর ১৯৬৩ সালে তিনি প্রাইভেটে ইংরেজিতে এমএ পাস করেন এবং ১৯৬৪ সালে ইংরেজি অধ্যাপনায় প্রবেশ করেন বিজয়গড় জ্যোতিষ রায় কলেজে। ইতিমধ্যে তাঁর প্রথম বই ঝাঁসীর রানী [১৯৫৬] প্রকাশ পায়। পরবর্তীকালে তিনি লেখাকেই পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। ইতিহাস তাঁর সাহিত্যজীবনে সব সময়ই গুরুত্ব পেয়ে এসেছে। তিনি মনে করতেন, ইতিহাসের মুখ্য কাজই হচ্ছে একই সঙ্গে বাইরের গোলমাল, সংগ্রাম ও সমারোহের আবর্জনা এবং ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে জনবৃত্তকে অন্বেষণ করা, অর্থ ও তাৎপর্য দেওয়া। এর মাধ্যমে বেরিয়ে আসবে সমাজনীতি ও অর্থনীতি, যার মানেই হলো লোকাচার, লোকসংস্কৃতি, লৌকিক জীবনব্যবস্থা। তাঁর প্রথমদিকের সাহিত্যকর্মে এই প্রয়াস পরিলক্ষিত হয়। তিনি ঐতিহাসিক পটভূমিকায় খুদাবক্স ও মোতির প্রেমের কাহিনী নিয়ে ১৯৫৬ সালে 'নটী' উপন্যাসটি লেখেন। এ ছাড়া প্রথম পর্যায়ে তিনি লোকায়ত নৃত্য-সঙ্গীতশিল্পীদের নিয়ে লিখেছেন মধুরে মধুর [১৯৫৮], সার্কাসের শিল্পীদের বৈচিত্র্যময় জীবন নিয়ে লেখেন প্রেমতারা [১৯৫৯]। এছাড়া যমুনা কী তীর [১৯৫৮], তিমির লগন [১৯৫৯], রূপরাখা [১৯৬০], বায়োস্কোপের বাক্স [১৯৬৪] প্রভৃতি উপন্যাস। ১৯৬৫ সালে মহাশ্বেতা দেবী অসিত গুপ্তকে বিয়ে করেন। কিন্তু সেই সম্পর্ক ১৯৭৬ সালে ভেঙে যায়। নিঃসঙ্গ জীবন, বিচ্ছেদ-বিরহ-বেদনায় তিনি নিজেকে সঁপে দেন লেখা এবং শিক্ষার ব্রতে। এ সময় তাঁর ব্যক্তিগত জীবন-সাহিত্য ও দর্শনের নতুন সত্তার প্রকাশ ঘটে। তাঁর সাহিত্য সৃষ্টিগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য আঁধার মানিক [১৯৬৬], কবি বন্দ্যঘটি গাঞির জীবন ও মৃত্যু [১৯৬৬], হাজার চুরাশির মা [১৯৭৪], ঘরে ফেরা [১৯৭৯]।
মহাশ্বেতা দেবী মনে করেন, সাহিত্যে শুধু হৃদয়গ্রাহ্যতা নয়, মস্তিষ্কগ্রাহ্যতাও চাই। তিনি বলেন, পাঠক-সমালোচককে আজ এ কথা বুঝতে হবে যে, আমি যা-যা লিখেছি তার মধ্য দিয়ে এটাই বলতে চেয়েছি যে, যা-যা ঘটেছে তা শুধু আজই ঘটছে না, চিরকালই ঘটে আসছে। তাঁর মতে, লেখকের কাজ হলো ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে সেই ঘটনাবলিকে স্থাপন করা। তিনি প্রায়শ এ কথাও বলে থাকেন যে, তিনি ইতিহাসের প্রতি দায়বদ্ধ। মহাশ্বেতা দেবী দীর্ঘ সাহিত্যিক জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছেন যে জনমানুষের সঙ্গে, তাদের বড় একটি অংশ হলো আমাদের প্রান্তিক দলিত জনগোষ্ঠীর গোত্রভুক্ত। সত্তরের মাঝামাঝি সময়ে মহাশ্বেতা দেবী তাঁর উপন্যাসকে উত্তর-ঔপনিবেশিক প্রতিবাদী আখ্যান থেকে আরও গভীরে নিয়ে গেলেন। আর বাংলা উপন্যাস সাহিত্যে নিয়ে এলেন একেবারে সভ্য সমাজের মানুষের বিচরণের বাইরের জগৎ। ইতিহাস অনুসন্ধানে তিনি চলে গেলেন একেবারে প্রান্তিক আদিবাসী জনগোষ্ঠীর কাছে। ইতিহাস, রাজনীতি ও উপকথাকে কেন্দ্র করে আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় প্রান্তিক আদিবাসীদের জীবনসংগ্রামের কথ্য ইতিহাসকে নিয়ে এলেন সুসভ্য নাগরিকদের পাঠ্যে। মহাশ্বেতা দেবীর এই কণ্ঠস্বর নিছক সমাজতাত্তি্বক নয়, বরং সমাজ- মনস্তাত্তি্বকের। তাঁর উপন্যাসের প্রেক্ষাপটেও এই বিশ্লেষিত দৃষ্টির প্রতিফলন হয়। ব্রাত্যজনের দলিত হওয়ার ইতিহাসকে সুরক্ষার সংগ্রামে ব্যাপ্ত হয়ে ওঠেন মহাশ্বেতা দেবী। অরণ্যচারী জনগোষ্ঠীর মুখে মুখে ঘুরে ফেরা জীবন ও ঐতিহ্য থেকে সেই জাতিসত্তার যে ইতিহাস তিনি রচনা করেন, যা তাঁর সাহিত্য জীবনের তৃতীয় পর্ব বলা যায়। এ সময় তাঁর উপন্যাসে সাব-অলটার্ন ভাবধারার উপস্থিতি দেখতে পাওয়া যায়। মহাশ্বেতা অন্ত্যজ আদিবাসীদের চোখ দিয়ে জীবনকে ব্যাখ্যা করেন। তাদের পুরাণ কথার ভেতর দিয়ে ইতিহাস তুলে আনেন, তা আধিপত্য বিস্তারকারী হেজিমনি [যবমবসড়হরপ] শ্রেণীর নয়, বরং শোষিত-দরিদ্র প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। মহাশ্বেতা দেবী উপন্যাস রচনার ক্ষেত্রে বৈশ্বিক ভৌগোলিক পরিবর্তনের সঙ্গে ভারতীয় রাজনৈতিক ইতিহাসের পরিবর্তনের ধারায় সেদেশীয় আদিবাসী জীবনের পরিবর্তনকে বর্ণনা করেন। পাহাড়ি অরণ্য জীবনের সঙ্গে উপন্যাসে ফুটে ওঠে পরিবেশের বিপন্নতার চিত্র, যা আজকের পৃথিবীকেও বিচলিত করে। তাঁর আদিবাসী জীবনকেন্দ্রিক উপন্যাসগুলো হলো :কবি বন্দ্যঘটী গাঞির জীবন ও মৃত্যু [১৯৬৭], অরণ্যের অধিকার [১৯৭৫], চোট্টি মুণ্ডা এবং তার তীর [১৯৮০], সুরজ গাগরাই [১৯৮৩], টেরোড্যাকটিল, পূরণসহায় ও পিরথা [১৯৮৭], ক্ষুধা [১৯৯২] এবং কৈর্বত খণ্ড [১৯৯৪] প্রভৃতি। উলি্লখিত উপন্যাসগুলো ছাড়া আরও বেশ কিছু উপন্যাসে মহাশ্বেতা দেবী আদিবাসী প্রসঙ্গ এনেছেন, তবে তা বিচ্ছিন্নভাবে। এ ছাড়াও তিনি আদিবাসীদের নিয়ে প্রচুর ছোটগল্প লিখেছেন। গল্পগ্রন্থের মধ্যে উল্লেখ্য_ শালগিরার ডাকে [১৯৮২], ইটের পরে ইট [১৯৮২], হরিরাম মাহাতো [১৯৮২], সিধু কানুর ডাকে [১৯৮৫] প্রভৃতি। এসব গল্প-উপন্যাসে তিনি সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সামরিক নিষ্পেষণের বিরুদ্ধে যেমন আদিবাসী প্রতিবাদী চরিত্র চিত্রিত করেছেন, তেমনি এদেশীয় সামন্ততান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার শোষণের প্রতি প্রতিবাদ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কণ্ঠস্বরে তুলে ধরেছেন। যা সাবঅলটার্ন উত্তরাধুনিকতারই এক স্টাডিজ। সে ক্ষেত্রে বলা যায়, পোস্টমডার্নিজমের ক্ষেত্রে সাবঅলটার্ন আসার আগে থেকেই মহাশ্বেতা তাঁর নিজের মতো করে সাবঅলটার্ন চর্চা করেছেন। কারণ সাবঅলটার্ন স্টাডিজ সংকলন প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৮২ সালে। সাবঅলটার্ন গবেষকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য জ্ঞানেন্দ্র পাণ্ডে, ডেভিড হার্ডিম্যান, রণজিৎ গুহ, শাহিদ আমিন, পার্থ চট্টোপাধ্যায়, গৌতম ভদ্র, গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক প্রমুখ।
এই তাত্তি্বকদের আলোচনার আগেই মহাশ্বেতা দেবীর উপন্যাসে শোষক আর শাসক শ্রেণীর যে দ্বন্দ্ব এবং চরিত্র পরম্পরায় যারা উঠে এসেছে তা সাবঅলটার্ন তাত্তি্বকদের নিম্নবর্গ ও উচ্চবর্গের শ্রেণীকরণের ব্যাখ্যায় স্থাপন করলে যথার্থ হবে। মহাশ্বেতা দেবীর আদিবাসী জীবনকেন্দ্রিক সাহিত্য নির্মাণের ক্ষেত্রে ঘটনার নাটকীয়তার চেয়ে মানব-চরিত্রের দিকে বিশেষ মনোযোগ তিনি দিয়েছেন। তাঁর আদিবাসী জীবনকেন্দ্রিক উপন্যাসের বেশিরভাগ প্রধান চরিত্র সেই শ্রেণী থেকে উঠে আসা মানুষ।
তাঁর এই সাহিত্যকৃতিকে ব্যাখ্যা করতে যেয়ে ধীমান দাশগুপ্ত বলেন_ "বাংলা সাহিত্যে রিয়ালিজমের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রবক্তা এবং রূপকার মানিক বন্দ্যোপ্যাধ্যায়। সেই রিয়ালিজমের বিশেষ একটি ধারার সর্বশ্রেষ্ঠ রূপকার হলেন মহাশ্বেতা দেবী। ... মহাশ্বেতার সাহিত্যিক ক্ষেত্রটিকে তাই বলা যায় মানিকের রিয়ালিজম, সতীনাথের ফর্মালিজম এবং তারাশঙ্করের এক্সপ্রেশনিজমের এক একীভূত ক্ষেত্র। আমার বিচারে মানিক বা তারাশঙ্করের চেয়েও সতীনাথের সঙ্গে মহাশ্বেতার আত্মীয়তা যেন অধিক। ... সতীনাথের মতোই মহাশ্বেতাও 'শ্রেণী বিভক্ত বর্ণবিচ্ছুরিত যৌনতাশাসিত ধর্মসাপেক্ষ প্রাদেশিকতা-নির্ভর' এক ভারতবর্ষের লেখক।" [ধীমান দাশগুপ্ত, প্রবন্ধ- 'কলম, আইডিয়া, কুড়ূল', বিকাশ শীল সম্পাদিত জনপদপ্রয়াস, পঞ্চম বর্ষ, তৃতীয়-চতুর্থ সংখ্যা]
বাংলা উপন্যাসে তিনি দলিত শ্রেণীর মানুষের সর্বাধিক উপস্থিতি ঘটিয়েছেন। ঙৎধষ ঃৎধফরঃরড়হ-এ যেই আদিবাসীদের ঐতিহ্য। যাদের প্রকৃতপক্ষে লিপি অনুপস্থিত বলে লোককথা, মিথ এবং উপকথার লিখিত রূপ পাওয়া যায়নি। জনজীবন থেকে এগুলো সংগ্রহ করে তাঁকে আখ্যানকাব্যের বিবরণ ও কথকতায় উপন্যাস সৃষ্টি করেছেন মহাশ্বেতা দেবী। এবং সেই উপন্যাসের কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেছে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রতিবাদের স্বর। সাবঅলটার্ন স্টাডির অন্যতম বিশ্লেষক গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক প্রশ্ন তুলেছিলেন_ 'দলিতরা কি কথা বলতে পারে?' তাঁর এই প্রশ্নের উত্তর আমরা মহাশ্বেতা দেবীর উপন্যাসের বিরসা, চোট্টি, সুরুজ গাগরাই, কোসিলা প্রমুখ চরিত্রের মাঝে খুঁজে পাই, যারা ভিন্ন ভিন্ন আখ্যানে কথা বলে ওঠে। মহাশ্বেতা দেখিয়েছেন কোন অবস্থায় দলিতরা কথা বলে। তার বিশিষ্টতা এই যে, তিনি বাংলা সাহিত্যে সর্বাধিক আদিবাসী জীবনকেন্দ্রিক উপন্যাস রচনা করে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন।
মহাশ্বেতা দেবীর দীর্ঘ সাহিত্যিক জীবনে তিনি সাহিত্য ও জীবনকে এক জায়গায় নিয়ে এসেছেন। তাঁর সাহিত্যে বাস্তব জীবনের শৈলী স্পষ্ট হয়ে ওঠে শিল্পসম্মতভাবে। সেই আখ্যান ইতিহাসের হোক কিংবা বর্তমান সময়ের। লেখক হিসেবে তিনি যেমন প্রতিবাদী তেমনি ব্যক্তিজীবনেও। মধ্য সত্তরের দশক থেকে আশির দশক আদিবাসীদের অধিকার আদায়ের পক্ষে প্রচুর কলাম লিখেছেন তিনি। ১৯৯২ সালে মহাশ্বেতা দেবী জেনেভা মহিলা সম্মেলনে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেন। সেখানে তিনি ভারতবর্ষের কৃষক সমাজকে দলিত আদিবাসী ও উপজাতিদের মতোই অসহায় বলে উপস্থাপন করেন।
বাবা মনীশ ঘটক মারা যাওয়ার পর বিকল্পধারার লিটল ম্যাগাজিন 'বর্তিকা' সম্পাদনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন মহাশ্বেতা দেবী ১৯৮০ সালে। নতুন করে 'বর্তিকা' লিটল ম্যাগাজিনের স্বতন্ত্রতার সঙ্গে সঙ্গে মহাশ্বেতা দেবীর আদিবাসী ও কৃষক সমাজের প্রতি দায়িত্ববোধের জায়গা থেকে কাজ করেন। বিশেষ সংখ্যাগুলোতে তিনি আদিবাসী মুণ্ডা, লোধা-শবর, সাঁওতাল, হরিজনসহ অসংখ্যা সংখ্যা প্রকাশ করেন গ্রাম সমীক্ষা হিসেবে। এভাবে তিনি আদিবাসীদের খুব কাছের মানুষ হয়ে ওঠেন। লোধাদের স্বীকৃতি চেয়েও তিনি দীর্ঘদিন সংগ্রাম করেন। তিনি প্রত্যক্ষভাবে গ্রামে গ্রামে হেঁটে তাদের সচেতন করার কাজ করেছেন। এইভাবে শুধু শিল্প সৃষ্টির জন্য নয়, অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে, মূলধারার মানুষের সচেতন সহানুভূতি আদায়ের লক্ষ্যে তিনি সাহিত্য রচনা করেন। মহাশ্বেতা দেবী প্রায় ২০টির মতো আদিবাসী সংগঠন গঠন করেন এবং নানা সংগঠনের সঙ্গে কার্যকরী সদস্য হয়ে তাদের অধিকার আদায়ের কাজ করে যান।
এ কথা নিঃসন্দেহে স্বীকৃত যে, বাংলা সাহিত্যে এক ম্যারাথন লেখক মহাশ্বেতা দেবী। তাঁর সাহিত্যকর্ম ইংরেজি, জার্মান, জাপানি, ফরাসি এবং ইতালীয় ভাষায় অনূদিত হয়েছে। এ ছাড়া অনেক বই ভারতীয় বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। আদিবাসীদের মাঝে কাজ করার জন্য ১৯৯৭ সালে ম্যাগসাইসাই পুরস্কারসহ ভারতের গুরুত্বপূর্ণ অনেক পুরস্কার পান তিনি। ২০১১ সালের নোবেল পুরস্কারের জন্য করা সাহিত্যিকদের তালিকায় উঠে আসে মহাশ্বেতা দেবীর নাম। ১৪ জানুয়ারি আজীবন সংগ্রামী এই লেখকের ৮৫তম জন্মদিন। বাংলা সাহিত্যের নবরূপের কারিগর, প্রতিবাদী সাহিত্যের মানুষটিকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা। হ

No comments

Powered by Blogger.