চৈতন্যের মুক্ত বাতায়ন-জনগণের মালিকানা ছিনতাই by যতীন সরকার

দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা, কারো দানে পাওয়া নয়'_কথাটার সত্যতা প্রশ্নাতীত। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, দাম দিয়ে কোনো কিছু কিনলেই তার মালিকানা কি চিরকালের জন্য বহাল থাকে? চোর-ছ্যাঁচড়ের হাত থেকে সেই মালিকানা বাঁচিয়ে রাখার জন্য সদাসতর্ক থাকতে হয় না কি? আমাদের স্বাধীন দেশটির মালিকানা বজায় রাখার জন্য আমরা কি তেমন সতর্ক থেকেছি?
থাকিনি যে অচিরেই তার প্রমাণ পাওয়া গেল।


Eternal vigilance is the price of liberty- এই মহাজন বাক্য যেন আমরা পুরোপুরি বিস্মৃত হয়েছিলাম। আমরা চূড়ান্ত আত্মতুষ্টিতে ডুবে গিয়েছিলাম। সেই আত্মতুষ্টির ফলেই আমরা মনে করে বসেছিলাম : ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর যে বিজয় অর্জন করেছি, সেই বিজয়ের ফল কেউ আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নিতে পারবে না।
তবে সেই আত্মতুষ্টির কালেও একটা মহৎ কাজ সম্পন্ন করেছিলাম। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই আমাদের নতুন রাষ্ট্রের মালিকানার যে অসাধারণ দলিল আমরা প্রস্তুত করে নিতে পেরেছিলাম, তারই নাম দিয়েছিলাম 'গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সংবিধান'। সেই সংবিধানরূপ দলিলটিতে আমরা স্পষ্ট করে লিখে রেখেছিলাম যে আমাদের রাষ্ট্রটির মালিক হচ্ছে জনগণ। অর্থাৎ এই রাষ্ট্রের যারা নাগরিক, তারা হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান কিংবা অন্য যেকোনো ধর্মতন্ত্রের অনুসারী হোক অথবা কোনো ধর্মতন্ত্রের প্রতিই তাদের আনুগত্য না থাকুক, বাঙালি বা অন্য কোনো জাতি-গোষ্ঠীর তারা অন্তর্গত থাকুক_এ রকম সব নাগরিকের সমান অধিকার, কোনো অজুহাতেই কোনো নাগরিকের কোনো মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ন করা যাবে না। কিংবা এই নাগরিক জনগণের কোনো গোষ্ঠী তাদের অধিকার ক্ষুণ্ন হয়েছে বলে ধারণা করতে পারে_রাষ্ট্রের পক্ষে এমন কিছু করাও মোটেই সংগত হবে না। এভাবেই রাষ্ট্রের ওপর জনগণের পূর্ণ মালিকানা প্রতিষ্ঠিত রাখতে হবে।
এই মালিকানা প্রতিষ্ঠার রক্ষাকবচরূপেই সংবিধানে গৃহীত হয়েছিল রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতি। তবে এই মূলনীতিগুলোর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে ভ্রান্তি ঘটার মতো অনেক ফাঁকফোকরও থেকে গিয়েছিল। এমনকি তখনকার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন নেতারাও সে রকম ভ্রান্তি থেকে মুক্ত ছিলেন না। যেমন_'জাতীয়তাবাদ'কে নিরঙ্কুশ 'বাঙালি জাতীয়তাবাদ' বলেই তাঁরা ধরে নিয়েছিলেন। তাই বাঙালি জাতির বাইরে অবস্থিত অন্য জাতি-গোষ্ঠীর মানুষকে তাঁরা 'বাঙালি' হয়ে যাওয়ার উপদেশ দিয়েছিলেন। এমন উপদেশ মানা অন্য জাতির মানুষদের পক্ষে কোনোমতেই সম্ভব ছিল না। সেই সব জাতিভুক্ত মানুষ এ রকম উপদেশের শুধু প্রতিবাদই করেনি, একপর্যায়ে তারা অস্ত্র হাতে নিতেও বাধ্য হয়েছিল।
এ রকমই বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছিল 'ধর্মনিরপেক্ষতা' নিয়েও। আসলে ইংরেজি 'সেক্যুলারিজম' শব্দটিই বাংলায় লিখিত হয়েছে 'ধর্মনিরপেক্ষতা'। এই বাংলা শব্দটিও বিভ্রান্তির জনক হয়ে দেখা দিয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষতাই জনগণের কাছে ধর্মহীনতা বলে প্রতিভাত হয়, তাই তারা এতে তাদের বড় ধরনের মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ন হয়েছে বলে মনে করতে থাকে। 'ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়'_শাসকদের এমন ব্যাখ্যাও জনগণকে সন্তুষ্ট না করে বরং আরো বেশি আতঙ্কিত ও অসন্তুষ্ট করে তোলে। এ রকম আতঙ্ক ও অসন্তোষ উপশমিত হওয়ার বদলে ক্রমবর্ধমান হয়ে চলে।
প্রকৃত প্রস্তাবে বাংলায় ব্যবহৃত 'ধর্ম' শব্দটির ভেতরেও বিভ্রান্তির বীজ নিহিত। সংস্কৃত ভাষার 'ধর্ম' শব্দটি ইংরেজি 'রিলিজিয়ন'-এর সঙ্গে একার্থক নয়। আসলে সংস্কৃত 'ধর্ম' শব্দটির সঠিক সমার্থক শব্দ ইংরেজিতে নেই, সম্ভবত কোনো ভাষায়ই নেই। 'দহন করা আগুনের ধর্ম'_এই কথাটির যদি ইংরেজি করা যায় 'বার্নিং ইজ দ্য রিলিজিয়ন অব ফায়ার', তাহলে নিতান্তই হাস্যকর শোনাবে না কি?
আবার ইংরেজি 'রিলিজিয়ন' শব্দটিকেও যখন বাংলায় লেখা হয় 'ধর্ম', তখন নতুন বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। এই বিভ্রান্তি দূর করার জন্য ঠিক কোন শব্দটি ব্যবহার করা যায়, তাও আমরা এযাবৎকাল জানতে বা বুঝতে পারিনি।
আসলে 'রিলিজিয়ন'বোধক জুতসই কোনো বাংলা শব্দ আছে কি? আমরা জানি না।
রিলিজিয়ন তো বিশেষ বিশেষ বিশ্বাসের ধারক, যেসব বিশ্বাস কোনোমতেই যুক্তি দিয়ে প্রতিষ্ঠা করা যায় না। এসব বিশ্বাসকে অবলম্বন করেই পৃথক পৃথক রিলিজিয়ন তৈরি হয় এবং বিভিন্ন রিলিজিয়ন অনুসারীদের পৃথক সম্প্রদায় গড়ে ওঠে। যেমন_হিন্দু মুসলিম বৌদ্ধ খ্রিস্টান ইত্যাদি। রিলিজিয়নগুলো ইহলোকের মঙ্গলামঙ্গলের কথা বললেও সব রিলিজিয়নেরই নির্ভরতা মূলত পরলোক-বিশ্বাসের ওপর। সেসব বিশ্বাস-অনুযায়ী যেমন আচার পালন ও নিষেধবিধি মান্য করতে হয়, সেগুলোতেও একটি রিলিজিয়নের সঙ্গে আরেকটি রিলিজিয়নের ঐক্য নেই, কখনো কখনো বৈপরীত্যও দেখা যায়। প্রত্যেক রিলিজিয়ন অনুসারী মানুষই আপন আপন সম্প্রদায়ের বিশ্বাস ও আচার-অনুষ্ঠানকে সঠিক ও সত্য বলে প্রচার করে এবং অন্যান্য সম্প্রদায়ের রিলিজিয়নকে বলে বেঠিক ও অসত্য। কখনো কখনো এমনও বলে যে সেসব রিলিজয়ন অনুসরণকারী মানুষরা পরলোকে সদ্গতি লাভ করতে পারবে না।
কিন্তু মানুষের যা প্রকৃত 'ধর্ম', তার সঙ্গে রিলিজিয়নের কোনো অপরিহার্য সম্পর্ক আছে কি? মনে তো হয় না। মানুষের ধর্ম তো মনুষ্যত্ব। কোনো মানুষ কোনো রিলিজিয়ন মানুক বা না মানুক কিংবা পরলোকে বিশ্বাস করুক বা না করুক_তাতে কিছুই যায়-আসে না। সত্য কথা বলা, সত্য পথে চলা, মানুষের কল্যাণসাধনে সতত সচেষ্ট থাকা এবং এ রকম নানা নৈতিক বিধানই মনুষ্যত্ব বা মানুষের ধর্ম। মানুষের এই ধর্ম ও রিলিজিয়ন কোনোমতেই এক নয়। তাই 'মানুষের ধর্ম' কথাটির অনুবাদে 'রিলিজিয়ন অব ম্যান' লেখাও সঠিক হয় না। অথচ ইংরেজিতে 'মানুষের ধর্ম' বোঝানোর মতো কোনো শব্দ বা শব্দগুচ্ছও খুঁজে পাওয়া যায় না। বিপদ বটে! এ রকম বিপদে স্বয়ং কবিগুরু রবীন্দ্রনাথকেও পড়তে হয়েছিল। তিনিও 'ধর্ম' আর 'রিলিজিয়ন'কে অভিন্ন মনে করতে পারেননি, কিন্তু 'রিলিজিয়ন' শব্দের কোনো বাংলা প্রতিশব্দও যে নেই, তাও তাঁর অজানা ছিল না। তাই তিনি একসময় 'রিলিজিয়ন'-এর প্রতিশব্দরূপে 'ধর্মতন্ত্র' শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। তবে যেকোনো কারণেই হোক, বাংলায় সে শব্দটির বহুল প্রচলন ঘটেনি।
এবার বলতে হয় 'রাষ্ট্র' সম্পর্কে। রিলিজিয়নের বিপরীতে রাষ্ট্রের কাজ ইহলোককে নিয়ে। তাহলে কি রাষ্ট্রের কোনো ধর্ম নেই? আমরা যেহেতু বলেছি যে সব কিছুরই ধর্ম আছে, সে কারণেই 'রাষ্ট্রের ধর্ম কী'_এ প্রশ্ন তো উঠবেই।
প্রশ্নের উত্তরে বলি, ইহলৌকিকতাই রাষ্ট্রের ধর্ম। এই ধর্ম থেকে বিচ্যুত হলে কোনো রাষ্ট্রই আর রাষ্ট্র থাকে না। রাষ্ট্রকে তার নাগরিকদের ইহলোকের কল্যাণের ওপরই নজর রাখতে হয়।
রাষ্ট্র কখনো কারো পরলোকের সদ্গতির বিধান দিতে পারে না।
অর্থাৎ রাষ্ট্রের কোনো 'রিলিজিয়ন' নেই, তবে তার 'ধর্ম' থাকতেই হবে। এই অর্থে কোনো রাষ্ট্রই 'ধর্মনিরপেক্ষ' হতে পারে না। তাই 'সেক্যুলারিজম'-এর প্রতিশব্দরূপে 'ধর্মনিরপেক্ষতা'ও একান্তই বিভ্রান্তিকর।
এই বিভ্রান্তিরই সুযোগ নেয় মতলববাজরা। তারা সরলমতি ও ধর্মপ্রাণ জনসাধারণকে প্রতিনিয়তই উসকাতে থাকে, যারা 'ধর্মনিরপেক্ষতা'কে সংবিধানের অন্যতম মূলনীতি বলে বিধিবদ্ধ করেছিল, তাদের বিরুদ্ধে গণ-অসন্তোষ ছড়াতে থাকে, ধর্মান্ধতার বিস্তার ঘটিয়ে রাষ্ট্রকে তার আপন ধর্ম থেকে বিচ্যুত করার পথ খুঁজতে থাকে। এ রকম করে মতলববাজরা কামিয়াবও হয়ে পড়ে। স্বাধীন রাষ্ট্ররূপে বাংলাদেশের চার বছর অতিক্রান্ত হওয়ার আগেই এখানে তারা পাকিস্তানের মতোই সামরিক শাসন নিয়ে আসে। সামরিক শাসকরা সংবিধানকে কাটাকুটি করে একে পাকিস্তানিকরণের দিকে এগিয়ে নেয়, বাংলাদেশের নাগরিকদের 'বাংলাদেশি জাতি' নামে অভিহিত করে তাদের মাথায় এক অদ্ভুত জাতীয়তাবাদ চাপিয়ে দেয়, 'ধর্মনিরপেক্ষতা'কেই লোপাট করে দেয় এবং সমাজতন্দ্র পঙ্গু করে ফেলে।
অর্থাৎ পাকিস্তানের ভূত বাংলাদেশের ঘাড়ে চেপে বসে। এক সামরিক শাসক সেই ভূতের প্ররোচনায় বাংলাদেশের সংবিধানের মাথায় বিশিষ্ট রিলিজিয়ন বা ধর্মতন্ত্র ইসলামের একটি বাণী লিখে দেয়, আরেক সামরিক শাসক এসে ইসলামকেই করে ফেলে 'রাষ্ট্রধর্ম'। এভাবেই এই কুচক্রীরা বাংলাদেশে ধর্মতন্ত্রী সাম্প্রদায়িকতার আমদানি ঘটিয়ে রাষ্ট্রটির চরিত্রকে পুরোপুরি বদলে দেয়, সাম্প্রদায়িক পাকিস্তানের সঙ্গে তার আর কোনো পার্থক্যই খুঁজে পাওয়া যায় না। বিশেষ করে অমুসলিম সম্প্রদায় ও আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অন্তর্গত মানুষগুলো পাকিস্তানের মতো বাংলাদেশেও হয়ে পড়ল দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক। আর সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য পরিবর্তন করার ফলে 'গণতন্ত্র'ও এখন হাস্যকরে পর্যবসিত হয়ে গেছে। যে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ সশস্ত্র মুক্তিসংগ্রামের কালে সপ্তম নৌবহর পাঠিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে বঙ্গোপসাগরে ডুবিয়ে দেওয়ার পাঁয়তারা করেছিল, সেই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের (যেমন_আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংক) কাছে স্বাধীন বাংলাদেশের সব শাসকগোষ্ঠীই আত্মসমর্পণ করেছে। অর্থাৎ অনেক চড়া দাম দিয়ে কেনা স্বাধীন বাংলাদেশের মালিকানা ছিনতাই হয়ে গেছে। সেই মালিকানাকে ফিরিয়ে আনতেই হবে।

লেখক : শিক্ষাবিদ

No comments

Powered by Blogger.