শীত আসে পাতা ঝরে by হাসনাত আবদুল হাই

তু হিসেবে, দেশে-বিদেশে, শীত বেশ অনাদৃত, উপেক্ষিত যদিও নয়। শীত মানুষকে ঘরমুখো করে, উষ্ণতার আকর্ষণে, হাড় কাঁপুনি থেকে রক্ষা পেতে। যে ঋতু মানুষকে ঘরের বাইরে থাকতে দেয় না তাকে নির্দয়, নিষ্ঠুরই মনে হয়েছে সাধারণ মানুষের কাছে। এখনও, সভ্যতার এত অগ্রগতি আর প্রযুক্তির ব্যবহারে প্রাকৃতিক অন্তরায়গুলিকে অতিক্রম করার কৌশল আয়ত্তে আসার পরও, শীতের দাপটে সন্ত্রস্ত হয় মানুষ, আত্মরক্ষার আয়োজনে অনেক সময় ব্যয় করে সকাল-সন্ধ্যা।


আর শীতের রাতের মতো সাধারণ মানুষের জন্য এত ভয়ের আর কোনো ঋতু নেই ক্যালেন্ডারে। অর্থবিত্ত দিয়ে সেই ভয় কাটিয়ে উঠতে পারে সৌভাগ্যবান যারা কিন্তু দরিদ্রজনের জন্য শীত এখনও নিদারুণ কষ্টের, অপরিসীম ভয়ের কারণ। বাংলাদেশের মতো দেশের উত্তরে শীতে জমে প্রাণ হারাতে হয় অসহায় মানুষকে প্রতি বছর। ধনী দেশেও এমন ঘটনা বিরল নয়। বরফপাতে জনজীবন বিপর্যস্ত হয় প্রায়ই যেখানে ধনী-দরিদ্রের তারতম্য থাকে না।
শীত এলে মানুষের অশান্তি বাড়ে, কমবেশি সবারই। অসুখী হওয়া কিংবা অসন্তুষ্টি প্রকাশের জন্য শেক্সপিয়র তাই ব্যবহার করেছেন 'উইন্টার অব আওয়ার ডিসকন্টেন্ট' কথাটি। তিনি বলতে চেয়েছেন মানুষের অশান্তি সব সময়ই কিছু না কিছু থাকে কিন্তু শীতকালে যেন তার তীব্রতা বৃদ্ধি পায়। তিনি যখন 'ব্লো ব্লো দাউ উইন্টার উইন্ড' বলে আহ্বান করেন, তখন স্পষ্ট করেই জানান যে শীতের বাতাস মানুষের অকৃতজ্ঞতার মতো অসহনীয় নয় আর সেই কথাতেও সুপ্ত থাকে শীতের বৈরী স্বভাবের বিষয়টি। শেক্সপিয়ারের মতো পাশ্চাত্যের প্রায় সব কবি-শিল্পীই শীতের উল্লেখে অনুদার, এমনকি সহানুভূতিহীন।
বাংলার কবি রবীন্দ্রনাথ প্রতিটি ঋতু নিয়ে কবিতা আর গান লিখেছেন। বর্ষার ওপর লেখা তাঁর গানের সংখ্যা দেড়শর মতো। বসন্তও খুব কাছাকাছি_ একশ' দশ কি পনেরো হবে। শরৎ পিছিয়ে আছে তেত্রিশটি গান নিয়ে। কিন্তু শীত একেবারেই নিচে, মাত্র বারোটি গান। কী করবেন কবি? যে ঋতু সকলের জন্য আনন্দের না, তাকে নিয়ে অনেক গান গাওয়ার সুযোগ কোথায়? জোর করে গাইতে গেলে তাতে প্রাণের স্পর্শ থাকে না। যতটুকু ভালো লাগবে তার চেয়ে বেশি ভালোবাসতে গেলে ভুল বোঝাবুঝির অবকাশ এসে যায়। তবে রবীন্দ্রনাথ শীতকে দেখেছেন দার্শনিকের দৃষ্টিতে, বলতে চেয়েছেন তার তিক্ততার মধ্যেই রয়েছে এক ধরনের সৌন্দর্য, যা তিনি খুঁজে পান, ব্যাখ্যা করেছেন এই ভাবে : শীতের হাওয়ার লাগল নাচন আমলকীর ঐ ডালে ডালে/পাতাগুলি শিরশিরিয়ে ঝরিয়ে দিল তালে তালে।' এভাবে পাতা ঝরিয়ে গাছটার কী উপকার করা হলো? হ্যাঁ, করা হলো বৈকি, কেননা 'উড়িয়ে দেওয়ার মাতন এসে কাঙাল তারে করলো শেষে/তখন তাহার ফলের বাহার রইলো না আর অন্তরালে।' পাতা ঝরিয়ে মিষ্টি ফল দৃশ্যমান করে যে শীত কবির কাছে তার মূল্য আছে, পত্র পল্লবহীন গাছ যতই করুণ দেখাক না কেন। তিনি উদারমনস্ক হয়ে তারপর বলেন : 'শূন্য করে ভরে দেওয়া যাহার খেলা/তারি লাগি রইনু বসে সকাল বেলা।' কৃপণ শীতকেও তিনি এই যুক্তিতে আদরে গ্রহণ করেন। অবশ্য শীতকে এইভাবে ভালোবাসার জন্য কবির মন থাকতে হয়, যা অনেকের নেই। কবি তা জানেন, তাই ডাক দিয়ে বলেন : পৌষ তোদের ডাক দিয়েছে, আয়রে ছুটে, আয় আয় আয় ডালা যে ভরেছে পাকা ফসলে, মরি হায় হায় হায়।' ফসল বেড়ে উঠেছে বর্ষায়, শরতে, অথবা হেমন্তে কিন্তু তার পাকা রূপ তো শীতের সময়ই দেখা গেল। এই ফসলের জন্য কোনো কৃতিত্ব শীতের নেই কিন্তু আলোয় হাসি যে জেগে উঠলো সে তো ধানের শীষে শিশির লাগার জন্যই। কবি এভাবে বারবার বাংলার গ্রামে যারা থাকে এবং শীতে কষ্ট পায় তাদের কাছে শীতের রিক্ততার ভেতর, সুন্দরের দিকটা তুলে ধরেছেন। রোদের সোনা যখন ছড়িয়ে পড়েছে মাটির আঁচলে, মাঠের বাঁশি শুনে আকাশ খুশি হয়ে উঠেছে, তখন ঘরে কে থাকতে পারে? কবি সবাইকে ডাক দিয়ে বলেছেন : খোলো খোলো দুয়ার খোলো। খুব সহজে না, বেশ বুঝিয়ে-সুজিয়ে শীতের ভয় কাটিয়ে ওঠাবার জন্য চেষ্টা করতে হয়েছে কবিকে।
অনেকের জন্য শীত কষ্টের, শীতের প্রকৃতি রিক্ততায় শীর্ণতায় করুণ। কিন্তু দেখতে যেমনই হোক নিষ্করুণ, জরাজীর্ণ, শীত শূন্য হাতে আসে না। পাতা ঝরে যায়, কিন্তু ফল বেরিয়ে আসে। মাঠে ফসল হেসে ওঠে। শুকনো পথ-ঘাট দিয়ে পায়ে হেঁটেই চলাচল করা যায় তখন। গ্রাম-বাংলায় বেড়ানোর সময়ই হলো শীত। কাদায় পা ডোবে না, বৃষ্টিতে গা ভেজে না এই ঋতুতে। খুব স্বস্তির সঙ্গে অতি সহজে বেড়িয়ে আসা যায় দূরের আত্মীয়বাড়ি। শরীরে একটা উত্তরীয় থাকলেই হলো, হোক না সেটা খদ্দরের আর পুরনো।
শীতের মৌসুমেই তো তৈরি হয় নানা রকমের পিঠা, ফসল ঘরে তোলার পর। পিঠা তৈরির কারুকাজ শিল্পে পরিণত হয় মেয়েদের উৎসাহী হাতের খেলায়। বাংলাদেশের গ্রামে মাঝে মধ্যেই কোনো না কোনো উৎসব লেগে আছে কিন্তু শীতে তার সংখ্যা যত, তেমন আর কোনো ঋতুতে নয়। শীত কষ্ট দেয় সাধারণ মানুষকে, সন্ধ্যার পর কাঁপায়। কিন্তু সে আনন্দ দেয় বেড়ানোর সুযোগ করে দিয়ে, পিঠার স্বাদ রসনায় এনে, উৎসবের আয়োজনে_ যার জন্য শীতকে শেষ পর্যন্ত ভালো না বেসে পারা যায় না। রবীন্দ্রনাথ শীতের এই উপহারগুলো উপলব্ধি করে লিখেছেন : 'তোমার সকল ভূষণ ঢাকা আছে, নাই যে অগোচর হা হা।' শীতের বৈধব্য তার রিক্ততা আর শূন্য হাতে আসার যে ভান তা কবির চোখ এড়ায় না। তিনি বলেন : 'একি মায়া, লুকাও কায়া জীর্ণ শীতের মাঝে।'
তার ভাবতে ভালো লেগেছে যে শীতের প্রচ্ছন্ন সৌন্দর্য শেষ পর্যন্ত সবার চোখে পড়বে, আর তাই তিনি উল্লাসের সঙ্গে বলেন, 'আসলে সবার পড়ল ধরা, তুমি যে ভাই, আমাদেরই।' রবীন্দ্রনাথ শীতকে প্রিয় করে দেখাবার জন্য কয়েকটি কবিতাতেই যা লিখেছেন আর কোনো দেশের কবি তেমনভাবে পারেননি। শেক্সপিয়র যেমন অতৃপ্তি আর অসন্তুষ্টির তীব্রতা বোঝানোর জন্য 'উইন্টার অব ডিসকন্টেন্ট' ব্যবহার করেছেন তেমন অনুদার হৃদয় তার ছিল না। ষড়ঋতু ছিল তার কাছে ছয় বোনের মতো। কেউ অনাদৃত হবার মতো নয়। যদিও দুর্বলতা থাকে কারও প্রতি বেশি।
শীত বদলে গিয়েছে বাংলাদেশে। আমাদের এবং পরবর্তী প্রজন্মের কাছে শীতের যে রূপ ছিল তা অক্ষুণ্ন নেই এখন। সে আসে দেরিতে, এসেই যাই যাই করে। দিনক্ষণ দিয়ে তাকে এখন আর বেঁধে রাখা যাচ্ছে না। কুয়াশা হয় আগের মতো, কিন্তু সেখানে মিশে থাকে ধুলো-বালি। পরিবেশের দূষণ প্রক্রিয়ায় শীত আড়ষ্ট। আগের মতো শীত একনাগাড়ে দুই মাসের কিংবা আরও বেশি সময়ের জন্য হয় না। শীত আসে কিস্তিতে কিস্তিতে, উত্তুরে হাওয়ার সঙ্গে চুক্তি করে। সূর্যের তাপের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই যেন। শীতের সূর্য উঠলেই শীত ফরাসি ছুটি নিয়ে চলে যায়। আবার উত্তর থেকে হাওয়া এলে তার হাত ধরে চলে আসে। আগে শীত এমন উত্তুরে হাওয়ানির্ভর ছিল না। সূর্যের তাপই ঠিক করে দিত কখন সে আসবে, কতদিন থাকবে। এখন সেটা নেই।
শীতের সকালে রোদে দাঁড়িয়ে বই পড়া, এমনকি নাশতা খাওয়ার দিন এখন শেষ। এত রকমের গরম কাপড় পাওয়া যায় এখন, এত কম দামে যে গরিব যারা তারাও সকালে একটা কিছু পরে যার যার কাজে বেরিয়ে পড়ে। রোদে দাঁড়িয়ে তাপ নিতে হয় না আয়েশ করে অনেকক্ষণ দিনের কাজ শুরু করার আগে। পুকুরের ঘাটলার সামনে দাঁড়িয়ে হি হি করে কাঁপতে কাঁপতে হঠাৎ চোখ বুজে হিমশীতল পুকুরে গিয়ে এক লাফে ডুবও দিতে হয় না অনেককে। কলের পানি আছে, অনেকের পক্ষে পানি গরম করে নেওয়াও সম্ভব এখন। ফলে শীতের সকালে প্রায় জমে যাওয়া পুকুরে ডুব দিয়ে হি হি করে কাঁপতে কাঁপতে উঠে আসার দিনও প্রায় শেষ অনেকের জন্য। আমাদের ছেলেবেলার সেই স্মৃতি শিহরণের, আনন্দের। শীতকে যেভাবে 'আলিঙ্গন' করেছি আমরা আর কোনো ঋতুকে নয়।
তবে এখনকার শীতে এমন একটা দৃশ্য দেখতে পাই, যা ছোটবেলায়, যৌবনে দেখিনি। কতো কতো পরিযায়ী পাখি আসে। তারা আসে শীতের হাত থেকে রক্ষা পেতে, পালিয়ে। খুব বেরসিক বলা যাবে না তাই বলে, কেননা তারা আমাদের শীতকে ভালোবেসেই আসে। বরফের মধ্যে বাস করে যে এস্কিমোরা তারা শীতের দেশ ছেড়ে অন্য কোথাও যায়নি। কখনও যাবে না। তাদের কথা মনে করেই তো আমরা 'ইগলু' নামের আইসক্রিম খাই। শীতকে বাইরে বাইরে যতই অপছন্দ করি, তার জন্য আমাদের বেশ দুর্বলতা রয়েছে। রবীন্দ্রনাথ সেই দুর্বলতা আরও জাগিয়ে দিয়ে গিয়েছেন। হ

No comments

Powered by Blogger.