খালেদ হোসাইনের পাতাদের সংসার by আরিফ ওবায়দুল্লাহ
পাতাদের আবার সংসার হয় নাকি?'_পড়ার টেবিল থেকে বইটি হাতে নিয়ে এমনই প্রশ্ন ছিল কবিতা-অবুঝ এক বন্ধুপ্রতিমের। বললাম, পাতা কেমন?_হতে পারে সবুজ, স্নিগ্ধ, হতে পারে জীর্ণ। এটা তো বৃক্ষই ধারণ করে; সময় শেষে ঝরে যায়, খসে পড়ে কিংবা ঝরানো হয়। ধরো এই বৃক্ষটাই পৃথিবী আর তুমি পাতা। এইবারে বলো তোমার কি সংসার নেই? তুমি কি ঝরবে না? দেখ, কবিরা কিভাবে পাতা দিয়ে সংসার গড়েন! অবাক বন্ধু, বই হাতে ধীরে ধীরে উল্টাতে লাগল পাতা।
কথা বলছিলাম কবি খালেদ হোসাইনের (জন্ম-১৯৬৪) 'পাতাদের সংসার' কাব্যগ্রন্থ প্রসঙ্গে। ২০০৭-এর বইমেলায় কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। এর আগে কবির 'ইলামিত্র ও অন্যান্য কবিতা' (২০০০), 'শিকার-যাত্রার আয়োজন' (২০০৫) ও 'জলছবির ক্যানভাস' (২০০৬), 'এক দুপুরের ঢেউ' (২০০৮), 'পায়ের তলায় এসে দাঁড়িয়ে' (২০০৯), 'চিরকাল আমি এখানে ছিলাম' (২৯১০) কাব্যগ্রন্থগুলো আমরা হাতে পাই।
বিষয় ও আঙ্গিক বিবেচনায় 'পাতাদের সংসার' আগের গ্রন্থগুলো থেকে ভিন্নমাত্রার, অনন্য সুরের। প্রকৃতির সঙ্গে সহবাস করে কবির নিরীক্ষা চলেছে সনেটের ছন্দ-কাঠামো নিয়ে। উপমা ও চিত্রকল্পের বিবিধ বুননে কবিতা-পঙ্ক্তিগুলো পেয়েছে নানা মাত্রা। আবার কখনো কখনো অপ্রচলিত এবং আঞ্চলিক শব্দ প্রয়োগে কবি ভিন্ন একটা আবহ সৃষ্টির প্রয়াসী। প্রকৃতিকে অবলম্বন করে লেখা হলেও কাব্যগ্রন্থটিতে মূলত সমকালীন সমাজমনস্কতা, প্রেমচেতনা, বিচিত্র বেদনাবোধ ও হাহাকারের চিত্র মূর্ত হয়ে উঠেছে।
আটচলি্লশটি কবিতা নিয়ে 'পাতাদের সংসার'-এর প্রতিটি কবিতাই চৌদ্দ পঙ্ক্তির। সনেটের আদল তবে কবির সচেতন প্রয়াস-প্রোথিত। কখনো মাত্রাবৃত্ত, কখনো অক্ষরবৃত্ত আবার কখনো প্রবহমান মুক্তকে কবি পথ চলেছেন। গ্রন্থের নাম-কবিতা 'পাতাদের সংসার'-এ সনেটের চরণান্তিক মিল বিন্যাস রক্ষিত হয়েছে : পাতাদের সংসারে উড়ে আসে ফাগুনের নদী/ পাতাদের সংসারে নীরবতা জুড়ে দেয় নাচ অনেক বিরহ-কাল পার হয়, একবার যদি/ সোনালি অগি্নকণা ছুড়ে দেয় জীবনের আঁচ। ['পাতাদের সংসার']
'পাতাদের সংসার'-এ উপমার নান্দনিক প্রয়োগ পাঠকের দৃষ্টি এড়ায় না। 'রাধার চোখের মতো জলদিঘি চুম্বনে অস্থির', 'পুরানো থামের মতো ধসে পড়ে মানুষের মন', 'বিষের বড়ির মতো গিলে খাব পাপ', 'ভরা কলসের মতো অতিরিক্ত ঠাণ্ডা ও চুপচাপ' কিংবা 'এখনও পিয়াল ফল ঘাসের স্তনের মতো কাঁদে' এমন অনেক উপমার প্রয়োগ নিঃসন্দেহে গ্রন্থের কবিতাগুলোকে ঋদ্ধ করেছে। 'কড়িকাঠ' কবিতায় একসঙ্গে একাধিক উপমার উপস্থিতি লক্ষ করার মতো : জাহাজের ডেকে খালি বোতলের মতো গড়াগড়ি/ খেতে খেতে জ্বলে-পুড়ে ছাই হয়ে গেছ। ['কড়িকাঠ']
শুধু উপমাই নয়, পাশাপাশি অসাধারণ চিত্রকল্পের ব্যবহার কবির কবিতায় আমরা পাই। কবিতায় কম প্রচলিত শব্দাবলি দিয়ে চিত্রকল্পের যে গাম্ভীর্যপূর্ণ বুনন তিনি এঁটেছেন, পাঠককে তা উপলব্ধি করতে হয় অদ্ভুত অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে : আমি আর বালিশের জরায়ুতে ডানাছাঁটা তুলো/ নই, সাবানের পিচ্ছিলতা নই, অন্ধ ঘেঁটুবনে/ পিতলের আংটি নই। ['সীমান্তেও সুখ নেই']
কবিতায় অপ্রচলিত ও আঞ্চলিক কিছু শব্দ ব্যবহার করে কবি খালেদ হোসাইন তাঁর কবিতায় একটা স্বতন্ত্র ভুবন নির্মাণে প্রয়াসী। 'সার বাঁধা', 'চাতাল', 'জালালি কৈতর', 'অন্ধ ঘেঁটুবন'_এমন আঞ্চলিক শব্দ কিংবা 'রাত্রির চোয়াল', 'হাড়-হাভাতের', 'নাভিকেন্দ', 'ডানাছাঁটা তুলো' প্রভৃতি শব্দের নতুনরূপে প্রয়োগ কবিতাগুলোতে এনেছে ভিন্নমাত্রা এবং নিঃসন্দেহে বলা যায় তা কবির স্বতন্ত্র ভুবন নির্মাণ-প্রচেষ্টারই পরিচায়ক।
খালেদ হোসাইনের কবিতায় মিথের প্রয়োগ কম। যে দু-এক জায়গায় মিথের উপস্থিতি আছে তাতে কবির সচেতন প্রয়োগভঙ্গির প্রকাশ ঘটেছে। যেমন_'রূপকথা' কবিতার কথা বলা যায়। জায়সির 'পদুমাবৎ' কিংবা আলাওলের 'পদ্মাবতী'র 'হীরামন' পাখি এ কবিতায় ভিন্নমাত্রা নিয়ে আবির্ভূত হয়েছে : মর্মান্তিক জলগন্ধ নিয়ে/ শব্দ থেকে ঝরে পড়ে অর্থের সমস্ত দায়ভার/ রূপার গাছের ডালে 'হীরামন' দেখে তা তাকিয়ে। [রূপকথা']
বাঙালির স্বর্ণালি দিনগুলো যেন কেবলই স্মৃতি। যে ঐতিহ্য আর ঐশ্বর্য এতকাল বাঙালি লালন করেছে তা আজ লুপ্ত অতীত। আর তাই ঐতিহ্য হারিয়ে কবি বেদনাবিদ্ধ : চরণে রুপার মল পাটের সৌরভে যেন নাচে/ দু-সিদ্ধ ধানের সোনা পায়ে পায়ে গেয়ে উঠত গান/ সেইসব রূপকথা_ঝলসে গেছে আগুনের আঁচে।
খালেদ হোসাইন আধুনিক প্রাগ্রসর এবং রোমান্টিক। আধুনিক কথকের মতো প্রেমিকার প্রতি অসামান্য আবেদন তাঁর কবিতায় লক্ষ করার মতো। কোথাও যেন প্রেমিকা-হারানোর বেদনায় তিনি বিদ্ধ নন। বরং নিদ্রামগ্ন কবিকে রমণীয় সুখ নিয়ে জাগিয়েছে অস্থির প্রণয়িনী। সে জন্যই কবি বলছেন : আমাকে জাগালে কেন অস্থিরতা, তীর ছুড়ে ছুড়ে?/ শীত-ঘুমে মগ্ন আমি ছিলাম স্বপ্নের জটাজালে/ বাস্তবের মোহমুক্ত যেন এক নিদ্রিত প্রান্তর/ যে ভুলেছে জীবনের অলিগলি চাহিদা ও তাপ। ['আমাকে জাগালে কেন, অস্থিরতা?]
সবশেষে বলা যায় 'পাতাদের সংসার' পাঠে অনুভূত হয় লোভ জাগানিয়া সুখ। পাঠক আকৃষ্ট হন বারবার পাঠ নিতে। কবি খালেদ হোসাইন যে দীপ্তি ও ঔজ্বল্য নিয়ে আবির্ভূত হয়েছেন তা শেষ অবধি থাকুক পাঠকের প্রত্যাশা এ-ই।
বিষয় ও আঙ্গিক বিবেচনায় 'পাতাদের সংসার' আগের গ্রন্থগুলো থেকে ভিন্নমাত্রার, অনন্য সুরের। প্রকৃতির সঙ্গে সহবাস করে কবির নিরীক্ষা চলেছে সনেটের ছন্দ-কাঠামো নিয়ে। উপমা ও চিত্রকল্পের বিবিধ বুননে কবিতা-পঙ্ক্তিগুলো পেয়েছে নানা মাত্রা। আবার কখনো কখনো অপ্রচলিত এবং আঞ্চলিক শব্দ প্রয়োগে কবি ভিন্ন একটা আবহ সৃষ্টির প্রয়াসী। প্রকৃতিকে অবলম্বন করে লেখা হলেও কাব্যগ্রন্থটিতে মূলত সমকালীন সমাজমনস্কতা, প্রেমচেতনা, বিচিত্র বেদনাবোধ ও হাহাকারের চিত্র মূর্ত হয়ে উঠেছে।
আটচলি্লশটি কবিতা নিয়ে 'পাতাদের সংসার'-এর প্রতিটি কবিতাই চৌদ্দ পঙ্ক্তির। সনেটের আদল তবে কবির সচেতন প্রয়াস-প্রোথিত। কখনো মাত্রাবৃত্ত, কখনো অক্ষরবৃত্ত আবার কখনো প্রবহমান মুক্তকে কবি পথ চলেছেন। গ্রন্থের নাম-কবিতা 'পাতাদের সংসার'-এ সনেটের চরণান্তিক মিল বিন্যাস রক্ষিত হয়েছে : পাতাদের সংসারে উড়ে আসে ফাগুনের নদী/ পাতাদের সংসারে নীরবতা জুড়ে দেয় নাচ অনেক বিরহ-কাল পার হয়, একবার যদি/ সোনালি অগি্নকণা ছুড়ে দেয় জীবনের আঁচ। ['পাতাদের সংসার']
'পাতাদের সংসার'-এ উপমার নান্দনিক প্রয়োগ পাঠকের দৃষ্টি এড়ায় না। 'রাধার চোখের মতো জলদিঘি চুম্বনে অস্থির', 'পুরানো থামের মতো ধসে পড়ে মানুষের মন', 'বিষের বড়ির মতো গিলে খাব পাপ', 'ভরা কলসের মতো অতিরিক্ত ঠাণ্ডা ও চুপচাপ' কিংবা 'এখনও পিয়াল ফল ঘাসের স্তনের মতো কাঁদে' এমন অনেক উপমার প্রয়োগ নিঃসন্দেহে গ্রন্থের কবিতাগুলোকে ঋদ্ধ করেছে। 'কড়িকাঠ' কবিতায় একসঙ্গে একাধিক উপমার উপস্থিতি লক্ষ করার মতো : জাহাজের ডেকে খালি বোতলের মতো গড়াগড়ি/ খেতে খেতে জ্বলে-পুড়ে ছাই হয়ে গেছ। ['কড়িকাঠ']
শুধু উপমাই নয়, পাশাপাশি অসাধারণ চিত্রকল্পের ব্যবহার কবির কবিতায় আমরা পাই। কবিতায় কম প্রচলিত শব্দাবলি দিয়ে চিত্রকল্পের যে গাম্ভীর্যপূর্ণ বুনন তিনি এঁটেছেন, পাঠককে তা উপলব্ধি করতে হয় অদ্ভুত অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে : আমি আর বালিশের জরায়ুতে ডানাছাঁটা তুলো/ নই, সাবানের পিচ্ছিলতা নই, অন্ধ ঘেঁটুবনে/ পিতলের আংটি নই। ['সীমান্তেও সুখ নেই']
কবিতায় অপ্রচলিত ও আঞ্চলিক কিছু শব্দ ব্যবহার করে কবি খালেদ হোসাইন তাঁর কবিতায় একটা স্বতন্ত্র ভুবন নির্মাণে প্রয়াসী। 'সার বাঁধা', 'চাতাল', 'জালালি কৈতর', 'অন্ধ ঘেঁটুবন'_এমন আঞ্চলিক শব্দ কিংবা 'রাত্রির চোয়াল', 'হাড়-হাভাতের', 'নাভিকেন্দ', 'ডানাছাঁটা তুলো' প্রভৃতি শব্দের নতুনরূপে প্রয়োগ কবিতাগুলোতে এনেছে ভিন্নমাত্রা এবং নিঃসন্দেহে বলা যায় তা কবির স্বতন্ত্র ভুবন নির্মাণ-প্রচেষ্টারই পরিচায়ক।
খালেদ হোসাইনের কবিতায় মিথের প্রয়োগ কম। যে দু-এক জায়গায় মিথের উপস্থিতি আছে তাতে কবির সচেতন প্রয়োগভঙ্গির প্রকাশ ঘটেছে। যেমন_'রূপকথা' কবিতার কথা বলা যায়। জায়সির 'পদুমাবৎ' কিংবা আলাওলের 'পদ্মাবতী'র 'হীরামন' পাখি এ কবিতায় ভিন্নমাত্রা নিয়ে আবির্ভূত হয়েছে : মর্মান্তিক জলগন্ধ নিয়ে/ শব্দ থেকে ঝরে পড়ে অর্থের সমস্ত দায়ভার/ রূপার গাছের ডালে 'হীরামন' দেখে তা তাকিয়ে। [রূপকথা']
বাঙালির স্বর্ণালি দিনগুলো যেন কেবলই স্মৃতি। যে ঐতিহ্য আর ঐশ্বর্য এতকাল বাঙালি লালন করেছে তা আজ লুপ্ত অতীত। আর তাই ঐতিহ্য হারিয়ে কবি বেদনাবিদ্ধ : চরণে রুপার মল পাটের সৌরভে যেন নাচে/ দু-সিদ্ধ ধানের সোনা পায়ে পায়ে গেয়ে উঠত গান/ সেইসব রূপকথা_ঝলসে গেছে আগুনের আঁচে।
খালেদ হোসাইন আধুনিক প্রাগ্রসর এবং রোমান্টিক। আধুনিক কথকের মতো প্রেমিকার প্রতি অসামান্য আবেদন তাঁর কবিতায় লক্ষ করার মতো। কোথাও যেন প্রেমিকা-হারানোর বেদনায় তিনি বিদ্ধ নন। বরং নিদ্রামগ্ন কবিকে রমণীয় সুখ নিয়ে জাগিয়েছে অস্থির প্রণয়িনী। সে জন্যই কবি বলছেন : আমাকে জাগালে কেন অস্থিরতা, তীর ছুড়ে ছুড়ে?/ শীত-ঘুমে মগ্ন আমি ছিলাম স্বপ্নের জটাজালে/ বাস্তবের মোহমুক্ত যেন এক নিদ্রিত প্রান্তর/ যে ভুলেছে জীবনের অলিগলি চাহিদা ও তাপ। ['আমাকে জাগালে কেন, অস্থিরতা?]
সবশেষে বলা যায় 'পাতাদের সংসার' পাঠে অনুভূত হয় লোভ জাগানিয়া সুখ। পাঠক আকৃষ্ট হন বারবার পাঠ নিতে। কবি খালেদ হোসাইন যে দীপ্তি ও ঔজ্বল্য নিয়ে আবির্ভূত হয়েছেন তা শেষ অবধি থাকুক পাঠকের প্রত্যাশা এ-ই।
No comments