জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়-প্রক্টরের বিরুদ্ধে শিক্ষক সমিতির সভাপতিকে লাঞ্ছনার অভিযোগ

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ কর্মীদের মারধরে ইংরেজি বিভাগের ছাত্র জুবায়ের আহমেদের মৃত্যুর ঘটনায় এখনো উত্তপ্ত ক্যাম্পাস। গতকাল বৃহস্পতিবার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আরজু মিয়া শিক্ষক সমিতির সভাপতি এ এ মামুনকে লাঞ্ছিত করেছেন বলে অভিযোগ করেছেন কয়েকজন শিক্ষক। এ ঘটনাসহ জুবায়েরের মৃত্যুর ঘটনায় প্রক্টর ও প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যদের বিচার না করা পর্যন্ত ক্লাস বর্জনসহ আন্দোলনের ঘোষণা দিয়েছে ‘শিক্ষক সমাজ’।


ঘটনার নিন্দা জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় শাখা প্রগতিশীল ছাত্রজোট, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট ও সাংস্কৃতিক জোটের নেতা-কর্মীরা। তবে প্রক্টর আরজু মিয়াসহ প্রশাসনপন্থী শিক্ষকেরা অধ্যাপক মামুনকে লাঞ্ছিত করার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। একাধিক শিক্ষক প্রথম আলোকে বলেন, গতকাল বেলা সাড়ে ১১টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের জহির রায়হান মিলনায়তনের সেমিনার কক্ষে শিক্ষক সমিতির বুধবারের স্থগিত সাধারণ সভা শুরু হয়। সভায় প্রক্টরের পদত্যাগসহ বিভিন্ন বিষয়ে পক্ষে-বিপক্ষে প্রশাসনপন্থী ও প্রশাসনবিরোধী শিক্ষকেরা বক্তব্য দেন। বক্তব্যের একপর্যায়ে বিএনপিপন্থী বয়োজ্যেষ্ঠ শিক্ষক মো. নূরুল ইসলাম সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত প্রশাসনপন্থী শিক্ষক মো. তানজিনুল হক মোল্লাকে ‘তুই বস’ বলে সম্বোধন করেন। এ নিয়ে প্রশাসনপন্থী শিক্ষকদের সঙ্গে অন্য শিক্ষকদের বাগিবতণ্ডা ও ধাক্কাধাক্কি হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে শিক্ষক সমিতির সভাপতি এ এ মামুন সভা স্থগিত করে কক্ষ থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করেন।
অধ্যাপক এ এ মামুনসহ অন্য শিক্ষকেরা প্রথম আলোকে বলেন, কক্ষ থেকে বের হওয়ার সময় প্রশাসনপন্থী শিক্ষকেরা ক্ষুব্ধ হয়ে মামুনের দিকে তেড়ে যান। একপর্যায়ে প্রক্টর আরজু মিয়া তাঁর শার্টের কলার ধরে লাঞ্ছিত করেন।
শিক্ষকনেতা এ এ মামুন কান্নাজড়িত কণ্ঠে প্রথম আলোকে বলেন, ‘এমন অপদস্থের ঘটনা ঘটবে, তা কখনোই ভাবিনি।’
দুপুর একটার দিকে সমাজবিজ্ঞান ভবনে শিক্ষক সমাজের ব্যানারে জরুরি সংবাদ সম্মেলন করেন আওয়ামী লীগপন্থী, বিএনপিপন্থী ও বামঘেঁষা শিক্ষকেরা। এতে শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক বিএনপিপন্থী শিক্ষক মো. শরিফ উদ্দিন বলেন, ‘শিক্ষক সমিতির সভাপতিকে লাঞ্ছিত করায় আমরা মর্মাহত।’
অধ্যাপক শরিফ উপস্থিত শিক্ষকদের পক্ষ থেকে পাঁচ দফা দাবি জানান। দাবিগুলো হলো: প্রক্টর আরজু মিয়াকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অপসারণ এবং দক্ষতা ও শৃঙ্খলা অধ্যাদেশ অনুসারে শাস্তি, নিরাপত্তা বিধানে ব্যর্থ প্রক্টরিয়াল বডির অপসারণ; জুবায়ের হত্যার ঘটনায় প্রশাসন মদদপুষ্ট তদন্ত কমিটি বাতিল করে নতুন কমিটি গঠন করে এক সপ্তাহের মধ্যে প্রতিবেদন প্রকাশ; ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের অবাধ রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তি নিশ্চিত করা এবং গণনিয়োগ দেওয়া শিক্ষকদের নিয়োগ বাতিল করা। এ ছাড়া প্রক্টর ও প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যদের বিচার না করা পর্যন্ত ক্লাস ও সব পেশাগত দায়িত্ব পালন না করার ঘোষণা দেন শিক্ষকেরা। দাবি আদায়ে কাল শনিবার বিশ্ববিদ্যালয়ের অমর একুশের পাদদেশে গণসমাবেশের আয়োজন করা হয়েছে। প্রশাসন দাবি না মানলে উপাচার্যের অপসারণের দাবিতে আন্দোলন করার হুমকি দিয়েছেন শিক্ষকেরা।
এর আগে দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে প্রশাসনপন্থী শিক্ষকেরা জহির রায়হান মিলনায়তনের সেমিনার কক্ষে সংবাদ সম্মেলন করেন। এতে শিক্ষক সমিতির সহসভাপতি প্রশাসনপন্থী অধ্যাপক আবুল খায়ের বাগিবতণ্ডা ও ধাক্কাধাক্কির ঘটনায় প্রশাসনবিরোধী আওয়ামী লীগপন্থী, বিএনপিপন্থী ও বামঘেঁষা শিক্ষকদের দায়ী করেন।
এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনপন্থী শিক্ষকেরা নিজেদের ‘বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী প্রগতিশীল শিক্ষক সমাজ’ উল্লেখ করে গতকাল সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ‘ইংরেজি বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র জুবায়ের আহমেদের নৃশংস মৃত্যুর অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাকে পুঁজি করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একাংশের রাজনৈতিক ফায়দা লোটার জোর প্রচেষ্টা কয়েক দিন ধরে অব্যাহত রয়েছে। আজ দুদিন ধরে তার নগ্ন প্রকাশ ঘটেছে।’ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, প্রক্টর আরজু মিয়া দলীয় শিক্ষকদের বলয়ের ভেতরে থাকা শিক্ষক সমিতির সভাপতি এ এ মামুনকে আক্রমণ করার সংবাদটি শুধু মিথ্যাই নয়, অভাবনীয়, বানোয়াট ও ষড়যন্ত্রমূলক।
একই ধরনের কথা বলেন প্রক্টর আরজু মিয়া। তিনি বলেন, ‘শিক্ষক সভাপতির সভাপতিকে লাঞ্ছিত করার বিষয়টি সত্য নয়। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করতে একটি কুচক্রী মহল লাশের রাজনীতি শুরু করেছে। পূর্বপরিকল্পিতভাবেই তারা সভায় বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি করে এ মিথ্যাচার চালাচ্ছে।’
প্রক্টরের পদত্যাগের দাবিতে মিছিল: বিশ্ববিদ্যালয় দিবস উপলক্ষে গতকাল সকাল ১০টার দিকে শিক্ষক সমাজের ব্যানারে ‘উৎসব হোক শোক ও প্রতিরোধের ভাষা’ স্লোগান নিয়ে মৌন মিছিল করেন প্রশাসনবিরোধী ও দাবি আদায়ের লক্ষ্যে আন্দোলনকারী শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। শিক্ষকেরা পরে অমর একুশের পাদদেশে সমাবেশ করে জুবায়ের হত্যার ঘটনায় প্রক্টরের পদত্যাগের দাবি জানান। এ সময় অধ্যাপক নাসিম আখতার হোসাইন বলেন, ‘আমার সন্তানের নিরাপত্তার দায়ভার নিতে যাঁরা ব্যর্থ হয়েছেন, সেই প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যদের পদত্যাগ করতে হবে।’
প্রক্টর আরজু মিয়া ও বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা কর্মকর্তা আজীম উদ্দিনের পদত্যাগের দাবিতে পরে দুপুর ১২টার দিকে ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল করেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা।
ছাত্রলীগের সাজাপ্রাপ্তদের নেতৃত্বে মিছিল: গোলাম আযমসহ মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত সবার ফাঁসির দাবিতে গতকাল একই সময়ে শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী ও ছাত্রছাত্রীর ব্যানারে ক্যাম্পাসে মানববন্ধন হয়। এতে প্রশাসনপন্থী শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী, আগে শাস্তিপ্রাপ্ত ও বিতর্কিত স্থগিত কমিটির ছাত্রলীগের কর্মীরা অংশ নেন। ছাত্রলীগের কর্মীরা পরে ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’, ‘যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি চাই’ স্লোগান দিয়ে বিক্ষোভ মিছিল করেন। মিছিলে নেতৃত্ব দেন ২০০৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের অভিযোগে পুলিশের হাতে আটক সুমন, গত বছরের মে মাসে সাংবাদিককে মারধর করায় এক মাসের জন্য বহিষ্কার হওয়া মাহতাব মেহেদি এবং বর্তমান সময়ে বিভিন্ন অভিযোগে অভিযুক্ত শরীফুল ইসলাম। এর আগে সকালে প্রশাসনবিরোধী আওয়ামী লীগপন্থী শিক্ষকেরাও একই দাবিতে লিখিত বিবৃতি দেন।
ছাত্রলীগের মিছিল প্রসঙ্গে আরজু মিয়া বলেন, ‘ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের কোনো নেতা-কর্মী নেই। তবে সেই মতাদর্শের শিক্ষার্থী তো থাকতেই পারে।’
জুবায়ের হত্যার ঘটনায় আরও একজন আটক: জুবায়ের আহমেদ হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকায় গতকাল সোয়া একটার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ রফিক জব্বার হলের সামনে থেকে সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ৩৭তম ব্যাচের ছাত্র মাহবুব আকরামকে আটক করেছে আশুলিয়া থানার পুলিশ। এর আগে ঘটনার দিন গত সোমবার মীর মশাররফ হোসেন হল থেকে আটক করা হয় প্রাণিবিদ্যা বিভাগের ৩৭তম ব্যাচের ছাত্র খন্দকার আশিকুল ইসলামকে।
গতকাল রাতে আশুলিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এস এম বদরুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, আশিকুলের দেওয়া তথ্যের ওপর ভিত্তি করে আকরামকে আটক করা হয়েছে। আটকের পর আকরামকে প্রাথমিকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে তিনি ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিলেন বলে স্বীকার করেছেন।

No comments

Powered by Blogger.