শেকড়ের ডাক-এই উপেক্ষা আত্মপ্রবঞ্চনারই শামিল by ফরহাদ মাহমুদ

র্ষায় স্বাভাবিক জোয়ারের পানিতেই তলিয়ে যায় বাগেরহাট শহরের রাস্তাঘাট। অমাবস্যা-পূর্ণিমার প্রভাবে জোয়ার যখন একটু বেশি হয়, তখন কক্সবাজার, ভোলা, পটুয়াখালী, বরগুনা শহরে ঢুকে যায় জোয়ারের পানি। গত বছর চট্টগ্রাম শহরকেও প্লাবিত করেছিল জোয়ারের পানি। উপকূলীয় জেলাগুলোর বিস্তৃত অঞ্চল বারবার জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হচ্ছে। ফলে সেসব এলাকায় চাষাবাদ চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে। এমনকি এলাকার বাড়িঘরে বারবার পানি ওঠায় স্থানীয় অধিবাসীদের পক্ষে সেখানে বসবাস করাই কঠিন হয়ে পড়েছে।


সাধারণত পূর্ণিমা-অমাবস্যায় জোয়ারের টান একটু বেশি হয়। অন্য সময়ের চেয়ে জোয়ারের পানি কয়েক ফুট পর্যন্ত উঁচু হয়। সেই সঙ্গে সাগর উত্তাল থাকলে তো কথাই নেই। জোয়ারের পানির উচ্চতা আরো বেড়ে যায়। এগুলো সাগরপাড়ের মানুষের জীবনে স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু সেই স্বাভাবিক ঘটনা আজ ক্রমেই অস্বাভাবিক হয়ে উঠছে। আমরা জানি, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতাও বাড়ছে। আর তার প্রভাব পড়ছে সাগরপাড়ের মানুষের জীবনে। তাদের আবাদি জমিগুলো ক্রমেই অনাবাদি হয়ে পড়ছে। ঘরবাড়িতে থাকাটাও কষ্টকর হয়ে পড়ছে। সেটি আরো ভয়ংকর রূপ ধারণ করে ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসের সময়। তাই বিস্তীর্ণ উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষ আজ আতঙ্কগ্রস্ত জীবন যাপন করছে। এমনিতেই সিডর ও আইলা নামের দুটি ভয়ংকর ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের আতঙ্ক তাদের এখনো তাড়া করে ফেরে। তার ওপর তাদের অরক্ষিত জীবনে ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস এলেই তাদের অবস্থা হয় অথৈ সাগরে হাবুডুবু খাওয়ার মতো।
সিডর ও আইলায় উপকূল রক্ষা বাঁধ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। বহু জায়গায় এখনো ভেঙে যাওয়া বাঁধ মেরামত করা সম্ভব হয়নি। সাতক্ষীরায় আইলায় ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধের একটি বড় অংশ আজও মেরামত করা যায়নি। তার ওপর জোয়ারের তোড়ে উপকূল রক্ষা বাঁধ জায়গায় জায়গায় ভেঙে পড়ায় বলা যায় গোটা উপকূলই আজ ভয়ানক বিপদসঙ্কুল। সেসব এলাকা দিনে দুইবারই জোয়ারের পানিতে ভাসে। তদুপরি দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে বাঁধের বাইরেও বহু মানুষ আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। আবার উপকূলে এমন অনেক এলাকা আছে যেখানে বাঁধ নির্মাণ কিংবা রক্ষা করাটাও খুবই কঠিন কাজ। যেমন_কক্সবাবাজারের টেকনাফ সংলগ্ন শাহপরীর দ্বীপে বাঁধ তৈরির বহু চেষ্টা করা হয়েছে, কিন্তু প্রতিবারই জোয়ারের পানি ভাসিয়ে নিয়েছে বালুমাটির ওপর গড়ে তোলা বাঁধ। শুধু প্লাবিত করা নয়, বহু এলাকা সাগরগর্ভে বিলীনও হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। মহেশখালী, কুতুবদিয়ার মতো প্রাচীন জনবসতির বিস্তীর্ণ এলাকা সাগরগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। সেখানে বায়ুবিদ্যুতের যে প্রকল্প ছিল, তা-ও আজ চূড়ান্ত ঝুঁকির মুখে। একই অবস্থা ভোলার শাহবাজপুর গ্যাসক্ষেত্রেরও।
সাধারণত ভরা বর্ষায় সাগর বেশি উত্তাল থাকে। তখন মোহনার নদীগুলোও কানায় কানায় পূর্ণ থাকে। এ সময় জোয়ারের সামান্য হেরফেরও বড় বিপর্যয় ডেকে আনে। আর ঘূর্ণিঝড়ের সঙ্গে যে জলোচ্ছ্বাস হয়, তাকে কোনো বাঁধ দিয়েই আটকে রাখা সম্ভব নয়। প্রাবল্য অনুসারে সাগরের জল ৩০ থেকে ৪০ ফুট উঁচু হয়ে উপকূলে আছড়ে পড়ে। দেখা দেয় মহাবিপর্যয়। মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার সেই ঝুঁকি নিয়েই সাগরপাড়ের মানুষগুলো যুগ যুগ ধরে বসবাস করে আসছে। একটু পেছন ফিরে তাকালেই উপকূলবাসীর এমন অনেক মৃত্যুর মিছিল আমাদের স্মৃতির পাতায় ভেসে উঠবে। কিন্তু স্বাভাবিক জোয়ারটাও যদি প্রতিরোধ করা না যায়, চাষাবাদ না করা যায়, তাহলে সেখানে মানুষ থাকবে কিভাবে? দুঃখজনক হলেও সত্য, ১৯৯২ সালে সরকারেরই গঠিত একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি উপকূলীয় মানুষের জানমাল রক্ষায় যেসব সুপারিশ করেছিল, সেগুলো আজও বাস্তবায়িত হয়নি। এ পর্যন্ত কোনো সরকারই উপকূল রক্ষা বাঁধকে উঁচু ও মজবুত করার কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। তৈরি হয়নি পর্যাপ্ত আশ্রয়কেন্দ্র। তৈরি হয়নি গবাদিপশু রক্ষার জন্য উঁচু মাটির ঢিবি। তাই উপকূলীয় এলাকার দুই কোটির মতো মানুষ আজ চরম বিপদের সম্মুখীন। তারা কোথায় যাবে? রাজধানীতে এসে উঠলে রাজধানী কি পারবে তাদের ধারণ করতে? যে মানুষ বা যে জাতি একটু দূরবর্তী চিন্তা করতে পারে, ভবিষ্যৎ বিবেচনায় নিয়ে উন্নয়ন করতে পারে_তারাই টিকে থাকতে পারে। কিন্তু আমরা তা পারছি কি?
'আমরা কি মানষির মধ্যে পড়ি'_এই প্রশ্ন ছিল খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার আলেয়া বেগমের। ৫৫ বছর বয়সে দিনের পর দিন উপোস করে, নির্ঘুম রাত কাটিয়ে এমনই সংশয় জন্মেছে তাঁর। শুধু আলেয়া বেগম নন, সাতক্ষীরা ও খুলনা জেলার ১০ লাখেরও বেশি মানুষ বন্যাকবলিত হয়ে গত দুটি ঈদ পার করেছে। অনেককেই ঘরবাড়ি ছেড়ে রাস্তার পাশে বা কোনো উঁচু স্থানে পলিথিনের ছাউনিতে আশ্রয় নিতে হয়েছিল। তাদের এই দুঃখের কারণ কপোতাক্ষ ও বেতনা নদী। নদী দুটি ভরাট হয়ে যাওয়ায় বৃষ্টির পানি নামতে পারে না। ফলে সৃষ্টি করে স্থায়ী জলাবদ্ধতার। ফসলের জমি, মাছের ঘের_সবই চলে যায় পানির নিচে। এই চিত্র ফি বছরের। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, নদী দুটি খননের কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু নদী খনন হচ্ছে না।
শুধু কপোতাক্ষ বা বেতনা নয়, দেশের অধিকাংশ নদীই আজ মৃতপ্রায়। এর ফলে বর্ষায় একদিকে বন্যা ও জলাবদ্ধতা ক্রমেই নিয়তি হয়ে দেখা দিচ্ছে, অন্যদিকে নদীভাঙন প্রতিবছরই হাজার হাজার পরিবারকে গৃহহারা ও নিঃস্ব করে দিচ্ছে। আবার শুষ্ক মৌসুমে পানির অভাবও ক্রমেই প্রকট থেকে প্রকটতর হচ্ছে। অনেক স্থানে মরুকরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। ফারাক্কা এবং তিস্তার উজানে ভারতের একতরফা বাঁধ নির্মাণ ও পানি প্রত্যাহারের কারণেই বাংলাদেশ আজ মরতে বসেছে। নদীগুলো শুকিয়ে যাওয়ায় বা নদীতে মিঠা পানির প্রবাহ ক্রমে ক্রমে হ্রাস পাচ্ছে। ফলে নোনাপানির অনুপ্রবেশ বাড়ছে। অদূর ভবিষ্যতে এটি যে দেশের জন্য এক মহাবিপর্যয় ডেকে আনছে_তা কি আমরা বুঝতে পারছি? এ থেকে বাঁচতে হলে অবশ্যই ভারতের সঙ্গে আমাদের অভিন্ন নদীগুলোর পানিবণ্টনের সমস্যা দ্রুত নিরসন করতে হবে। দ্বিপক্ষীয় উপায়ে সম্ভব না হলে বহুপক্ষীয় প্রচেষ্টা চালাতে হবে। চুপ করে থাকা হবে আত্মহত্যারই শামিল। পাশাপাশি দেশের নদীগুলো পুনরুদ্ধারে সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে। সাতক্ষীরাসহ কিছু কিছু স্থানে আশু পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। প্রায় এক ডজন ড্রেজার সংগ্রহ অবশ্যই এ সরকারের একটি ভালো পদক্ষেপ। কিন্তু সেখানে থেমে থাকলে হবে না। সেগুলোর যথাযথ ব্যবহার করতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, নদী না বাঁচলে এই দেশও বাঁচানো সম্ভব হবে না। তাই নদীর ক্ষতি হতে পারে, এমন কোনো প্রকল্প হাতে নেওয়া থেকেও আমাদের বিরত থাকতে হবে।
জেনেভাভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংগঠন অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু পর্যবেক্ষণকেন্দ্র জানিয়েছে, কেবল ২০১০ সালেই চার কোটি ২০ লাখ মানুষ গৃহহারা হয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশসহ এশিয়ার কয়েকটি দেশের উদ্বাস্তুর সংখ্যাই বেশি। আর এদের উদ্বাস্তু হওয়ার প্রধান কারণ বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়। প্রাপ্ত তথ্যমতে, গত দুই দশকে প্রাকৃতিক দুর্যোগের সংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। আবার শুধু সংখ্যা নয়, দুর্যোগের তীব্রতা বা ধ্বংস করার ক্ষমতাও অনেক বেড়েছে। ফলে প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বাড়ছে অনেক বেশি করে। আমরা বিষয়গুলো যে উপলব্ধি করছি না, তা নয়। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে আমরা বেশ জোরের সঙ্গেই কথাগুলো বলছি। কিন্তু বাঁচা-মরার সন্ধিক্ষণে থাকা উপকূলের কয়েক কোটি মানুষের জন্য আমাদেরও তো কিছু করণীয় আছে। গত রাষ্ট্রীয় বাজেট কি তার পক্ষে কথা বলে?
প্রতিবছরই আগাম বন্যায় আমাদের হাওরাঞ্চলে বোরো ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। বিশেষজ্ঞ ব্যক্তি ও সংস্থার পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বাংলাদেশে বন্যা ছাড়া অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগে সম্পদের যত ক্ষয়ক্ষতি হয়, কেবল বন্যায় প্রতি বছর তার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়। অথচ বন্যার ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় এ পর্যন্ত কোনো সরকারই কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তে দেখা যায়, বাংলাদেশে বন্যার প্রকোপ ক্রমেই বাড়ছে এবং দুটি বড় বন্যার মধ্যবর্তী সময়সীমা কমে আসছে। বাংলাদেশে এই অতিরিক্ত বন্যার প্রধান কারণও হচ্ছে, নদীগুলো ভরাট হয়ে যাওয়া। কারণ বর্ষাকালে বাংলাদেশের নদীগুলো দিয়ে যে পরিমাণ পানি প্রবাহিত হয় তার প্রায় ৯৪ শতাংশই আসে উজান থেকে। এ পানি আটকে রাখার কোনো উপায় নেই। আবার আমাদের নদীগুলোর গভীরতা না থাকায় সেই পানি ধারণও করতে পারে না। তখন নদীর দুই কূল ছাপিয়ে পানি লোকালয় বা ফসলি জমি ডুবিয়ে দেয়। আবার খাল, বিল, জলাশয় ক্রমাগত ভরাট হওয়ার ফলে অভ্যন্তরীণ বৃষ্টির পানিও বন্যার মাত্রা বাড়াতে সাহায্য করে। অন্যদিকে পাহাড়ি ঢলের সঙ্গে প্রতিবছর প্রায় ৯৪ লাখ মেট্রিক টন পলি এসে জমা হয় আমাদের নদীগুলোতে। ফলে নদী ভরাট প্রক্রিয়া আরো ত্বরান্বিত হচ্ছে। তাই ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে নদীগুলোর নাব্যতা ফিরিয়ে আনা ছাড়া বন্যা সমস্যা মোকাবিলার আর কোনো উপায় নেই। অত্যন্ত ব্যয়সাপেক্ষ হলেও এই ড্রেজিং আমাদের করতেই হবে। তা না হলে প্রতিবছর তার চেয়েও বেশি ক্ষয়ক্ষতি আমাদের মোকাবিলা করতে হবে।

লেখক : সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.