একজন মানুষের প্রতিকৃতি by তিতাশ চৌধুরী
আমাদের হাবিব বর্তমানে কোথায় আছে, কেমন আছে, কীভাবে আছে—কিছুই জানি না। ২০০৩ সালের পর হাবিবের সঙ্গে আমার আর দেখা হয়নি। দেখা হওয়াও সম্ভব ছিল না। কেননা, একটু আগেই বলেছি, আমি কলেজে দু’একবার গেলেও হাবিবের সঙ্গে দেখা হওয়ার সুযোগ ঘটেনি।
কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের দুটো অংশ। একটি ইন্টারমিডিয়েট শাখা, অন্যটি ডিগ্রি। এ দুয়ের দূরত্ব প্রায় এক কিলোমিটারের মতো। ইন্টারমিডিয়েট শাখা শহরে রানীর দীঘির পাড়ে, আর ডিগ্রি শহরতলীর ধর্মপুর নামক স্থানে। হাবিব ইন্টারমিডিয়েট শাখার প্রিন্সিপালের পিয়ন। এই হাবিব সব প্রিন্সিপালেরই প্রিয়ভাজন। পিয়ন অর্থাত্ চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী কলেজে একশ’জনের মতো ছিল। তা সত্ত্বেও হাবিবকে আমার সবচেয়ে উঁচু মনে হতো। কারণ হাবিবের মতো গুণাবলী কলেজে অন্য কোনো পিয়নের ছিল না। সবারই কোনো না কোনো ক্ষেত্রে ত্রুটি ছিল। চরিত্রের স্খলন ছিল। পিয়ন হিসেবে হাবিবের এসব কোনো দোষ ছিল না। হাবিবের সাধুতা, আন্তরিকতা, বিশ্বস্ততা, আনুগত্য, দায়িত্ববোধ, কর্তব্যপরায়ণ, আদেশ পালনে তত্পরতা, আদর্শ ও দর্শন কলেজের সব প্রিন্সিপালেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।
হাবিব ছিল সারল্যের প্রতিমূর্তি। সহজতা ছিল তার প্রধান ভূষণ। তার মধ্যে কোনো চালাকি ছিল না। কাজে ফাঁকি দেয়া কাকে বলে সে জানত না। কোনো সুযোগ সুবিধা গ্রহণের ক্ষেত্রেও সে ছিল উদাসীন। হাবিব শেলী-কীট্স্ পাঠ করেনি, কিন্তু তাদের সত্য ও সুন্দরকে সে জীবনে অসাধারণভাবে ধারণ করেছিল। তাকে কখনও মিথ্যা কথা বলতে দেখিনি বা শুনিনি। সত্য ও সুন্দরই ছিল তার জীবনের সঙ্কল্প। অথচ তার কোনো শিক্ষা ছিল না। সই করা ছাড়া সে তেমন কোনো লেখাপড়া জানত না। এজন্য কলেজে তাকে আমার সবচেয়ে ‘উঁচু মানুষ’ বলে মনে হতো— যদিও একথা আমি কলেজ জীবনে কোনো দিন কারও কাছে প্রকাশ করিনি। হাবিব নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করত, কলেজে তার জুড়ি ছিল না। হাবিবের মতো পিয়ন এ কালে বিরল। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের (প্রতিষ্ঠা ১৮৯৯) ইতিহাসে তার মতো কেউ নেই। ছিল প্রথম দিকে দু’তিনজন। তবে তারা আবার বাঙালি ছিল না। বলিরাজ, তেওয়ারি ও মোঙ্গা। তারাও হাবিবের মতো ছিল সরল ও আদর্শের প্রতিমূর্তি।
হাবিব সামান্য বেতনে একটি বড় সংসার পরিচালনা করত। তবু তার কোনো অভিযোগ ছিল না। সে দু’বেলা পেটপুরে খেতে পারত কিনা আমার সন্দেহ। সে অভাবের কথা নিরলে কোনো প্রিন্সিপালকে বলত বলে মনে হয় না। আমাকেও বলেনি কোনো দিন। তবে সে তার ছেলেকে কলেজে একটি চাকরি দেয়ার কথা বলেছিল। আমি সে ব্যবস্থা করেছিলাম। সে তাতে দারুণ খুশি হয়েছিল।
হাবিব কালেজে ঠিক সময়ে উপস্থিত হতো। কোনো দিন তার ব্যত্যয় ঘটেনি। সংসার, বাইরের কোলাহল কিংবা ঝড়বৃষ্টি কোনো কিছুই তাকে তার কর্তব্য থেকে বিরত রাখতে পারেনি। কলেজে হরতাল হলেও সে প্রিন্সিপালের কক্ষ তালা দিয়ে বাইরে একটা টুলে বসে থাকত। প্রিন্সিপাল না আসা কিংবা না বলা পর্যন্ত সে ঠায় একাকী বসে ঝিমুত। আমার সময়ে এমন অনেক দিনই গেছে চাবি দিয়ে চলে যাওয়ার কথা তাকে বলতে ভুলে গেছি। কিন্তু সে তার দায়িত্ব-কর্তব্য থেকে বিচ্যুত হয়নি। আমি মনে মনে অবাকই হতাম এই ভেবে যে, এমন মানুষ আজও আছে এই দেশে!
আগেই বলেছি, হাবিব খুব সকালে অফিসে চলে আসত। চাবি আনতে গেলে আমি বলতাম, অফিসের সময় তো এখনও ঢের বাকি। সে বলত : ‘অফিস খুলে সাফ্সুতরা করতে কখন যে স্যার সময় পার হয়ে যায় টের পাই না’ বলেই সে একটু হাসত। হাবিবের শারীরিক গড়ন তেমন ভালো ছিল না। শুকনো, লম্বা কিসিমের শরীর নিয়ে সে একটি ছন্দে হাঁটা-চলা করত। তাকে দেখলে বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ লেগেছে বলে মনে হতো। সে দুপুরে কী খেত জানি না। তবে খুব ঘন ঘন চা খেত। সে ছিল চা খোর। সে বলত, ‘স্যার, চা খেলে পেটের ক্ষিধা থাকে না।’ চা আবার নিজের পয়সাই খেত। এসব কথা চিন্তা করে একদিন আমার করণিককে ডেকে এনে বললাম, ‘আজ থেকে হাবিবকে প্রতিদিন পাঁচ টাকা করে নাস্তার জন্য দেবেন। অথবা মাসের শেষে একসঙ্গে বিবিধ বেসরকারি খাত থেকে সব টাকাটা দিয়ে দিতে পারেন।’ এতে হাবিবকে খুশির পরিবর্তে একটু চিন্তিত মনে হলো। আমি দু’একদিন পরপরই তাকে টাকা দেয়া হয় কিনা খোঁজ নিতাম। অবশ্য হাবিবই আমাকে তার প্রতিদিন টাকা পাওয়ার কথা বলত। কয়েকদিন পর হাবিব আমাকে বলে, ‘স্যার, টাকাটা না নিলে হয় না।’ হাবিবের কথায় আমি তো অবাক। আমি বললাম, ‘কলেজের অন্য পিয়নরা তো তোমার মতো নয়। তাই তুমি নাস্তার পয়সা নেবে না কেন? আরও বললাম, ‘তুমি কোনো অনুষ্ঠান হলেও নিজের অংশটা নিতে পার না। অন্যেরা তোমার ভাগ জোর করে খেয়ে ফেলে। তাই না? ‘হ, স্যার’ সে উত্তর দেয়। সেজন্য তোমাকে নাস্তার টাকা দেয়ার জন্য একটি স্থায়ী আদেশ করে দিয়ে গেলাম। আমি কলেজ ছেড়ে আসার পর একদিন শুনলাম হাবিব আর নাস্তার টাকা নিচ্ছে না। কথাটি শুনে হাবিবের জন্য কষ্টই হলো। হাবিব আসলেই সবার চেয়ে কোথায় যেন আলাদা। তাকে কি একজন সংস্কৃতিবান মানুষ বলা যায়?
লেখক : কবি, গবেষক, প্রাবন্ধিক, শিক্ষাবিদ ও অলক্ত সম্পাদক।
হাবিব ছিল সারল্যের প্রতিমূর্তি। সহজতা ছিল তার প্রধান ভূষণ। তার মধ্যে কোনো চালাকি ছিল না। কাজে ফাঁকি দেয়া কাকে বলে সে জানত না। কোনো সুযোগ সুবিধা গ্রহণের ক্ষেত্রেও সে ছিল উদাসীন। হাবিব শেলী-কীট্স্ পাঠ করেনি, কিন্তু তাদের সত্য ও সুন্দরকে সে জীবনে অসাধারণভাবে ধারণ করেছিল। তাকে কখনও মিথ্যা কথা বলতে দেখিনি বা শুনিনি। সত্য ও সুন্দরই ছিল তার জীবনের সঙ্কল্প। অথচ তার কোনো শিক্ষা ছিল না। সই করা ছাড়া সে তেমন কোনো লেখাপড়া জানত না। এজন্য কলেজে তাকে আমার সবচেয়ে ‘উঁচু মানুষ’ বলে মনে হতো— যদিও একথা আমি কলেজ জীবনে কোনো দিন কারও কাছে প্রকাশ করিনি। হাবিব নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করত, কলেজে তার জুড়ি ছিল না। হাবিবের মতো পিয়ন এ কালে বিরল। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের (প্রতিষ্ঠা ১৮৯৯) ইতিহাসে তার মতো কেউ নেই। ছিল প্রথম দিকে দু’তিনজন। তবে তারা আবার বাঙালি ছিল না। বলিরাজ, তেওয়ারি ও মোঙ্গা। তারাও হাবিবের মতো ছিল সরল ও আদর্শের প্রতিমূর্তি।
হাবিব সামান্য বেতনে একটি বড় সংসার পরিচালনা করত। তবু তার কোনো অভিযোগ ছিল না। সে দু’বেলা পেটপুরে খেতে পারত কিনা আমার সন্দেহ। সে অভাবের কথা নিরলে কোনো প্রিন্সিপালকে বলত বলে মনে হয় না। আমাকেও বলেনি কোনো দিন। তবে সে তার ছেলেকে কলেজে একটি চাকরি দেয়ার কথা বলেছিল। আমি সে ব্যবস্থা করেছিলাম। সে তাতে দারুণ খুশি হয়েছিল।
হাবিব কালেজে ঠিক সময়ে উপস্থিত হতো। কোনো দিন তার ব্যত্যয় ঘটেনি। সংসার, বাইরের কোলাহল কিংবা ঝড়বৃষ্টি কোনো কিছুই তাকে তার কর্তব্য থেকে বিরত রাখতে পারেনি। কলেজে হরতাল হলেও সে প্রিন্সিপালের কক্ষ তালা দিয়ে বাইরে একটা টুলে বসে থাকত। প্রিন্সিপাল না আসা কিংবা না বলা পর্যন্ত সে ঠায় একাকী বসে ঝিমুত। আমার সময়ে এমন অনেক দিনই গেছে চাবি দিয়ে চলে যাওয়ার কথা তাকে বলতে ভুলে গেছি। কিন্তু সে তার দায়িত্ব-কর্তব্য থেকে বিচ্যুত হয়নি। আমি মনে মনে অবাকই হতাম এই ভেবে যে, এমন মানুষ আজও আছে এই দেশে!
আগেই বলেছি, হাবিব খুব সকালে অফিসে চলে আসত। চাবি আনতে গেলে আমি বলতাম, অফিসের সময় তো এখনও ঢের বাকি। সে বলত : ‘অফিস খুলে সাফ্সুতরা করতে কখন যে স্যার সময় পার হয়ে যায় টের পাই না’ বলেই সে একটু হাসত। হাবিবের শারীরিক গড়ন তেমন ভালো ছিল না। শুকনো, লম্বা কিসিমের শরীর নিয়ে সে একটি ছন্দে হাঁটা-চলা করত। তাকে দেখলে বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ লেগেছে বলে মনে হতো। সে দুপুরে কী খেত জানি না। তবে খুব ঘন ঘন চা খেত। সে ছিল চা খোর। সে বলত, ‘স্যার, চা খেলে পেটের ক্ষিধা থাকে না।’ চা আবার নিজের পয়সাই খেত। এসব কথা চিন্তা করে একদিন আমার করণিককে ডেকে এনে বললাম, ‘আজ থেকে হাবিবকে প্রতিদিন পাঁচ টাকা করে নাস্তার জন্য দেবেন। অথবা মাসের শেষে একসঙ্গে বিবিধ বেসরকারি খাত থেকে সব টাকাটা দিয়ে দিতে পারেন।’ এতে হাবিবকে খুশির পরিবর্তে একটু চিন্তিত মনে হলো। আমি দু’একদিন পরপরই তাকে টাকা দেয়া হয় কিনা খোঁজ নিতাম। অবশ্য হাবিবই আমাকে তার প্রতিদিন টাকা পাওয়ার কথা বলত। কয়েকদিন পর হাবিব আমাকে বলে, ‘স্যার, টাকাটা না নিলে হয় না।’ হাবিবের কথায় আমি তো অবাক। আমি বললাম, ‘কলেজের অন্য পিয়নরা তো তোমার মতো নয়। তাই তুমি নাস্তার পয়সা নেবে না কেন? আরও বললাম, ‘তুমি কোনো অনুষ্ঠান হলেও নিজের অংশটা নিতে পার না। অন্যেরা তোমার ভাগ জোর করে খেয়ে ফেলে। তাই না? ‘হ, স্যার’ সে উত্তর দেয়। সেজন্য তোমাকে নাস্তার টাকা দেয়ার জন্য একটি স্থায়ী আদেশ করে দিয়ে গেলাম। আমি কলেজ ছেড়ে আসার পর একদিন শুনলাম হাবিব আর নাস্তার টাকা নিচ্ছে না। কথাটি শুনে হাবিবের জন্য কষ্টই হলো। হাবিব আসলেই সবার চেয়ে কোথায় যেন আলাদা। তাকে কি একজন সংস্কৃতিবান মানুষ বলা যায়?
লেখক : কবি, গবেষক, প্রাবন্ধিক, শিক্ষাবিদ ও অলক্ত সম্পাদক।
No comments