আদালতে সাক্ষ্য দিলেন এফবিআই কর্মকর্তা ডেবরা লাপরিভেট-পাচার করা অর্থে ভ্রমণ ও কেনাকাটা করেন তারেক

সিঙ্গাপুরের এনসিটি ব্যাংকে গিয়াস উদ্দিন আল মামুনের অ্যাকাউন্ট পর্যালোচনা করে জানা যায়, তারেক-মামুনের পাচার করা টাকা সেখানে জমা হয়। সেই হিসাবের বিপরীতে পাওয়া ভিসা ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করেন তারেক রহমান। তিনি কার্ডের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের শপিং মলে কেনাকাটা করেন।সিঙ্গাপুরে অর্থপাচার মামলায় বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও তাঁর বন্ধু ব্যবসায়ী গিয়াস উদ্দিন আল মামুনের বিরুদ্ধে গতকাল বুধবার


আদালতে সাক্ষ্য দেওয়ার সময় মার্কিন তদন্ত সংস্থা এফবিআইয়ের কর্মকর্তা ডেবরা লাপরিভেট এসব কথা বলেন।
ডেবরার সাক্ষ্য নেন ঢাকার বিশেষ আদালত ৩-এর বিচারক মো. মোজাম্মেল হোসাইন। সাক্ষী জবানবন্দি দিলেও আদালতে কারাগার থেকে হাজির করা আসামি গিয়াস উদ্দিন আল মামুনের পক্ষে জেরা করেননি তাঁর আইনজীবীরা। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেনের নেতৃত্বে বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা মামুনের পক্ষে আদালতে উপস্থিত ছিলেন। এফবিআই কর্মকর্তার সাক্ষ্যগ্রহণ স্থগিত রাখতে আদালতের কাছে আবেদন করলে আদালত আবেদন নামঞ্জুর করেন।
এরপর মামুনের আইনজীবীরা একযোগে আদালত বর্জনের ঘোষণা দিয়ে এজলাস থেকে বেরিয়ে আসেন। এর আগে অনেক হৈচৈ হয়। মামলার বাদী এর আগে সাক্ষ্য দিয়েছেন। তাঁকে অবশ্য মামুনের আইনজীবীরা জেরা করেছেন। গত মঙ্গলবারও বাদীকে জেরা করেন খন্দকার মাহবুব হোসেন। তারেক রহমান পলাতক থাকায় তাঁর পক্ষে সাক্ষীদের জেরা করার আইনগত সুযোগ না থাকায় মামুনের পক্ষেই বিএনপির আইনজীবীরা আদালতে কথা বলেন।
গত মঙ্গলবার রাষ্ট্রপক্ষে এক আবেদন করে এফবিআই কর্মকর্তাকে মামলার সাক্ষী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার অনুমতি চাওয়া হয়। আদালত ওই আবেদন মঞ্জুর করে ডেবরা লাপরিভেটের সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য গতকাল দিন ধার্য করেন।
গতকাল সকালে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ও দুর্নীতি দমন কমিশনের প্রধান আইনজীবী আনিসুল হক আদালতে হাজির হন। সঙ্গে এববিআই কর্মকর্তা ডেবরাও আসেন। অন্যদিকে কারাগার থেকে মামুনকেও আদালতে হাজির করা হয়। পরে তাঁর আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন, ব্যারিস্টার ফখরুল ইসলাম, অ্যাডভোকেট সানা উল্লাহ মিয়া, ইকবাল হোসেন, মাসুদ আহমেদ তালুকদারসহ বিএনপির অনেক আইনজীবী আদালতে উপস্থিত হন। দুপুর ১১টার সময় আদালত এ মামলার কার্যক্রম শুরু করেন। এ সময় আসামি মামুনের পক্ষে এক দরখাস্ত দিয়ে ডেবরার সাক্ষ্যগ্রহণ মুলতবি রাখার আবেদন জানানো হয়।
খন্দকার মাহবুব হোসেন আদালতকে বলেন, এ পর্যায়ে এই সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ বেআইনি হবে। তিনি বলেন, এই সাক্ষী অভিযোগপত্রভুক্ত (চার্জশিট) সাক্ষী নন। অভিযোগপত্রভুক্ত সাক্ষীদের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হওয়ার পরই কেবল রাষ্ট্রপক্ষ অন্য সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ করতে পারে।
আদালত এ সময় রাষ্ট্রপক্ষের বক্তব্য জানতে চান। অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ও অ্যাডভোকেট আনিসুল হক বলেন, এ মুহূর্তে অভিযোগপত্রের বাইরের সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ করতে আইনগত কোনো বাধা নেই। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪০ ধারা আদালতে পড়ে শোনান। ওই ধারায় বলা হয়েছে, যেকোনো পর্যায়ে আদালত যেকোনো সাক্ষীর সাক্ষ্য নিতে পারেন।
আদালত এ পর্যায়ে আসামিপক্ষের আইনজীবীদের উদ্দেশ করে বলেন, 'সাক্ষ্যগ্রহণ করা যাবে না এ ধরনের আইন আপনাদের জানা আছে কি না।' আসামিপক্ষের আইনজীবীরা কোনো জবাব দিতে পারেননি। পরে আদালত আসামিপক্ষের সাক্ষ্যগ্রহণ মুলতবি রাখার আবেদন নামঞ্জুর করেন।
আদালত রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের বলেন, সাক্ষীকে সাক্ষীর কাঠগড়ায় তোলেন। তখন এফবিআই কর্মকর্তা ডেবরা সাক্ষীর কাঠগড়ায় যান। এ সময় আসামিপক্ষের আইনজীবীরা হৈচৈ করে আদালত বর্জনের ঘোষণা দিয়ে আদালত কক্ষ থেকে বেরিয়ে যান। পরে অ্যাডভোকেট সানা উল্লাহ মিয়ার নেতৃত্বে বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা আদালত চত্বরে মিছিল করেন।
ডেবরার জবানবন্দি শেষ হওয়ার পর আদালত মামুনকে জেরা করার আহ্বান জানালে মামুন সাক্ষীকে জেরা করবেন না বলে জানান। এরপর আদালত এ সাক্ষীর সাক্ষ্য সমাপ্ত ঘোষণা করেন। তখন আসামিপক্ষের আরেক আইনজীবী একটি দরখাস্ত দিয়ে মামলায় পরবর্তী সাক্ষীর সাক্ষ্য মুলতবি করার আবেদন জানান। আবেদনে বলা হয়, আদালতের আদেশের বিরুদ্ধে তাঁরা উচ্চ আদালতে যাবেন। এমনকি এ আদালত থেকে অন্য আদালতে মামলা স্থানান্তরের আবেদনও জানানো হবে বলে দরখাস্তে উল্লেখ করা হয়। দরখাস্তটি আগামী ধার্য তারিখে শুনানির জন্য নথিতে রাখার নির্দেশ দেন আদালত। একই সঙ্গে আগামী ৮ ডিসেম্বর পরবর্তী শুনানির তারিখ ধার্য করেন।
ডেবরার জবানবন্দি : ডেবরা লাপরিভেট প্রথমেই নিজের নাম, বাবার নাম, বয়স বলেন। তিনি ১৬ বছর এফবিআইয়ের এজেন্ট হিসেবে কর্মরত রয়েছেন বলে আদালতকে জানান। তিনি রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত হয়ে আদালতে সাক্ষ্য দিতে আসেননি বলেও আদালতকে জানান।
ডেবরা সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে জবানবন্দিতে বলেন, বাংলাদেশ থেকে যে অর্থ বিদেশে পাচার হয়েছে সে অর্থ খুঁজে বের করা ও উদ্ধার করার জন্য ২০০৭ সালে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সহায়তা চায়। সেই সূত্রে দুই দেশের সরকার একটি দ্বিপক্ষীয় চুক্তি করে এবং মিউচ্যুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্টেন্সের মাধ্যমে সহায়তা দিতে রাজি হয় যুক্তরাষ্ট্র। এরপর যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগ তদন্তে সহায়তা করার জন্য এফবিআইকে দায়িত্ব দেয়। তদন্ত পরিচালনার কাজটি পান ডেবরা। এরপর তিনি সিঙ্গাপুর এনসিটি ব্যাংকে তারেক-মামুনের সংশিষ্ট কাগজপত্র খতিয়ে দেখেন।
ডেবরা বলেন, তিনি পর্যবেক্ষণ করে দেখতে পান গিয়াসউদ্দিন আল মামুনের সিঙ্গাপুরের এনসিটি ব্যাংকের হিসাব থেকে তারেক রহমান ভিসা ক্রেডিট কার্ড পান। তিনি সেই কার্ডের মাধ্যমে মামুনের অ্যাকাউন্ট থেকে ৫০ হাজার ৬১৩ ইউএস ডলার ব্যয় করে বিদেশ ভ্রমণ, চিকিৎসা ও বিভিন্ন সামগ্রী কেনাকাটা করেন। তারেক রহমান ব্যাংকক, দুবাই, জার্মানিসহ কয়েকটি দেশে ভ্রমণ করার সময় সেখানকার বড় বড় শপিংমলে ভিসা কার্ডের মাধ্যমে এই কেনাকাটা করেন।
ডেবরা আদালতে আরো বলেন, অনুসন্ধান করে তিনি দেখেছেন, মামুনের নামেও একটি ভিসা ক্রেডিট কার্ড রয়েছে। তদন্তে ডেবরা আরো পর্যবেক্ষণ করেন, ২০০৩ সালের ১ আগস্ট বাংলাদেশের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নির্মাণ কনস্ট্রাকশন লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক খাদিজা ইসলাম সাত লাখ ৫০ হাজার ইউএস ডলার মামুনের অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর করেন।
এ পর্যায়ে ডেবরা তদন্ত চলাকালীন তারেক ও মামুনের ভিসা ক্রেডিট কার্ড পাওয়ার আবেদনপত্র, তাঁদের পাসপোর্ট, অন্যান্য সংশ্লিষ্ট কাগজপত্রসহ দুই বান্ডিলের একটি ৪১ পৃষ্ঠা ও অন্যটিতে ২২৯ পৃষ্ঠার তথ্য আদালতের অনুমতিক্রমে আদালতে দাখিল করেন।
সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে দুদকের আইনজীবী আনিসুল হক সাংবাদিকদের জানান, ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪০ ধারা অনুযায়ী মামলা প্রমাণের জন্য যেকোনো সময় অভিযোগপত্রের বাইরেও অতিরিক্ত সাক্ষী আদালতে হাজির করতে পারেন। এত দোষের কিছু নেই।
এর আগে আদালত থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় মামুনের আইনজীবী অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, ডেবরার সাক্ষ্য নেওয়ার ক্ষেত্রে আইন লঙ্ঘন করা হয়েছে। ডেবরা অভিযোগপত্রভুক্ত সাক্ষী নন। নিয়ম অনুযায়ী অভিযোগপত্রভুক্ত সাক্ষীদের সাক্ষ্য শোনার পর অভিযোগপত্রের বাইরের মনোনীত সাক্ষীর বক্তব্য নেওয়া যায়_এ ক্ষেত্রে তা করা হয়নি। ডেবরা জবানবন্দিতে যা বলেছেন এবং সাক্ষ্যের সমর্থনে যেসব কাগজপত্র দাখিল করেছেন, তা পর্যবেক্ষণের জন্য আসামিপক্ষের আইনজীবীদের সময় দেওয়া হয়নি বলেও অভিযোগ করেন তিনি। মামুনের আরেক আইনজীবী অ্যাডভোকেট সানা উল্লাহ মিয়া বলেন, সাক্ষ্যগ্রহণে আইন ভাঙার অভিযোগে তাঁরা উচ্চ আদালতে যাবেন।
গত ৮ আগস্ট একই আদালত এ মামলায় তারেক ও মামুনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন। ওই দিন তারেকের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও জারি করেন।
২০০৯ সালের ২৬ অক্টোবর দুর্নীতি দমন কমিশনের সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ ইব্রাহিম ক্যান্টনমেন্ট থানায় এ মামলা করেন। গত বছরের ৬ জুলাই তারেক রহমান ও তাঁর ব্যবসায়িক অংশীদার গিয়াসউদ্দিন আল মামুনের বিরুদ্ধে মামলার বাদী ও তদন্ত কর্মকর্তা দুদকের সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ ইব্রাহিম অভিযোগপত্র দাখিল করেন।
অভিযোগপত্রে বলা হয়, টঙ্গীর বিসিক শিল্প এলাকায় একটি ৮০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের কার্যক্রম শুরু হলে ওই কার্যাদেশ পাইয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে 'নির্মাণ কনস্ট্রাকশন লি.' কম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক খাদিজা ইসলামের কাছ থেকে তাঁরা দুজন মিলে ২০০৩ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০০৭ সালের ৩১ মে পর্যন্ত ২০ কোটি ৪১ লাখ ২৫ হাজার ৮৪৩ টাকা সিঙ্গাপুরের ৬৫ চুলিয়া স্ট্রিটের ওভারসিজ চায়নিজ ব্যাংকিং করপোরেশন লিমিটেডে (ওসিবিসি) পাচার করেন।

No comments

Powered by Blogger.