সেতুবন্ধ রচিত হবে কি?-সার্ক শীর্ষ সম্মেলন by হুমায়ুন কবির
মালদ্বীপে আজ বৃহস্পতিবার শুরু হচ্ছে সার্ক শীর্ষ সম্মেলন। দ্বীপরাজ্যের রাজধানী মালে থেকে ৫০০ কিলোমিটার দূরের শহর আড্ডুতে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর শীর্ষ নেতারা 'সেতুবন্ধ রচনা' করায় করণীয়গুলো নিয়ে আলোচনা করবেন। আঞ্চলিক যোগাযোগ বাড়ানোর বিষয়টি নিশ্চিতভাবেই প্রাধান্য পাবে। এ যোগাযোগ যানবাহন চলাচলে, সাহিত্য-সংস্কৃতিতে, ব্যবসা-বাণিজ্যে এবং মানুষে মানুষে। এ ক্ষেত্রে আদর্শ হিসেবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় আসিয়ানভুক্ত
দেশগুলো এবং ইউরোপে ইউরোপীয় ইউনিয়নকে গণ্য করা হয়। সার্ক প্রতিষ্ঠার পর ২৫ বছরেরও বেশি অতিক্রান্ত হয়েছে। নিয়মিত শীর্ষ সম্মেলনও অনুষ্ঠিত হচ্ছে। কিন্তু সংস্থাটি এখনও প্রত্যাশা থেকে দূরে রয়ে গেছে।
এবারের শীর্ষ সম্মেলনে কয়েকটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। যেমন, সার্ক সিড ব্যাংক স্থাপন, প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঘটনায় পরস্পরের পাশে দ্রুত দাঁড়ানো এবং পণ্যের ক্ষেত্রে আঞ্চলিক মান নির্ধারণ ব্যবস্থা। এসব ইস্যু বাংলাদেশের জন্য বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক। কেউ কেউ অভিযোগ করে থাকেন, সার্ক শীর্ষ সম্মেলন অনেকটা শীর্ষ নেতাদের বার্ষিক পুনর্মিলনীর মতো হয়ে পড়েছে। নেতৃবৃন্দ নিয়মিত বৈঠক করেন, সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়; কিন্তু তা কার্যকর করার বাস্তব উদ্যোগ তেমন দেখা যায় না। এ ধারণার অন্যতম কারণ সম্ভবত এটাই যে, ১৯৮৫ সালে এ সংস্থা তার যাত্রা শুরুর পর এ পর্যন্ত এমন কোনো উদ্যোগ বা পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেনি, যাকে এ অঞ্চলের দেড়শ' কোটির বেশি অধিবাসী নিজেদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য মনে করতে পেরেছে।
তবে সাম্প্রতিক সময়ের কিছু প্রবণতা আমাদের আশাবাদী করে তোলে। সার্ক দেশগুলোর মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য হালে বাড়তে শুরু করেছে। সম্প্রতি পাকিস্তান তার 'চির বৈরী প্রতিবেশী' ভারতকে বাণিজ্যে অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত দেশের মর্যাদা প্রদানে উদ্যোগী হয়েছে (ভারত পাকিস্তানকে এ সুবিধা আরও আগেই দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে)। ইউরোপ, আমেরিকা ও জাপানে অর্থনৈতিক মন্দা প্রকট। এ অবস্থায় দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো নিজেদের মধ্যে বাণিজ্য বাড়াতে আগ্রহী। উন্নত বিশ্বের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক থাকলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে না, এটা বেশি বেশি করে উপলব্ধিতে আসছে। একে অপরকে তার বাজার খুলে দিলে এবং কারও পণ্যের নির্ঝঞ্ঝাট প্রবেশে প্রতিবন্ধকতা গড়ে না তুললে নিজেদের মধ্যে বাণিজ্য বাড়বেই। এর সুফলও প্রতিটি দেশ ভোগ করবে। সার্ক দেশগুলো অভিন্ন পণ্য মান সংক্রান্ত চুক্তি সম্পাদন করলে বাণিজ্য বাড়াতে তা সহায়ক হবে।
প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময়ে একে অপরের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার প্রয়োজন এখন যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বাংলাদেশ, নেপাল, পাকিস্তান, মালদ্বীপ ও ভারত অনুভব করছে। ঘন ঘন দুর্যোগ নেমে আসছে এবং তার বেশ কয়েকটির আঘাত মারাত্মক। মালদ্বীপ তাদের বেশিরভাগ দ্বীপ তলিয়ে যেতে পারে বলে শঙ্কিত। নেপালের শঙ্কা হিমালয়ের বরফ গলে যাওয়া নিয়ে। বাংলাদেশের বিপুল অংশ জমি গ্রাস করে নেবে বঙ্গোপসাগর, এমন শঙ্কা জাতিসংঘ বিশেষজ্ঞদের। কোনো কোনো দুর্যোগ একসঙ্গে একাধিক দেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এ অবস্থায় প্রতিকার ও প্রতিরোধের জন্য পরস্পরের পাশে দাঁড়াতেই হবে।
গোটা বিশ্বেই এখন খাদ্য নিরাপত্তা গুরুতর সমস্যা। দক্ষিণ এশিয়ায়ও তা প্রকট। কখনও কখনও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে খাদ্য ও বিভিন্ন ধরনের কৃষিপণ্য উৎপাদনে সংকট দেখা দেয়। বাংলাদেশের জন্যও এটা বড় ধরনের সমস্যা। কৃষি কাজের জন্য আমাদের জমির পরিমাণ বেশি নয়। স্বল্প জমিতে অধিক খাদ্য ফলানোর চ্যালেঞ্জ আমাদের সামনে। আরও কয়েকটি দেশেরও একই সমস্যা। এ অবস্থায় সার্ক সিড ব্যাংক গড়ে তোলা হলে খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা সহজ হবে।
এবারে সার্কের ১৭তম শীর্ষ সম্মেলন। এটা সুলক্ষণ যে, সার্কভুক্ত প্রতিটি দেশেই গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার কাজ করছে এবং তাদের নেতারা সম্মেলনে উপস্থিত রয়েছেন। তবে এ উপলব্ধিও সবার মধ্যে রয়েছে যে, কেবল অবাধ ভোটাধিকারের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকার কায়েম হলেই সমাজের গণতন্ত্রায়ন নিশ্চিত হয় না। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার জন্য আরও অনেক কিছু করা প্রয়োজন_ এমন তাগিদ দিচ্ছে নাগরিক সমাজ। প্রতিবেশী ভারতে এখন দুর্নীতিবিরোধী কঠোর আইন প্রণয়নের জন্য সরকারের ওপর প্রবল চাপ তৈরি হয়েছে। তারা এমনকি পার্লামেন্টে পাসের জন্য এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট বিলও উপস্থাপন করছে। সার্কভুক্ত অন্যান্য দেশেও গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা আরও উন্নত করার জন্য তাগিদ বাড়ছে। একই সঙ্গে এ বিষয়ে নাগরিক সমাজের সমন্বিত উদ্যোগও লক্ষণীয়। সম্প্রতি নেপালে এ সংক্রান্ত একটি সম্মেলনে সুশাসন সংক্রান্ত খসড়া তৈরি হয়েছে, যা নিয়ে মালদ্বীপের শীর্ষ সম্মেলনে আলোচনা হবে বলে আশা করা যায়। একটি বিষয়ে এখন মোটামুটি সব দেশেই সাধারণ অভিমত রয়েছে যে, অগণতান্ত্রিক শাসন কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য হবে না। বাংলাদেশের সংবিধানেও বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে এ সংক্রান্ত গণতান্ত্রিক সনদ গৃহীত হলে প্রতিটি দেশেই এ মনোভাব আরও জোরালো হবে। সুশাসন জোরদার এখন গোটা অঞ্চলের সম্মিলিত প্রত্যাশা এবং তা পূরণে আট দেশের নেতৃত্বকে হাত মেলাতে হবে। এ ক্ষেত্রে তারা যেভাবে এতদিন চলেছেন তা থেকে কিছুটা নয় বরং যথেষ্ট সরে আসতে হবে। এ পরিবর্তন আনতে কি তারা প্রকৃতই আগ্রহী, তার প্রমাণ মিলতে পারে আজ ও আগামীকালের শীর্ষ সম্মেলনে।
হুমায়ুন কবির : সাবেক পররাষ্ট্র সচিব
এবারের শীর্ষ সম্মেলনে কয়েকটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। যেমন, সার্ক সিড ব্যাংক স্থাপন, প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঘটনায় পরস্পরের পাশে দ্রুত দাঁড়ানো এবং পণ্যের ক্ষেত্রে আঞ্চলিক মান নির্ধারণ ব্যবস্থা। এসব ইস্যু বাংলাদেশের জন্য বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক। কেউ কেউ অভিযোগ করে থাকেন, সার্ক শীর্ষ সম্মেলন অনেকটা শীর্ষ নেতাদের বার্ষিক পুনর্মিলনীর মতো হয়ে পড়েছে। নেতৃবৃন্দ নিয়মিত বৈঠক করেন, সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়; কিন্তু তা কার্যকর করার বাস্তব উদ্যোগ তেমন দেখা যায় না। এ ধারণার অন্যতম কারণ সম্ভবত এটাই যে, ১৯৮৫ সালে এ সংস্থা তার যাত্রা শুরুর পর এ পর্যন্ত এমন কোনো উদ্যোগ বা পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেনি, যাকে এ অঞ্চলের দেড়শ' কোটির বেশি অধিবাসী নিজেদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য মনে করতে পেরেছে।
তবে সাম্প্রতিক সময়ের কিছু প্রবণতা আমাদের আশাবাদী করে তোলে। সার্ক দেশগুলোর মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য হালে বাড়তে শুরু করেছে। সম্প্রতি পাকিস্তান তার 'চির বৈরী প্রতিবেশী' ভারতকে বাণিজ্যে অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত দেশের মর্যাদা প্রদানে উদ্যোগী হয়েছে (ভারত পাকিস্তানকে এ সুবিধা আরও আগেই দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে)। ইউরোপ, আমেরিকা ও জাপানে অর্থনৈতিক মন্দা প্রকট। এ অবস্থায় দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো নিজেদের মধ্যে বাণিজ্য বাড়াতে আগ্রহী। উন্নত বিশ্বের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক থাকলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে না, এটা বেশি বেশি করে উপলব্ধিতে আসছে। একে অপরকে তার বাজার খুলে দিলে এবং কারও পণ্যের নির্ঝঞ্ঝাট প্রবেশে প্রতিবন্ধকতা গড়ে না তুললে নিজেদের মধ্যে বাণিজ্য বাড়বেই। এর সুফলও প্রতিটি দেশ ভোগ করবে। সার্ক দেশগুলো অভিন্ন পণ্য মান সংক্রান্ত চুক্তি সম্পাদন করলে বাণিজ্য বাড়াতে তা সহায়ক হবে।
প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময়ে একে অপরের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার প্রয়োজন এখন যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বাংলাদেশ, নেপাল, পাকিস্তান, মালদ্বীপ ও ভারত অনুভব করছে। ঘন ঘন দুর্যোগ নেমে আসছে এবং তার বেশ কয়েকটির আঘাত মারাত্মক। মালদ্বীপ তাদের বেশিরভাগ দ্বীপ তলিয়ে যেতে পারে বলে শঙ্কিত। নেপালের শঙ্কা হিমালয়ের বরফ গলে যাওয়া নিয়ে। বাংলাদেশের বিপুল অংশ জমি গ্রাস করে নেবে বঙ্গোপসাগর, এমন শঙ্কা জাতিসংঘ বিশেষজ্ঞদের। কোনো কোনো দুর্যোগ একসঙ্গে একাধিক দেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এ অবস্থায় প্রতিকার ও প্রতিরোধের জন্য পরস্পরের পাশে দাঁড়াতেই হবে।
গোটা বিশ্বেই এখন খাদ্য নিরাপত্তা গুরুতর সমস্যা। দক্ষিণ এশিয়ায়ও তা প্রকট। কখনও কখনও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে খাদ্য ও বিভিন্ন ধরনের কৃষিপণ্য উৎপাদনে সংকট দেখা দেয়। বাংলাদেশের জন্যও এটা বড় ধরনের সমস্যা। কৃষি কাজের জন্য আমাদের জমির পরিমাণ বেশি নয়। স্বল্প জমিতে অধিক খাদ্য ফলানোর চ্যালেঞ্জ আমাদের সামনে। আরও কয়েকটি দেশেরও একই সমস্যা। এ অবস্থায় সার্ক সিড ব্যাংক গড়ে তোলা হলে খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা সহজ হবে।
এবারে সার্কের ১৭তম শীর্ষ সম্মেলন। এটা সুলক্ষণ যে, সার্কভুক্ত প্রতিটি দেশেই গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার কাজ করছে এবং তাদের নেতারা সম্মেলনে উপস্থিত রয়েছেন। তবে এ উপলব্ধিও সবার মধ্যে রয়েছে যে, কেবল অবাধ ভোটাধিকারের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকার কায়েম হলেই সমাজের গণতন্ত্রায়ন নিশ্চিত হয় না। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার জন্য আরও অনেক কিছু করা প্রয়োজন_ এমন তাগিদ দিচ্ছে নাগরিক সমাজ। প্রতিবেশী ভারতে এখন দুর্নীতিবিরোধী কঠোর আইন প্রণয়নের জন্য সরকারের ওপর প্রবল চাপ তৈরি হয়েছে। তারা এমনকি পার্লামেন্টে পাসের জন্য এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট বিলও উপস্থাপন করছে। সার্কভুক্ত অন্যান্য দেশেও গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা আরও উন্নত করার জন্য তাগিদ বাড়ছে। একই সঙ্গে এ বিষয়ে নাগরিক সমাজের সমন্বিত উদ্যোগও লক্ষণীয়। সম্প্রতি নেপালে এ সংক্রান্ত একটি সম্মেলনে সুশাসন সংক্রান্ত খসড়া তৈরি হয়েছে, যা নিয়ে মালদ্বীপের শীর্ষ সম্মেলনে আলোচনা হবে বলে আশা করা যায়। একটি বিষয়ে এখন মোটামুটি সব দেশেই সাধারণ অভিমত রয়েছে যে, অগণতান্ত্রিক শাসন কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য হবে না। বাংলাদেশের সংবিধানেও বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে এ সংক্রান্ত গণতান্ত্রিক সনদ গৃহীত হলে প্রতিটি দেশেই এ মনোভাব আরও জোরালো হবে। সুশাসন জোরদার এখন গোটা অঞ্চলের সম্মিলিত প্রত্যাশা এবং তা পূরণে আট দেশের নেতৃত্বকে হাত মেলাতে হবে। এ ক্ষেত্রে তারা যেভাবে এতদিন চলেছেন তা থেকে কিছুটা নয় বরং যথেষ্ট সরে আসতে হবে। এ পরিবর্তন আনতে কি তারা প্রকৃতই আগ্রহী, তার প্রমাণ মিলতে পারে আজ ও আগামীকালের শীর্ষ সম্মেলনে।
হুমায়ুন কবির : সাবেক পররাষ্ট্র সচিব
No comments