কৃষি অর্থনীতি, কৃষকের অর্থনীতি by মাহবুব হোসেন
এবারে প্রকৃতি খুব সদয় ছিল। নিয়মিত বৃষ্টির কারণে আমরা বলতে পারি এবার স্মরণকালের মধ্যে 'আমনের জন্য অন্যতম সেরা মৌসুম' ছিল। ফলন অতীতের রেকর্ড ছাড়িয়ে যাবে বলেই মনে হচ্ছে। এ অবস্থায় বোরো চাল যেসব চাষির ঘরে রয়েছে তারা গোলা খালি করতে শুরু করেছে। অতীতে আমন ধান ওঠার আগের দুটি মাস আশ্বিন-কার্তিককে মঙ্গার সময় বলে ধরা হতো। এ সময়ে ধান-চালের বাজার থাকত চড়া।
কিন্তু এবারে একেবারে ভিন্ন চিত্র_ বাজারে দাম বরং অন্য সময়ের তুলনায় কম। এখন মান ভেদে ৫০০-৬০০ টাকায় ধান বিক্রি হচ্ছে। তবে এর চেয়ে দাম কমবে বলে মনে হয় না। কারণ সচ্ছল কৃষকরা বোরো চাল বাজারে ছেড়ে আমন চাল দিয়ে গোলা ভরে ফেলবে
নতুন আমন ধান উঠতে না উঠতেই বাজারে চালের দাম কমতে শুরু করেছে। গত বছরের ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসের কথা আমরা স্মরণ করতে পারি। তখনও বোরো ধান কাটার সময় হয়নি। ধান-চালের বাজার ছিল ঊর্ধ্বমুখী। এপ্রিলের শেষ ও মে মাসের প্রথম দিকে নতুন চাল বাজারে আসার কথা। আবহাওয়া ভালো ছিল। তাই ধারণা করা হয়, নতুন চাল বাজারে এলে দামের ঊর্ধ্বগতিতে লাগাম পড়বে। দাম বাড়তে থাকায় সরকার আমদানি বাড়িয়ে বাজারে হস্তক্ষেপ করার সিদ্ধান্ত নেয়। আমাদের সতর্কবার্তা ছিল, আমদানি যেন হিসাব করে করা হয়। এপ্রিল পর্যন্ত যেন সমস্যা না হয়, তার প্রতি নজর রেখে দেশের বাজারে অন্য দেশ থেকে আনা চালের জোগান বাড়াতে হবে। নতুন ধান উঠলে বাজারে চাপ কমবে। কিন্তু এ সময়ে যদি আমদানি করা চাল দেশের বাজারে আসে তাহলে সরবরাহ বেশি হয়ে যাবে এবং বাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। অর্থাৎ দাম কমবে। বিশেষ করে উৎপাদকদের জন্য এমন পরিস্থিতি কাঙ্ক্ষিত নয়। কিন্তু দেখা গেল, সরকার প্রয়োজনের অতিরিক্ত চাল আমদানি করেছে। ফলে বাজারে সরবরাহ বেড়েছে এবং তাতে নতুন ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। বোরো ধান-চালের একটি অংশ কৃষক ও মিল মালিকদের গোলা-গুদামে রয়ে গেছে। এখন আমন মৌসুম শুরু হওয়ার আগে এ চাল বাজারে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে এবং বাজারে এর প্রভাব আমরা দেখছি। এ সময়ের অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, আমদানির প্রয়োজন হলে তা কেনা ও সরবরাহ সময়মতো হওয়া চাই। আমাদের ধান-চালের বাজারে দুটি প্রধান মৌসুম হচ্ছে আমন ও বোরো। এ সময়ে বাজারে জোগান বিপুলভাবে বেড়ে যায়। মৌসুমের সময়ে আমদানি করা চালের সরবরাহ বাড়লে উৎপাদক এবং ধান-চালের ব্যবসায়ী উভয়ের জন্য সমস্যা সৃষ্টি হয়।
সরকার প্রয়োজনের চেয়ে বেশি চাল আমদানি করায় খাদ্য বাজেটও স্ফীত হচ্ছে। ভর্তুকি বাড়ছে। ওপেন মার্কেট সেলে ৪৫ টাকায় আমদানি করা চাল ২৫ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে। এখন খাদ্যের বাজার সহনশীল। কিন্তু সরকারের গুদামে যেহেতু আমদানি এবং দেশীয় বাজার থেকে সংগ্রহ করা যথেষ্ট চাল রয়েছে, তাই কেনা দামের চেয়ে অনেক কমে সরকার তা বাজারে ছেড়ে দিচ্ছে। গুদাম খালি করতে হবে যে, নইলে আমন মৌসুমের চাল কোথায় রাখা হবে?
তবে আমাদের কৃষি অর্থনীতিতে যেসব পরিবর্তন ঘটে চলেছে সেটাও মনে রাখা দরকার। এখন কিন্তু সব কৃষক নতুন ধান ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই বাজারে তা বিক্রি করে দেয় না। ক্ষুদ্র কৃষকদের বিকল্প তেমন নেই। কিন্তু ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচির কারণে গ্রামের অনেক পরিবারে নগদ অর্থ থাকে। প্রবাসে কাজের সুবাদেও এখন গ্রামের অন্তত ২০ শতাংশ পরিবারে এক ধরনের সচ্ছলতা রয়েছে। তাই ধান ওঠার সময়ে যদি বাজারে দাম কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় না থাকে তাহলে অনেক কৃষক পরিবার তা ধরে রাখতে পারে। ঠিক এ কারণে আমদানি করা চালের সরবরাহ ভালো থাকলেও পাইকারি ও খুচরা বাজারে বোরো মৌসুমে ধান-চালের দাম তেমন কমেনি। বাজার চড়া হওয়ার জন্য কৃষকরা অপেক্ষা করে। তবে বাজার খুব একটা না বাড়ায় তারা আশাহত হয় এবং এখন আমন ধান ওঠার শুরুতে তারা এ মজুদ ছেড়ে দিতে শুরু করেছে।
এবারে প্রকৃতি খুব সদয় ছিল। নিয়মিত বৃষ্টির কারণে আমরা বলতে পারি এবার স্মরণকালের মধ্যে 'আমনের জন্য অন্যতম সেরা মৌসুম' ছিল। ফলন অতীতের রেকর্ড ছাড়িয়ে যাবে বলেই মনে হচ্ছে। এ অবস্থায় বোরো চাল যেসব চাষির ঘরে রয়েছে তারা গোলা খালি করতে শুরু করেছে। অতীতে আমন ধান ওঠার আগের দুটি মাস আশ্বিন-কার্তিককে মঙ্গার সময় বলে ধরা হতো। এ সময়ে ধান-চালের বাজার থাকত চড়া। কিন্তু এবারে একেবারে ভিন্ন চিত্র_ বাজারে দাম বরং অন্য সময়ের তুলনায় কম। এখন মানভেদে ৫০০-৬০০ টাকায় ধান বিক্রি হচ্ছে। তবে এর চেয়ে দাম কমবে বলে মনে হয় না। কারণ সচ্ছল কৃষকরা বোরো চাল বাজারে ছেড়ে আমন চাল দিয়ে গোলা ভরে ফেলবে। তারা বাজার একটু ভালো হওয়ার জন্য অপেক্ষা করবে।
আমাদের দেশে খাদ্যসহ নানা ধরনের পণ্যে সিন্ডিকেটের কথা বলা হয়। কিন্তু খাদ্যশস্যের বাজার পর্যবেক্ষণ করে বলা যায়, এখানে বিষয়টি তেমন কার্যকর নয়। বরং প্রতিযোগিতা রয়েছে এবং এর প্রভাবও সময় সময় বাজারে পড়ছে।
এখন দেখা যাক, আমন মৌসুমের শুরুতে ধান-চালের দাম কমতে থাকার কী প্রভাব বাজারে পড়বে। একটি বিষয় স্পষ্ট যে, বাজারে দাম তুলনামূলক কম থাকায় কৃষকের আয় কমবে। এখন উৎপাদন ব্যয় বেশি পড়ছে। চাষাবাদের জন্য মজুরি বেশি দিতে হয়। সার-ডিজেলের দামও বেড়েছে। তবে আমন ও বোরো মৌসুমে এ খাতে খরচে তারতম্য রয়েছে। বোরো মৌসুমে সেচের পানির জন্য কৃষককে প্রচুর ব্যয় করতে হয়। সারও প্রয়োগ করতে হয় প্রচুর। কিন্তু আমনে সেচের কাজ করে দেয় প্রকৃতি। এবারে প্রকৃতি ছিল আরও সদয়। বন্যা হয়নি। নিয়মিত বৃষ্টিপাত হওয়ায় সম্পূরক সেচের প্রয়োজন পড়েনি। তবে বোরো ধানের ফলন আমনের তুলনায় কিছুটা বেশি হয়। চুলচেরা হিসাবে দেখা যায়, কেজিপ্রতি আমন ও বোরো ধানের উৎপাদন ব্যয় প্রায় কাছাকাছি। তারপরও আমনে ব্যয় একটু কমই পড়ে। তাই বাজার কিছুটা পড়তির দিকে হলেও কৃষকের লোকসান হবে না।
গত তিন-চার বছর সচ্ছল কৃষকরা ধান-চাল থেকে ভালো লাভ করেছে। ধানের দাম পেয়েছে গড়ে ৮০০ টাকারও বেশি। এবারে যদি ৫০০-৬০০ টাকায় বিক্রি করতে হয়, তবে তারা হতাশ হবেই।
এখন প্রশ্ন, ভালো মার্জিন না পেলে তারা কি আগামী বোরো মৌসুমে ধান চাষে নিরুৎসাহিত হবে? তারা কি চাষাবাদের জমি কমিয়ে দেবে? এটা সম্ভবত ঘটবে না। কারণ কৃষকের বিকল্প তেমন নেই। বোরো মৌসুমে বিকল্প ফসল হতে পারে আলু। এবারে আলুর ফলন ভালো ছিল এবং কৃষকরা তেমন লাভবান হতে পারেনি। পাটের এলাকা সীমিত। গত বছর পাটের বাজার ছিল তেজি। কিন্তু এবারের চিত্র ভিন্ন_ বাজার চরম মন্দা। তাই কৃষকের বিকল্প কোথায়? কিছু জমি ভুট্টা চাষের জন্য ব্যবহার হতে পারে। তবে কৃষককে মূলত ধান চাষেই থাকতে হবে। তবে আমন ধানে কাঙ্ক্ষিত দাম না মিললে তারা বোরো চাষ প্রচুর জমিতে করলেও ক্ষেতের পরিচর্যা কমিয়ে দিতে পারে। তারা সেচের পানি ও সারের যথাযথ ব্যবহার না-ও করতে পারে। তবে ২-৩ মাস পর যদি ধানের দাম বেড়ে যায়. তাহলে বোরো চাষে আসবে নতুন উৎসাহ। বিশ্ববাজারও তাদের জন্য উৎসাহ সৃষ্টি করতে পারে। এ বাজারে চালের জোগান আসে প্রধানত থাইল্যান্ড, পাকিস্তান, ভিয়েতনাম ও ভারত থেকে। থাইল্যান্ডে বন্যার প্রকোপ মারাত্মক। অথচ এ দেশটিই বিশ্বের চালের বাজারের এক-তৃতীয়াংশ নিয়ন্ত্রণ করে। তাদের রফতানি কমলে বাজারে এর প্রভাব পড়বেই। এর সুযোগ নিতে চেষ্টা করবে ভিয়েতনাম। ভারতে প্রচুর ধান হলেও তাদের অভ্যন্তরীণ বাজারের কথা চিন্তা করতে হয়। সে দেশের সরকার ধান-চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে মাঝে মধ্যেই রফতানির ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে। বেসরকারি খাতের ব্যবসায়ীরা চাইলেই রফতানি করতে পারে না। তাছাড়া সামনে রয়েছে সাধারণ নির্বাচন। মূল্যস্ফীতির হারও চড়া। এ কারণে বাজার স্থিতিশীল রাখার জন্য চাল রফতানিতে নিষেধজ্ঞা আসা অসম্ভব নয়। কিছুদিন আগে পেঁয়াজ রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল অভ্যন্তরীণ বাজার স্থিতিশীল রাখার জন্য। এ অবস্থায় জানুয়ারির দিকে বিশ্ববাজার ঊর্ধ্বমুখী হতেই পারে। এখন প্রতি টন চাল মেলে ৫০০ থেকে ৬০০ ডলারে। সেটা বেড়ে ৭০০-৮০০ ডলার হওয়া অসম্ভব নয়। অথচ চাহিদা ও সরবরাহে ভারসাম্যের কারণে বাংলাদেশের চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। আমাদের বিশ্ববাজারের ওপর এই মুহূর্তে নির্ভরতা নেই। কিন্তু বিশ্ববাজার অস্থির হলে বিশ্বায়নের যুগে আমরা তা থেকে মুক্ত থাকতে পারব বলে মনে হয় না। বিশ্ববাজারে ভালো দাম পেলে আমাদের ব্যবসায়ীরা কিছু চাল রফতানিও করে দিতে পারে। এর ফলে বাজার ঊর্ধ্বমুখী হওয়া অসম্ভব নয়।
এ অবস্থায় সরকারের পলিসি অবস্থান কী হবে, সেটাই প্রশ্ন। তাদের প্রথম কাজ হবে কৃষকরা যেন ধান চাষে নিরুৎসাহিত না হয় সেটা নিশ্চিত করা। তাদের আমন চাল সংগ্রহ করতেই হবে। এটাও মনে রাখতে হবে, বিশ্ববাজার থেকে কেনার চেয়ে দেশের কৃষকদের কাছ থেকে কিনলে ধানের বাজার যেমন পড়ে যাবে না, তেমনি সরকারের ব্যয়ও তুলনামূলক কম পড়বে। তাছাড়া এ ক্রয় হবে দেশীয় মুদ্রায়, বিদেশি মুদ্রার মজুদে যে চাপ রয়েছে তাতে সরকারকে হাত দিতে হবে না।
দ্বিতীয়ত, সরকারের গুদামে এখনও যে খাদ্যশস্য রয়েছে সেটা ছেড়ে দিতে হবে। এ জন্য খাদ্যের বিনিময়ে কাজ কর্মসূচি চালু করতে হবে। শীত মৌসুমে উপকূল এলাকায় বাঁধ রক্ষণাবেক্ষণ এবং দেশের বিভিন্ন এলাকায় হাজামজা খাল খনন ও পুনঃখননের কাজ করা যায়। তবে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে বিলম্ব করলে চলবে না। বর্ষায় এ কাজে হাত দিলে তা হবে পানিতে চাল ঢালা। সময়ের কাজ সময়ে না করলে তার মূল্য দিতে হয় এবং অনেক সময় তা যথেষ্ট চড়া হয়ে থাকে। একইসঙ্গে এ সময়ে যাতে আমদানি করা চাল বাজারে না আসে সেটাও নিশ্চিত করা চাই। ভারত ৩ লাখ টন চাল বাংলাদেশে বিক্রি করতে চায় বলে শোনা যাচ্ছে। এ সময়ে তা এমনকি কম দামে পেলেও কেনার যুক্তি নেই। এ চাল বাজারে এলে বিপর্যয় ঘটতে পারে কৃষি অর্থনীতিতে। অর্থনীতির অন্যান্য শাখাও তাতে আক্রান্ত হওয়ার শঙ্কা থাকে।
কৃষি অর্থনীতির কারণে আমরা খানিকটা স্বস্তির অবস্থানে রয়েছি। বাজারে কেবল দাম বাড়ে_ এ চিত্র এখন নেই। কিন্তু খানিকটা হতাশ কৃষকরা। তবে এটাও কিন্তু মনে রাখা দরকার, দ্রুতই বিশ্ববাজারের চিত্র পাল্টে যেতে পারে এবং তাতে কিন্তু আমাদের বাজারেও আগুন লাগা অসম্ভব নয়। এ কারণে নিজের ক্ষেত-খামারে যেমন মনোযোগ বাড়াতে হবে, তেমনি বিশ্বের কোন বাজারে কী ঘটছে তারও খোঁজখবর রেখে সময়োপযোগী ও দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করা চাই।
ড. মাহবুব হোসেন :অর্থনীতিবিদ এবং প্রধান নির্বাহী, ব্র্যাক
নতুন আমন ধান উঠতে না উঠতেই বাজারে চালের দাম কমতে শুরু করেছে। গত বছরের ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসের কথা আমরা স্মরণ করতে পারি। তখনও বোরো ধান কাটার সময় হয়নি। ধান-চালের বাজার ছিল ঊর্ধ্বমুখী। এপ্রিলের শেষ ও মে মাসের প্রথম দিকে নতুন চাল বাজারে আসার কথা। আবহাওয়া ভালো ছিল। তাই ধারণা করা হয়, নতুন চাল বাজারে এলে দামের ঊর্ধ্বগতিতে লাগাম পড়বে। দাম বাড়তে থাকায় সরকার আমদানি বাড়িয়ে বাজারে হস্তক্ষেপ করার সিদ্ধান্ত নেয়। আমাদের সতর্কবার্তা ছিল, আমদানি যেন হিসাব করে করা হয়। এপ্রিল পর্যন্ত যেন সমস্যা না হয়, তার প্রতি নজর রেখে দেশের বাজারে অন্য দেশ থেকে আনা চালের জোগান বাড়াতে হবে। নতুন ধান উঠলে বাজারে চাপ কমবে। কিন্তু এ সময়ে যদি আমদানি করা চাল দেশের বাজারে আসে তাহলে সরবরাহ বেশি হয়ে যাবে এবং বাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। অর্থাৎ দাম কমবে। বিশেষ করে উৎপাদকদের জন্য এমন পরিস্থিতি কাঙ্ক্ষিত নয়। কিন্তু দেখা গেল, সরকার প্রয়োজনের অতিরিক্ত চাল আমদানি করেছে। ফলে বাজারে সরবরাহ বেড়েছে এবং তাতে নতুন ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। বোরো ধান-চালের একটি অংশ কৃষক ও মিল মালিকদের গোলা-গুদামে রয়ে গেছে। এখন আমন মৌসুম শুরু হওয়ার আগে এ চাল বাজারে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে এবং বাজারে এর প্রভাব আমরা দেখছি। এ সময়ের অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, আমদানির প্রয়োজন হলে তা কেনা ও সরবরাহ সময়মতো হওয়া চাই। আমাদের ধান-চালের বাজারে দুটি প্রধান মৌসুম হচ্ছে আমন ও বোরো। এ সময়ে বাজারে জোগান বিপুলভাবে বেড়ে যায়। মৌসুমের সময়ে আমদানি করা চালের সরবরাহ বাড়লে উৎপাদক এবং ধান-চালের ব্যবসায়ী উভয়ের জন্য সমস্যা সৃষ্টি হয়।
সরকার প্রয়োজনের চেয়ে বেশি চাল আমদানি করায় খাদ্য বাজেটও স্ফীত হচ্ছে। ভর্তুকি বাড়ছে। ওপেন মার্কেট সেলে ৪৫ টাকায় আমদানি করা চাল ২৫ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে। এখন খাদ্যের বাজার সহনশীল। কিন্তু সরকারের গুদামে যেহেতু আমদানি এবং দেশীয় বাজার থেকে সংগ্রহ করা যথেষ্ট চাল রয়েছে, তাই কেনা দামের চেয়ে অনেক কমে সরকার তা বাজারে ছেড়ে দিচ্ছে। গুদাম খালি করতে হবে যে, নইলে আমন মৌসুমের চাল কোথায় রাখা হবে?
তবে আমাদের কৃষি অর্থনীতিতে যেসব পরিবর্তন ঘটে চলেছে সেটাও মনে রাখা দরকার। এখন কিন্তু সব কৃষক নতুন ধান ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই বাজারে তা বিক্রি করে দেয় না। ক্ষুদ্র কৃষকদের বিকল্প তেমন নেই। কিন্তু ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচির কারণে গ্রামের অনেক পরিবারে নগদ অর্থ থাকে। প্রবাসে কাজের সুবাদেও এখন গ্রামের অন্তত ২০ শতাংশ পরিবারে এক ধরনের সচ্ছলতা রয়েছে। তাই ধান ওঠার সময়ে যদি বাজারে দাম কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় না থাকে তাহলে অনেক কৃষক পরিবার তা ধরে রাখতে পারে। ঠিক এ কারণে আমদানি করা চালের সরবরাহ ভালো থাকলেও পাইকারি ও খুচরা বাজারে বোরো মৌসুমে ধান-চালের দাম তেমন কমেনি। বাজার চড়া হওয়ার জন্য কৃষকরা অপেক্ষা করে। তবে বাজার খুব একটা না বাড়ায় তারা আশাহত হয় এবং এখন আমন ধান ওঠার শুরুতে তারা এ মজুদ ছেড়ে দিতে শুরু করেছে।
এবারে প্রকৃতি খুব সদয় ছিল। নিয়মিত বৃষ্টির কারণে আমরা বলতে পারি এবার স্মরণকালের মধ্যে 'আমনের জন্য অন্যতম সেরা মৌসুম' ছিল। ফলন অতীতের রেকর্ড ছাড়িয়ে যাবে বলেই মনে হচ্ছে। এ অবস্থায় বোরো চাল যেসব চাষির ঘরে রয়েছে তারা গোলা খালি করতে শুরু করেছে। অতীতে আমন ধান ওঠার আগের দুটি মাস আশ্বিন-কার্তিককে মঙ্গার সময় বলে ধরা হতো। এ সময়ে ধান-চালের বাজার থাকত চড়া। কিন্তু এবারে একেবারে ভিন্ন চিত্র_ বাজারে দাম বরং অন্য সময়ের তুলনায় কম। এখন মানভেদে ৫০০-৬০০ টাকায় ধান বিক্রি হচ্ছে। তবে এর চেয়ে দাম কমবে বলে মনে হয় না। কারণ সচ্ছল কৃষকরা বোরো চাল বাজারে ছেড়ে আমন চাল দিয়ে গোলা ভরে ফেলবে। তারা বাজার একটু ভালো হওয়ার জন্য অপেক্ষা করবে।
আমাদের দেশে খাদ্যসহ নানা ধরনের পণ্যে সিন্ডিকেটের কথা বলা হয়। কিন্তু খাদ্যশস্যের বাজার পর্যবেক্ষণ করে বলা যায়, এখানে বিষয়টি তেমন কার্যকর নয়। বরং প্রতিযোগিতা রয়েছে এবং এর প্রভাবও সময় সময় বাজারে পড়ছে।
এখন দেখা যাক, আমন মৌসুমের শুরুতে ধান-চালের দাম কমতে থাকার কী প্রভাব বাজারে পড়বে। একটি বিষয় স্পষ্ট যে, বাজারে দাম তুলনামূলক কম থাকায় কৃষকের আয় কমবে। এখন উৎপাদন ব্যয় বেশি পড়ছে। চাষাবাদের জন্য মজুরি বেশি দিতে হয়। সার-ডিজেলের দামও বেড়েছে। তবে আমন ও বোরো মৌসুমে এ খাতে খরচে তারতম্য রয়েছে। বোরো মৌসুমে সেচের পানির জন্য কৃষককে প্রচুর ব্যয় করতে হয়। সারও প্রয়োগ করতে হয় প্রচুর। কিন্তু আমনে সেচের কাজ করে দেয় প্রকৃতি। এবারে প্রকৃতি ছিল আরও সদয়। বন্যা হয়নি। নিয়মিত বৃষ্টিপাত হওয়ায় সম্পূরক সেচের প্রয়োজন পড়েনি। তবে বোরো ধানের ফলন আমনের তুলনায় কিছুটা বেশি হয়। চুলচেরা হিসাবে দেখা যায়, কেজিপ্রতি আমন ও বোরো ধানের উৎপাদন ব্যয় প্রায় কাছাকাছি। তারপরও আমনে ব্যয় একটু কমই পড়ে। তাই বাজার কিছুটা পড়তির দিকে হলেও কৃষকের লোকসান হবে না।
গত তিন-চার বছর সচ্ছল কৃষকরা ধান-চাল থেকে ভালো লাভ করেছে। ধানের দাম পেয়েছে গড়ে ৮০০ টাকারও বেশি। এবারে যদি ৫০০-৬০০ টাকায় বিক্রি করতে হয়, তবে তারা হতাশ হবেই।
এখন প্রশ্ন, ভালো মার্জিন না পেলে তারা কি আগামী বোরো মৌসুমে ধান চাষে নিরুৎসাহিত হবে? তারা কি চাষাবাদের জমি কমিয়ে দেবে? এটা সম্ভবত ঘটবে না। কারণ কৃষকের বিকল্প তেমন নেই। বোরো মৌসুমে বিকল্প ফসল হতে পারে আলু। এবারে আলুর ফলন ভালো ছিল এবং কৃষকরা তেমন লাভবান হতে পারেনি। পাটের এলাকা সীমিত। গত বছর পাটের বাজার ছিল তেজি। কিন্তু এবারের চিত্র ভিন্ন_ বাজার চরম মন্দা। তাই কৃষকের বিকল্প কোথায়? কিছু জমি ভুট্টা চাষের জন্য ব্যবহার হতে পারে। তবে কৃষককে মূলত ধান চাষেই থাকতে হবে। তবে আমন ধানে কাঙ্ক্ষিত দাম না মিললে তারা বোরো চাষ প্রচুর জমিতে করলেও ক্ষেতের পরিচর্যা কমিয়ে দিতে পারে। তারা সেচের পানি ও সারের যথাযথ ব্যবহার না-ও করতে পারে। তবে ২-৩ মাস পর যদি ধানের দাম বেড়ে যায়. তাহলে বোরো চাষে আসবে নতুন উৎসাহ। বিশ্ববাজারও তাদের জন্য উৎসাহ সৃষ্টি করতে পারে। এ বাজারে চালের জোগান আসে প্রধানত থাইল্যান্ড, পাকিস্তান, ভিয়েতনাম ও ভারত থেকে। থাইল্যান্ডে বন্যার প্রকোপ মারাত্মক। অথচ এ দেশটিই বিশ্বের চালের বাজারের এক-তৃতীয়াংশ নিয়ন্ত্রণ করে। তাদের রফতানি কমলে বাজারে এর প্রভাব পড়বেই। এর সুযোগ নিতে চেষ্টা করবে ভিয়েতনাম। ভারতে প্রচুর ধান হলেও তাদের অভ্যন্তরীণ বাজারের কথা চিন্তা করতে হয়। সে দেশের সরকার ধান-চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে মাঝে মধ্যেই রফতানির ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে। বেসরকারি খাতের ব্যবসায়ীরা চাইলেই রফতানি করতে পারে না। তাছাড়া সামনে রয়েছে সাধারণ নির্বাচন। মূল্যস্ফীতির হারও চড়া। এ কারণে বাজার স্থিতিশীল রাখার জন্য চাল রফতানিতে নিষেধজ্ঞা আসা অসম্ভব নয়। কিছুদিন আগে পেঁয়াজ রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল অভ্যন্তরীণ বাজার স্থিতিশীল রাখার জন্য। এ অবস্থায় জানুয়ারির দিকে বিশ্ববাজার ঊর্ধ্বমুখী হতেই পারে। এখন প্রতি টন চাল মেলে ৫০০ থেকে ৬০০ ডলারে। সেটা বেড়ে ৭০০-৮০০ ডলার হওয়া অসম্ভব নয়। অথচ চাহিদা ও সরবরাহে ভারসাম্যের কারণে বাংলাদেশের চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। আমাদের বিশ্ববাজারের ওপর এই মুহূর্তে নির্ভরতা নেই। কিন্তু বিশ্ববাজার অস্থির হলে বিশ্বায়নের যুগে আমরা তা থেকে মুক্ত থাকতে পারব বলে মনে হয় না। বিশ্ববাজারে ভালো দাম পেলে আমাদের ব্যবসায়ীরা কিছু চাল রফতানিও করে দিতে পারে। এর ফলে বাজার ঊর্ধ্বমুখী হওয়া অসম্ভব নয়।
এ অবস্থায় সরকারের পলিসি অবস্থান কী হবে, সেটাই প্রশ্ন। তাদের প্রথম কাজ হবে কৃষকরা যেন ধান চাষে নিরুৎসাহিত না হয় সেটা নিশ্চিত করা। তাদের আমন চাল সংগ্রহ করতেই হবে। এটাও মনে রাখতে হবে, বিশ্ববাজার থেকে কেনার চেয়ে দেশের কৃষকদের কাছ থেকে কিনলে ধানের বাজার যেমন পড়ে যাবে না, তেমনি সরকারের ব্যয়ও তুলনামূলক কম পড়বে। তাছাড়া এ ক্রয় হবে দেশীয় মুদ্রায়, বিদেশি মুদ্রার মজুদে যে চাপ রয়েছে তাতে সরকারকে হাত দিতে হবে না।
দ্বিতীয়ত, সরকারের গুদামে এখনও যে খাদ্যশস্য রয়েছে সেটা ছেড়ে দিতে হবে। এ জন্য খাদ্যের বিনিময়ে কাজ কর্মসূচি চালু করতে হবে। শীত মৌসুমে উপকূল এলাকায় বাঁধ রক্ষণাবেক্ষণ এবং দেশের বিভিন্ন এলাকায় হাজামজা খাল খনন ও পুনঃখননের কাজ করা যায়। তবে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে বিলম্ব করলে চলবে না। বর্ষায় এ কাজে হাত দিলে তা হবে পানিতে চাল ঢালা। সময়ের কাজ সময়ে না করলে তার মূল্য দিতে হয় এবং অনেক সময় তা যথেষ্ট চড়া হয়ে থাকে। একইসঙ্গে এ সময়ে যাতে আমদানি করা চাল বাজারে না আসে সেটাও নিশ্চিত করা চাই। ভারত ৩ লাখ টন চাল বাংলাদেশে বিক্রি করতে চায় বলে শোনা যাচ্ছে। এ সময়ে তা এমনকি কম দামে পেলেও কেনার যুক্তি নেই। এ চাল বাজারে এলে বিপর্যয় ঘটতে পারে কৃষি অর্থনীতিতে। অর্থনীতির অন্যান্য শাখাও তাতে আক্রান্ত হওয়ার শঙ্কা থাকে।
কৃষি অর্থনীতির কারণে আমরা খানিকটা স্বস্তির অবস্থানে রয়েছি। বাজারে কেবল দাম বাড়ে_ এ চিত্র এখন নেই। কিন্তু খানিকটা হতাশ কৃষকরা। তবে এটাও কিন্তু মনে রাখা দরকার, দ্রুতই বিশ্ববাজারের চিত্র পাল্টে যেতে পারে এবং তাতে কিন্তু আমাদের বাজারেও আগুন লাগা অসম্ভব নয়। এ কারণে নিজের ক্ষেত-খামারে যেমন মনোযোগ বাড়াতে হবে, তেমনি বিশ্বের কোন বাজারে কী ঘটছে তারও খোঁজখবর রেখে সময়োপযোগী ও দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করা চাই।
ড. মাহবুব হোসেন :অর্থনীতিবিদ এবং প্রধান নির্বাহী, ব্র্যাক
No comments