শিক্ষা-মানসম্মত উচ্চশিক্ষার দুর্গম পথ by মোঃ আসাদুল্লাহ

বেষণার জন্য বরাদ্দ না বাড়ালে উচ্চশিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ শুধু পাঠদান তথা জ্ঞান বিতরণ নয়, নতুন জ্ঞানেরও সৃষ্টি করা। প্রথম কাজটি সাফল্যের সঙ্গে সম্পন্ন করা গেলেও দ্বিতীয় কাজটিতে আশানুরূপ সাফল্য অর্জিত হয়নি। এ বছর উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের তুলনায় উচ্চশিক্ষার সুযোগ সীমিত। সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় মিলিয়েও সংস্থান করা কার্যত অসম্ভব। তাই রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে একটা সময়োচিত পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি
উচ্চশিক্ষা নাগরিকের অধিকার। তাদের এ অধিকারের প্রতি সম্মান দেওয়া রাষ্ট্রের দায়িত্ব। দেশে জনসংখ্যা যেমনি বাড়ছে, তেমনি বাড়ছে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাস করা ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা। আর এ অধিকারের প্রতি সম্মান জানিয়ে দেশে নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হচ্ছে। স্বাধীনতার আগে যেখানে ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয় (দুটি কারিগরি, চারটি সাধারণ) ছিল সেখানে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে বর্তমানে চালু বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৮৪টি (সরকারি ৩৩টি, বেসরকারি ৫১টি)। এ ছাড়া আরও কিছু সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা পর্যায়ে রয়েছে। সুতরাং উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে একটা অগ্রগতি যে হয়েছে সেটা ধরে নেওয়া যায়। যদিও শিক্ষার মান নিয়ে নানা মহলের নানাবিধ প্রশ্ন রয়েছে তারপরও দেশের মানবসম্পদ উন্নয়নে বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান অস্বীকার করা যায় না। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে মানসম্মত শিক্ষার জন্য যেটা সব থেকে বেশি প্রয়োজন সেটা হলো মানসম্মত শিক্ষক। শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে বর্তমানে প্রচলিত মৌখিক পরীক্ষার পাশাপাশি লিখিত পরীক্ষা ও ক্লাস উপস্থাপনা জরুরি। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে মৌখিক পরীক্ষার পাশাপাশি লিখিত পরীক্ষা নেওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। তবে লিখিত পরীক্ষা নেওয়া হোক বা না হোক ক্লাস উপস্থাপনা খুবই জরুরি। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়েরই নিজস্ব আইন রয়েছে। আইনের ভেতরে থেকে তারা এটার প্রচলন করতে পারে। অবশ্য এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দিতে পারে। শিক্ষক নিয়োগের পর শিক্ষকদের পেশাগত উন্নয়নে শিক্ষক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাটাও জরুরি, যেখানে নবীন শিক্ষকদের গবেষণাসহ উচ্চতর ডিগ্রি গ্রহণ করতে উৎসাহিত করতে হবে। এ জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বা সরকার তথা মঞ্জুরি কমিশন 'ফান্ডে'র ব্যবস্থা করবে অথবা বিদেশি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে শিক্ষা বিনিময়ের আওতা সম্প্রসারণের উদ্যোগ গ্রহণ করবে। সুতরাং শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করার জন্য একদিকে যেমন প্রয়োজন বিজ্ঞানসম্মত ও স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ করা, তেমনি অন্যদিকে প্রয়োজন নিয়োগের পরে চাহিদাভিত্তিক যুগোপযোগী পৌনঃপুনিক শিক্ষক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শিক্ষকদের পেশাগত উৎকর্ষ সাধন করা। দেশের প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় সদ্য প্রতিষ্ঠিত অপেক্ষাকৃত নবীন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করাটা অত্যন্ত জরুরি। কেননা এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে সিনিয়র শিক্ষকদের সংখ্যা এমনিতেই কম থাকে, তার ওপর নবীন শিক্ষকদের মাত্রাতিরিক্ত দায়িত্ব পালনসহ প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনার অভাবে নিজেকে উন্নয়ন করার ব্যাপারটা একটু কঠিন হয়ে পড়ে। তাই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যদি স্বউদ্যোগে নবীন শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে অথবা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন সহযোগিতা করে, তাহলে কিছুটা হলেও অন্তত শিক্ষা ও শিক্ষকের মান ধরে রাখা সম্ভব হবে। শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিতকল্পে আরেকটি ব্যাপার খুবই গুরুত্বপূর্ণ, সেটি হচ্ছে একটি অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিল গঠন। এ কাউন্সিল দেশের ৩৩টি সরকারি ও ৫১টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান নির্ণয় করবে। ইতিমধ্যে সরকার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান নির্ণয়ের জন্য অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিল গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এ উদ্যোগ অবশ্যই সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। ফলে অভিভাবকসহ শিক্ষার্থীরা নিশ্চিত হতে পারবেন যে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের মান কী রকম। সরকার বা মঞ্জুরি কমিশন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্যও একটি অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিল গঠন করতে পারে। তাদের কর্মপরিধির মধ্যে থাকবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষা ও শিক্ষকদের মান যাচাই, পরীক্ষা পদ্ধতি বিশেল্গষণ, শিক্ষা কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করাসহ আনুষঙ্গিক বিষয়গুলো তদারকি করা। শিক্ষকদের পেশাগত দক্ষতা মূল্যায়নে গবেষণা, প্রকাশনার পাশাপাশি ছাত্রছাত্রী কর্তৃক মূল্যায়নের বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে। শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধাসহ জবাবদিহিতার বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা উচিত। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের নির্দেশনা ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের আন্তরিকতা একত্র করা গেলেই মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব। বাংলাদেশে এমনও সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে যেখানে ছাত্রছাত্রীরা তাদের নির্ধারিত মেয়াদের মধ্যে ডিগ্রি শেষ করে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করে। হরতাল-ধর্মঘটসহ রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা কোনো কিছুই শিক্ষাদান কর্মকাণ্ডে বিঘ্ন ঘটাতে পারে না। ছাত্রছাত্রী, শিক্ষকমণ্ডলী তথা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের আন্তরিকতার কারণেই এটা সম্ভব হয়। আমরা জানি যে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সরকারি মঞ্জুরি ব্যতীত আর কোনো নিজস্ব আয় নেই। শিক্ষার্থীদের প্রদত্ত বেতন থেকে প্রাপ্ত আয় অতি নগণ্য। সরকারি বরাদ্দের সিংহভাগই ব্যয় হয় শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা প্রদানে। এহেন পরিস্থিতিতে গবেষণার জন্য বরাদ্দ না বাড়ালে উচ্চশিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ শুধু পাঠদান তথা জ্ঞান বিতরণ নয়, নতুন জ্ঞানেরও সৃষ্টি করা। প্রথম কাজটি সাফল্যের সঙ্গে সম্পন্ন করা গেলেও দ্বিতীয় কাজটিতে আশানুরূপ সাফল্য অর্জিত হয়নি। এ বছর উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের তুলনায় উচ্চশিক্ষার সুযোগ সীমিত। সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় মিলিয়েও সংস্থান করা কার্যত অসম্ভব। তাই রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে একটা সময়োচিত পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। দেশের পুরনো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেখানে অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা রয়েছে, সেখানে আসন সংখ্যা বাড়িয়ে এর কিছুটা হলেও সমাধান সম্ভব। মাঝে মধ্যে শিক্ষকদের উচ্চশিক্ষার জন্য ছুটি নিয়ে অনেক সমালোচনা হয়; কিন্তু একটা ব্যাপার অবশ্যই মনে রাখতে হবে, শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য উচ্চশিক্ষা অপরিহার্য। তাই শিক্ষকরা উচ্চশিক্ষার জন্য ছুটিতে যান। এখানে উলেল্গখ্য, ছুটির নীতিমালা সব বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য এক রকম নয়। কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে মাত্রাতিরিক্ত শিথিলতার কারণে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে বিদেশে গিয়ে আর ফিরে আসেন না বা এসেও চাকরি থেকে পদত্যাগ করেন। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাপ্ত সুবিধাদি ফেরত দেন না বা নূ্যনতম দায়িত্ব পালন করেন না। সেটা যেমন সত্য তেমনি এটাও সত্য যে, উচ্চশিক্ষা শেষে ফিরে এসে দেশের উন্নয়নে অবদান রাখেন। এদের সংখ্যাই বেশি। তাই গুটিকয়েক শিক্ষকের জন্য পুরো শিক্ষক সমাজ অনৈতিকতার দোষে দুষ্ট হতে পারে না। যেখানে বিশ্ববিদ্যালয় বা সরকার শিক্ষকদের উচ্চশিক্ষার জন্য উলেল্গখযোগ্য কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করে না, সেখানে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নিজ উদ্যোগে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে চাইলে কেউ তাতে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করতে পারে না। করা উচিত নয়। তবে এ ক্ষেত্রে শিক্ষকদেরও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা জরুরি।

মোঃ আসাদুল্লাহ : শিক্ষক, ঢাকা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (ডুয়েট)
ashadullah.bd@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.