নির্যাতনের হাতিয়ার রিমান্ডঃ ডিজিটাল শাসনে মানবাধিকার ভূলুণ্ঠিত
রিমান্ডের দানবীয় তাণ্ডব হাড়ে হাড়ে টের তারাই পেয়েছেন যারা এর শিকার হয়েছেন। অথচ এ ধরনের আচরণ সংবিধান কর্তৃক প্রদত্ত নাগরিক নিরাপত্তার সম্পূর্ণ বিপরীত, আইনের শাসনের সঙ্গেও এর কোনো সম্পর্কই নেই। রিমান্ডের নামে সব সময়ই পুলিশ গ্রেফতারকৃতদের কাছ থেকে তথ্য আদায়ের নাম করে আদালত থেকে রিমান্ড আদায় করে। তবে গত সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জরুরি অবস্থায় রিমান্ড হয়ে উঠেছিল বিভীষিকাময়।
অনেক ক্ষেত্রেই রিমান্ডের বালাই ছিল না। চোখ বেঁধে নেয়া হতো অজানা জায়গায়। যাদের ক্ষেত্রে এটা সম্ভব হয়নি তেমন রাজনীতিবিদসহ অনেককেই রিমান্ডে নিয়ে ‘জিজ্ঞাসাবাদের’ পর অসুস্থ অবস্থায় পুলিশের কাঁধে ভর করে আদালতে হাজির হতে দেখা গেছে। এভাবে নির্যাতিতদের কেউ কেউ এখন ক্ষমতাসীন দলের সংসদ সদস্য। জাতীয় সংসদে তারা বেশ ক্ষোভের সঙ্গে সে নির্যাতনের কথাও বলেছেন। বিচার দাবি করেছেন। দায়ীদের বিরুদ্ধে মামলা করতে চেয়েও সে পথে এগোননি। কেন, সেটা এখন পরিষ্কার। তাদের সরকারও যে রিমান্ডকে ক্ষমতার স্বার্থে কাজে লাগাচ্ছে! গতকালের আমার দেশ-এ প্রকাশিত প্রতিবেদনে এসবই বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হয়েছে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, রাজধানী ঢাকার ৯টি ম্যাজিসেল্ট্রট আদালত ৫৮ দিনে রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন ২০০৫ জনকে। প্রতিদিন গড়ে ৩৫ জনকে রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ ও সিআইডি। এসব রিমান্ডে নেয়া ব্যক্তিদের বেশিরভাগই পরবর্তী সময়ে অসুস্থ হয়ে আদালতে হাজির হয়েছেন। চিকিত্সা নিতে হয়েছে অনেককে। রিমান্ডে নির্যাতিত কয়েকজন গ্রেফতারকৃত বিডিআর সদস্য হাসপাতালে মারাও গেছেন। অর্থাত্ জরুরি অবস্থার সরকারের অনেক কিছুর মতোই রিমান্ডে এনে নির্যাতনের ধারাটিও বর্তমান সরকার ভালোভাবেই বহাল রেখেছে। যদিও এ সরকার নির্বাচিত ও গণতান্ত্রিক বলে পরিচিত এবং সংবিধান রক্ষা, সুশাসন ও আইনের শাসনের কথায় ক্ষমতাসীনরা সোচ্চার। অথচ বিভিন্ন অভিযোগে আটক ব্যক্তিদের রিমান্ডে এনে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন যে সংবিধানে বর্ণিত মৌলিক মানবাধিকার ও ন্যায়বিচার লাভের অধিকারের সুস্পষ্ট লগ্ধঘন সেটা তারা বেমালুম ভুলে যান। এদেশীয়দের নির্যাতনের লক্ষ্যেই ঔপনিবেশিক আমলে চালু রিমান্ডের আইনটি এখনও বহাল রাখা হয়েছে। একশ’ বছরের বেশি পুরনো ফৌজদারি আইনের দুর্বলতার কারণেই রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতনের প্রতিকার হচ্ছে না বলে আইন বিশেষজ্ঞদের ধারণা। ফলে সরকার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে এবং পুলিশও ইচ্ছামত রিমান্ডকে নির্যাতনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার সুযোগ পেয়েছে। এক্ষেত্রে জুডিশিয়াল ম্যাজিসেল্ট্রট আদালত নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথকীকরণ হয়ে সুপ্রিমকোর্টের আওতায় গেলেও সরকারের প্রভাবমুক্ত হয়েছে বলা যাবে না। রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতনের অভিযোগ শোনার পরও আবারও রিমান্ড মঞ্জুর করা হচ্ছে। রিমান্ডের উদ্দেশ্য মোটেই জিজ্ঞাসাবাদ নয়, পুলিশ বা সিআইডি কাসল্টডিতে নেয়াটাই আসল, সেটাও কোনো গোপন বিষয় নয়। উদাহরণ হিসেবে গ্রেফতারকৃত সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীকে অসুস্থতার কারণে হাইকোর্ট জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদের নির্দেশ দিলেও সে অনুযায়ী ব্যবস্থা না নিয়ে সরকারের আপিল বিভাগে এর বিরুদ্ধে আবেদন করার ঘটনাই যথেষ্ট। এমনটা হতো না যদি সরকার রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদে হাইকোর্টের নির্দেশনা ও গাইডলাইন বাস্তবায়নে সচেষ্ট হতো। ২০০৩ সালে দেয়া হাইকোর্টের রায়ে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদকালে আসামির আইনজীবীর উপস্থিতি এবং রিমান্ডে নেয়ার আগে ও পরে ডাক্তারের পরীক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু সরকার হাইকোর্টের রায়ের প্রতি বুড়ো আঙুল দেখিয়ে চলায় রিমান্ডের ঘটনা মাত্রাছাড়া হয়ে উঠেছে। এ প্রসঙ্গে দেশি-বিদেশি মদত ও অর্থে পুষ্ট মানবাধিকার এবং আইন সহায়তা কেন্দ্রগুলো বর্তমানে রিমান্ডের বাড়াবাড়ি নিয়ে আশ্চর্যজনকভাবে নিশ্চুপ থাকার বিষয়টি উল্লেখ না করে পারা যায় না। অধিকার ছাড়া এ ধরনের বেশিরভাগ সংস্থার নীরব ভূমিকা তাদের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতাই প্রমাণ করে। দলীয় রাজনীতির স্বার্থে মানবাধিকার কর্মীদের এ ধরনের ভূমিকা খুবই দুঃখজনক ও ঘোষিত উদ্দেশ্যের বরখেলাপ। এর ফলে একদিকে জনগণের অধিকার ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে, অন্যদিকে সরকার ও থানা পুলিশের আইন লগ্ধঘন এবং দুর্নীতি বৃদ্ধি পাচ্ছে। গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় আইন শুধু দুষ্টের দমনই করে না, নাগরিকদের সুরক্ষার দায়িত্বও পালন করে। রিমান্ডের নিষ্ঠুর তাণ্ডবতাই যদি হয় ডিজিটাল যুগে উত্তরণের একটি নমুনা, তাহলে সুপ্রিমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের আদেশটির অবস্থা কী দাঁড়ায়—তা সহজেই অনুমেয়। ক্ষমতা গ্রহণের বর্ষপূর্তির দু’মাস বাকি থাকতেই যদি অবস্থা এমন হয় তাহলে পরবর্তী সময়ে কী দশা হবে ভেবে দুশ্চিন্তা জাগে।
No comments