খুচরো ঘটনার স্মৃতি by আল মাহমুদ
যৌবনে এই জগৎ-সংসার ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ আমার হয়েছিল। আমি ঘুরেছি। অনেক ঘটনার বিবরণ আমি দিয়েছি। তবুও আমার মন ভরে আছে আরও কিছু খুচরো ঘটনার স্মৃতিতে। খুচরো বললাম এ কারণে যে, এসব ঘটনার বিবরণ সাধারণত লেখকরা দিতে চান না; কিন্তু ওইসব খুচরো ঘটনা এক সময় যে আনন্দ দিয়েছিল সেটাও তো কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করা উচিত।
আমি প্যারিসে ভ্রমণের সময় স্পেনে যাওয়ায় খুব আকাঙ্খা পোষণ করেছিলাম; কিন্তু নানা প্রতিবন্ব্দকতায় আমি স্পেনে প্রবেশ করতে পারিনি। যে ট্রেনটিতে আমার যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল, সে ট্রেনটি দেখতে আমি রেলওয়ে সেল্টশনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। ভাবছিলাম এই ট্রেনটি কত সৌভাগ্যের অধিকারী? অথচ আমি না যেতে পারার দুঃখ নিয়ে ফিরে যাচ্ছি।
স্পেনে যেতে না পারলেও যে বাসায় অবস্থান করছিলাম সেখানে ‘স্পিনাক’ বলে এক ধরনের শাক দিয়ে ভাত খেয়েছিলাম। কথাটা কিন্তু আমি সারা জীবনেও ভুলতে পারিনি। স্মৃতির পেছনে লেগে থাকে কিছু খুচরো স্মৃতি। এই শাক স্পেন থেকে প্যারিসে আমদানি করা হয়। খুবই স্বাদযুক্ত এই খাদ্য আমার রসনায় লেগে আছে। কত বিবরণ তো লিখেছি; কিন্তু এই শাকের আশ্চর্য স্বাদের কথা আমি কেন যে ভুলতে পারি না তা ঠিক জানি না। আজ কতদিন পরে একটু সুযোগ পেয়ে ওই শাকের মহাত্ম্য আস্বাদনের বিষয়টি উল্লেখ করতে ইচ্ছে হলো। মানুষ এ রকমই। তার স্মৃতির চৌহদ্দি যতই সঙ্কীর্ণ হোক তাতে জগৎ-সংসার ধরে যায়।ত এক সময় যখন আমার চোখ ভালো ছিল তখন কেবল পড়ার কথা বলতাম। কী পড়েছি সেটা নিয়ে বলতে ভালো লাগত। পড়াটাও যে ধারণ করার একটা সামান্য উপায় মাত্র সেটা ঠিকমত বুঝতে পারতাম না। এখন বুঝেছি পড়া নয়, ধরা নয়, জ্ঞানার্জনের বহুবিধ উপায় আছে যা মানুষকে সমৃদ্ধ করে। আমি সামান্য মানুষ। এই জগত্-সংসারে বিচরণ করতে গিয়ে পদে পদে ধাক্কা খেয়ে শিখেছি। শিখেছি অনেক নারীর কাছেও। সাধারণত কৃপণতা ও সন্দেহ বাতিকতা নারীদের একটা আত্মরক্ষার স্বভাব; কিন্তু আমি যাদের নিকটবর্তী হয়েছি তারা অকৃপণভাবেই আমাকে জ্ঞান অর্জনে সাহায্য করেছে। আমার যৌবনকালে আমার মধ্যে খানিকটা----কাজ করত। যেমন আমি প্যারিসে সাজলিজে বা দশ রাস্তার মোড় দেখতে সোজা উপরে উঠে গিয়েছিলাম। পরে অবশ্য কোমর নিয়ে ভুগেছি; কিন্তু প্রাথমিক উৎসাহ আমাকে চঞ্চল করে ঠেলে উঠিয়ে দিয়েছিল। আজকাল সেসব কথা হঠাৎ হঠাৎ মনে পড়ে যায়। একাকী হাসি। আমি কবির জীবন কাটাতে গিয়ে অনেক দুঃস্বপেম্নর মধ্যেও সাঁতার কেটেছি। সবকিছু যে আমার জন্য উপকারী হয়েছে অমন দাবি করি না। অনেক দুঃখ-দুর্দশা আমাকে পোহাতে হয়েছে। প্যারিসে আমি জোয়ান অব আর্ক’র একটি যুদ্ধংদেহী ভাস্কর্যের সামনে দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম। অনেকক্ষণ ঠাঁয় দাঁড়িয়েছিলাম। এই কৃষককন্যা ফরাসিদের এক সময়কার মৃত আত্মাকে জাগিয়েছিল। সে বলেছিল, সে স্বপম্নাদিষ্ট হয়ে ফরাসিদের রক্ষার জন্য আবির্ভূত হয়েছে এবং ফদ্ধান্স আক্রমণকারী বিদেশিদের প্রতিহত করার জন্য সে আদিষ্ট হয়েছে। এই কথায় ফরাসিরা যুদ্ধের জন্য তার পেছনে এসে সমবেত হয়েছিল এবং যুদ্ধে বহিরাক্রমণকারীদের পরস্ত করে ভাগিয়ে দিয়েছিল। পরে অবশ্য তার নিজের লোকেরাই বিশ্বাসঘাতকতা করে তাকে শত্রুর হাতে তুলে দিয়েছিল। শত্রুরা তাকে ডাইনি বলে পুড়িয়ে মেরেছিল; কিন্তু এই কৃষককন্যার গৌরব আজও ম্লান হয়নি। এখনও তার মর্মরমূর্তি শোভা পাচ্ছে যে অবস্থায় সে যুদ্ধের জন্য আহ্বান করেছিল তা মূর্ত হয়ে উঠেছে—এটাই দর্শক মাত্রেরই হৃদয়ে ঠাঁই করে নিয়েছে। এটাই এখনও মানুষের মনে উদ্দীপনা জাগায়। পরে তাকে কীভাবে মারা হয়েছিল সেটা নয়। মানব জাতির বীরত্বের কাহিনী এভাবেই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মূর্ত হয়ে আছে। আর সবই মিথ্যে হয়ে গেছে। আমি যৌবনে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে বেড়িয়ে এসব বীরত্বের বিবরণ একদা সংগ্রহ করেছিলাম। আমার কবিতায়, আমার কাহিনীতে সে সবেরই কিছু আমি বর্ণনা করতে পেরেছি। না পারলেও আমার প্রয়াস ছিল। আন্তরিকতা ছিল এসব বর্ণনার। আমি আমার পাঠকদের এসব বিষয়ে সচেতন রেখে লিখে গেছি। আমার লেখা যারা আন্তরিকতা নিয়ে পাঠ করেছেন তারা বুঝতে পারবেন আমি কত পরিশ্রমের সঙ্গে এসব কাহিনী বর্ণনার চেষ্টা করেছি। কোথাও সফল হয়েছি, কোথাও আমি নিজে ক্লান্ত হলেও চেষ্টার ত্রুটি করিনি। আমার কথা হলো আমি লেখকের বৃত্তি গ্রহণ করেছিলাম এবং সেই প্রতিশ্রুতি পূরণের জন্য অবিশ্রাম চেষ্টা করে গেছি। কোথাও শৈথিল্য নেই।
লেখক : কবি
স্পেনে যেতে না পারলেও যে বাসায় অবস্থান করছিলাম সেখানে ‘স্পিনাক’ বলে এক ধরনের শাক দিয়ে ভাত খেয়েছিলাম। কথাটা কিন্তু আমি সারা জীবনেও ভুলতে পারিনি। স্মৃতির পেছনে লেগে থাকে কিছু খুচরো স্মৃতি। এই শাক স্পেন থেকে প্যারিসে আমদানি করা হয়। খুবই স্বাদযুক্ত এই খাদ্য আমার রসনায় লেগে আছে। কত বিবরণ তো লিখেছি; কিন্তু এই শাকের আশ্চর্য স্বাদের কথা আমি কেন যে ভুলতে পারি না তা ঠিক জানি না। আজ কতদিন পরে একটু সুযোগ পেয়ে ওই শাকের মহাত্ম্য আস্বাদনের বিষয়টি উল্লেখ করতে ইচ্ছে হলো। মানুষ এ রকমই। তার স্মৃতির চৌহদ্দি যতই সঙ্কীর্ণ হোক তাতে জগৎ-সংসার ধরে যায়।ত এক সময় যখন আমার চোখ ভালো ছিল তখন কেবল পড়ার কথা বলতাম। কী পড়েছি সেটা নিয়ে বলতে ভালো লাগত। পড়াটাও যে ধারণ করার একটা সামান্য উপায় মাত্র সেটা ঠিকমত বুঝতে পারতাম না। এখন বুঝেছি পড়া নয়, ধরা নয়, জ্ঞানার্জনের বহুবিধ উপায় আছে যা মানুষকে সমৃদ্ধ করে। আমি সামান্য মানুষ। এই জগত্-সংসারে বিচরণ করতে গিয়ে পদে পদে ধাক্কা খেয়ে শিখেছি। শিখেছি অনেক নারীর কাছেও। সাধারণত কৃপণতা ও সন্দেহ বাতিকতা নারীদের একটা আত্মরক্ষার স্বভাব; কিন্তু আমি যাদের নিকটবর্তী হয়েছি তারা অকৃপণভাবেই আমাকে জ্ঞান অর্জনে সাহায্য করেছে। আমার যৌবনকালে আমার মধ্যে খানিকটা----কাজ করত। যেমন আমি প্যারিসে সাজলিজে বা দশ রাস্তার মোড় দেখতে সোজা উপরে উঠে গিয়েছিলাম। পরে অবশ্য কোমর নিয়ে ভুগেছি; কিন্তু প্রাথমিক উৎসাহ আমাকে চঞ্চল করে ঠেলে উঠিয়ে দিয়েছিল। আজকাল সেসব কথা হঠাৎ হঠাৎ মনে পড়ে যায়। একাকী হাসি। আমি কবির জীবন কাটাতে গিয়ে অনেক দুঃস্বপেম্নর মধ্যেও সাঁতার কেটেছি। সবকিছু যে আমার জন্য উপকারী হয়েছে অমন দাবি করি না। অনেক দুঃখ-দুর্দশা আমাকে পোহাতে হয়েছে। প্যারিসে আমি জোয়ান অব আর্ক’র একটি যুদ্ধংদেহী ভাস্কর্যের সামনে দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম। অনেকক্ষণ ঠাঁয় দাঁড়িয়েছিলাম। এই কৃষককন্যা ফরাসিদের এক সময়কার মৃত আত্মাকে জাগিয়েছিল। সে বলেছিল, সে স্বপম্নাদিষ্ট হয়ে ফরাসিদের রক্ষার জন্য আবির্ভূত হয়েছে এবং ফদ্ধান্স আক্রমণকারী বিদেশিদের প্রতিহত করার জন্য সে আদিষ্ট হয়েছে। এই কথায় ফরাসিরা যুদ্ধের জন্য তার পেছনে এসে সমবেত হয়েছিল এবং যুদ্ধে বহিরাক্রমণকারীদের পরস্ত করে ভাগিয়ে দিয়েছিল। পরে অবশ্য তার নিজের লোকেরাই বিশ্বাসঘাতকতা করে তাকে শত্রুর হাতে তুলে দিয়েছিল। শত্রুরা তাকে ডাইনি বলে পুড়িয়ে মেরেছিল; কিন্তু এই কৃষককন্যার গৌরব আজও ম্লান হয়নি। এখনও তার মর্মরমূর্তি শোভা পাচ্ছে যে অবস্থায় সে যুদ্ধের জন্য আহ্বান করেছিল তা মূর্ত হয়ে উঠেছে—এটাই দর্শক মাত্রেরই হৃদয়ে ঠাঁই করে নিয়েছে। এটাই এখনও মানুষের মনে উদ্দীপনা জাগায়। পরে তাকে কীভাবে মারা হয়েছিল সেটা নয়। মানব জাতির বীরত্বের কাহিনী এভাবেই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মূর্ত হয়ে আছে। আর সবই মিথ্যে হয়ে গেছে। আমি যৌবনে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে বেড়িয়ে এসব বীরত্বের বিবরণ একদা সংগ্রহ করেছিলাম। আমার কবিতায়, আমার কাহিনীতে সে সবেরই কিছু আমি বর্ণনা করতে পেরেছি। না পারলেও আমার প্রয়াস ছিল। আন্তরিকতা ছিল এসব বর্ণনার। আমি আমার পাঠকদের এসব বিষয়ে সচেতন রেখে লিখে গেছি। আমার লেখা যারা আন্তরিকতা নিয়ে পাঠ করেছেন তারা বুঝতে পারবেন আমি কত পরিশ্রমের সঙ্গে এসব কাহিনী বর্ণনার চেষ্টা করেছি। কোথাও সফল হয়েছি, কোথাও আমি নিজে ক্লান্ত হলেও চেষ্টার ত্রুটি করিনি। আমার কথা হলো আমি লেখকের বৃত্তি গ্রহণ করেছিলাম এবং সেই প্রতিশ্রুতি পূরণের জন্য অবিশ্রাম চেষ্টা করে গেছি। কোথাও শৈথিল্য নেই।
লেখক : কবি
No comments