চরিত্র হননের মহোৎসব হবে আজ by আহমেদ শরীফ শুভ
আজ ১৭ নভেম্বর মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর ৩৫তম মৃত্যুবার্ষিকী। আমাদের ভূখণ্ডের রাজনীতির ত্রিকালদর্শী এই পুরুষ কেবল একজন রাজনীতিবিদই ছিলেন না, একজন সমাজ সংস্কারকও ছিলেন। তিনি ছিলেন গণমানুষের হৃদয়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে তিনি ছিলেন এক ব্যতিক্রম ব্রিড। মোহ আর ক্ষমতার রাজনীতির বিপরীতে দাঁড়িয়ে নির্মোহ আর ক্ষমতাবিমুখ এই মানুষটি আজীবন সাধারণ মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য লড়াই করেছেন।
আর সে লড়াই তিনি করে গেছেন গণমানুষের কাতারে দাঁড়িয়ে, তাদের পাশে থেকে, তাদের পাশে রেখে। এমনকি তিনিই একমাত্র নেতা যিনি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের নিউক্লিয়াসকে বিকেন্দ্রীকরণের বাস্তব সম্মত পদক্ষেপ নিতে পেরেছিলেন। তিনি রাজধানীর বাইরে থেকেই তার দলীয় নেতৃত্ব দিতে এবং সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে সক্ষম হয়েছিলেন। বাংলাদেশের খেটে খাওয়া শ্রমিক কৃষকের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম যতদিন চলবে মৌলানা ভাসানী ততদিনই সেই সংগ্রামের প্রেরণা হয়ে থাকবেন। শুধু তাই নয়, আমাদের জাতিসত্তার অস্তিত্বের সঙ্গেও তার জীবন ও রাজনীতি অবিচ্ছেদ্য। বাংলাদেশের গণমানুষের আত্মার আত্মীয় এই মজলুম জননেতার মৃত্যুবার্ষিকীতে তাই আমাদের সকৃতজ্ঞ শ্রদ্ধাঞ্জলি।
রাজনৈতিক ভাবাদর্শের ক্ষেত্রে মওলানা ভাসানী ছিলেন অন্য দশজন নেতার চেয়ে একেবারেই ভিন্ন ধারার। তিনি দেশের মানুষের ধর্মবিশ্বাসের আওতার মধ্যেই একটি সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার স্বপ্ন দেখেছিলেন। তার রাজনৈতিক মতাদর্শ ছিল বাম ঘরানার। সমাজতন্ত্রের বিভিন্ন তত্ত্বের আলোকে তার মত ও পথ নিয়ে যতই বিতর্ক থাকুক না কেন, তার মতবাদ যতই বিশুদ্ধ বা অশুদ্ধ হোক না কেন, একমাত্র বঙ্গবন্ধু ছাড়া আর কোনও নেতা বংলাদেশের মানুষের নাড়ির স্পন্দন এমনভাবে উপলব্ধি করতে পারেননি।
দেশের জনগোষ্ঠীর একটি বিশাল অংশ তার ব্যক্তিগত কারিশমার ভক্ত ও তার রাজনৈতিক মতাদর্শের অনুসারী হলেও ভাসানীর মৃত্যুর পর তার প্রবর্তিত রাজনৈতিক স্রোতধারাটির অপমৃত্যু হয়।
ভাসানীর অনুসারীদের মধ্যে যারা রাজনীতিতে সক্রিয় থেকেছেন তাদের অধিকাংশই পরবর্তী সময়ে বিএনপিতে যোগ দিয়েছেন। এদের অনেকেই দলটিতে নেতৃস্থানীয়। তারা মওলানার ভাবাদর্শ পরিত্যাগ করেই বিএনপিতে যোগ দিয়েছিলেন বলে ধরে নেওয়া সঙ্গত।
কারণ, এই দলের প্রতিষ্ঠাতা বাহ্যিকভাবে ভাসানীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল বলে দেখালেও বিএনপিকে সমাজতন্ত্রবিরোধী শক্তি হিসাবেই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এমনকি তিনি ক্ষমতায় এসেই রাষ্ট্রীয় মূলনীতি থেকে ভাসানীর আদর্শ সমাজতন্ত্রকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করেছিলেন।
ভাসানী ন্যাপের আদর্শের সাথে বিএনপির আদর্শগত মিল সামান্যই। তবে একথা মানতে কোনও দ্বিধা নেই যে, রাজনীতি সব সময়েই গতিশীল। সুতরাং রাজনৈতিক বিশ্বাস ও মতাদর্শ সঙ্গত কারণেই পরিবর্তনশীল হতে পারে। তাই কেউ যদি ভাসানীর রাজনৈতিক দর্শনকে সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে অনুপযোগী মনে করে পরিত্যাগ করেন তাতে দোষের কিছু নেই। বরং সেই অধিকার যে কোন রাজনীতিকেরই রয়েছে। কিন্তু নিজেদের পরিত্যক্ত আদর্শের প্রবক্তাকে নিয়ে যখন কেউ স্মৃতিচারণের উৎসবে মেতে তার রাজনৈতিক চরিত্র হননে লিপ্ত হন তখন প্রশ্ন থেকে যায়। এই বাস্তবতার আলোকেই আজ ভাসানীর মৃত্যুবার্ষিকী, তার রাজনৈতিক উত্তরাধিকার, সাবেক অনুসারীদের মৃত্যুবার্ষিকী পালনের ঘটা–- এ সব কিছু নিয়েই নতুন ভাবে মূল্যায়নের সময় এসেছে।
মৃত্যুবার্ষিকী উদযাপনের বিষয়টি সব সময়েই সংবেদনশীল। এই দিনে মৃত ব্যক্তির জীবনের ইতিবাচক দিকগুলো নিয়ে আলোচনা সামাজিক শিষ্ঠাচারের অংশ। কিন্তু এই মৃত্যুবার্ষিকী যদি কোনও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের হয়ে থাকে তবে তাকে কেন্দ্র করে বিতর্ক ও অসংযত আবেগ বহিঃপ্রকাশের নজিরও আমাদের কম নেই। কখনো বা আবার দিনটির আয়োজন এবং আবেদনকে এমনভাবে দলীয়করণ করা হয় যে তাতে মৃত্যুবার্ষিকী পালনের আসল উদ্দেশ্যটিই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে।
ভাসানীর মৃত্যুর পর থেকেই বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক সংগঠন বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে দিনটি পালন করে আসছে। বিএনপি ও তার অঙ্গ সংগঠনগুলো সব সময়েই এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা রেখে আসছে। ভাসানীকে বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যেতে না দেওয়ার জন্য তাদের এ উদ্যোগ আপাত দৃষ্টিতে প্রশংসনীয় মনে হতে পারে। কিন্তু মৃত্যুবার্ষিকীর এই স্মরণসভায় যে ভাসানীকে উপস্থাপন করা হয় বা হবে তিনি কোন ভাসানী? তিনি কি সেই ভাসানী যিনি এ দেশের ভূখানাঙ্গা মানুষের জন্য সমতাভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য নিরন্তর সংগ্রাম করে গেছেন? দুর্ভাগ্যবশত আজ আগামী প্রজন্মের সামনে উপস্থাপন করা হবে ‘ইসলামী মুল্যবোধের ধারক ও বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের অগ্রণী পুরুষ’ কোনও এক অলীক মওলানা ভাসানীকে। সেই ভাসানীর সাথে আসল ভাসানীর কোনও মিল নেই।
বিএনপির রাজনৈতিক দর্শন এবং দলটির নেতাদের ভোগ বিলাসের জীবনের সাথে প্রকৃত মওলানা ভাসানীর জীবন ও দর্শনের মিল অতি সামান্যই।
কাগমারী সম্মেলনে দাঁড়িয়ে মওলানা ভাসানী যখন পাকিস্তানিদের ‘আসসালামু আলাইকুম’ বলেছিলেন তখন তিনি ‘বাঙালী’ জাতিসত্তার কথা বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশী’ জাতির কথা নয়। অথচ তাকে মরণোত্তর ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী’ সাজানো হয়েছে।
মুক্তি সংগ্রামের অন্যতম প্রধান এই নেতার মৃত্যুবার্ষিকীতে দাঁড়িয়ে বক্তব্য রাখেন স্বাধীনতাযুদ্ধের স্বীকৃত বিরোধীরা। তার স্মৃতির প্রতি এর চেয়ে বড় প্রহসন আর কি হতে পারে! মৃত্যুবার্ষিকীতে দাঁড়িয়ে বিএনপি নেতারা ভাসানীর কোন আদর্শকে মূল্যায়ন করেন, আজ সেই প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক। মওলানার আদর্শকে মাইনাস করে তার মৃত্যুবার্ষিকী পালনের ঘটার মধ্যে তাই প্রশ্ন থেকে যায় উদ্দেশ্যের সততা নিয়ে।
ভাসানীর নিজের প্রতিষ্ঠিত দলটি আজ বিলুপ্ত। যদিও ভাসানী ন্যাপ নামে কয়েকটি প্যাড সর্বস্ব দল আজো টিকে আছে। সেই দল উপদলগুলোর সাথে ভাসানী-প্রতিষ্ঠিত দলটির কোনও আদর্শিক সম্পর্ক নেই। এই ব্যক্তিসর্বস্ব সংগঠনগুলো মূলত বিএনপির বি-টিম হিসাবেই কাজ করে। পক্ষান্তরে ভাসানী যে রাজনৈতিক দলটির গঠন প্রক্রিয়ার মূল ভূমিকা রেখেছিলেন সেই আওয়ামী লীগ মাওলানা ভাসানীর স্মৃতি ও তার মৃত্যুবার্ষিকীকে করে চরম উপেক্ষা। সেই সুযোগেই স্বাধীনতা সংগ্রামী সমাজতন্ত্রী মওলানা ভাসানী মরণোত্তর হাইজ্যাক হয়ে গেছেন স্বাধীনতা বিরোধীদের পৃষ্ঠপোষক ও পুঁজিবাদের ধারকদের হাতে। তার নাম আওয়ামী লীগ আর স্মরণ করে না। তবে যখন দেখি তাজউদ্দীনের নামে বাংলাদেশে কোনও উল্লেখযোগ্য স্থাপনা হয়নি আজো, তার নাম বিস্মৃতির অন্তরালে চলে যাচ্ছে ক্রমশ তখন আর ভাসানীর স্মৃতির প্রতি আওয়ামী লীগের নির্লিপ্ততা দেখে অবাক হই না। কেবল একজনের স্মৃতির প্রতিই আওয়ামী লীগের দায়বদ্ধতা, যা এই মহাপুরুষটি নিজে বেঁচে থাকলেও চাইতেন না।
প্রিয় মওলানা ভাসানী! আপনার মৃত্যুবার্ষিকীতে বাংলাদেশের গণমানুষের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা গ্রহণ করুন। কিন্তু আমরা ক্ষমাপ্রার্থীও বটে। আজ আপনার রাজনৈতিক স্রোতধারা বিলুপ্ত। আপনার প্রতিষ্ঠিত আওয়ামী লীগ আপনাকে আজ স্মরণ করবে না। ভাসানী ন্যাপ নামধারী বামুন রাজনীতি ব্যবসায়ীরা আজ পত্রিকায় বিবৃতি দেবেন নিজেদের নাম ছাপা হওয়ার স্বার্থে। আর বিএনপি আপনাকে আগামী প্রজন্মের সামনে উপস্থাপন করবে ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের অগ্রনায়ক এবং ইসলামী ভাবধারার রাজনীতির’ মহান নেতা হিসাবে। আজ সারাদেশে সভা সমাবেশে আপনার রাজনৈতিক চরিত্র হননের মহোৎসব হবে। আপনি সারাজীবন যাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন তারা এবং তাদের নব্য দোসরেরা আপনার ছবি এবং কবরের সামনে দাঁড়িয়ে নিজেদের ছবি তোলার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হবে। আমাদের ক্ষমা করবেন প্রিয় মওলানা।
shuvo.sharif@gmail.com
রাজনৈতিক ভাবাদর্শের ক্ষেত্রে মওলানা ভাসানী ছিলেন অন্য দশজন নেতার চেয়ে একেবারেই ভিন্ন ধারার। তিনি দেশের মানুষের ধর্মবিশ্বাসের আওতার মধ্যেই একটি সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার স্বপ্ন দেখেছিলেন। তার রাজনৈতিক মতাদর্শ ছিল বাম ঘরানার। সমাজতন্ত্রের বিভিন্ন তত্ত্বের আলোকে তার মত ও পথ নিয়ে যতই বিতর্ক থাকুক না কেন, তার মতবাদ যতই বিশুদ্ধ বা অশুদ্ধ হোক না কেন, একমাত্র বঙ্গবন্ধু ছাড়া আর কোনও নেতা বংলাদেশের মানুষের নাড়ির স্পন্দন এমনভাবে উপলব্ধি করতে পারেননি।
দেশের জনগোষ্ঠীর একটি বিশাল অংশ তার ব্যক্তিগত কারিশমার ভক্ত ও তার রাজনৈতিক মতাদর্শের অনুসারী হলেও ভাসানীর মৃত্যুর পর তার প্রবর্তিত রাজনৈতিক স্রোতধারাটির অপমৃত্যু হয়।
ভাসানীর অনুসারীদের মধ্যে যারা রাজনীতিতে সক্রিয় থেকেছেন তাদের অধিকাংশই পরবর্তী সময়ে বিএনপিতে যোগ দিয়েছেন। এদের অনেকেই দলটিতে নেতৃস্থানীয়। তারা মওলানার ভাবাদর্শ পরিত্যাগ করেই বিএনপিতে যোগ দিয়েছিলেন বলে ধরে নেওয়া সঙ্গত।
কারণ, এই দলের প্রতিষ্ঠাতা বাহ্যিকভাবে ভাসানীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল বলে দেখালেও বিএনপিকে সমাজতন্ত্রবিরোধী শক্তি হিসাবেই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এমনকি তিনি ক্ষমতায় এসেই রাষ্ট্রীয় মূলনীতি থেকে ভাসানীর আদর্শ সমাজতন্ত্রকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করেছিলেন।
ভাসানী ন্যাপের আদর্শের সাথে বিএনপির আদর্শগত মিল সামান্যই। তবে একথা মানতে কোনও দ্বিধা নেই যে, রাজনীতি সব সময়েই গতিশীল। সুতরাং রাজনৈতিক বিশ্বাস ও মতাদর্শ সঙ্গত কারণেই পরিবর্তনশীল হতে পারে। তাই কেউ যদি ভাসানীর রাজনৈতিক দর্শনকে সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে অনুপযোগী মনে করে পরিত্যাগ করেন তাতে দোষের কিছু নেই। বরং সেই অধিকার যে কোন রাজনীতিকেরই রয়েছে। কিন্তু নিজেদের পরিত্যক্ত আদর্শের প্রবক্তাকে নিয়ে যখন কেউ স্মৃতিচারণের উৎসবে মেতে তার রাজনৈতিক চরিত্র হননে লিপ্ত হন তখন প্রশ্ন থেকে যায়। এই বাস্তবতার আলোকেই আজ ভাসানীর মৃত্যুবার্ষিকী, তার রাজনৈতিক উত্তরাধিকার, সাবেক অনুসারীদের মৃত্যুবার্ষিকী পালনের ঘটা–- এ সব কিছু নিয়েই নতুন ভাবে মূল্যায়নের সময় এসেছে।
মৃত্যুবার্ষিকী উদযাপনের বিষয়টি সব সময়েই সংবেদনশীল। এই দিনে মৃত ব্যক্তির জীবনের ইতিবাচক দিকগুলো নিয়ে আলোচনা সামাজিক শিষ্ঠাচারের অংশ। কিন্তু এই মৃত্যুবার্ষিকী যদি কোনও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের হয়ে থাকে তবে তাকে কেন্দ্র করে বিতর্ক ও অসংযত আবেগ বহিঃপ্রকাশের নজিরও আমাদের কম নেই। কখনো বা আবার দিনটির আয়োজন এবং আবেদনকে এমনভাবে দলীয়করণ করা হয় যে তাতে মৃত্যুবার্ষিকী পালনের আসল উদ্দেশ্যটিই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে।
ভাসানীর মৃত্যুর পর থেকেই বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক সংগঠন বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে দিনটি পালন করে আসছে। বিএনপি ও তার অঙ্গ সংগঠনগুলো সব সময়েই এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা রেখে আসছে। ভাসানীকে বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যেতে না দেওয়ার জন্য তাদের এ উদ্যোগ আপাত দৃষ্টিতে প্রশংসনীয় মনে হতে পারে। কিন্তু মৃত্যুবার্ষিকীর এই স্মরণসভায় যে ভাসানীকে উপস্থাপন করা হয় বা হবে তিনি কোন ভাসানী? তিনি কি সেই ভাসানী যিনি এ দেশের ভূখানাঙ্গা মানুষের জন্য সমতাভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য নিরন্তর সংগ্রাম করে গেছেন? দুর্ভাগ্যবশত আজ আগামী প্রজন্মের সামনে উপস্থাপন করা হবে ‘ইসলামী মুল্যবোধের ধারক ও বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের অগ্রণী পুরুষ’ কোনও এক অলীক মওলানা ভাসানীকে। সেই ভাসানীর সাথে আসল ভাসানীর কোনও মিল নেই।
বিএনপির রাজনৈতিক দর্শন এবং দলটির নেতাদের ভোগ বিলাসের জীবনের সাথে প্রকৃত মওলানা ভাসানীর জীবন ও দর্শনের মিল অতি সামান্যই।
কাগমারী সম্মেলনে দাঁড়িয়ে মওলানা ভাসানী যখন পাকিস্তানিদের ‘আসসালামু আলাইকুম’ বলেছিলেন তখন তিনি ‘বাঙালী’ জাতিসত্তার কথা বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশী’ জাতির কথা নয়। অথচ তাকে মরণোত্তর ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী’ সাজানো হয়েছে।
মুক্তি সংগ্রামের অন্যতম প্রধান এই নেতার মৃত্যুবার্ষিকীতে দাঁড়িয়ে বক্তব্য রাখেন স্বাধীনতাযুদ্ধের স্বীকৃত বিরোধীরা। তার স্মৃতির প্রতি এর চেয়ে বড় প্রহসন আর কি হতে পারে! মৃত্যুবার্ষিকীতে দাঁড়িয়ে বিএনপি নেতারা ভাসানীর কোন আদর্শকে মূল্যায়ন করেন, আজ সেই প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক। মওলানার আদর্শকে মাইনাস করে তার মৃত্যুবার্ষিকী পালনের ঘটার মধ্যে তাই প্রশ্ন থেকে যায় উদ্দেশ্যের সততা নিয়ে।
ভাসানীর নিজের প্রতিষ্ঠিত দলটি আজ বিলুপ্ত। যদিও ভাসানী ন্যাপ নামে কয়েকটি প্যাড সর্বস্ব দল আজো টিকে আছে। সেই দল উপদলগুলোর সাথে ভাসানী-প্রতিষ্ঠিত দলটির কোনও আদর্শিক সম্পর্ক নেই। এই ব্যক্তিসর্বস্ব সংগঠনগুলো মূলত বিএনপির বি-টিম হিসাবেই কাজ করে। পক্ষান্তরে ভাসানী যে রাজনৈতিক দলটির গঠন প্রক্রিয়ার মূল ভূমিকা রেখেছিলেন সেই আওয়ামী লীগ মাওলানা ভাসানীর স্মৃতি ও তার মৃত্যুবার্ষিকীকে করে চরম উপেক্ষা। সেই সুযোগেই স্বাধীনতা সংগ্রামী সমাজতন্ত্রী মওলানা ভাসানী মরণোত্তর হাইজ্যাক হয়ে গেছেন স্বাধীনতা বিরোধীদের পৃষ্ঠপোষক ও পুঁজিবাদের ধারকদের হাতে। তার নাম আওয়ামী লীগ আর স্মরণ করে না। তবে যখন দেখি তাজউদ্দীনের নামে বাংলাদেশে কোনও উল্লেখযোগ্য স্থাপনা হয়নি আজো, তার নাম বিস্মৃতির অন্তরালে চলে যাচ্ছে ক্রমশ তখন আর ভাসানীর স্মৃতির প্রতি আওয়ামী লীগের নির্লিপ্ততা দেখে অবাক হই না। কেবল একজনের স্মৃতির প্রতিই আওয়ামী লীগের দায়বদ্ধতা, যা এই মহাপুরুষটি নিজে বেঁচে থাকলেও চাইতেন না।
প্রিয় মওলানা ভাসানী! আপনার মৃত্যুবার্ষিকীতে বাংলাদেশের গণমানুষের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা গ্রহণ করুন। কিন্তু আমরা ক্ষমাপ্রার্থীও বটে। আজ আপনার রাজনৈতিক স্রোতধারা বিলুপ্ত। আপনার প্রতিষ্ঠিত আওয়ামী লীগ আপনাকে আজ স্মরণ করবে না। ভাসানী ন্যাপ নামধারী বামুন রাজনীতি ব্যবসায়ীরা আজ পত্রিকায় বিবৃতি দেবেন নিজেদের নাম ছাপা হওয়ার স্বার্থে। আর বিএনপি আপনাকে আগামী প্রজন্মের সামনে উপস্থাপন করবে ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের অগ্রনায়ক এবং ইসলামী ভাবধারার রাজনীতির’ মহান নেতা হিসাবে। আজ সারাদেশে সভা সমাবেশে আপনার রাজনৈতিক চরিত্র হননের মহোৎসব হবে। আপনি সারাজীবন যাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন তারা এবং তাদের নব্য দোসরেরা আপনার ছবি এবং কবরের সামনে দাঁড়িয়ে নিজেদের ছবি তোলার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হবে। আমাদের ক্ষমা করবেন প্রিয় মওলানা।
shuvo.sharif@gmail.com
No comments