সাধ্যাতীত ব্যয় এবং আর্থিক সংকট by এম এ তসলিম
কিছুদিন আগে দেশের অর্থনৈতিক সংকট নিয়ে আলোচনার জন্য কয়েকজন অর্থনীতিবিদকে নিয়ে একটি বৈঠকের আয়োজন করা হয়েছিল। সংকটটি যে ধীরে ধীরে গভীরতর হচ্ছে, বড় আকার ধারণ করছে, বৈঠকে তাঁরা সে আশঙ্কা প্রকাশ করেন।
তবে সংকটের কারণ হিসেবে অতিরিক্ত ঋণ ও উচ্চ মূল্যস্ফীতিকে দায়ী করা হচ্ছিল। কুইক রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্টের বা ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য অত্যাধিক খরচ, ভর্তুকি এবং বাজেট ঘাটতিকেও কেউ কেউ সংকটের কারণ হিসেবে তুলে ধরেছিলেন। এসব শুনে মনে হচ্ছিল, আলোচকরা নিজ নিজ অবস্থান থেকে একটা খণ্ডিত চিত্র তুলে ধরেছেন। তাঁরা যেন বিচ্ছিন্নভাবে দেখছিলেন হাতির প্রকাণ্ড শুঁড়, থামের মতো পা অথবা বিশালকায় দাঁত। কিন্তু হাতির পূর্ণ অবয়ব স্পষ্টভাবে চিত্রিত হয়নি।
বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের বিবরণ থেকে যেমন প্রকৃত প্রাণীটিকে বোঝা যায় না, তেমনি সামগ্রিকভাবে একটি দেশের অর্থনৈতিক সংকটের কারণ বিচ্ছিন্নভাবে কিছু খাতের অবস্থা পর্যালোচনা করে বোঝা একটু কঠিন। অথচ সঠিক নীতি প্রণয়নে এই সামগ্রিক কারণটিকে চিহ্নিত করা একান্ত প্রয়োজন।
একটু খতিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে যে, এখনকার যে সংকটের কথা বলা হচ্ছে তাঁর প্রধান কারণ হলো অতিরিক্ত ব্যয়, যেটির জন্য সরকার এবং ব্যক্তি খাত—দুই পক্ষই দায়ী। যেসব সমস্যার কথা বলা হয়েছে তাদের প্রায় সবগুলোরই উৎস হলো অতিরিক্ত ব্যয়। দেশের অর্থব্যবস্থার নীতিনির্ধারকেরা যদি সংকট সঠিকভাবে মোকাবিলা করতে চান তাহলে তাঁদেরকে অবশ্যই এই লাগামহীন খরচের রাশ টেনে ধরতে হবে।
সরকারতো বটেই, প্রত্যেকটি মানুষেরই একটি করে বাজেট আছে। এটা হলো তাঁর আয় এবং ব্যয়ের একটি হিসাব। যখন খরচ আয়ের চেয়ে বেশি হয়ে যায় তখন হয় বাজেট ঘাটতি, উল্টোটা হলে উদ্বৃত্ত থেকে যায়। ঘাটতি পূরণ করা যায় ধার করে অথবা সম্পদ বিক্রি করে।
যে কোনো অশিক্ষিত চাষী বা শ্রমিক এমনিক সাধারণ গৃহিনীকেও সহজে বোঝান যায় যে আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হওয়াটা বিপজ্জনক। দুর্ভাগ্যক্রমে অনেক সরকারকে বিশেষত উদারপন্থী সরকারকে এটা বোঝান বড়ই দুস্কর যে ক্রমবর্ধমান ঘাটতি একসময় অর্থনীতিকে সমস্যার মধ্যে ফেলে দেয়। এর অতি সাম্প্রতিক উদাহরণ হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং প্রায় দেউলিয়া হয়ে যাওয়া গ্রিস।
এই দুটি দেশের সরকারই (এবং আরও অনেক দেশের) অপরিণামদর্শীভাবে বছরের পর বছর ঘাটতি বাজেট দিয়ে পাহাড়সম ঋণ করে ফেলেছে। এতে স্বাভাবিকভাবেই এই ঋণ অর্থর্নতির জন্য বিরাট হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে দেশগুলোকে এখন কৃচ্ছ্র সাধন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে যা সাধারণ জনগণের জন্য বেশ দুর্ভোগ বয়ে আনছে।
একটা নির্মম পরিহাস যে, সরকার ও এর ভ্রান্ত নীতি যার সুযোগ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াল স্ট্রিটের রথী-মহারথীরা বিশ্বময় বিপর্যয় সৃষ্টি করলেও তাঁরা খুব একটা ক্ষতিগ্রস্ত হননি। উল্টো অনেক প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তারা এই চরম দুঃসময়েও তাঁদের বিশাল অঙ্কের বোনাসটি নিতে ভুল করেননি। অথচ একই সময়ে তাঁরা সরকারের কাছ থেকে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বেইল-আউট বা সাহায্য প্যাকেজ নিয়েছেন।
এই পরিস্থিতিতে মার্কিন নাগরিকেরা স্বাভাবিকভাবেই ক্ষুব্ধ এবং অবশেষে প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠেছে। আরব বসন্তের মতো এই মার্কিনি বসন্তও যথেষ্ট সাড়া জাগিয়েছে। ভিয়েতনামের পরে এই প্রথম এই রকম ব্যাপক আন্দোলন হচ্ছে এই দেশে। ইউরোপের সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে এই আন্দোলন ইউরোপের অনেক দেশে ছড়িয়ে যাচ্ছে। তবে যে কোনো দেশের ঘাটতি মূল্যায়ন করতে গেলে নির্ভরযোগ্য তথ্য প্রয়োজন। বাংলাদেশ সরকারের বাজেট ঘাটতি সম্পর্কে তথ্য পাওয়া সহজ কিন্তু ব্যক্তি খাতের হিসাব পাওয়াটি সেই তুলনায় যথেষ্ট কঠিন। ব্যক্তি খাতের হিসাব সরাসরি নির্ণয় করা না গেলেও সামষ্টিক অর্থনীতির কিছু তাত্ত্বিক সমীকরণের প্রয়োগ ঘটিয়ে এটি হিসাব করা যায়। এ রকম একটি সমীকরণ হলো বাজেট ঘাটতি ও ব্যক্তি খাতের ঘাটতি চলতি হিসাবের ঘাটতির সমান।
অর্থাৎ চলতি হিসাবের ঘাটতির বড় অংশটাই ব্যক্তি খাতের উদ্বৃত্ত কমে ঘাটতিতে পরিণত হওয়া। এই কমে যাওয়ার একটা বড় কারণ হতে পারে রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্টে বিনিয়োগ। সরকার জ্বালানিসংকট দ্রুত নিরসনের জন্য ব্যক্তি খাতে এই পদ্ধতিতে নতুন বিদ্যুৎ উৎপাদনের দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছে। এর ফলে তেলের আমদানি ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। একই সময়ে অন্যান্য শিল্পে বিনিয়োগ জ্বালানিসংকটের কারণে সীমিত ছিল। আবার যেহেতু জ্বালানিসংকটের দ্রুত কোনো সমাধান নেই, তাই অদূর ভবিষ্যতে অন্যান্য শিল্পে দ্রুত প্রবৃদ্ধি ঘটার তেমন কোনো সম্ভাবনা নেই।
জ্বালানি খাতে ভর্তুকির একটি বিরাট অংশ ব্যয় হচ্ছে এই গ্যাস এবং তেল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে প্রণোদনা হিসেবে যাতে এই প্রতিষ্ঠানগুলো লাভের মুখ দেখতে পায়। ফলে সৃষ্ট বাজেট ঘাটতি নিঃসন্দেহে এই অর্থবছরে আরও অনেক বৃদ্ধি পাবে। বিদ্যুৎ ও তেলের দামের ওপর যে ভর্তুকি আছে সেটি কমিয়ে সরকার এই বাজেট ঘাটতি কমিয়ে আনতে পারে, যেটি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলেরও পরামর্শ। কিন্তু এটি রাজনৈতিকভাবে সরকারের জন্য বেশ অস্বস্তিকর। বিশেষ করে এখনকার পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সরকার তাঁর শুরুর দিকের রাজনৈতিক সমর্থন অনেকখানি হারিয়ে ফেলেছে বলে পর্যবেক্ষকেরা মনে করছেন।
আরেকটা উদ্বেগের ব্যাপার হলে, প্রবাসী আয়প্রবাহ বৃদ্ধির হার দ্রুত কমে যাচ্ছে। যেখানে ২০০৮ সালে এই প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৩৩ শতাংশ এবং ২০০৯ সালে ১৯ শতাংশ, ২০১০ সালে তা ২ শতাংশে নেমে এসেছে। প্রবাসী আয়ের প্রবাহ ২০১১ সালে কিছুটা চাঙা হতে পারে। কিন্তু এটা আমদানির সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে পারবে না। ফলে এই অর্থবছরে চলতি হিসাব ঘাটতি দেখা দেওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। দেশের অর্থনীতির চলতি হিসাব ২০০৪-০৫ অর্থবছরের পর এই প্রথমবারের মতো ঘাটতির সম্মুখীন হবে। এতে গত সাত বছরে গড়া কষ্টসাধ্য রাজস্ব শৃঙ্খলা বিপত্তিতে পড়বে।
এই ঘাটতি পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার সময় এটা অনেকটাই অপ্রাসঙ্গিক যে অতিরিক্ত খরচ কোন খাতে হচ্ছে—বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে নাকি খাদ্যদ্রব্য আমদানিতে অথবা অন্য কোনো পণ্য আমদানিতে। যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি করছি, অবশ্যম্ভাবীভাবে সেটি চলতি হিসাবে ঘাটতিরূপে দেখা যাবে। জাতীয় ঘাটতি যত বেশি হবে, তত বেশি হবে চলতি হিসাবের ঘাটতি। বাজেট ঘাটতি কমানো যেতে পারে আয় বাড়িয়ে অথবা ব্যয় কমিয়ে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ইদানীং রাজস্ব আয় বাড়াতে বেশ সাফল্য অর্জন করেছে। আরও বাড়ানের চেষ্টা করাটা হিতে বিপরীত হতে পারে। তাই আয় হয়তো খুব বেশি বাড়ানো যাবে না।
এটি অনস্বীকার্য যে সরকারের ব্যয় কমাতে না পারলে বাজেট ঘাটতি কমবে না। সরকারকে এ জন্য কিছু উচ্চাভিলাষী প্রকল্প কাটছাঁট করতে হতে পারে। সরকারের মনে রাখা উচিত, যেকোনো খাতে অতিরিক্ত খরচ করলে অন্যান্য উৎপাদনশীল খাতে ব্যয় করার ক্ষমতা কমে যায়। একইভাবে ব্যক্তি খাতের অতিরিক্ত ব্যয় সম্পর্কেও সজাগ থাকতে হবে। মুদ্রানীতি ও রাজস্বনীতির সুচিন্তিত সমন্বয়ে ব্যক্তি ও রাজস্ব খাতের এই ঘাটতিসংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হতে পারে।
আবার ঘাটতি অর্থায়ন যদি কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে করা হয়, তাহলে অর্থনীতিতে মানিটারি রিজার্ভ (মুদ্রার মজুদ) বৃদ্ধি পায় যা মুদ্রার সরবরাহ বাড়িয়ে দেয়। ফলে মূল্যস্ফীতির এক অশুভ চক্রের সৃষ্টি হয়। সরকার আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে সরাসরি ঋণ করলে ব্যক্তি খাতের ঋণ নেওয়ার সক্ষমতা হ্রাস পায়। ফলে সুদের হার বেড়ে যায়। ব্যক্তি খাত এই অতিরিক্ত সুদের হার সামলাতে না পারলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক মুদ্রাবাজারে পুনরায় মুদ্রা সরবরাহ বাড়িয়ে দিতে পারে। ফলে অবশ্যম্ভাবীভাবে মূল্যস্ফীতির চাপ আরও বেড়ে যায়।
এসব কিছু থেকে আবার এটা বোঝানো হচ্ছে না যে এখনকার পরিস্থিতি খুবই ভয়াবহ, বাজেট ঘাটতি একেবারেই আয়ত্তের বাইরে চলে গিয়েছে এবং অর্থনীতি একটি মহাসংকটের মধ্যে আছে। বরং যে ধরনের সমস্যা তৈরি হয়েছে তা সুষ্ঠু অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে মোকাবিলা করা সম্ভব। সরকারের এ ব্যাপারে সদিচ্ছা থাকলে প্রথমেই উচ্চাকাঙ্ক্ষা কিছুটা কমিয়ে বাস্তবধর্মী প্রকল্প নিয়ে অগ্রসর হতে হবে- সম্পদের অপ্রতুলতার কথা চিন্তা করে। সরকার চাইলে এখনো অপরিণামদর্শী হয়ে বৃহত্তর ঘাটতির দিকে যেতে পারে। কিন্তু সেটি অবশ্যম্ভাবীভাবে অর্থনীতিকে একটি বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে নিয়ে যাবে।
এম এ তসলিম: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
m_a_taslim@yahoo.com
তবে সংকটের কারণ হিসেবে অতিরিক্ত ঋণ ও উচ্চ মূল্যস্ফীতিকে দায়ী করা হচ্ছিল। কুইক রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্টের বা ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য অত্যাধিক খরচ, ভর্তুকি এবং বাজেট ঘাটতিকেও কেউ কেউ সংকটের কারণ হিসেবে তুলে ধরেছিলেন। এসব শুনে মনে হচ্ছিল, আলোচকরা নিজ নিজ অবস্থান থেকে একটা খণ্ডিত চিত্র তুলে ধরেছেন। তাঁরা যেন বিচ্ছিন্নভাবে দেখছিলেন হাতির প্রকাণ্ড শুঁড়, থামের মতো পা অথবা বিশালকায় দাঁত। কিন্তু হাতির পূর্ণ অবয়ব স্পষ্টভাবে চিত্রিত হয়নি।
বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের বিবরণ থেকে যেমন প্রকৃত প্রাণীটিকে বোঝা যায় না, তেমনি সামগ্রিকভাবে একটি দেশের অর্থনৈতিক সংকটের কারণ বিচ্ছিন্নভাবে কিছু খাতের অবস্থা পর্যালোচনা করে বোঝা একটু কঠিন। অথচ সঠিক নীতি প্রণয়নে এই সামগ্রিক কারণটিকে চিহ্নিত করা একান্ত প্রয়োজন।
একটু খতিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে যে, এখনকার যে সংকটের কথা বলা হচ্ছে তাঁর প্রধান কারণ হলো অতিরিক্ত ব্যয়, যেটির জন্য সরকার এবং ব্যক্তি খাত—দুই পক্ষই দায়ী। যেসব সমস্যার কথা বলা হয়েছে তাদের প্রায় সবগুলোরই উৎস হলো অতিরিক্ত ব্যয়। দেশের অর্থব্যবস্থার নীতিনির্ধারকেরা যদি সংকট সঠিকভাবে মোকাবিলা করতে চান তাহলে তাঁদেরকে অবশ্যই এই লাগামহীন খরচের রাশ টেনে ধরতে হবে।
সরকারতো বটেই, প্রত্যেকটি মানুষেরই একটি করে বাজেট আছে। এটা হলো তাঁর আয় এবং ব্যয়ের একটি হিসাব। যখন খরচ আয়ের চেয়ে বেশি হয়ে যায় তখন হয় বাজেট ঘাটতি, উল্টোটা হলে উদ্বৃত্ত থেকে যায়। ঘাটতি পূরণ করা যায় ধার করে অথবা সম্পদ বিক্রি করে।
যে কোনো অশিক্ষিত চাষী বা শ্রমিক এমনিক সাধারণ গৃহিনীকেও সহজে বোঝান যায় যে আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হওয়াটা বিপজ্জনক। দুর্ভাগ্যক্রমে অনেক সরকারকে বিশেষত উদারপন্থী সরকারকে এটা বোঝান বড়ই দুস্কর যে ক্রমবর্ধমান ঘাটতি একসময় অর্থনীতিকে সমস্যার মধ্যে ফেলে দেয়। এর অতি সাম্প্রতিক উদাহরণ হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং প্রায় দেউলিয়া হয়ে যাওয়া গ্রিস।
এই দুটি দেশের সরকারই (এবং আরও অনেক দেশের) অপরিণামদর্শীভাবে বছরের পর বছর ঘাটতি বাজেট দিয়ে পাহাড়সম ঋণ করে ফেলেছে। এতে স্বাভাবিকভাবেই এই ঋণ অর্থর্নতির জন্য বিরাট হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে দেশগুলোকে এখন কৃচ্ছ্র সাধন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে যা সাধারণ জনগণের জন্য বেশ দুর্ভোগ বয়ে আনছে।
একটা নির্মম পরিহাস যে, সরকার ও এর ভ্রান্ত নীতি যার সুযোগ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াল স্ট্রিটের রথী-মহারথীরা বিশ্বময় বিপর্যয় সৃষ্টি করলেও তাঁরা খুব একটা ক্ষতিগ্রস্ত হননি। উল্টো অনেক প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তারা এই চরম দুঃসময়েও তাঁদের বিশাল অঙ্কের বোনাসটি নিতে ভুল করেননি। অথচ একই সময়ে তাঁরা সরকারের কাছ থেকে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বেইল-আউট বা সাহায্য প্যাকেজ নিয়েছেন।
এই পরিস্থিতিতে মার্কিন নাগরিকেরা স্বাভাবিকভাবেই ক্ষুব্ধ এবং অবশেষে প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠেছে। আরব বসন্তের মতো এই মার্কিনি বসন্তও যথেষ্ট সাড়া জাগিয়েছে। ভিয়েতনামের পরে এই প্রথম এই রকম ব্যাপক আন্দোলন হচ্ছে এই দেশে। ইউরোপের সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে এই আন্দোলন ইউরোপের অনেক দেশে ছড়িয়ে যাচ্ছে। তবে যে কোনো দেশের ঘাটতি মূল্যায়ন করতে গেলে নির্ভরযোগ্য তথ্য প্রয়োজন। বাংলাদেশ সরকারের বাজেট ঘাটতি সম্পর্কে তথ্য পাওয়া সহজ কিন্তু ব্যক্তি খাতের হিসাব পাওয়াটি সেই তুলনায় যথেষ্ট কঠিন। ব্যক্তি খাতের হিসাব সরাসরি নির্ণয় করা না গেলেও সামষ্টিক অর্থনীতির কিছু তাত্ত্বিক সমীকরণের প্রয়োগ ঘটিয়ে এটি হিসাব করা যায়। এ রকম একটি সমীকরণ হলো বাজেট ঘাটতি ও ব্যক্তি খাতের ঘাটতি চলতি হিসাবের ঘাটতির সমান।
অর্থাৎ চলতি হিসাবের ঘাটতির বড় অংশটাই ব্যক্তি খাতের উদ্বৃত্ত কমে ঘাটতিতে পরিণত হওয়া। এই কমে যাওয়ার একটা বড় কারণ হতে পারে রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্টে বিনিয়োগ। সরকার জ্বালানিসংকট দ্রুত নিরসনের জন্য ব্যক্তি খাতে এই পদ্ধতিতে নতুন বিদ্যুৎ উৎপাদনের দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছে। এর ফলে তেলের আমদানি ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। একই সময়ে অন্যান্য শিল্পে বিনিয়োগ জ্বালানিসংকটের কারণে সীমিত ছিল। আবার যেহেতু জ্বালানিসংকটের দ্রুত কোনো সমাধান নেই, তাই অদূর ভবিষ্যতে অন্যান্য শিল্পে দ্রুত প্রবৃদ্ধি ঘটার তেমন কোনো সম্ভাবনা নেই।
জ্বালানি খাতে ভর্তুকির একটি বিরাট অংশ ব্যয় হচ্ছে এই গ্যাস এবং তেল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে প্রণোদনা হিসেবে যাতে এই প্রতিষ্ঠানগুলো লাভের মুখ দেখতে পায়। ফলে সৃষ্ট বাজেট ঘাটতি নিঃসন্দেহে এই অর্থবছরে আরও অনেক বৃদ্ধি পাবে। বিদ্যুৎ ও তেলের দামের ওপর যে ভর্তুকি আছে সেটি কমিয়ে সরকার এই বাজেট ঘাটতি কমিয়ে আনতে পারে, যেটি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলেরও পরামর্শ। কিন্তু এটি রাজনৈতিকভাবে সরকারের জন্য বেশ অস্বস্তিকর। বিশেষ করে এখনকার পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সরকার তাঁর শুরুর দিকের রাজনৈতিক সমর্থন অনেকখানি হারিয়ে ফেলেছে বলে পর্যবেক্ষকেরা মনে করছেন।
আরেকটা উদ্বেগের ব্যাপার হলে, প্রবাসী আয়প্রবাহ বৃদ্ধির হার দ্রুত কমে যাচ্ছে। যেখানে ২০০৮ সালে এই প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৩৩ শতাংশ এবং ২০০৯ সালে ১৯ শতাংশ, ২০১০ সালে তা ২ শতাংশে নেমে এসেছে। প্রবাসী আয়ের প্রবাহ ২০১১ সালে কিছুটা চাঙা হতে পারে। কিন্তু এটা আমদানির সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে পারবে না। ফলে এই অর্থবছরে চলতি হিসাব ঘাটতি দেখা দেওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। দেশের অর্থনীতির চলতি হিসাব ২০০৪-০৫ অর্থবছরের পর এই প্রথমবারের মতো ঘাটতির সম্মুখীন হবে। এতে গত সাত বছরে গড়া কষ্টসাধ্য রাজস্ব শৃঙ্খলা বিপত্তিতে পড়বে।
এই ঘাটতি পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার সময় এটা অনেকটাই অপ্রাসঙ্গিক যে অতিরিক্ত খরচ কোন খাতে হচ্ছে—বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে নাকি খাদ্যদ্রব্য আমদানিতে অথবা অন্য কোনো পণ্য আমদানিতে। যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি করছি, অবশ্যম্ভাবীভাবে সেটি চলতি হিসাবে ঘাটতিরূপে দেখা যাবে। জাতীয় ঘাটতি যত বেশি হবে, তত বেশি হবে চলতি হিসাবের ঘাটতি। বাজেট ঘাটতি কমানো যেতে পারে আয় বাড়িয়ে অথবা ব্যয় কমিয়ে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ইদানীং রাজস্ব আয় বাড়াতে বেশ সাফল্য অর্জন করেছে। আরও বাড়ানের চেষ্টা করাটা হিতে বিপরীত হতে পারে। তাই আয় হয়তো খুব বেশি বাড়ানো যাবে না।
এটি অনস্বীকার্য যে সরকারের ব্যয় কমাতে না পারলে বাজেট ঘাটতি কমবে না। সরকারকে এ জন্য কিছু উচ্চাভিলাষী প্রকল্প কাটছাঁট করতে হতে পারে। সরকারের মনে রাখা উচিত, যেকোনো খাতে অতিরিক্ত খরচ করলে অন্যান্য উৎপাদনশীল খাতে ব্যয় করার ক্ষমতা কমে যায়। একইভাবে ব্যক্তি খাতের অতিরিক্ত ব্যয় সম্পর্কেও সজাগ থাকতে হবে। মুদ্রানীতি ও রাজস্বনীতির সুচিন্তিত সমন্বয়ে ব্যক্তি ও রাজস্ব খাতের এই ঘাটতিসংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হতে পারে।
আবার ঘাটতি অর্থায়ন যদি কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে করা হয়, তাহলে অর্থনীতিতে মানিটারি রিজার্ভ (মুদ্রার মজুদ) বৃদ্ধি পায় যা মুদ্রার সরবরাহ বাড়িয়ে দেয়। ফলে মূল্যস্ফীতির এক অশুভ চক্রের সৃষ্টি হয়। সরকার আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে সরাসরি ঋণ করলে ব্যক্তি খাতের ঋণ নেওয়ার সক্ষমতা হ্রাস পায়। ফলে সুদের হার বেড়ে যায়। ব্যক্তি খাত এই অতিরিক্ত সুদের হার সামলাতে না পারলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক মুদ্রাবাজারে পুনরায় মুদ্রা সরবরাহ বাড়িয়ে দিতে পারে। ফলে অবশ্যম্ভাবীভাবে মূল্যস্ফীতির চাপ আরও বেড়ে যায়।
এসব কিছু থেকে আবার এটা বোঝানো হচ্ছে না যে এখনকার পরিস্থিতি খুবই ভয়াবহ, বাজেট ঘাটতি একেবারেই আয়ত্তের বাইরে চলে গিয়েছে এবং অর্থনীতি একটি মহাসংকটের মধ্যে আছে। বরং যে ধরনের সমস্যা তৈরি হয়েছে তা সুষ্ঠু অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে মোকাবিলা করা সম্ভব। সরকারের এ ব্যাপারে সদিচ্ছা থাকলে প্রথমেই উচ্চাকাঙ্ক্ষা কিছুটা কমিয়ে বাস্তবধর্মী প্রকল্প নিয়ে অগ্রসর হতে হবে- সম্পদের অপ্রতুলতার কথা চিন্তা করে। সরকার চাইলে এখনো অপরিণামদর্শী হয়ে বৃহত্তর ঘাটতির দিকে যেতে পারে। কিন্তু সেটি অবশ্যম্ভাবীভাবে অর্থনীতিকে একটি বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে নিয়ে যাবে।
এম এ তসলিম: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
m_a_taslim@yahoo.com
No comments