অবসরপ্রাপ্ত দুই মেজরের কথা by মাহবুব তালুকদার
গুরুদেব যোগাসনে ধ্যানস্থ হইয়া বসিয়াছিলেন। শিষ্য তাহার মুখশ্রী অবলোকন করিতেছিল। ধ্যানমগ্ন অবস্থায় গুরুদেবের মুখমণ্ডল হইতে ঐশ্বরিক বিভা ছড়ায়। চতুষ্পার্শ্ব যেন আলোকিত হইয়া ওঠে। উহা দেখিয়া শিষ্য একপ্রকার অভিভূত হইয়াছিল। একসময়ে গুরুদেবের চক্ষুদ্বয় উন্মীলিত হইল। তিনি শিষ্যের প্রতি দৃকপাত করিয়া কহিলেন, বত্স! অবধান করো। আপনার যথা আজ্ঞা প্রভু! শিষ্য অবনত শিরে কহিল। তুমি কি দুই মেজরের আইনি লড়াই সম্পর্কে অবহিত আছো?
হ্যাঁ, প্রভু! আমি আদালতের ঘটনা ও দুর্ঘটনা লইয়া সর্বদাই ভাবিত। ওই স্থানে যাহা কিছু ঘটে, সংবাদ মাধ্যমে তাহা অনুসরণ করি। বুঝিতেছি আপনি মেজর (অব.) হাফিজ ও মেজর (অব.) জসিমের সংসদ নির্বাচনের কথা উল্লেখ করিয়াছেন। তাহাদের উভয়ের নানাবিধ মিল দেখিয়া আমি নিজেই বিস্মিত। তাহাদের মধ্যে মিল কোথায়? বরং উভয়ের মধ্যে বস্ল গরমিল পরিলক্ষিত হইতেছে। আমার সীমাহীন অজ্ঞতা মার্জনা করিলে বাধিত হইব। শিষ্য বিনয়াবনত কণ্ঠে বলিল, তাহারা উভয়ে কেবল অবসরপ্রাপ্ত মেজর নহেন, উভয়ের নামের সহিত ‘উদ্দিন’ আছে। উভয়েই এক উপজেলার বাসিন্দা। এতদ্ব্যতীত তাহারা উভয়ে একই সংসদ সদস্যপদের দাবিদার। রুদেব মৃদুহাস্যভরে জানাইলেন, তুমি যথার্থ বলিয়াছ। এক্ষণে মেজর (অব.) জসিম উদ্দিনের এমপি পদ বাতিল প্রসঙ্গে যাহা জানো, বর্ণনা করো। শিষ্য জানাইল, দুর্নীতির দায়ে বাধ্যতামূলক অবসরপ্রাপ্ত ভোলা-৩ আসনের আওয়ামী লীগ দলীয় এমপি মেজর (অব.) জসিম উদ্দিনের সংসদ সদস্যপদ সুপ্রিমকোর্টের রায়ে খারিজ হইয়া গিয়াছে। এতদ্সম্পর্কে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ বা আরপিও-তে বলা হইয়াছে, প্রতিরক্ষা কর্ম বিভাগের চাকরি হইতে বরখাস্ত, অপসারিত বা বাধ্যতামলূক অবসরের পরে ৫ বত্সরকাল অতিবাহিত না হইলে কাহারও মনোনয়নপত্র বৈধ হিসাবে ঘোষিত হইবে না। মেজর জসিম উদ্দিন দুর্নীতির দায়ে অবসরপ্রাপ্ত হওয়ায় এই আইনের ব্যত্যয় ঘটার কোনো অবকাশ ছিল না এবং নির্বাচনে তাহার মনোনয়ন ছিল অবৈধ। তাহার প্রতিপক্ষ বিএনপি দলীয় অপর নির্বাচন প্রার্থী মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন এমতাবস্থায় জসিম উদ্দিনের প্রার্থিতা চ্যালেঞ্জ করিয়া হাইকোর্টে রিট করিলে হাইকোর্ট জসিম উদ্দিনের সংসদ সদস্যপদ বাতিল করিয়া ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ তারিখে রায় প্রদান করেন। উক্ত রায়ের সাত মাস পর গত ২৩ সেপ্টেম্বর ২০০৯ তারিখে প্রধানমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে সেনাবাহিনীর সংশ্লিষ্ট দফতর ‘বাধ্যতামূলক অবসর’ আদেশ পরিবর্তন করিয়া ‘অকালীন অবসর’ প্রদানের আদেশ জারি করে। জারি করা আদেশের কার্যকারিতা দেওয়া হইয়াছে ৫ বৎসর পূর্বে ২০০৪ সালের ৩১ আগসল্ট হইতে। এই গেজেট নোটিফিকেশন দেখাইয়া মেজর জসিম সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগে তাহার সংসদ সদস্যপদ রক্ষার চেষ্টা চালান। কিন্তু হাইকোর্টের রায়ের পর ওই আদেশের কোনো কার্যকারিতা নাই বলিয়া আপিল বিভাগ উহা প্রত্যাখ্যান করে। শিষ্যের বর্ণনা সমাপ্ত হইলে গুরুদেব জিজ্ঞাসিলেন, এই বিষয়ে তোমার অভিমত কী?
গোস্তাকি মাফ করিলে আমার বক্তব্য জানাইতে পারি। নির্ভয়ে বলো। মহাত্মন! পত্রিকায় লিখিয়াছে মেজর (অব.) জসিম উদ্দিনের সংসদ সদস্যপদ রক্ষার জন্য সেনাবাহিনীর নোটিফিকেশনের কার্যক্রম ছিল অনৈতিক। উহা কাহার নির্দেশে হইয়াছিল? মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর। তিনি একাধারে প্রতিরক্ষামন্ত্রীও বটে। বৎস! প্রধানমন্ত্রীর কোনো কার্যক্রমই অনৈতিক হইতে পারে না। তিনি যাহা কিছু করিবেন বা করিয়াছেন, সবই নৈতিক। প্রভু! ইহা কি কোনো কথা হইতে পারে? অবশ্যই পারে। ইংরেজিতে একটি প্রবাদ আছে, রাজা ভুল করিতে পারেন না। তদ্রূপ আমাদের প্রধানমন্ত্রীও ভুল করিতে পারেন না। তাহার সকল আদেশ-নির্দেশকে নির্ভুল ও শুদ্ধ বলিয়া গণ্য করিতে হইবে। তাহার বিষয়ে নৈতিকতার প্রশ্ন তোলা অবান্তর। কিন্তু মেজর (অব.) জসিমকে লইয়া নির্বাচন কমিশনের কার্যক্রমও কি নৈতিক? তাহাদের কোন্ কার্যক্রম? ফেব্রুয়ারি মাসে হাইকোর্টে মেজর (অব.) জসিম সংসদ সদস্যপদ হারানোর পর নির্বাচন কমিশন জুন মাসে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে সংশোধনী আনে। উহাতে বলা হয়, দুর্নীতির দায়ে বাধ্যতামূলক অবসরপ্রাপ্ত হইলেই কেবল ৫ বত্সর অতিক্রান্ত হইতে হইবে। অন্যথায় ৩ বত্সর অতিক্রান্ত হইলেই অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তি বা সামরিক কর্মকর্তা সংসদ সদস্য হওয়ার বা থাকার যোগ্য হইবেন। কিন্তু ব্যক্তির কারণে নির্বাচন কমিশন বিধি পরিবর্তন করিলেও দেখা গেল মেজর (অব.) জসিমের চাকরিচ্যুতি ঘটিয়াছিল দুর্নীতির কারণে। অতএব তাহার শেষরক্ষা হইল না। গুরুদেব বলিলেন, তুমি পুরো ঘটনাই বিবৃত করিলে। তোমার অভিমত প্রকাশ করিলে না। প্রভু! নির্বাচন কমিশন অতিশয় নগ্নভাবে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের সংশোধনী আনয়ন করিয়াছে। ইহা অত্যন্ত অনৈতিক। ইহাতে কমিশনের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হইয়াছে। কী মূর্তি বলিলে? ভাবমূর্তি। শিষ্য কহিল, আমি নির্বাচন কমিশনের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হইয়াছে বলিয়া মনে করি। বৎস! নির্বাচন কমিশনের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হইয়াছে মনে করিলে উহা তোমার সমস্যার ব্যাপার, নির্বাচন কমিশনের উহাতে কোনো সমস্যা নাই। কিন্তু নির্বাচন কমিশন তো ব্যক্তির জন্য বিধি পরিবর্তন করিতে পারে না। অবশ্যই পারে। ব্যক্তির জন্য আমাদের দেশের সংবিধান পরিবর্তন হইতে পারিলে নির্বাচন কমিশন ব্যক্তির জন্য বিধি পরিবর্তন করিতে পারিবে না কেন? প্রভু! আমি এই সকল কথায় বিভ্রান্ত হইতেছি। বিভ্রান্তির কিছু নাই। নির্বাচন কমিশনের হাতে একটি মহা মূল্যবান অস্ত্র রহিয়াছে। উহার নাম ‘ডকট্রিন অব নেসিসিটি’। নির্বাচন কমিশন ইহা প্রয়োগ করিয়া যে কোনো অনৈতিক বা অবৈধ কাজকে নৈতিক বা বৈধ ঘোষণা করিতে পারে। মেজর (অব.) জসিমের সংসদ সদস্যপদ রক্ষার্থে ‘ডকট্রিন অব নেসিটিসি?’ কেন নয়? মেজর (অব.) জসিমের ব্যাপারে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় যখন সংশোধিত নোটিফিকেশন জারি করিয়া ‘বাধ্যতামূলক অবসর’কে ‘অকালীন অবসর’ হিসাবে রূপান্তর করিল, তখন নির্বাচন কমিশনও ব্যাকআপ প্রদান করিতে ওই আইনের সংশোধনী জারি করে। ইহা কি উচিত হইয়াছে? উচিত-অনুচিতের প্রশ্ন তোলা এই ক্ষেত্রে অবান্তর। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে নির্বাচন কমিশন সরকারের মন জোগাইয়া কাজ করিতে পারিলে বর্তমান গণতান্ত্রিক সরকারের আমলে তাহা পারিবে না কেন? ইহার কারণ কি এই যে, দেশে বর্তমানে জরুরি অবস্থা নাই? মেজর (অব.) জসিমের ঘটনায় অনেকে নির্বাচন কমিশনের পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ করিয়াছেন। তাহাতে কী হইল? তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে নির্বাচন কমিশন বিএনপি মহাসচিবের নিকট প্রেরিতব্য চিঠি খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনের পরিবর্তে মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদকে প্রদান করিয়াছিল। উহাতে অনেকে মেজর (অব.) হাফিজের প্রতি নির্বাচন কমিশনের পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ তুলিয়াছিলেন। নির্বাচন কমিশন তো পুনরায় মেজর (অব.) হাফিজের প্রতি পক্ষপাতিত্বের ঝুঁকি নিতে পারে না। পূর্বের পক্ষপাতিত্ব ব্যালেন্স করিতেই এইবার তাহারা মেজর (অব.) জসিমের প্রতি ঝুঁকিয়াছেন। প্রভু! নির্বাচন কমিশনের বিপদ এখনও কাটে নাই। কেন? মেজর (অব.) জসিম উদ্দিনের সদস্যপদ বাতিল করিয়া নির্বাচন কমিশন শিগগিরই ভোলা-৩ আসনকে শূন্য ঘোষণা করিবে। উক্ত গেজেট প্রকাশের ৯০ দিনের মধ্যে কমিশনকে সংশ্লিষ্ট আসনে উপনির্বাচন সম্পন্ন করিতে হইবে। তবে নির্বাচন কমিশন এই আসনে উপনির্বাচন, না পুনরায় নির্বাচন করিবে তাহা লইয়া দ্বিধায় পড়িয়াছে। তাহাদের দ্বিধার কারণ কী? নিয়ম অনুযায়ী উপনির্বাচন হইলে উহা সম্পূর্ণ নতুন প্রার্থী দ্বারা নতুন তফশিলে নির্বাচন হইতে হইবে। অন্যদিকে পুনর্নির্বাচন হইলে আওয়ামী লীগের প্রার্থিতা বাতিল হওয়ায় বাকি প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বাদ দিয়া অন্যদের লইয়া নির্বাচন করা কি সম্ভব? তাহা ঠিক। তবে মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন দাবি করিয়াছেন, যেহেতু বিজয়ী প্রার্থীর প্রার্থিতা অবৈধ ঘোষিত হইয়াছে, সেই হেতু দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ভোটপ্রাপ্ত প্রার্থী হিসাবে তিনি বিজয়ী ঘোষণার যোগ্য। সুনামগঞ্জে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের আসনে এইরূপ নজির আছে বলিয়া তিনি উল্লেখ করিয়াছেন। এ অবস্থায় মেজর (অব.) জসিম উদ্দিনের ভবিষ্যত্ কী? মেজর জসিম উদ্দিন ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বলিয়াছেন, সুপ্রিমকোর্টের রায় হাতে পাওয়ার পর তিনি সেনাবাহিনী ও নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ নেবেন। তিনি নাকি এখন রাজনৈতিক মৃত্যুর প্রহর গুনিতেছেন। তাহার অভিযোগ কী? তাহার অভিযোগ হইতেছে, তিনি যদি সেনাবাহিনীতে থাকা অবস্থায় কোনো অনিয়ম বা দুর্নীতি করিয়া থাকেন, তাহা হইলে কেন সেনা আইনে তাহার বিচার হইল না? আর নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে অভিযোগ? তাহার মনে হইয়াছে নির্বাচন কমিশনে তিনি কোনো তথ্য গোপন করেন নাই। নির্বাচন কমিশনের অনুমোদন পাইয়াই তিনি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করিয়াছিলেন। এমতাবস্থায়, যাহা কিছু ঘটিয়াছে, তাহার জন্য নির্বাচন কমিশনই দায়ী। শিষ্য জানাইল। ইহাতে নির্বাচন কমিশনের অবস্থান কী? গুরুদেব জিজ্ঞাসিলেন। নির্বাচন কমিশনার এম ছস্লল হোসাইন জানাইয়াছেন, মনোনয়নপত্র জমা দিবার সময় মেজর (অব.) জসিম উদ্দিন একটি চিঠি লিখিয়া জানাইয়াছিলেন, তাহার ক্ষেত্রে আরপিও ১২(১) (জ) প্রযোজ্য। ১২(১) (ছ) প্রযোজ্য নহে। ফলে সেনাবাহিনীর বিশেষজ্ঞের মতামতের ভিত্তিতে মেজর (অব.) জসিম উদ্দিনের মনোনয়নপত্র বৈধ ঘোষণা করা হয়। হাইকোর্টের রায়ে দেখা যায়, মূলত মেজর (অব.) জসিম উদ্দিনের বিষয়ে আরপিও ১২(১) (ছ)ই প্রযোজ্য। ইহাতে তাহার মনোনয়নপত্র বৈধ হওয়ার অবকাশ ছিল না। মেজর (অব.) জসিম উদ্দিনের পুনরায় নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার পথ রুদ্ধ হইয়াছে কি? আগামীতে ভোলা-৩ আসনে উপনির্বাচন হইলে মেজর (অব.) জসিমউদ্দিন উহাতে প্রার্থী হইতে পারেন। দুর্নীতির দায়ে সেনাবাহিনীতে অবসর প্রদানের পর গত আগসল্ট মাসে তাহার ৫ বত্সর অতিক্রান্ত হইয়াছে। এমতাবস্থায় আগামী দিনে যে কোনো নির্বাচনে মেজর (অব.) জসিম উদ্দিন সংসদ সদস্য প্রার্থী হওয়ার উপযুক্ত। তবে তিনি সংসদ সদস্য হইতে পারিবেন কিনা সন্দেহ। কেন? এই কথা বলিতেছ কেন? সংসদ সদস্য হইতে হইলে এইবারও তাহাকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাইতে হইবে। আওয়ামী লীগ তাহাকে পুনরায় মনোনয়ন দিবে কিনা, তাহা একটি মূল্যবান প্রশ্ন। আর বাক্যব্যয় না করিয়া গুরুদেব দুই চোখ বুজিয়া গভীর ধ্যানে মগ্ন হইলেন। শিষ্যের ধারণা হইল, গুরুদেব ধ্যানস্থ হইয়া মেজর (অব.) জসিম উদ্দিন ভবিষ্যতে মনোনয়ন পাইবেন কিনা, উহার উত্তর অনুসন্ব্দান করিতেছেন।
লেখক : কবি ও কথাসাহিত্যিক
ই-মেইল : mahabub_talukdar@yahoo.com
গোস্তাকি মাফ করিলে আমার বক্তব্য জানাইতে পারি। নির্ভয়ে বলো। মহাত্মন! পত্রিকায় লিখিয়াছে মেজর (অব.) জসিম উদ্দিনের সংসদ সদস্যপদ রক্ষার জন্য সেনাবাহিনীর নোটিফিকেশনের কার্যক্রম ছিল অনৈতিক। উহা কাহার নির্দেশে হইয়াছিল? মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর। তিনি একাধারে প্রতিরক্ষামন্ত্রীও বটে। বৎস! প্রধানমন্ত্রীর কোনো কার্যক্রমই অনৈতিক হইতে পারে না। তিনি যাহা কিছু করিবেন বা করিয়াছেন, সবই নৈতিক। প্রভু! ইহা কি কোনো কথা হইতে পারে? অবশ্যই পারে। ইংরেজিতে একটি প্রবাদ আছে, রাজা ভুল করিতে পারেন না। তদ্রূপ আমাদের প্রধানমন্ত্রীও ভুল করিতে পারেন না। তাহার সকল আদেশ-নির্দেশকে নির্ভুল ও শুদ্ধ বলিয়া গণ্য করিতে হইবে। তাহার বিষয়ে নৈতিকতার প্রশ্ন তোলা অবান্তর। কিন্তু মেজর (অব.) জসিমকে লইয়া নির্বাচন কমিশনের কার্যক্রমও কি নৈতিক? তাহাদের কোন্ কার্যক্রম? ফেব্রুয়ারি মাসে হাইকোর্টে মেজর (অব.) জসিম সংসদ সদস্যপদ হারানোর পর নির্বাচন কমিশন জুন মাসে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে সংশোধনী আনে। উহাতে বলা হয়, দুর্নীতির দায়ে বাধ্যতামূলক অবসরপ্রাপ্ত হইলেই কেবল ৫ বত্সর অতিক্রান্ত হইতে হইবে। অন্যথায় ৩ বত্সর অতিক্রান্ত হইলেই অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তি বা সামরিক কর্মকর্তা সংসদ সদস্য হওয়ার বা থাকার যোগ্য হইবেন। কিন্তু ব্যক্তির কারণে নির্বাচন কমিশন বিধি পরিবর্তন করিলেও দেখা গেল মেজর (অব.) জসিমের চাকরিচ্যুতি ঘটিয়াছিল দুর্নীতির কারণে। অতএব তাহার শেষরক্ষা হইল না। গুরুদেব বলিলেন, তুমি পুরো ঘটনাই বিবৃত করিলে। তোমার অভিমত প্রকাশ করিলে না। প্রভু! নির্বাচন কমিশন অতিশয় নগ্নভাবে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের সংশোধনী আনয়ন করিয়াছে। ইহা অত্যন্ত অনৈতিক। ইহাতে কমিশনের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হইয়াছে। কী মূর্তি বলিলে? ভাবমূর্তি। শিষ্য কহিল, আমি নির্বাচন কমিশনের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হইয়াছে বলিয়া মনে করি। বৎস! নির্বাচন কমিশনের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হইয়াছে মনে করিলে উহা তোমার সমস্যার ব্যাপার, নির্বাচন কমিশনের উহাতে কোনো সমস্যা নাই। কিন্তু নির্বাচন কমিশন তো ব্যক্তির জন্য বিধি পরিবর্তন করিতে পারে না। অবশ্যই পারে। ব্যক্তির জন্য আমাদের দেশের সংবিধান পরিবর্তন হইতে পারিলে নির্বাচন কমিশন ব্যক্তির জন্য বিধি পরিবর্তন করিতে পারিবে না কেন? প্রভু! আমি এই সকল কথায় বিভ্রান্ত হইতেছি। বিভ্রান্তির কিছু নাই। নির্বাচন কমিশনের হাতে একটি মহা মূল্যবান অস্ত্র রহিয়াছে। উহার নাম ‘ডকট্রিন অব নেসিসিটি’। নির্বাচন কমিশন ইহা প্রয়োগ করিয়া যে কোনো অনৈতিক বা অবৈধ কাজকে নৈতিক বা বৈধ ঘোষণা করিতে পারে। মেজর (অব.) জসিমের সংসদ সদস্যপদ রক্ষার্থে ‘ডকট্রিন অব নেসিটিসি?’ কেন নয়? মেজর (অব.) জসিমের ব্যাপারে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় যখন সংশোধিত নোটিফিকেশন জারি করিয়া ‘বাধ্যতামূলক অবসর’কে ‘অকালীন অবসর’ হিসাবে রূপান্তর করিল, তখন নির্বাচন কমিশনও ব্যাকআপ প্রদান করিতে ওই আইনের সংশোধনী জারি করে। ইহা কি উচিত হইয়াছে? উচিত-অনুচিতের প্রশ্ন তোলা এই ক্ষেত্রে অবান্তর। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে নির্বাচন কমিশন সরকারের মন জোগাইয়া কাজ করিতে পারিলে বর্তমান গণতান্ত্রিক সরকারের আমলে তাহা পারিবে না কেন? ইহার কারণ কি এই যে, দেশে বর্তমানে জরুরি অবস্থা নাই? মেজর (অব.) জসিমের ঘটনায় অনেকে নির্বাচন কমিশনের পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ করিয়াছেন। তাহাতে কী হইল? তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে নির্বাচন কমিশন বিএনপি মহাসচিবের নিকট প্রেরিতব্য চিঠি খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনের পরিবর্তে মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদকে প্রদান করিয়াছিল। উহাতে অনেকে মেজর (অব.) হাফিজের প্রতি নির্বাচন কমিশনের পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ তুলিয়াছিলেন। নির্বাচন কমিশন তো পুনরায় মেজর (অব.) হাফিজের প্রতি পক্ষপাতিত্বের ঝুঁকি নিতে পারে না। পূর্বের পক্ষপাতিত্ব ব্যালেন্স করিতেই এইবার তাহারা মেজর (অব.) জসিমের প্রতি ঝুঁকিয়াছেন। প্রভু! নির্বাচন কমিশনের বিপদ এখনও কাটে নাই। কেন? মেজর (অব.) জসিম উদ্দিনের সদস্যপদ বাতিল করিয়া নির্বাচন কমিশন শিগগিরই ভোলা-৩ আসনকে শূন্য ঘোষণা করিবে। উক্ত গেজেট প্রকাশের ৯০ দিনের মধ্যে কমিশনকে সংশ্লিষ্ট আসনে উপনির্বাচন সম্পন্ন করিতে হইবে। তবে নির্বাচন কমিশন এই আসনে উপনির্বাচন, না পুনরায় নির্বাচন করিবে তাহা লইয়া দ্বিধায় পড়িয়াছে। তাহাদের দ্বিধার কারণ কী? নিয়ম অনুযায়ী উপনির্বাচন হইলে উহা সম্পূর্ণ নতুন প্রার্থী দ্বারা নতুন তফশিলে নির্বাচন হইতে হইবে। অন্যদিকে পুনর্নির্বাচন হইলে আওয়ামী লীগের প্রার্থিতা বাতিল হওয়ায় বাকি প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বাদ দিয়া অন্যদের লইয়া নির্বাচন করা কি সম্ভব? তাহা ঠিক। তবে মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন দাবি করিয়াছেন, যেহেতু বিজয়ী প্রার্থীর প্রার্থিতা অবৈধ ঘোষিত হইয়াছে, সেই হেতু দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ভোটপ্রাপ্ত প্রার্থী হিসাবে তিনি বিজয়ী ঘোষণার যোগ্য। সুনামগঞ্জে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের আসনে এইরূপ নজির আছে বলিয়া তিনি উল্লেখ করিয়াছেন। এ অবস্থায় মেজর (অব.) জসিম উদ্দিনের ভবিষ্যত্ কী? মেজর জসিম উদ্দিন ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বলিয়াছেন, সুপ্রিমকোর্টের রায় হাতে পাওয়ার পর তিনি সেনাবাহিনী ও নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ নেবেন। তিনি নাকি এখন রাজনৈতিক মৃত্যুর প্রহর গুনিতেছেন। তাহার অভিযোগ কী? তাহার অভিযোগ হইতেছে, তিনি যদি সেনাবাহিনীতে থাকা অবস্থায় কোনো অনিয়ম বা দুর্নীতি করিয়া থাকেন, তাহা হইলে কেন সেনা আইনে তাহার বিচার হইল না? আর নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে অভিযোগ? তাহার মনে হইয়াছে নির্বাচন কমিশনে তিনি কোনো তথ্য গোপন করেন নাই। নির্বাচন কমিশনের অনুমোদন পাইয়াই তিনি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করিয়াছিলেন। এমতাবস্থায়, যাহা কিছু ঘটিয়াছে, তাহার জন্য নির্বাচন কমিশনই দায়ী। শিষ্য জানাইল। ইহাতে নির্বাচন কমিশনের অবস্থান কী? গুরুদেব জিজ্ঞাসিলেন। নির্বাচন কমিশনার এম ছস্লল হোসাইন জানাইয়াছেন, মনোনয়নপত্র জমা দিবার সময় মেজর (অব.) জসিম উদ্দিন একটি চিঠি লিখিয়া জানাইয়াছিলেন, তাহার ক্ষেত্রে আরপিও ১২(১) (জ) প্রযোজ্য। ১২(১) (ছ) প্রযোজ্য নহে। ফলে সেনাবাহিনীর বিশেষজ্ঞের মতামতের ভিত্তিতে মেজর (অব.) জসিম উদ্দিনের মনোনয়নপত্র বৈধ ঘোষণা করা হয়। হাইকোর্টের রায়ে দেখা যায়, মূলত মেজর (অব.) জসিম উদ্দিনের বিষয়ে আরপিও ১২(১) (ছ)ই প্রযোজ্য। ইহাতে তাহার মনোনয়নপত্র বৈধ হওয়ার অবকাশ ছিল না। মেজর (অব.) জসিম উদ্দিনের পুনরায় নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার পথ রুদ্ধ হইয়াছে কি? আগামীতে ভোলা-৩ আসনে উপনির্বাচন হইলে মেজর (অব.) জসিমউদ্দিন উহাতে প্রার্থী হইতে পারেন। দুর্নীতির দায়ে সেনাবাহিনীতে অবসর প্রদানের পর গত আগসল্ট মাসে তাহার ৫ বত্সর অতিক্রান্ত হইয়াছে। এমতাবস্থায় আগামী দিনে যে কোনো নির্বাচনে মেজর (অব.) জসিম উদ্দিন সংসদ সদস্য প্রার্থী হওয়ার উপযুক্ত। তবে তিনি সংসদ সদস্য হইতে পারিবেন কিনা সন্দেহ। কেন? এই কথা বলিতেছ কেন? সংসদ সদস্য হইতে হইলে এইবারও তাহাকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাইতে হইবে। আওয়ামী লীগ তাহাকে পুনরায় মনোনয়ন দিবে কিনা, তাহা একটি মূল্যবান প্রশ্ন। আর বাক্যব্যয় না করিয়া গুরুদেব দুই চোখ বুজিয়া গভীর ধ্যানে মগ্ন হইলেন। শিষ্যের ধারণা হইল, গুরুদেব ধ্যানস্থ হইয়া মেজর (অব.) জসিম উদ্দিন ভবিষ্যতে মনোনয়ন পাইবেন কিনা, উহার উত্তর অনুসন্ব্দান করিতেছেন।
লেখক : কবি ও কথাসাহিত্যিক
ই-মেইল : mahabub_talukdar@yahoo.com
No comments