কনোকো-ফিলিপসের সঙ্গে চুক্তিটি কার স্বার্থে? by প্রশান্ত মাহমুদ

বাংলাদেশ সরকার ও মার্কিন কম্পানি কনোকো-ফিলিপসের মধ্যে গত ১৬ জুন একটি প্রোডাকশন শেয়ারিং কন্ট্রাক্ট (পিএসসি) বা উৎপাদন অংশীদারি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এ চুক্তির ফলে কনোকো-ফিলিপস বাংলাদেশের সমুদ্রবক্ষের ১০ ও ১১ নম্বর গ্যাস ব্লকে গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের অধিকার লাভ করল। এখন পর্যন্ত এ চুক্তি সম্পর্কে যেসব তথ্য প্রকাশিত হয়েছে, তার ভিত্তিতে বলা যায় এটি জনস্বার্থবিরোধী।


তবে এ বছর চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হলেও এটি স্বাক্ষরের জন্য তৎপর ২০০৮ সাল থেকেই চলছে।বাংলাদেশ প্রথম পিএসসি করে ১৯৭৪ সালে, যদিও সেটা সমুদ্রবক্ষে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। পরবর্তীকালে ১৯৯৩ সালে বিএনপি সরকারের সময় প্রথম বিডিং রাউন্ড অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় দেশের সমগ্র এলাকা ২৩টি ব্লকে ভাগ করা হয় এবং চারটি বহুজাতিক কম্পানির কাছে মোট আটটি ব্লক ইজারা দেওয়া হয়। এই বহুজাতিক কম্পানিগুলো হচ্ছে_অঙ্েিডন্টাল, কেয়ার্ন এনার্জি, অকল্যান্ড রেঙ্উড ও ইউনাইটেড মেরিডিয়ান। ১৯৯৭ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দ্বিতীয় বিডিং রাউন্ড অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় বহুজাতিক কম্পানি টাল্লো, শেভরন-টেঙ্াকো, শেল-কেয়ার্ন ও ইউনোকলের কাছে চারটি ব্লক তুলে দেওয়া হয়। ১৯৯৩ এবং ১৯৯৭ সালে মোট ১০টি পিএসসি স্বাক্ষরিত হয়। এর মধ্যে দুটি মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে বর্তমানে আটটি চালু আছে। এরপর ২০০৮ সালের আগে আর কোনো পিএসসি স্বাক্ষরিত হয়নি। ২০০৮ সালে অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে এসে সমুদ্রবক্ষের এলাকাকে নতুন করে ২৮টি ব্লকে ভাগ করা হয় এবং অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে মডেল পিএসসি ২০০৮ প্রণীত হয়। সর্বশেষ প্রণীত এই পিএসসিতে গ্যাস রপ্তানির বিধান রাখা হয়েছে, যা আগের পিএসসিগুলোতে ছিল না।
গত ১৬ জুন বাংলাদেশ সরকার ও কনোকো-ফিলিপসের মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তিটি হয়েছে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে পাস হওয়া এই রপ্তানিমুখী মডেল পিএসসি-২০০৮ অনুসারে। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমল থেকেই এই মডেল পিএসসি-২০০৮ নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে আপত্তি জানানো হচ্ছিল। যাদের মধ্যে বর্তমানে তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি প্রধান। সে সময় জনমত উপেক্ষা করে অতি দ্রুত মডেল পিএসসি প্রণীত হয়েছিল। ২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার দরপত্র আহ্বান করে তিন মাস পর সেটি গ্রহণ করে। সে সময় ৯টি ব্লকের দরপত্র পাওয়া যায় এবং এর ভিত্তিতে অক্টোবর মাসে দুটি বহুজাতিক কম্পানিকে নির্বাচিত করা হয়। তবে তখন কোনো চুক্তি করা হয়নি। কিন্তু অনির্বাচিত সরকার যা করতে সাহস করেনি, নির্বাচিত মহাজোট সরকার ক্ষমতায় এসে এবং জনমত রীতিমতো উপেক্ষা করে সেই কাজটিই সম্পাদন করেছে। যার ফলে সংগত কারণেই চুক্তির স্বচ্ছতা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন উঠেছে।
চুক্তিটি কেন জনস্বার্থবিরোধী তা মডেল পিএসসি-২০০৮ সালের দিকে তাকালেই স্পষ্ট হয়ে যায়। যে পিএসসি-২০০৮ অনুসারে এই চুক্তি করা হয়েছে, তার মূল দলিলের ১৫.৫.১ ধারায় বলা আছে যে ১৫.৫.৪, ১৫.৫.৫ ও ১৫.৫.৬ ধারার অনুচ্ছেদসাপেক্ষে এবং ১৫.৫.২ ধারায় বর্ণিত হিসাব অনুযায়ী কন্ট্রাক্টরের (এ ক্ষেত্রে কনোকো-ফিলিপস) যেকোনো পরিমাণ বাজারজাতযোগ্য প্রাকৃতিক গ্যাস তরলীকৃত করে রপ্তানি করার অধিকার থাকবে। এই বাজারজাতযোগ্য প্রাকৃতিক গ্যাসের মধ্যে থাকবে কন্ট্রাক্টরের কস্ট রিকভারি গ্যাস (বিনিয়োগের টাকা তুলে আনতে যে পরিমাণ গ্যাস বিক্রি করতে হবে), কন্ট্রাক্টরের প্রোফিট গ্যাস (কস্ট রিকভারি হয়ে যাওয়ার পর যে গ্যাস থাকবে তার মধ্যে কন্ট্রাক্টরের অংশ) এবং পেট্রোবাংলার প্রফিট গ্যাস অথবা যেখানে প্রযোজ্য, সংরক্ষণের পর পেট্রোবাংলার বাকি যে অংশ থাকে। উল্লেখ্য, কনোকো-ফিলিপস উৎপাদিত গ্যাসের ৫৫ শতাংশ তাদের উৎপাদন খরচ হিসেবে নিয়ে যাবে। বাকি ৪৫ শতাংশের ভাগাভাগি হবে। সেখানে বাংলাদেশ ৫৫ থেকে ৮০ শতাংশ পর্যন্ত গ্যাস পাবে। তবে ১৫.৫.৪ ধারা অনুযায়ী বাংলাদেশ কোনোভাবেই মোট গ্যাসের ২০ শতাংশের বেশি পাবে না। পিএসসি ২০০৮ সালের মূল দলিলের ১৫.৫.৪ ধারায় বলা হয়েছে, যদি বাংলাদেশ সমুদ্র থেকে স্থলে এই গ্যাস নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজনীয় পরিবহনব্যবস্থা চালু করতে পারে এবং অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে এই গ্যাস ব্যবহার করতে পারে, তাহলেই কেবল বাংলাদেশের পক্ষে পেট্রোবাংলা তার অংশের প্রোফিট গ্যাস রাখার অধিকার পাবে। তবে তা কোনো অবস্থায়ই মোট প্রাপ্ত বাজারজাতযোগ্য গ্যাসের ২০ শতাংশের বেশি হবে না। এই ধারায় আরো বলা আছে, পেট্রোবাংলা প্রতি মাসে স্থানীয় ব্যবহারের জন্য যে পরিমাণ গ্যাস সংরক্ষণ করতে চায়, তা তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস রপ্তানি চুক্তির আগে জানাতে হবে এবং প্রতি মাসে সংরক্ষিত গ্যাসের পরিমাণ গ্যাস রপ্তানি চুক্তির পূর্ণ মেয়াদকাল পর্যন্ত কার্যকর থাকবে। পেট্রোবাংলা অনুরোধ করলে ১১তম বছরের শুরু থেকে ওপরে বর্ণিত সংরক্ষিত গ্যাসের পরিমাণ ২০ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো যেতে পারে। তার মানে, যেকোনো হিসাবেই কনোকো-ফিলিপস মোট বাজারজাতযোগ্য গ্যাসের ৮০ শতাংশ রপ্তানি করতে পারবে। এ অধিকার তাদের বিনা শর্তেই দেওয়া হয়েছে। এখন বাংলাদেশ যদি পাইপলাইন স্থাপন না করতে পারে বা এই গ্যাস ব্যবহার করতে না পারে, তাহলে চুক্তি অনুসারে কনোকো-ফিলিপস পুরো গ্যাসই রপ্তানি করার সুযোগ পাবে।
ওপরের তথ্যগুলোই বলে দেয়, এই চুক্তি কতটা অসম ও জনগণের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতাপূর্ণ। বাংলাদেশের সংবিধান অনুসারে এ দেশের স্থল ও জলসীমায় প্রাপ্ত সব সম্পদের মালিক এ দেশের জনগণ, সরকার নয়। কিন্তু এ দেশের নির্বাচিত বা অনির্বাচিত সরকারে থাকা লোকজন এবং তাদের অনির্বাচিত উপদেষ্টাদের কর্মকাণ্ড আর আচরণে মনে হয় জনগণ নয়, তাঁরাই বাংলাদেশের সব সম্পদের মালিক। অতএব, তাঁরা এই সম্পদ নিয়ে যা খুশি তা-ই করার অধিকার রাখে। নইলে কোনো রকম জনমতের তোয়াক্কা না করে সরকার এভাবে চুক্তি সম্পাদন করতে পারত না।
অন্যদিকে কস্ট রিকভারি নিয়ে আমাদের দেশের জনগণের তিক্ত অভিজ্ঞতা আছে। আমরা দেখেছি, বহুজাতিক কম্পানিগুলো নানাভাবে খরচের পরিমাণ বাড়তি দেখিয়ে কস্ট রিকভারি পর্যায় দীর্ঘায়িত করে। মাগুরছড়ায় অঙ্েিডন্টাল ১৯৯৫ সালে জরিপ ও কূপ খননের জন্য শুরুতে এক কোটি ৮৮ লাখ ডলার খরচের হিসাব দিলেও ১৯৯৭ সালে কূপ খননের হিসাব ছাড়াই প্রায় পাঁচ কোটি ডলার খরচ দেখায়। সাঙ্গু গ্যাসক্ষেত্রে কেয়ার্ন বিডিংয়ের শুরুতে প্রকল্প ব্যয় এক কোটি আট লাখ ১০ হাজার ডলার দেখালেও শেষ পর্যন্ত ৬৬ কোটিতে পেঁৗছায় এবং আমাদের সরকারও তা মেনে নেয়। ফলে বাংলাদেশে যে প্রোফিট গ্যাস পাওয়ার কথা তা অনেকাংশে কমে যায়।
কনোকো-ফিলিপসের সঙ্গে এই চুক্তির আরেকটি দিক অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা দরকার। কনোকো আর ফিলিপস একত্রিত হওয়ার আগে ও পরে বহুবার দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে। ১৯৭৭ সালে ফিলিপস পেট্রলিয়াম উত্তর সাগরের ইকোফিস্ক তেলক্ষেত্রের ব্রাভো প্লাটফরমে ব্লোআউট ঘটায়, যা এখন পর্যন্ত উত্তর সাগরের সবচেয়ে বড় ব্লোআউট হিসেবেই পরিগণিত। একীভূত হওয়ার পর ২০০৪ সালে কনোকো-ফিলিপসের অদক্ষতার কারণে যুক্তরাষ্ট্রের ডালকো প্যাসেজে দুর্ঘটনা ঘটায়। এতে প্রায় এক হাজার গ্যালন তেল সমুদ্রে ছড়িয়ে পড়ে। ব্যাপক পরিবেশদূষণ ঘটানোর কারণে এ ঘটনায় ওয়াশিংটন ডিপার্টমেন্ট অব ইকোলজি কনোকো-ফিলিপসকে পাঁচ লাখ ৪০ হাজার ডলার জরিমানা করে, যা ছিল কোনো অয়েল স্পিলের জন্য ইকোলজি ডিপার্টমেন্টের করা সর্বোচ্চ জরিমানা। ২০০৬ সালে কানাডার এডসন থেকে ২৬ কিমি. দক্ষিণ-পূর্বের একটি গ্যাসকূপে ব্লোআউট ঘটে। ২০০৮ সালে তাদের অদক্ষতার কারণে কানাডায় গ্রাউন্ড বার্চের গ্যাসকূপে আগুন ধরে যায়। ২০০৮ সালের ২৫ ডিসেম্বর তারা আলাস্কার কুপারুক তেলক্ষেত্রে অয়েল স্পিল ঘটায়, যা ছিল ওই অঞ্চলের এ যাবৎকালের সবচেয়ে বড় অয়েল স্পিলগুলোর একটি। এ ছাড়া ২০০৭ সালের মাঝামাঝি থেকে ২০১০ সালের শুরু পর্যন্ত সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের অকুপেশনাল সেফটি অ্যান্ড হেলথ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন পরিবেশ ও স্বাস্থ্যগত নিরাপত্তা ভঙ্গের কারণে কম্পানিটিকে ১১৮ বার নোটিশ দিয়েছে। এ বছরের জুলাই মাসেই চীনের বোহাই উপসাগরে কনোকো-ফিলিপসের তত্ত্বাবধানে তেলকূপ খননের সময় বড় দুর্ঘটনা ঘটে। ফলে সমুদ্রের চার হাজার ২৫০ বর্গকিলোমিটার এলাকায় তেল ছড়িয়ে পড়ে। চীনা কর্তৃপক্ষ বলছে, কনোকো-ফিলিপসের অবহেলার কারণেই এ ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় তেল নির্গমন বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত কনোকো-ফিলিপসের কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে চীন। খুব স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে, যে কম্পানির দুর্ঘটনার ইতিহাস এত দীর্ঘ, সেই কম্পানি কিভাবে দক্ষ হয়? এ রকম একটি কম্পানির কাছে আমাদের গ্যাসসম্পদ কতটুকু নিরাপদ? শুধু গ্যাসসম্পদই বড় কথা নয়, বঙ্গোপসাগরের প্রাণবৈচিত্র্য ও পরিবেশ কতটা নিরাপদ থাকবে?

লেখক : অর্থনীতি বিষয়ক লেখক

No comments

Powered by Blogger.