বোরকার বিরুদ্ধে আবার ষড়যন্ত্রঃ ইতালি সরকারকে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে
আবার ইসলামী বিধান তথা মুসলিম সংস্কৃতিকে অপদস্থ করার ঘৃণ্য চক্রান্তে লিপ্ত হয়েছে ইউরোপের কিছু মুসলিমবিদ্বেষী গোষ্ঠী। বালখিল্য অজুহাত দাঁড় করিয়ে তারা ইসলামী তাহজিব-তমদ্দুনকে হেয়প্রতিপন্ন করতে আদাজল খেয়ে লেগেছে। ধর্মীয় মূল্যবোধের বিরুদ্ধে এই সজ্ঞান শত্রুতা নতুন কিছু নয়। ইতিহাসের বিভিন্ন পর্বে মুসলিম সমাজের আধ্যাত্মিক ও সামাজিক ঐক্যের চেতনা খর্ব করার কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়েছে মুসলিমবিদ্বেষীরা।
সেই ধারাবাহিকতারই আরেকটি ন্যক্কারজনক দৃষ্টান্ত স্থাপিত হতে যাচ্ছে ইতালিতে এবং যথারীতি তাত্ক্ষণিকভাবে এর প্রতিবাদ জানিয়েছেন বিশ্বের ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা। জানা গেছে, সম্প্রতি ইতালির জাতীয় সংসদে একটি উদ্ভট বিল উত্থাপন করা হয়েছে। বিলটির উপস্থাপক বর্তমান বার্লুসকনি সরকারের অন্যতম শরিক দল লেগা নর্থের সংসদ সদস্য বর্বেতো কোতা। এই বিলে ধর্মীয় কারণে বোরকা ব্যবহার তথা মুখমণ্ডল আবৃত করাকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বিলটি সংসদে পাস হলে কোনো মুসলিম মহিলা বোরকা ব্যবহার করলে তাকে তাত্ক্ষণিকভাবে গ্রেফতার করা হবে এবং সর্বোচ্চ দু’বছর পর্যন্ত জেল ও জরিমানা করা যাবে। এ বিলের পক্ষে বর্বেতো কোতা আত্মপক্ষ সমর্থন করে খোঁড়া যুক্তির অবতারণা করে বলেছেন, আমরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষপ্রসূত, প্রতিহিংসাপরায়ণ বা তাদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করছি না। তিনি আরেকটি রাজনৈতিক চাতুরিপূর্ণ যুক্তি পেশ করেছেন যে, ইতালি ও ইতালির জনগণের নিরাপত্তা আমাদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আমরা সেই লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি। এজন্য জাতীয় স্বার্থেই এই বিল উত্থাপন করা হয়েছে। বোরকাবিরোধী বর্বেতো কোতার যুক্তির মধ্যে দুটি প্রধান প্রতিপাদ্য লক্ষণীয়। প্রথমত, বোরকা-নেকাব নিষিদ্ধ করে মুসলমানদের ধর্মানুভূতিতে আঘাত করা তার অভিপ্রায় নয়। ধর্ম এবং ইতিহাস সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা বা শ্রদ্ধাবোধ থাকলে তার নিশ্চয়ই জানা থাকা উচিত যে, নারীর সম্ভ্রম ও শালীনতা সুরক্ষার প্রয়োজনে শুরু থেকেই মুসলমান নারীর বহিরাবরণ পরার নিয়ম করা হয়েছে। এটা কোনো আঞ্চলিক রেওয়াজ বা আকস্মিক সংস্কার নয়, পর্দা মেনে চলা ইসলামের বিধান। অন্যান্য ধর্মেও, এমনকি ইতালিতেও ধর্মপ্রাণ নারী-পুরুষ স্বতন্ত্র পরিচ্ছদ ব্যবহার করেন। খ্রিসল্টান ধর্মের নারী যাজক ও বিশপদের বিশেষ পরিচ্ছদ ব্যবহার করার নিয়ম রয়েছে। বৌদ্ধভিক্ষু-ভিক্ষুণীদের পোশাকও স্বাতন্ত্র্যের চিহ্ন বহন করে। শিখ পুরুষরা যে পাঁচটি বিশেষ নিয়ম পালন করেন তার মধ্যে হাতের লৌহবলয় ও মাথার পাগড়ি অন্যতম। এজন্য ভারত জাতীয় ঐক্যের প্রতীক সেনাবাহিনীতেও শিখ সেনাদের পাগড়ি ব্যবহার নিষিদ্ধ করেনি। এসব বিষয় প্রতিটি ধর্মীয় বিধি ও সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত। এগুলো আইন করে নিষিদ্ধ করা যদি ধর্মানুভূতিতে আঘাত করা না হয় তাহলে আর আঘাত কাকে বলে তা কোনো বিবেকবান মানুষের বোধগম্য নয়। এর আগে ফদ্ধান্স, জার্মানি, সুইডেন প্রভৃতি দেশে বোরকাসহ শিখদের পাগড়ি নিষিদ্ধ করার নানারকম চক্রান্ত চলেছে। কিছুদিন আগে ফদ্ধান্সের প্রেসিডেন্ট সারকোজি সেদেশের পার্লামেন্টে মুসলিম নারীদের হিজাব পরার বিরোধিতা করে যে বক্তৃতা দেন, তার পেছনে কী উদ্দেশ্য কাজ করেছিল তা কারও অজানা নয়। পশ্চিমা বিশ্বের তৈরি মুসলমানদের জঙ্গিরূপে চিহ্নিত করার যে প্রচেষ্টা রয়েছে, ফদ্ধান্সের প্রেসিডেন্টের ওই বক্তৃতায় ছিল তারই ইঙ্গিত। অথচ বোরকা ও হিজাব ধর্মপ্রাণ মুসলিম নারীর সম্ভ্রমের প্রতীক। ইতালির সংসদ সদস্য এসব জেনেই উদ্দেশ্যমূলকভাবে ধর্মানুভূতিতে খড়গাঘাত করে নির্লজ্জ যুক্তির অবতারণা করেছেন। কোতার যুক্তির দ্বিতীয় পর্বটি বর্তমান সাম্রাজ্যবাদী-আধিপত্যবাদী রাজনীতির রহস্যে মোড়ানো। তিনি ইতালি ও ইতালির জনগণের নিরাপত্তার জন্য বোরকা-নেকাব নিষিদ্ধ করার যুক্তি দিয়েছেন। এর আগেও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ধর্মবিদ্বেষীরা এ ধরনের কপট তত্ত্ব জাহির করেছে। বলা হয়েছে, মুসলিম জঙ্গিবাদের সঙ্গে যুক্ত নারীরা বোরকার আড়ালে অস্ত্রাদি লুকিয়ে নাশকতা করতে পারে। নেকাব-হিজাবের জন্য তাদের শনাক্ত করাও মুশকিল। তাই যদি হয় তাহলে তো পাশ্চাত্যের ওভারকোটসহ বিভিন্ন শীতের পরিচ্ছদও নিষিদ্ধ করা দরকার। উল্লেখ্য, আমেরিকা ও তাদের দোসরদের উদ্ভাবিত ‘মুসলিম জঙ্গিবাদ তত্ত্ব’ প্রতিষ্ঠা করার অংশ হিসেবে ইতালির সংসদে এই উদ্ভট বিল উত্থাপন করা হয়েছে। ইতালি একটি গণতান্ত্রিক দেশ। স্বভাবতই সে দেশ সব ধর্মের মানুষের ধর্মীয় মূল্যবোধ বজায় রাখার অধিকার সংরক্ষণ করে। আমরা মনে করি, ইতালি সরকারের শুভবুদ্ধির উদয় ঘটবে, তারা ধর্মীয় ঐক্য ও সহনশীলতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে।
No comments