সাদাকালো-ঢাকা বিভাজন বাস্তবতাভিত্তিক নয় by আহমদ রফিক
সন্দেহ নেই, ঢাকা মহানগরের জনসংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। ফলে তীব্র হয়ে উঠছে যানজট থেকে নানা সমস্যা_শব্দদূষণ, বায়ুদূষণ ইত্যাদি। এসব সমস্যা নিয়েই ৪০০ বছরের ঢাকা, ঐতিহ্যবাহী ঢাকা আমাদের জন্য গর্ব ও গৌরবের। পুরান ঢাকার অনেক ঐতিহ্য নিয়ে শুধু ঢাকাইয়ারা নন, নতুন ঢাকা যদি বলি, উত্তর ঢাকার মানুষও রীতিমতো কৌতূহলী ও আগ্রহী, তাহলে ভুল বলা হবে না।
তাই সমস্যার মূলে গিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করে সমাধানের পথ খুঁজে বের করার চেষ্টা হবে বাস্তবতা। তা না করে সিটি করপোরেশন তথা ঢাকাকে দ্বিখণ্ডিত করার পরিকল্পনা সঠিক বলে মনে হয় না। পৃথিবীর বৃহৎ মহানগরগুলোতেও সমস্যা রয়েছে, কই সেখানে তো বিভাজনের কথা ওঠেনি। এমনকি প্রতিবেশী রাজ্যের রাজধানী কলকাতার বিভিন্নমাত্রিক সমস্যা কম নয়। অনেক দিন ধরে স্থানীয়রা উত্তর কলকাতা ও দক্ষিণ কলকাতার বয়ানে রঙ্গ-রসিকতা করলেও কখনো বিভাজনের কথা বলেননি, ভাবেননি। বরং বিভাজনের কথা তুললে আঁতকে উঠবেন।
আর ঢাকার এত সমস্যা-জটিলতার মধ্যেও এ পর্যন্ত কোনো দলের বিশ্লেষণ বা চিন্তাবিদ অথবা নগর পরিকল্পনাবিদ ঢাকাকে দ্বিখণ্ডিত করে সমস্যা সমাধানের উপায় নির্ধারণের কথা ভাবেননি, বলেননি। অথচ হঠাৎ করেই মন্ত্রিসভা এমন একটা অবিশ্বাস্য সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে, কার বা কাদের সঙ্গে পরামর্শ করে জানি না। কিংবা হয়তো আদৌ কারো সঙ্গে পরামর্শ করেওনি।
বিশদ আলোচনার আগে আমরা তাই বলি, রাজনীতির বহুল প্রচলিত প্রথার মতো নগরবাসীর গণভোট নিয়েই দেখুন না তাঁরা কী চান। আমার বিশ্বাস, অন্তত বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ (গোঁড়া দলীয় সমর্থক বাদে) কেউ তা চাইবেন না। কারণ পুরান-নতুন মিলে অখণ্ড ঢাকার মধ্যে একটা আ@ি@@@ক সংহতি রয়েছে। সেখানে আঘাত করা কি ঠিক হবে?
বিভাগপূর্বকালে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের কেন্দ্রভূমি ছিল পুরান ঢাকা। ব্রিটিশপূর্ব আমলের ঢাকার বিভিন্ন ঐতিহ্য_মসলিন থেকে বাখরখানি সবই তো পুরান ঢাকার অবদান, যার অনেক কিছু এখনো বর্তমান। নতুন গড়ে ওঠা ঢাকা তথা উত্তর ঢাকা কিন্তু সে ঐতিহ্যের অংশীদার। ঐতিহ্যবাহী আদালত ভবন থেকে রাজস্ব আদায়ের (ছোট-বড় ব্যবসা-বাণিজ্যকেন্দ্রিক) প্রধান উৎস কিন্তু এখনো পুরান ঢাকা। মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকার কথা মনে রেখেই এ কথা বলছি। মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকার শাঁসালো লোকজনের কত শতাংশ পুরান ঢাকা থেকে আগত, তা কি কেউ কখনো হিসাব করে দেখেছেন? ঢাকাকে বিভক্ত করলে বুড়িগঙ্গাকে ভাগ করা হবে কিভাবে?
প্রসঙ্গত একটা কথা বলি, একসময় গুলশান ও মিরপুর আলাদা পৌরসভার অধীনে ছিল, কিন্তু তাতে তেমন কোনো সুফল মেলেনি বলে সেসব অঞ্চল মূল ঢাকার নগর করপোরেশনের অধীনে আনা হয়। ২০০৫ সালে বিশ্বব্যাংকের সমীক্ষায় সিদ্ধান্ত ছিল, ঢাকার জনসেবা নিশ্চিত করতে হলে ঢাকাকে একক স্বশাসন কর্তৃপক্ষের আওতায় আনতে হবে। এরপর ছয় বছর পার হয়ে গেছে, কোনো সরকারই বিশ্বব্যাংকের সে পরামর্শে কান দেয়নি।
দেখে ভালো লাগছে যে সরকার সমর্থক বা বিরোধী দলের সমর্থক চিন্তাবিদ, বিশ্লেষক অনেকে এই দ্বিভাজনের বিপরীত চিন্তায় কলম ধরেছেন। আওয়ামী লীগ সমর্থক একজন শিক্ষাবিদ বিশ্বব্যাংকের বক্তব্য বা সাবেক মেয়র (প্রয়াত) মোহাম্মদ হানিফের অনুরূপ চিন্তার সূত্র না টেনেই লিখেছেন স্বাধীন নগর কর্তৃপক্ষ কার্যকর করার পক্ষে। তাঁর ভাষায়_'পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ার একাধিক পন্থার মধ্যে হতে পারে রাজধানী ঢাকাকে নগর সরকারের অধীনে এনে তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া।'
তিনি অবশ্য একাধিক পন্থার কথা উল্লেখ করেও বিকল্প কোনো পন্থার কথা স্পষ্ট করে বলেননি। বরং বলেছেন, ঢাকা দ্বিখণ্ডিত করতে গেলে বিভিন্ন সেবাদানকারী সংস্থা যেমন_ওয়াসা, ডেসকো, রাজউক, তিতাস গ্যাস সব কিছুই ভাগ করতে হবে। সে হবে এক এলাহিকাণ্ড, যা সমস্যা কমানোর বদলে বরং বাড়িয়ে তুলবে। ব্যবসা-বাণিজ্যের ওলটপালট তো আছেই। তাদের অনেকে প্রশাসনিক জটিলতা ও হয়রানির শিকার হবেন। এ বাস্তবতা অস্বীকারের কোনো উপায় নেই।
আরো একটি তথ্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। অনেকেই বলেছেন, এ বিভাজন পরিকল্পনা রাজনৈতিক তথা দলীয় সিদ্ধান্তের অন্তর্গত। অথচ খবরে প্রকাশ, বিভাজনের বিরুদ্ধে শুধু ঢাকার বর্তমান মেয়র বা বিএনপির কাউন্সিলররাই নন, আওয়ামী লীগ সমর্থিত কাউন্সিলররাও একযোগে প্রতিবাদ করেছেন এবং বিভাজনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। সেখানে দলীয় বিভেদ পাত্তা পায়নি। বরং পেয়েছে ঐতিহ্যবাহী শাহী ঢাকার প্রতি মমত্ববোধ_যা প্রায়ই সভায় বা সম্মেলনে অথবা লেখায় প্রকাশ পেয়ে থাকে।
তাই সমস্যার চুলচেরা বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখলে সমস্যা সমাধানের সূত্রগুলো বেরিয়ে আসবে। দেখা যাবে, অখণ্ড ঢাকায় 'নগর সরকার' বা অনুরূপ কোনো বিকল্প ব্যবস্থায় বিরাজমান সমস্যাগুলোর সমাধান সম্ভব। সে ক্ষেত্রে যেকোনো মেয়র বা অনুরূপ অভিজ্ঞতাসম্পন্ন মানুষ বলবেন_সমস্যার পেছনে বহু কারণের মধ্যে প্রধান দুটো হলো অর্থ ও ক্ষমতা।
বিস্তারিত আলোচনায় দেখা যাবে, এমন বিপুলসংখ্যক মানুষের নগরে প্রতিটি পরিবার বা মানুষের জন্য সেবাদানের প্রয়োজনমাফিক অর্থের সরবরাহ তথা বরাদ্দ সম্ভব হয় না। ভাগ হলে কি অর্থ বরাদ্দ বাড়ানো সম্ভব হবে? যদি হয়, তাহলে অখণ্ড অবস্থায়ই তো তা সম্ভব। তা ছাড়া বিভক্ত হলে বরং খরচ আরো বাড়বে। দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা যা (যে জন্য ব্যাংক থেকে সরকারকে ক্রমাগত ঋণ নিতে হচ্ছে), তাতে এ বিভাজন অর্থনৈতিক দিক থেকে 'গোদের ওপর বিষফোঁড়ার' মতো হয়ে দাঁড়াবে।
বর্তমান অবস্থায় অনেকে বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে সমন্বয়হীনতার কথা বলে থাকেন, যা নাগরিকদের জন্য দুর্ভোগের কারণ হয়ে ওঠে। এগুলোকে 'নগর সরকারের' অধীনে নেওয়া হলে সমস্যা অনেকটা লাঘব হতে পারে। তা ছাড়া মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে করপোরেশনের কাজকর্মের চালাচালিতে যে দীর্ঘসূত্রতা তারও অবসান ঘটানো খুব জরুরি এবং তা নাগরিক সেবার পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনায়।
ঢাকার জনসংখ্যা নিয়ে নানাজনের নানা মত। সেসব তথ্যগত তর্ক বাদ দিয়েই বলি, ঢাকার ক্রমবর্ধমান নাগরিক স্রোত ঠেকানো খুব জরুরি। বিশেষ করে যখন দেখা যাচ্ছে ধীরে হলেও গ্রাম উঠে আসছে নগরে, মানবেতর-বস্তি জীবনযাপন সত্ত্বেও। এর জন্য দরকার জাতীয় পর্যায়ে অর্থনৈতিক উন্নয়ন। গ্রামে অর্থ উপার্জনের মোটামুটি একটা ব্যবস্থা থাকলে মুক্ত হাওয়ার অধিবাসী গ্রামের মানুষ শহরে আসতে চাইবে না। তাই দরকার বাস্তব বিবেচনার গ্রামোন্নয়ন পরিকল্পনা, সেখানে ক্ষুদ্র পেশাজীবীদের জন্য সাহায্য এবং ক্ষুদ্র গ্রামীণ কুটির শিল্পের বিকাশ। তাতেও মহানগর ঢাকার ওপর চাপ কমবে। এসব দীর্ঘমেয়াদি বিষয়_রাজনৈতিক ও সামাজিক, অর্থনৈতিক বিবেচনা, বিশ্লেষণ, সিদ্ধান্ত ও বাস্তবায়ন ছাড়া ঢাকার একটি মূল সমস্যারও জট খোলা সম্ভব হবে না।
আর মহানগরের সুষ্ঠু পরিচালনায় এককেন্দ্রিক ক্ষমতায়নের কথা আগেই বলা হয়েছে, যা এর আগে কেউ কেউ বলেছেন। এক কেন্দ্র থেকে কাজ করা হলে বলা যায়, সেবাদানের কাজ অপেক্ষাকৃত সহজ হবে। সিদ্ধান্তের জন্য দরজায় দরজায় ঘুরতে হয় না, তাতে ফালতু সময় নষ্ট হয় না। দেড় কোটি ঢাকাবাসীর সমস্যা সমাধান দুই ভাগ বা তিন ভাগ করেও হবে না। বরং দুজন ডেপুটি মেয়রের কথা ভাবা যেতে পারে বা ততোধিক ডেপুটি মেয়র_যাঁরা প্রত্যক্ষভাবে উত্তর, দক্ষিণ বা অন্য অংশের সেবাদানের বাস্তবতা পর্যবেক্ষণ ও পরিচালনা করবেন। এবং সে ক্ষেত্রে সবার ওপরে মেয়র। তাঁর মূল কাজ হবে সমন্বয়ের।
সবশেষের কথা_সিটি করপোরেশনের সমস্যাগুলোর চুলচেরা বিশ্লেষণ করে তবেই সঠিক সিদ্ধান্তে পেঁৗছানো সম্ভব। মনে রাখতে হবে করপোরেশনের শাসনতান্ত্রিক ও আইনগত দুর্বলতার কথা। একে দলীয় রাজনীতির ঊধর্ে্ব রাখার চিন্তা, এর দক্ষ জনবলের স্বল্পতার কথা, সর্বোপরি কঠোর হাতে দুর্নীতি দমনের ব্যবস্থার কথা। এসব দিকে কখনো নজর দেওয়া হয়নি। কিন্তু দেওয়া দরকার।
তা ছাড়া করপোরেশনে যৌথ নেতৃত্ব কর্মক্ষেত্রে আগ্রহ-উদ্দীপনা সৃষ্টি করতে পারে। দুই বা তিন ডেপুটি মেয়রসহ প্রধান মেয়রের যৌথ তত্ত্বাবধানে কাউন্সিলরদের সমদায়িত্বে সংশ্লিষ্ট করা দরকার। সেই সঙ্গে জবাবদিহিতা। কিন্তু কার কাছে। সেটা 'চেইন অব কমান্ড' অনুযায়ী। সবার ওপরে মন্ত্রণালয়। কিন্তু মন্ত্রণালয় যে কারো কারো ভাষায় 'যন্ত্রণালয়'_এ কথা কমবেশি অনেকেই স্বীকার করে থাকেন মূলত সুতো টানাটানির কারণে।
সে জন্যই আমি স্বাধীন নগর কর্তৃপক্ষ হিসেবে করপোরেশনকে দেখা অপেক্ষাকৃত বাস্তবধর্মী বলে মনে করি। সে ক্ষেত্রে তাদের জবাবদিহিতা অবশ্য থাকতে হবে। গোটা কর্তৃপক্ষসহ নগরপিতা দায়ী থাকবেন রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী কিংবা প্রধান বিচারপতির কাছে_প্রতিটি কাজের অনুমতির জন্য নয়, জবাবদিহিতার প্রশ্নে।
সবশেষে বিভাজন প্রসঙ্গে অন্তত দু-তিনজনের লেখার সঙ্গে ঐকমত্যে বলা চলে, এ ধরনের সিদ্ধান্ত দলনিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞ ও চিন্তকদের সঙ্গে আলোচনা ও পরামর্শমাফিক হওয়া দরকার। তা না হলে তা হবে চট্টগ্রাম ও নারায়ণগঞ্জের মেয়র নির্বাচনে সমর্থন দানের মতোই ভুল সিদ্ধান্ত। এ কথা সত্য যে দেশে দলনিরপেক্ষ মানুষ, বিশেষ করে তেমন ভোটারের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। চট্টগ্রাম ও নারায়ণগঞ্জ তার প্রমাণ। চাপিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্ত অনেক সময় বুমেরাং হয়ে ওঠে। দুই ভাগ হলেই ঢাকা সরকারি দলের আওতায় আসবে, তেমন নিশ্চয়তা কে দিতে পারে? লেখক : ভাষাসংগ্রামী, কবি, প্রাবন্ধিক
ও রবীন্দ্র গবেষক
আর ঢাকার এত সমস্যা-জটিলতার মধ্যেও এ পর্যন্ত কোনো দলের বিশ্লেষণ বা চিন্তাবিদ অথবা নগর পরিকল্পনাবিদ ঢাকাকে দ্বিখণ্ডিত করে সমস্যা সমাধানের উপায় নির্ধারণের কথা ভাবেননি, বলেননি। অথচ হঠাৎ করেই মন্ত্রিসভা এমন একটা অবিশ্বাস্য সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে, কার বা কাদের সঙ্গে পরামর্শ করে জানি না। কিংবা হয়তো আদৌ কারো সঙ্গে পরামর্শ করেওনি।
বিশদ আলোচনার আগে আমরা তাই বলি, রাজনীতির বহুল প্রচলিত প্রথার মতো নগরবাসীর গণভোট নিয়েই দেখুন না তাঁরা কী চান। আমার বিশ্বাস, অন্তত বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ (গোঁড়া দলীয় সমর্থক বাদে) কেউ তা চাইবেন না। কারণ পুরান-নতুন মিলে অখণ্ড ঢাকার মধ্যে একটা আ@ি@@@ক সংহতি রয়েছে। সেখানে আঘাত করা কি ঠিক হবে?
বিভাগপূর্বকালে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের কেন্দ্রভূমি ছিল পুরান ঢাকা। ব্রিটিশপূর্ব আমলের ঢাকার বিভিন্ন ঐতিহ্য_মসলিন থেকে বাখরখানি সবই তো পুরান ঢাকার অবদান, যার অনেক কিছু এখনো বর্তমান। নতুন গড়ে ওঠা ঢাকা তথা উত্তর ঢাকা কিন্তু সে ঐতিহ্যের অংশীদার। ঐতিহ্যবাহী আদালত ভবন থেকে রাজস্ব আদায়ের (ছোট-বড় ব্যবসা-বাণিজ্যকেন্দ্রিক) প্রধান উৎস কিন্তু এখনো পুরান ঢাকা। মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকার কথা মনে রেখেই এ কথা বলছি। মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকার শাঁসালো লোকজনের কত শতাংশ পুরান ঢাকা থেকে আগত, তা কি কেউ কখনো হিসাব করে দেখেছেন? ঢাকাকে বিভক্ত করলে বুড়িগঙ্গাকে ভাগ করা হবে কিভাবে?
প্রসঙ্গত একটা কথা বলি, একসময় গুলশান ও মিরপুর আলাদা পৌরসভার অধীনে ছিল, কিন্তু তাতে তেমন কোনো সুফল মেলেনি বলে সেসব অঞ্চল মূল ঢাকার নগর করপোরেশনের অধীনে আনা হয়। ২০০৫ সালে বিশ্বব্যাংকের সমীক্ষায় সিদ্ধান্ত ছিল, ঢাকার জনসেবা নিশ্চিত করতে হলে ঢাকাকে একক স্বশাসন কর্তৃপক্ষের আওতায় আনতে হবে। এরপর ছয় বছর পার হয়ে গেছে, কোনো সরকারই বিশ্বব্যাংকের সে পরামর্শে কান দেয়নি।
দেখে ভালো লাগছে যে সরকার সমর্থক বা বিরোধী দলের সমর্থক চিন্তাবিদ, বিশ্লেষক অনেকে এই দ্বিভাজনের বিপরীত চিন্তায় কলম ধরেছেন। আওয়ামী লীগ সমর্থক একজন শিক্ষাবিদ বিশ্বব্যাংকের বক্তব্য বা সাবেক মেয়র (প্রয়াত) মোহাম্মদ হানিফের অনুরূপ চিন্তার সূত্র না টেনেই লিখেছেন স্বাধীন নগর কর্তৃপক্ষ কার্যকর করার পক্ষে। তাঁর ভাষায়_'পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ার একাধিক পন্থার মধ্যে হতে পারে রাজধানী ঢাকাকে নগর সরকারের অধীনে এনে তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া।'
তিনি অবশ্য একাধিক পন্থার কথা উল্লেখ করেও বিকল্প কোনো পন্থার কথা স্পষ্ট করে বলেননি। বরং বলেছেন, ঢাকা দ্বিখণ্ডিত করতে গেলে বিভিন্ন সেবাদানকারী সংস্থা যেমন_ওয়াসা, ডেসকো, রাজউক, তিতাস গ্যাস সব কিছুই ভাগ করতে হবে। সে হবে এক এলাহিকাণ্ড, যা সমস্যা কমানোর বদলে বরং বাড়িয়ে তুলবে। ব্যবসা-বাণিজ্যের ওলটপালট তো আছেই। তাদের অনেকে প্রশাসনিক জটিলতা ও হয়রানির শিকার হবেন। এ বাস্তবতা অস্বীকারের কোনো উপায় নেই।
আরো একটি তথ্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। অনেকেই বলেছেন, এ বিভাজন পরিকল্পনা রাজনৈতিক তথা দলীয় সিদ্ধান্তের অন্তর্গত। অথচ খবরে প্রকাশ, বিভাজনের বিরুদ্ধে শুধু ঢাকার বর্তমান মেয়র বা বিএনপির কাউন্সিলররাই নন, আওয়ামী লীগ সমর্থিত কাউন্সিলররাও একযোগে প্রতিবাদ করেছেন এবং বিভাজনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। সেখানে দলীয় বিভেদ পাত্তা পায়নি। বরং পেয়েছে ঐতিহ্যবাহী শাহী ঢাকার প্রতি মমত্ববোধ_যা প্রায়ই সভায় বা সম্মেলনে অথবা লেখায় প্রকাশ পেয়ে থাকে।
তাই সমস্যার চুলচেরা বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখলে সমস্যা সমাধানের সূত্রগুলো বেরিয়ে আসবে। দেখা যাবে, অখণ্ড ঢাকায় 'নগর সরকার' বা অনুরূপ কোনো বিকল্প ব্যবস্থায় বিরাজমান সমস্যাগুলোর সমাধান সম্ভব। সে ক্ষেত্রে যেকোনো মেয়র বা অনুরূপ অভিজ্ঞতাসম্পন্ন মানুষ বলবেন_সমস্যার পেছনে বহু কারণের মধ্যে প্রধান দুটো হলো অর্থ ও ক্ষমতা।
বিস্তারিত আলোচনায় দেখা যাবে, এমন বিপুলসংখ্যক মানুষের নগরে প্রতিটি পরিবার বা মানুষের জন্য সেবাদানের প্রয়োজনমাফিক অর্থের সরবরাহ তথা বরাদ্দ সম্ভব হয় না। ভাগ হলে কি অর্থ বরাদ্দ বাড়ানো সম্ভব হবে? যদি হয়, তাহলে অখণ্ড অবস্থায়ই তো তা সম্ভব। তা ছাড়া বিভক্ত হলে বরং খরচ আরো বাড়বে। দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা যা (যে জন্য ব্যাংক থেকে সরকারকে ক্রমাগত ঋণ নিতে হচ্ছে), তাতে এ বিভাজন অর্থনৈতিক দিক থেকে 'গোদের ওপর বিষফোঁড়ার' মতো হয়ে দাঁড়াবে।
বর্তমান অবস্থায় অনেকে বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে সমন্বয়হীনতার কথা বলে থাকেন, যা নাগরিকদের জন্য দুর্ভোগের কারণ হয়ে ওঠে। এগুলোকে 'নগর সরকারের' অধীনে নেওয়া হলে সমস্যা অনেকটা লাঘব হতে পারে। তা ছাড়া মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে করপোরেশনের কাজকর্মের চালাচালিতে যে দীর্ঘসূত্রতা তারও অবসান ঘটানো খুব জরুরি এবং তা নাগরিক সেবার পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনায়।
ঢাকার জনসংখ্যা নিয়ে নানাজনের নানা মত। সেসব তথ্যগত তর্ক বাদ দিয়েই বলি, ঢাকার ক্রমবর্ধমান নাগরিক স্রোত ঠেকানো খুব জরুরি। বিশেষ করে যখন দেখা যাচ্ছে ধীরে হলেও গ্রাম উঠে আসছে নগরে, মানবেতর-বস্তি জীবনযাপন সত্ত্বেও। এর জন্য দরকার জাতীয় পর্যায়ে অর্থনৈতিক উন্নয়ন। গ্রামে অর্থ উপার্জনের মোটামুটি একটা ব্যবস্থা থাকলে মুক্ত হাওয়ার অধিবাসী গ্রামের মানুষ শহরে আসতে চাইবে না। তাই দরকার বাস্তব বিবেচনার গ্রামোন্নয়ন পরিকল্পনা, সেখানে ক্ষুদ্র পেশাজীবীদের জন্য সাহায্য এবং ক্ষুদ্র গ্রামীণ কুটির শিল্পের বিকাশ। তাতেও মহানগর ঢাকার ওপর চাপ কমবে। এসব দীর্ঘমেয়াদি বিষয়_রাজনৈতিক ও সামাজিক, অর্থনৈতিক বিবেচনা, বিশ্লেষণ, সিদ্ধান্ত ও বাস্তবায়ন ছাড়া ঢাকার একটি মূল সমস্যারও জট খোলা সম্ভব হবে না।
আর মহানগরের সুষ্ঠু পরিচালনায় এককেন্দ্রিক ক্ষমতায়নের কথা আগেই বলা হয়েছে, যা এর আগে কেউ কেউ বলেছেন। এক কেন্দ্র থেকে কাজ করা হলে বলা যায়, সেবাদানের কাজ অপেক্ষাকৃত সহজ হবে। সিদ্ধান্তের জন্য দরজায় দরজায় ঘুরতে হয় না, তাতে ফালতু সময় নষ্ট হয় না। দেড় কোটি ঢাকাবাসীর সমস্যা সমাধান দুই ভাগ বা তিন ভাগ করেও হবে না। বরং দুজন ডেপুটি মেয়রের কথা ভাবা যেতে পারে বা ততোধিক ডেপুটি মেয়র_যাঁরা প্রত্যক্ষভাবে উত্তর, দক্ষিণ বা অন্য অংশের সেবাদানের বাস্তবতা পর্যবেক্ষণ ও পরিচালনা করবেন। এবং সে ক্ষেত্রে সবার ওপরে মেয়র। তাঁর মূল কাজ হবে সমন্বয়ের।
সবশেষের কথা_সিটি করপোরেশনের সমস্যাগুলোর চুলচেরা বিশ্লেষণ করে তবেই সঠিক সিদ্ধান্তে পেঁৗছানো সম্ভব। মনে রাখতে হবে করপোরেশনের শাসনতান্ত্রিক ও আইনগত দুর্বলতার কথা। একে দলীয় রাজনীতির ঊধর্ে্ব রাখার চিন্তা, এর দক্ষ জনবলের স্বল্পতার কথা, সর্বোপরি কঠোর হাতে দুর্নীতি দমনের ব্যবস্থার কথা। এসব দিকে কখনো নজর দেওয়া হয়নি। কিন্তু দেওয়া দরকার।
তা ছাড়া করপোরেশনে যৌথ নেতৃত্ব কর্মক্ষেত্রে আগ্রহ-উদ্দীপনা সৃষ্টি করতে পারে। দুই বা তিন ডেপুটি মেয়রসহ প্রধান মেয়রের যৌথ তত্ত্বাবধানে কাউন্সিলরদের সমদায়িত্বে সংশ্লিষ্ট করা দরকার। সেই সঙ্গে জবাবদিহিতা। কিন্তু কার কাছে। সেটা 'চেইন অব কমান্ড' অনুযায়ী। সবার ওপরে মন্ত্রণালয়। কিন্তু মন্ত্রণালয় যে কারো কারো ভাষায় 'যন্ত্রণালয়'_এ কথা কমবেশি অনেকেই স্বীকার করে থাকেন মূলত সুতো টানাটানির কারণে।
সে জন্যই আমি স্বাধীন নগর কর্তৃপক্ষ হিসেবে করপোরেশনকে দেখা অপেক্ষাকৃত বাস্তবধর্মী বলে মনে করি। সে ক্ষেত্রে তাদের জবাবদিহিতা অবশ্য থাকতে হবে। গোটা কর্তৃপক্ষসহ নগরপিতা দায়ী থাকবেন রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী কিংবা প্রধান বিচারপতির কাছে_প্রতিটি কাজের অনুমতির জন্য নয়, জবাবদিহিতার প্রশ্নে।
সবশেষে বিভাজন প্রসঙ্গে অন্তত দু-তিনজনের লেখার সঙ্গে ঐকমত্যে বলা চলে, এ ধরনের সিদ্ধান্ত দলনিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞ ও চিন্তকদের সঙ্গে আলোচনা ও পরামর্শমাফিক হওয়া দরকার। তা না হলে তা হবে চট্টগ্রাম ও নারায়ণগঞ্জের মেয়র নির্বাচনে সমর্থন দানের মতোই ভুল সিদ্ধান্ত। এ কথা সত্য যে দেশে দলনিরপেক্ষ মানুষ, বিশেষ করে তেমন ভোটারের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। চট্টগ্রাম ও নারায়ণগঞ্জ তার প্রমাণ। চাপিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্ত অনেক সময় বুমেরাং হয়ে ওঠে। দুই ভাগ হলেই ঢাকা সরকারি দলের আওতায় আসবে, তেমন নিশ্চয়তা কে দিতে পারে? লেখক : ভাষাসংগ্রামী, কবি, প্রাবন্ধিক
ও রবীন্দ্র গবেষক
No comments