বয়ঃসন্ধি নয়, জন্ম থেকেই মেয়েরা বৈষম্যের শিকার by লুৎফর রহমান রনো

কিছুদিন আগে 'এ পারসপেকটিভ অন জেন্ডার ইকোয়ালিটি ইন বাংলাদেশ' শিরোনামে ইউনিসেফের একটি প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। তাতে গবেষণালব্ধ যেসব তথ্য-পরিসংখ্যান রয়েছে, তা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় নারী-পুরুষ বৈষম্যের মাত্রা উপলব্ধির জন্য; এতে কারো দ্বিমত থাকার কথা নয়। তবে তথ্যের সঙ্গে তত্ত্বের অমিল রয়েছে বলে আমি মনে করি।


প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, 'বাংলাদেশে বয়ঃসন্ধিকালে পেঁৗছানোর পর মেয়েরা সামাজিকভাবে বৈষম্যের শিকার হয়। তবে পঞ্চম জন্মদিন পর্যন্ত মেয়েশিশুরা নিজগৃহে বৈষম্যের শিকার হয় না' (২৬ অক্টোবর, কালের কণ্ঠ)। প্রতিবেদনের বক্তব্য অনুযায়ী, শারীরিক নির্যাতন বা সুস্পষ্টভাবে লক্ষণীয় বঞ্চনার শুরু থেকে বৈষম্যের কাল ধরা হয়েছে। যেমন_মাধ্যমিক পর্যায়ে স্কুলে ভর্তির পর ঝরে পড়া, সঙ্গী ছাড়া মেয়েদের বাইরে বেরোতে না দেওয়া, ইভ টিজিং বা যৌন হয়রানি ও শারীরিক-মানসিক সহিংসতা ইত্যাদি। অথচ এ-জাতীয় নির্যাতন হলো আসলে কন্যাশিশুর প্রতি আজন্ম বৈষম্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গির বহিঃপ্রকাশ। এর অর্থ এটা নয় যে বয়ঃসন্ধিকালে মেয়েরা বৈষম্যের শিকার হয় এবং তাও নয় যে পাঁচ-ছয় বছর পর্যন্ত মেয়েশিশুরা পরিবারের মধ্যে বৈষম্যের শিকার হয় না।
১৯৮৪ সালের ৬ নভেম্বর বাংলাদেশ সিডো (CEDAW) দলিলে সই করে। তবে একাধিক ধারাসহ ১৩(ক) উপধারা বাদ দিয়ে সেটি অনুমোদন করা হয়েছিল। আর ওই ধারায় পরিবারের নারী-পুরুষ সবার সমান অধিকার সংরক্ষণ বা সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার সুপারিশ ছিল। পরিবারের নারী-পুরুষ সম্প্রদায়গত প্রাচীন সংস্কৃতির দ্বারা এতই আবিষ্ট যে গ্রামাঞ্চলে ছেলেশিশু জন্মলাভ করলে আজান দেওয়া হয় বা উলুধ্বনি। কিন্তু কন্যাসন্তানের জন্মে তা হয় না বা হলেও আজান বা উলু সংক্ষিপ্ত করা হয়, অর্থাৎ সম্পূর্ণ করার প্রয়োজন নেই নারীর বেলায়। এ প্রথার মধ্যে তর্কাতীত প্রকাশ যে নারী অসম্পূর্ণ মানুষ। শিশুকন্যা জন্ম দেন যে মা, তিনি বোঝেন কন্যাশিশু জন্মদানের মতো 'অপরাধের' শাস্তি কী ভয়াবহ (এসব নির্যাতন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মানসিক)।
'নারী নির্যাতনের ১০ বছরের ঘটনার ওপর এক গবেষণা জরিপে দেখা গেছে, ৩১ শতাংশ নারী হত্যার কারণ পারিবারিক কলহ। এই কলহের প্রধান দিক হচ্ছে যৌতুক, শাশুড়ি-ননদের অত্যাচার, গহনা বিক্রি নিয়ে কিংবা সম্পত্তিসংক্রান্ত বিবাদ। যে মহিলা সম্পত্তিহীন তার ওপর অত্যাচার ঘটে নাকের ফুল, মুরগির ডিম ইত্যাদি নিয়ে।...' (বাংলাদেশের নারী, সম্পাদনা আলী রিয়াজ)। এসব পারিবারিক কলহের প্রকার ও মাত্রা স্থান-কাল-পাত্রভেদে বিভিন্ন। শহরের ও শিক্ষিত পরিবারের ভেতরেও নারী নির্যাতনের কারণ প্রথমত ও প্রধানত নারীকে অধস্তন ভাবা বা লৈঙ্গিক বৈষম্য ও যৌতুক বা সম্পদ সম্পৃক্ততা। এসবের মধ্যে যে মেয়েশিশুর জন্ম ও বেড়ে ওঠা সে নিঃসন্দেহে একধরনের নির্যাতনের মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠে, বৈষম্যমূলক শিক্ষা-সংস্কার-চিন্তা-চেতনায় গড়ে তোলা হয়। এমনকি ছেলেশিশুর মতো সে কল্পনাও করতে পারবে না মেয়ে বলে। এমনই পারিবারিক শিক্ষা-সংস্কৃতির মধ্যে যে শিশুরা বেড়ে ওঠে, তারা বয়ঃসন্ধিকালে তাই একজন হয় ছেলে, একজন হয় মেয়ে। একজন 'দুর্বল', অন্যজন 'সবল'। ছেলেকে নির্যাতন করার 'বৈধতা' দিয়েছে বা দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলেছে তার পরিবার। মেয়েকে সে 'বৈধ' নির্যাতন থেকে নিজেকে দূরে রাখার, বেঁচে থাকার শিক্ষা দিয়েছে সেই পরিবারই। শিশু-শৈশবকালের এমন মনস্তাত্তি্বক চর্চার মাধ্যমে পরিবার যে মেয়েকে বয়ঃসন্ধিকালে পেঁৗছাল, সেই মেয়ের ওপর সামাজিকভাবে বৈষম্যবাদী নির্যাতন অবধারিত হয়ে ওঠে।
ইউনিসেফের প্রতিবেদন বলা হয়েছে, পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত পরিবারের মধ্যে মেয়েশিশু বৈষম্যের শিকার হয় না। ওপরে মানসিক দিকের আলোকপাত কিঞ্চিৎ করা হয়েছে। এ ছাড়া শারীরিকভাবেও মেয়েশিশুর বঞ্চনা, যেমন খাওয়াদাওয়া-আদর-যত্ন-প্রারম্ভিক শিক্ষা_এসবের মধ্যে ছেলেদের সঙ্গে মেয়েদের পার্থক্য থাকে। মূলত লৈঙ্গিক বৈষম্যই এখনো বাংলাদেশের সমাজে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সমানভাবে একজন নারীকে 'নারী' করেই রাখে।
ইউনিসেফের প্রতিবেদনেই যে তথ্য পাওয়া যায় তাতেই ধারণা করতে কষ্ট হয় না অনূর্ধ্ব পাঁচ বছর বয়সের মেয়েশিশুর অবস্থা। বাংলাদেশে এক বছরের কম বয়সীদের মধ্যে অনুপাত হলো ১০৭.৫ জন পুরুষের বিপরীতে ১০০ জন নারী। এ ছাড়া পাঁচ বছরের কম বয়সী ছেলে ও মেয়ের অনুপাত বিভিন্ন অঞ্চলভিত্তিক দেখানো হয়েছে। বান্দরবানে ছেলে মেয়ে ১১৮:১০০, কুমিল্লায় ১১২:১০০, চুয়াডাঙ্গায় ১১২:১০০, হবিগঞ্জে ১১৫:১০০, মৌলভীবাজারে ১১২:১০০। এ তথ্য থেকে সুস্পষ্ট প্রতীয়মান হচ্ছে যে পাঁচ বছরের নিচের বয়সের মেয়েরা ভয়াবহ বৈষম্যের শিকার। তাহলে প্রতিবেদনে বয়ঃসন্ধি থেকে মেয়েদের বৈষম্যের কাল শুরু কথাটি যে সঠিক নয়, তা ওই প্রতিবেদনেই বিধৃত। বলা যেতে পারে, বয়ঃসন্ধিকাল থেকে বৈষম্যজনিত বাধা-বঞ্চনা মেয়েদের জীবনে দৃশ্যমান হয়। অনধিক ১০ বছর বয়সী শিশু মেয়ের হৃদয়বিদারক আত্মহত্যার সংবাদ আমরা পড়েছি পত্রপত্রিকায়। পড়েছি বলে মনে পড়ে না যে কোনো ছেলেশিশু বা কিশোর আত্মহত্যা করেছে। এর কারণও জৈবিক নয়, সামাজিক।
পরিবার তথা সমাজ একটি ছেলেকে শিশু অবস্থায় শিক্ষা দেওয়া শুরু করে, 'তুমি বেশি বেশি খাও, লড়াই করতে হবে, প্রতিষ্ঠিত হতে হবে...।' মেয়েশিশুকে ঠিক বিপরীত শিক্ষা দেওয়া হয়, 'তুমি একটু কম খেলেও ক্ষতি নেই। ছেলেদের শক্তি দরকার।' আর মেয়েদের বলা হয় বা না বলে প্ররোচিত করা হয়, হাঁড়ি-পাতিল ঘষা-মাজা করা, অবসরে সাজগোজ করা, নম্রস্বরে কথা বলা, অনাকাঙ্ক্ষিত বিপদ-আপদ থেকে পালিয়ে আত্মরক্ষা করা ইত্যাদি। এসব শিশু বয়সের বৈষম্যবাদী শিক্ষা শুধু নয়, জীবন বরবাদ করে দেওয়ার মতো ব্যবস্থাই রয়ে গেছে পরিবারের মধ্যে, সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। তাই কন্যাশিশু মোটেও নিরাপদ নয় পরিবারের মধ্যে বৈষম্যমূলক পরিস্থিতির শিকার থেকে।
প্রসঙ্গত: কোন জাতি কতটুকু উন্নত, এর মানদণ্ড হিসেবে দেখা হবে সে জাতির নারীশিশু পরিস্থিতির উন্নয়ন। কার্ল মার্কস বলেছিলেন প্রবাদপ্রতিম এ কথাটি। আমরা আমাদের উন্নয়নের চিত্র তাই দেখছি ভালোভাবেই। নারী এখন শতভাগ বাণিজ্যিক প্রকল্পের নাম। নারী উন্নয়নের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট হচ্ছে নানাভাবে। সরকারি-বেসরকারি প্রাতিষ্ঠানিক-অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবে। সম্পত্তির উত্তরাধিকার সৃষ্টির নিমিত্তে নারীর নিয়তি নির্ধারিত করেছে পুরুষ, আজ থেকে প্রায় তিন হাজার বছর আগে। আজও সেই নারী বাণিজ্যিকভাবে পাচার হয় দেশ-দেশান্তরে। পৃথিবীর প্রায় সব দেশের পতিতালয়ে বন্দি বা স্বেচ্ছাবন্দি কোটি নারী। এই বাণিজ্য-চিন্তা পরিবারের ভেতরে পুরুষের মগজের কোষে কোষে আজ অবধি বিদ্যমান বলেই 'যৌতুক প্রথা' বিলুপ্ত হচ্ছে না। ছেলেকে বিয়ে করিয়ে অর্থ আমদানি হয়। মেয়ের জন্য ব্যয় করতে হয়। এমন ব্যবসায়িক প্রথাও নারীর প্রতি নির্মম করে তোলে মানুষকে। অধিকাংশ মানুষ তাই নারীর বেলায় হারিয়ে ফেলে মানবীয় বৃত্তি, উল্টো জেগে ওঠে মনে বাণিজ্যবৃত্তি। এসবের অবসান আমরা সবাই চাই। ইউনিসেফের প্রতিবেদনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য আমাদের অনুপ্রাণিত করে। তবে তথ্য ও তত্ত্বের সমন্বয়পূর্বক কর্মপরিকল্পনা ছাড়া সফলতা খুব কম।
লেখক : সাংবাদিক
ronokk1969@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.