আমদানি নিষিদ্ধ হয়নি ইজি বাইক-নিম্নমানের যন্ত্রাংশ সংযোজনের অভিযোগ by শেখ শাফায়াত হোসেন
বিদ্যুৎ খরচের কারণে দেশে ইজি বাইক আমদানি নিষিদ্ধ করার উদ্যোগ নিয়েছিল সরকার। তবে শেষ পর্যন্ত আমদানিকারকদের দাবিতে এ সিদ্ধান্ত থেকে সরে দাঁড়িয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। অভিযোগ উঠেছে, অধিক মুনাফার আশায় কিছু আমদানিকারক ও খুচরা যন্ত্রাংশ বিক্রেতা ইজি বাইকের সংযোজনের সময় নিম্নমানের টায়ার, ব্যাটারি ও চার্জার ব্যবহার করছেন। আর এতে প্রতারিত হচ্ছেন গ্রাম থেকে আসা সহজ-সরল ক্রেতারা।
চলতি অর্থবছর থেকে সরকার রিচার্জেবল ব্যাটারিচালিত তিন চাকার অটোরিকশার (ইজি বাইক) ওপর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করেছে। এ কারণে প্রতিটি ইজি বাইকের দাম প্রায় ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। এর আগে গত মে মাসে আমদানি নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় তোড়জোড় শুরুর পর পরই ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা দাম বেড়েছিল ইজি বাইকের। দুই দফা দাম বাড়ার ফলে বাজারে ইজি বাইকের দাম বেড়ে প্রায় দ্বিগুণের কাছাকাছি চলে এসেছে।
খুচরা বিক্রেতারা জানান, ইজি বাইকের দাম এমন অস্বভাবিক হারে বেড়ে যাওয়ায় এর বিক্রি আগের তুলনায় কমে গেছে। অন্যদিকে অধিক মুনাফা লাভের আশায় কিছু আমদানিকারক খুচরা বিক্রেতাদের সঙ্গে যোগসাজশে নিম্নমানের ইজি বাইক আমদানি ও বিক্রি করতে শুরু করেছেন।
রাজধানীর কমলাপুরের বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহি মোস্তফা কামাল স্টেডিয়াম মার্কেট থেকে মূলত সারা দেশের ইজি বাইক সরবরাহ করা হচ্ছে। সেখানকার শখানেক প্রতিষ্ঠান ইজি বাইক আমদানি, সংজোযন ও বিক্রয়ের কাজে নিয়োজিত। তা ছাড়া ওই মার্কেটে ইজি বাইকের যন্ত্রাংশও বিক্রি করা হয়। সরেজমিনে ওই মার্কেটে গিয়ে দেখা গেছে, সেখানকার খুচরা বিক্রেতারা গুণগত মানভেদে প্রতিটি ইজি বাইকের দাম নিচ্ছেন এক লাখ ৪৫ হাজার থেকে এক লাখ ৫৫ হাজার টাকা পর্যন্ত।
মূল্যবৃদ্ধির বিষয়ে আমদানিকারকরা বলছেন, আমদানি নিষিদ্ধ না হলেও চলতি অর্থবছর থেকে আমদানিপর্যায়ে ৯৩ শতাংশ হারে শুল্ক আরোপ করেছে সরকার। এ কারণে ইজি বাইকের দাম বেড়েছে। আর এই বর্ধিত দামের বোঝা বইতে হচ্ছে যাত্রীদের। বাজার ঘুরে দেখা গেছে, বর্তমানে পাঁচ ব্যাটারির ইজি বাইক (এস পাওয়ার) বিক্রি হচ্ছে এক লাখ ৪৫ হাজার টাকায় এবং এর থেকে একটু ভালো মানের (ইলেকট্রিক পাওয়ার) ইজি বাইক বিক্রি হচ্ছে এক লাখ ৫৫ হাজার টাকায়। এক বছর আগে এ ধরনের ইজি বাইকের দাম ছিল ৮৫ থেকে ৯৫ হাজার টাকা। আর চার ব্যাটারির ইজি বাইক এখন আর বাজারে পাওয়া যাচ্ছে না।
এদিকে মূল্যবৃদ্ধির ফলে বিক্রি কমে যাওয়া এই মার্কেটের একশ্রেণীর অসাধু আমদানিকারক ও সংজোযনকারী প্রতিষ্ঠান মুনাফা লাভের নতুন ফন্দি এটেছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই মার্কেটের একাধিক আমদানিকারক ও খুচরাপর্যায়ের বিক্রেতারা কালের কণ্ঠকে জানান, কতিপয় আমদানিকারক, সংযোজনকারী প্রতিষ্ঠান ও খুচরা বিক্রেতা ইজি বাইকের সংযোজনের সময় নিম্নমানের টায়ার, ব্যাটারি, মোটর ও চার্জার ব্যবহার করছেন। আর এতে প্রতারিত হচ্ছেন গ্রাম থেকে আসা সহজ-সরল ক্রেতারা।
গতকাল ওই মার্কেটে নারায়ণগঞ্জ থেকে ইজি বাইকের ব্যাটারি কিনতে আসেন রফিকুল ইসলাম নামের এক ব্যবসায়ী। তাঁর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মাত্র পাঁচ মাস আগে তিনি ওই মার্কেটের একটি প্রতিষ্ঠান থেকে একটি ইজি বাইক কিনেছিলেন। এরই মধ্যে ব্যাটারি নষ্ট হয়ে গেছে! রফিকুল বলেন, তখন তিনি ইজি বাইক সম্পর্কে তেমন অভিজ্ঞ ছিলেন না বলে তাঁকে এমনভাবে ঠকানো হয়েছে।
কমলাপুর স্টেডিয়াম মার্কেটের কয়েকটি প্রতিষ্ঠান মালিকের বিরুদ্ধে এ ধরনের অসাধু কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার সুস্পষ্ট অভিযোগ করেছে সেখানকার খুচরা বিক্রেতাদের একাংশ। নাম গোপন রাখার শর্তে একটি ইজি বাইক বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী কালের কণ্ঠকে বলেন, ওই মার্কেটের ভালো ব্র্যান্ডের কয়েক ধরনের ইজি বাইকের যন্ত্রাংশ খুলে নিম্নমানের যন্ত্রাংশ লাগিয়ে বিক্রি করছেন সেখানকার কিছু খুচরা বিক্রেতা। এ ব্যাপারে ফ্রেন্ডস বিডি লি.র স্বত্বাধিকারী ও বাংলাদেশ ইলেকট্রিকাল ভেহিকেল ইম্পোর্টার্স, আসেম্বেলারস, ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড ডিসটিবিউটরস আসোসিয়েশন (বিইভিইএএমএ)-এর সভাপতি খায়রুল হাসান (মিলা) কালের কণ্ঠকে বলেন, 'ইদানীং মার্কেটে এমন অপকর্ম সংগঠিত হচ্ছে বলে বেশ কিছু খবর আমার কানে এসেছে। তবে সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ না থাকায় এ ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হয়নি।' তবে এতে মার্কেটের বেশ দুর্নাম হচ্ছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
নিষিদ্ধ হয়নি আমদানি : ইজি বাইক চার্জ দেওয়ার কাজে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বিদ্যুৎ খরচের দোহাই দিয়ে চলতি বছরের মে মাসে এর আমদানি নিষিদ্ধ করার দাবি তোলে বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত এক আন্তমন্ত্রণালয় বৈঠকে ব্যাটারিচালিত ইজি বাইকের আমদানি, উৎপাদন এবং নতুন করে নিবন্ধন দেওয়া নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বৈঠকে দেশে চলাচল করছে_এমন ইজি বাইকের বয়সসীমা বেঁধে দেওয়ার ব্যাপারেও আলোচনা হয়। কিন্তু ছয় মাস পরও এ ব্যাপারে কোনো ধরনের সিদ্ধান্তে পেঁৗছতে পারেনি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়। বরং চলতি অর্থবছর থেকে ইজি বাইক আমদানির শুল্ক ৩৭ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৯৩ শতাংশ করা হয়েছে।
ডিজিটাল অটোর স্বত্বাধিকারী ও বিইভিইএএমএর প্রচার সম্পাদক মো. মোরর্শেদ আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, দেশে এখন ইজি বাইকের সংখ্যা প্রায় তিন লাখের মতো। আর এর ওপর নির্ভর করে সারা দেশে প্রায় পাঁচ থেকে সাত লাখ লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে।
আমদানি অব্যাহত রয়েছে উল্লেখ করে মোরশেদ জানান, 'ইজি বাইকের আমদানি নিষিদ্ধ করা হলে এ খাতের ব্যবসায়ীরা চরম ক্ষতিগ্রস্ত হবেন_এমন দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ইজি বাইক আমদানি নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে। তা ছাড়া বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার (ডাবি্লউটিও) সদস্য হিসেবে বাংলাদেশ কোনো পণ্যের আমদানি নিষিদ্ধ করতে পারে না। আর নিষিদ্ধ করলেও দেশে ওইসব পণ্য উৎপাদন করার বিধান নেই।'
দেশে এ ধরনের বাহনের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে উল্লেখ করে মোরশেদ বলেন, 'জ্বালানি তেলের দাম বাড়ছে। এর প্রভাবে সকল ধরনের নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে। অন্যদিকে সরকার বাইরের দেশ থেকে বিদ্যুৎ কেনার চেষ্টা করছে। তা ছাড়া কয়েক মাস যাবৎ বিদ্যুৎ সরবরাহ আগের তুলনায় বেড়েছে। প্রতিটি ইজি বাইক চার্জ দেওয়ার জন্য দশমিক ৯ ইউনিট বিদ্যুৎ প্রয়োজন হয়। এখন এ ধরনের পরিবেশবান্ধব যানবাহন দেশের জন্য খুবই প্রয়োজনীয়। এ কারণে সরকারের এ ধরনের বাহন চলাচল উৎসাহিত করা যুক্তিসংগত হবে।'
No comments