জাতীয় নির্বাচন ২০১৪-সংলাপের বিকল্প নেই
সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল হওয়ার প্রেক্ষাপটে ২০১৪ সালে অনুষ্ঠেয় পরবর্তী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে এখনই নানামুখী আলাপ-আলোচনা শুরু হয়েছে। দৃশ্যত এ নিয়ে বাংলাদেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল ও জোট পরস্পরবিরোধী অবস্থান নিয়েছে। অতীতের রাজনৈতিক ধারা বিবেচনা করে অনেকেই মনে করছেন, রাজনৈতিক দলগুলোর পরস্পরবিরোধী মনোভাব সাংঘর্ষিক এমনকি সংঘাতমূলক পরিস্থিতির
সৃষ্টি করতে পারে। ফলে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানে অনেক দেরি থাকলেও সমাজের নানা মহল থেকে এখনই বিষয়টি নিয়ে ফয়সালা করার তাগিদ দেওয়া হচ্ছে। নির্বাচন অনুষ্ঠানের পদ্ধতি নিয়ে রাজনীতির মাঠ গরম না হয়ে বরং জাতীয় স্বার্থ, গঠনমূলক উন্নয়ন পরিকল্পনা নিয়েই রাজনৈতিক দলগুলো কর্মসূচি দিলে সেটি জনগণের কাছে অধিকতর গ্রহণযোগ্য হবে। কিন্তু দিন যতই যাচ্ছে, ততই সাংঘর্ষিক পরিস্থিতির আলামত স্পষ্ট হয়ে উঠছে। রাজনৈতিক দলগুলো বিনাযুদ্ধে সূচ্যগ্র মেদিনী ছাড়তে নারাজ। এমন পরিস্থিতিতে দেশের সচেতন নাগরিকরা রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে খোলামেলা আলাপ-আলোচনা ও সংলাপের কথা বলছেন। এ সংলাপ হতে পারে জাতীয় সংসদে। পঞ্চদশ সংশোধনীর আগে-পরে নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে সংসদে বিতর্কের মাধ্যমে বিষয়টি সমাধানের তাগিদ দেওয়া হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকেও বিরোধী দলকে আলোচনায় ডাকা হয়েছে। কিন্তু তাতে সাড়া মেলেনি। বিরোধী দলের অনুপস্থিতিতে সংশোধনী পাস হয়েছে। সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল হলেও অনেকে মনে করেন, আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে এ ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা যেমন সম্ভব, তেমনি রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতে বিকল্প ব্যবস্থাও খুঁজে পাওয়া সম্ভব। এ কথা সত্য যে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রত্যাবর্তনের সময় থেকে এ পর্যন্ত যত জাতীয় নির্বাচন হয়েছে তাতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মধ্যস্থতা বিশেষ কার্যকর হয়েছে। নির্বাচন যেমন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়েছে, তেমনি রাজনৈতিক দলগুলোর পারস্পরিক অনাস্থা এবং অবিশ্বাসের প্রেক্ষাপটে নির্বাচনী কার্যক্রম আস্থার সঙ্গে পরিচালিত হতে পেরেছে। ফলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অনুপস্থিতিতে নির্বাচন কেমন হবে তা নিয়ে জনমনে সংশয় দেখা দিতে পারে। বোধগম্য কারণে রাজনৈতিক দলগুলোও দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নিতে অনিচ্ছুক হতে পারে। আবার এ কথাও সত্য, পৃথিবীর বহু দেশেই তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার অনুপস্থিতি সত্ত্বেও অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব হচ্ছে। দলীয় সরকারের অন্তর্বর্তী ও সীমিত ভূমিকা এবং নির্বাচন কমিশনসহ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর অবাধ ক্ষমতা সেখানে আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। আমাদের পার্শ্ববর্তী গণতান্ত্রিক দেশ ভারতেও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন জনগণ ও রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থা অর্জন করেছে। এমন একটি নির্বাচন কমিশন আমাদের দেশেও গঠিত হতে পারে। এ জন্য কমিশনের ক্ষমতা বাড়ানো দরকার। শুধু ক্ষমতা ও এখতিয়ার বাড়ানোই নয়, সবার কাছে গ্রহণযোগ্য কমিশন গড়ে তুলতে যোগ্য ব্যক্তিদের কমিশনার হিসেবে নিয়োগ দেওয়াও দরকার। বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ হতে চললেও নতুন কমিশন গঠনে এখনও খোলামেলা আলোচনা হতে দেখা যাচ্ছে না। এ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর পারস্পরিক আলাপ-আলোচনাও হচ্ছে না। ফলে নতুন ও শক্তিশালী একটি নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে পরবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে সরকার কতটা প্রস্তুত তা এখনও স্পষ্ট নয়। পরবর্তী নির্বাচন বিশ্বাসযোগ্যভাবে করতে যে আবশ্যিক কাজগুলো করা দরকার তা কতটা হচ্ছে সে নিয়েও প্রশ্ন তোলা যায়। বিভিন্ন বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের চাপান-উতোর চলছে। নির্বাচন কমিশনের আহ্বানে সংলাপ সফল হতে পারছে না। এমন অবস্থায় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সংলাপের বিকল্প আসলেই নেই। বিশেষ করে বড় দুটি রাজনৈতিক দল একমত না হলে দেশ যে সংঘর্ষের দিকেই এগিয়ে যাবে তা স্পষ্ট। সম্প্রতি ঢাকা সফররত জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুনও রাজনৈতিক সংকট নিরসনে দলগুলোর মধ্যে সংলাপের পরামর্শ দিয়েছেন। দেশের শান্তিকামী নাগরিকদের অবস্থানও তাই। সংসদে ও সংসদের বাইরে আলোচনার মাধ্যমে সরকার ও বিরোধী দলকে ঠিক করতে হবে তারা কোন পদ্ধতিতে নির্বাচন চায়। পারস্পরিক বিশ্বাস ও আস্থার প্রেক্ষাপট তৈরি হলে আবারও সংসদের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা ফেরত আনা সম্ভব। দলগুলো একমত হলে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন সফল করাও সম্ভব। হাতে সময় আছে বলে বিষয়টি নিয়ে কালক্ষেপণের সুযোগ নেই। এটি পরিস্থিতিতে অনর্থক জটিলতা তৈরি করবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, বন্ধু-শুভানুধ্যায়ীদের পরামর্শ মেনে নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো যদি সংলাপের পথে অগ্রসর হয়, সেটিই হবে মঙ্গলজনক।
No comments