পরিকল্পনাকারীদের একজন গ্রেফতার :মন্ত্রীর ভাইকে ধরতে অভিযান by পিনাকি দাসগুপ্ত ও প্রীতিরঞ্জন সাহা
নরসিংদী পৌর মেয়র লোকমান হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারীদের অন্যতম একজনকে গতকাল বুধবার রাজধানী থেকে গ্রেফতার করেছে নরসিংদী পুলিশ। হত্যাকাণ্ডের অর্থের জোগান থেকে শুরু করে সবকিছু গ্রেফতারকৃত এ ব্যক্তির তত্ত্বাবধানে হয়েছিল। ওই ব্যক্তির দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে অপর আসামিদের গ্রেফতারে জন্য ঢাকা ও নরসিংদীতে পুলিশের ১০টি টিম কাজ শুরু করেছে। তদন্তের স্বার্থে তার পরিচয় গোপন রাখা হয়েছে।
গ্রেফতারকৃত এ ব্যক্তি নরসিংদীর বাসিন্দা নন বলে জানা গেছে। গ্রেফতারকৃত শহর যুবলীগ নেতা আশরাফ সরকারের তথ্যের ভিত্তিতে তাকে গ্রেফতার করা হয়। বিকেল ৪টার দিকে রাজধানী থেকে গ্রেফতারের পর তাকে নরসিংদী নেওয়া হয়। এদিকে হত্যা মামলার প্রধান আসামি ডাক
ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজুর ভাই সালাহউদ্দিন আহমেদ বাচ্চু ও পিএস মাসুদুর রহমান মুরাদকে গ্রেফতারে অভিযান শুরু হয়েছে। অন্যদিকে পুলিশ নিশ্চিত হয়েছে, লোকমান হোসেনকে হত্যার জন্য রাজধানী ঢাকা থেকে পেশাদার কিলার ভাড়া করে নেওয়া হয়েছিল। গ্রেফতারকৃত আশরাফ জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন, তিন মাস আগে থেকে লোকমানকে হত্যার পরিকল্পনা চলে। এজন্য ঢাকা ও নরসিংদীতে ৬ দফায় বৈঠক হয়। আশরাফকে গতকাল নরসিংদী আদালতে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ডে নিয়েছে নরসিংদী জেলা গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। সূত্র জানায়, ব্যক্তিগত রেষারেষির কারণেই লোকমানকে হত্যা করা হয়েছে।
এদিকে গতরাত ১২টার দিকে গ্রেফতাকৃত ওই ব্যক্তি, আশরাফ, টিপ্পন ও হাজী সেলিমকে আবারও মুখোমুখি করে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। এর আগে আলাদাভাবেও তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। গতকাল মুখোমুখি জিজ্ঞাসাবাদকালে টিপ্পন মুখ খুলতে শুরু করেছেন। টিপ্পন জানিয়েছেন, লোকমানকে হত্যার জন্য আগেও কয়েকবার টার্গেট করা হয়েছিল। লোকমান অধিকাংশ সময় দেহরক্ষী ও নেতাকর্মী পরিবেষ্টিত থাকায় তা সম্ভব হয়নি। গত ২৫ অক্টোবর থেকে তাকে অনুসরণ করা হচ্ছিল। তাদের টার্গেট ছিল ঈদের সময়। তার আগেই ১ নভেম্বরকে সুযোগ হিসেবে ধরে নেওয়া হয়। কারণ ওই দিন লোকমানের সঙ্গে দেহরক্ষী ছিল না। হামলার পর কিলাররা যেন সহজে পালাতে পারে সে জন্য আওয়ামী লীগ অফিসের বাইরে কিলারদের সহযোগীরা অবস্থান নেয়। গুলি করার পর সহযোগীরা উপস্থিত লোকজনের সঙ্গে মিশে যায়।
একটি সূত্র দাবি করেছে, লোকমান হত্যা মামলার এজাহারভুক্ত ৪ নম্বর আসামি নরসিংদী শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি মমতাজ উদ্দিন ভূঁইয়াকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। রাত সাড়ে ১২টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ঢাকা ও নরসিংদী পুলিশ গ্রেফতারের বিষয়টি নিশ্চিত করেনি।
মামলার বাদী নিহত পৌর মেয়র লোকমান হোসেনের ভাই কামরুজ্জামান কামরুল সমকালকে বলেন, মমতাজকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে তিনি একাধিক সূত্র থেকে জানতে পেরেছেন।
নরসিংদী পৌরসভার সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আবদুল মতিন সরকারের ছোট ভাই আশরাফ হোসেন সরকার ওরফে আশরাফ নরসিংদী শহর যুবলীগের সভাপতি। মতিন সরকার লোকমান হত্যা মামলার ২ নম্বর আসামি। তিনি ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজুর সমর্থনপুষ্ট।
মামলার তদন্ত সূত্র জানায়, পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে আশরাফ জানিয়েছেন, লোকমানকে হত্যার জন্য তারা দীর্ঘদিন ধরে পরিকল্পনা করছিলেন। এজন্য ঢাকায় দুই এবং নরসিংদীতে চার দফায় বৈঠক করা হয়। বৈঠকের আয়োজন করেন আওয়ামী লীগ নেতা মোবারক হোসেন মোবা। প্রতিটি বৈঠকে আশরাফ উপস্থিত ছিলেন। লোকমানকে হত্যার প্রথম প্রস্তাব আসে মোবারক হোসেন মোবার কাছ থেকেই। প্রথম দিকে আশরাফ রাজি হননি। পরে তিনি একমত হন। পুরো পরিকল্পনায় অর্থের জোগান দেন মোবা। তবে ওই বৈঠকগুলোতে মোবা ও আশরাফ ছাড়া আর কে কে উপস্থিত ছিলেন পুলিশ তা চিহ্নিত করার চেষ্টা করছে। জিজ্ঞাসাবাদে আশরাফ আরও জানান, মোবাই বলতে পারবেন এর হত্যার পেছনে আর কার সম্পৃক্ততা রয়েছে।
সূত্র জানায়, ১৫ বছর ধরে আশরাফ হোসেন লাইসেন্স করা একটি পিস্তল ব্যবহার করেন। এ পিস্তল হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত হয়েছিল কি-না তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। লোকমান হত্যার পর থেকে আশরাফের পিস্তলটির কোনো হদিস নেই। আশরাফের শ্বশুরবাড়ি পুরান ঢাকার কলতাবাজার এলাকায়। পুরান ঢাকাসহ রাজধানীর বিভিন্ন পেশাদার কিলারের সঙ্গে আশরাফের রয়েছে সুসম্পর্ক। গত পৌর নির্বাচনের সময়ও আশরাফ রাজধানী থেকে বেশ কয়েকজন পেশাদার কিলারকে নরসিংদীতে নিয়ে গিয়েছিলেন। লোকমান হত্যাকাণ্ডেও সে সব কিলারকেই ভাড়া করে নেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে আশরাফের ভগি্নপতি দেলোয়ার হোসেন পুরান ঢাকার কাপ্তানবাজার এরশাদ মার্কেটের সাধারণ সম্পাদক। তার বিরুদ্ধেও নানা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অভিযোগ রয়েছে। হত্যাকাণ্ডের পর আশরাফ তার ভগি্নপতি দেলোয়ারের এলিফ্যান্ট রোডের বাসায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। তাকে রাখা হয়েছিল ভগি্নপতির বাসার পাশের একটি বাসায়। পুলিশ তার অবস্থান জেনে গেছে এটা নিশ্চিত হওয়ার পরই গ্রেফতার হওয়ার তিনদিন আগে আশরাফ আত্মগোপন করেন পেশায় জেলা জজ তার এক ভাগ্নের খিলগাঁওয়ে বিশ্বরোড সংলগ্ন বাসায়। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ পাঁচতলা ওই বাসা থেকে সোমবার ভোর রাতে তাকে গ্রেফতার করে।
১০ দিনের রিমান্ডে আশরাফ : মঙ্গলবার গভীর রাতে কড়া পুলিশ পাহারায় আশরাফকে নরসিংদীতে নেওয়া হয়। রাতেই নরসিংদী ডিবি পুলিশের দফতরে তাকে কয়েক দফা জিজ্ঞাসাবাদ চলে। গতকাল বুধবার দুপুর সাড়ে ১২টায় কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে পুলিশ তাকে বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট ও হেলমেট পরিয়ে নরসিংদীর চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট নিতাই চন্দ্র সাহার আদালতে হাজির করে। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ডিবি পরিদর্শক মামুনুর রশীদ মণ্ডল দশ দিনের রিমান্ডের আবেদন জানালে আদালত তা মঞ্জুর করেন।
এদিকে আশরাফের গ্রেফতার ও আদালতে হাজির করা হচ্ছে_ এ খবর জানাজানি হলে কয়েকশ' মানুষ তাকে দেখার জন্য আদালতের আশপাশে ভিড় করে। তাদের সামলাতে পুলিশ ও র্যাব সদস্যদের রীতিমতো হিমশিম খেতে হয়। আদালতে উপস্থিত ও শুনানি খুব অল্প সময়ের মধ্যে শেষ হয়। তারপর তাকে নেওয়া হয় ডিবি দফতরে।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আদালতে পেশ করা প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন, লোকমান হত্যা মামলায় এজাহারনামীয় আসামি আশরাফ। ইতিমধ্যে গ্রেফতারকৃত আসামি কাজী মাসুদ পারভেজ ওরফে টিপ্পন আশরাফের ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন। হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার এবং অপরাপর সহযোগী আসামিদের গ্রেফতার ও মামলার মূল রহস্য উদ্ঘাটনে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ একান্ত আবশ্যক। এ সময় মামলায় সরকার পক্ষে সিএসআই আশরাফুল আলম ও আনোয়ার হোসেন আদালতে যুক্তি উপস্থাপন করেন। আসামি পক্ষে কোনো আইনজীবী জামিনের আবেদন করেননি।
মুখোমুখি জিজ্ঞাসাবাদ : মঙ্গলবার রাতেই ঢাকা থেকে নরসিংদী নেওয়ার পর পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে নিজেকে হত্যার দায় থেকে বাঁচাতে বিভিন্ন তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেন আশরাফ। এ অবস্থায় রিমান্ডে থাকা আসামি টিপ্পন ও হাজি সেলিমকে মুখোমুখি করা হয় তার। তারপরই মুখ খুলতে শুরু করেন আশরাফ। লোকমান হত্যার পরিকল্পনা থেকে নিজের পালিয়ে থাকা পর্যন্ত সব কিছুরই বিবরণ দেন তিনি। তার দেওয়া তথ্য মতে পুলিশ অপর আসামিদের গ্রেফতারে অভিযান জোরদার করে। এদিকে গ্রেফতারকৃত হাজি সেলিমকে চার দিন ও টিপ্পনকে আট দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। আজ চার দিন রিমান্ড শেষে সেলিমকে আদালতে হাজির করা হতে পারে।
বাচ্চু যে কোনো সময় গ্রেফতার হতে পারেন : পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, সালাহউদ্দিন আহমেদ বাচ্চুকে গ্রেফতারের জন্য পুলিশ আগে থেকেই তৎপর ছিল। তিনি বার বার তার অবস্থান পরিবর্তন করার কারণে তাকে গ্রেফতারে বিলম্ব হচ্ছে। বর্তমানে তিনি পুলিশের নজরদারির মধ্যেই রয়েছেন। তাকে গ্রেফতারে একাধিক টিম অভিযান অব্যাহত রেখেছে। যে কোনো সময় এজাহারভুক্ত এ আসামিকে গ্রেফতার করা সম্ভব হবে।
ওই কর্মকর্তা বলেন, সালাহউদ্দিন আহমেদ বাচ্চুসহ তিন আসামির আগাম জামিন শুনানির জন্য তারিখ নির্ধারণ ছিল গতকাল বুধবার। সে অনুয়ায়ী আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও হাইকোর্ট এলাকায় গোয়েন্দা নজরদারির প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। বাচ্চুসহ অন্য আসামিদের চিহ্নিত করার জন্য নরসিংদী পুলিশের এক কর্মকর্তাকে ঢাকায় ডেকে আনা হয়েছিল। বুধবার শুনানি না হয়ে তার আগেই গত সোমবার আগাম জামিনের জন্য বাচ্চু, মুরাদ আহমেদ ও মমতাজ উদ্দিন নামে এজাহারভুক্ত তিন আসামি আদালতে যান। ওই দিন সকাল সোয়া ১১টার দিকে ঢাকার পুলিশ এ খবর জানতে পারে। এর কিছুক্ষণের মধ্যে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা নরসিংদী পুলিশের ওই সদস্যকে নিয়ে উচ্চ আদালত এলাকায় তাদের গ্রেফতারের জন্য অভিযান চালান। নরসিংদী পুলিশের ওই সদস্য আসামিদের চিহ্নিত করতে না পারায় ঢাকার পুলিশ মামলার বাদীর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। বাদীর দেওয়া বর্ণনা অনুযায়ী ওই দিন বিকেল ৩টা পর্যন্ত আদালত এলাকায় অবস্থান নেয় পুলিশ। পরে অভিযানকারী পুলিশ দলটি জানতে পারে, কালো গ্গ্নাসে ঘেরা একটি প্রাইভেটকারে ওই তিন আসামি পালিয়ে যান। তাদের মধ্যে সালাহউদ্দিন আহমেদ বাচ্চু আদালতে নীল রঙের ফুলহাতা শার্ট পরে এসেছিলেন। অপর একজন সাদা রঙের হাফ শার্ট ও একজনের পরনে সাদা ফুল শার্ট ছিল।
পুলিশের ওই কর্মকর্তা বলেন, মামলার এজারভুক্ত তিন আসামি দেশের বাইরে অবস্থান করছেন বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। বাকিদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ বেশ কয়েক আসামির অবস্থান শনাক্ত করা গেছে। তারা নরসিংদী জেলার বাইরে আত্মগোপনে রয়েছেন। তাদের মূল অবস্থান নিশ্চিত হয়ে গ্রেফতার অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
শোকসভা : এদিকে গতকাল বুধবার নরসিংদী জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের প্রস্তুতিমূলক সভায় নিহত মেয়র লোকমান হোসেনের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। এছাড়া নরসিংদী সরকারি কলেজে ছাত্র সংসদের পক্ষ থেকে শোকসভা, দোয়া ও মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করা হয়। কলেজের অধ্যক্ষ আবু বক্কর সিদ্দিকের সভাপতিত্বে সভায় বক্তব্য রাখেন নরসিংদী সদরের এমপি লে. কর্নেল (অব.) নজরুল ইসলাম হিরু, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট আসাদুজ্জামান, সাধারণ সম্পাদক আবদুল মতিন ভঁূইয়া, অধ্যক্ষ অহিভূষণ চক্রবর্তী, ড. মশিউর রহমান মৃধা, জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি শাহ আলম, এসএম কাইয়ুম ও ভিপি শামীম নেওয়াজ। সভায় নরসিংদী সদরের এমপি হীরু বলেন, লোকমান হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের গ্রেফতারে তার প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে। হত্যাকারী যতই প্রভাবশালী হোক তাকে বিচারের আওতায় আসতেই হবে।
No comments