প্রদীপ যেন না নেভে

বারের ঈদে মুক্তি পাওয়া সাতটি চলচ্চিত্র নিয়ে নিজের মন্তব্য জানিয়েছেন চলচ্চিত্রকার শহীদুল ইসলাম খোকন
চলচ্চিত্রের অবস্থা ভালো না, ভালো না, ভালো না। গত কয়েক বছর ধরে ভাঙা রেকর্ডের মতো এ কথাটিই কানে শুধু বাজছে। প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে নাশতা-গোসলের পাট চুকিয়ে এফডিসিতে রওনা হই। চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতিতে বসে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে শুরু হয় আড্ডা।


প্রসঙ্গ যাই হোক, ঘুরেফিরে চলচ্চিত্রই আলোচনায় চলে আসে। প্রায় তিন যুগের অভ্যাস। চাইলেই কি বদলানো যায়? যখনই চলচ্চিত্রের প্রসঙ্গ আসে, তখনই শুনতে হয় দুরবস্থার কথা। চলচ্চিত্র নিয়ে হতাশার বাণী শুনতে শুনতে আশার প্রদীপটি যেন নিভে যাচ্ছিল। তবে ঈদের পরদিন ছিল একেবারে ভিন্ন। পরিচালক সমিতিতে ঢুকতেই দেখি বদিউল আলম খোকনের হাস্যোজ্জ্বল মুখ। তিনি জানালেন, ঈদে মুক্তি পাওয়া 'বস নাম্বার ওয়ান' ভালো ব্যবসা করছে। তথ্যটি শুনে ভালো লাগল। এ যেন মেঘাচ্ছন্ন আকাশে এক ঝলক সূর্যের আলো। মুহূর্তের মধ্যে পরিচালক ও প্রযোজকদের মুখে আশার বাণী। 'ছবির অবস্থা আবারও ভালো হচ্ছে। দর্শক প্রেক্ষাগৃহে আসছে। ঈদে মুক্তি পাওয়া সব ছবিই ভালো ব্যবসা করছে'_ পরিচালক সমিতির কক্ষের বাইরে একে অন্যকে এমন তথ্যই জানাচ্ছেন। একটি তথ্য জানাতেই হয়_ এবার ঈদুল আজহায় মুক্তি পেয়েছে পাঁচটি ছবি। এগুলো হলো মুহাম্মদ মোস্তফা কামাল রাজ পরিচালিত 'প্রজাপতি', রাজু চৌধুরীর 'প্রিয়া আমার জান', মোহাম্মদ হোসেন জেমীর 'কিং খান', বদিউল আলম খোকনের 'বস নাম্বার ওয়ান' ও মনতাজুর রহমান আকবর পরিচালিত 'ছোট্ট সংসার'। এ ছাড়া টিভিতে ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ার হয়েছে নোমান রবিনের 'জলদস্যুদের রক্ত রহস্য', হাসিবুর রেজা কল্লোল পরিচালিত 'অন্ধ নিরাঙ্গম' ও 'বন্ধু তুমি আমার'।
পারিবারিক কাজে মতিঝিল হয়ে নিউমার্কেট যাওয়ার উদ্দেশে এফডিসি থেকে বের হলাম। মতিঝিল যেতেই দেখি মধুমিতা প্রেক্ষাগৃহে দর্শকের দীর্ঘলাইন। 'ছোট্ট সংসার' দেখতেই শত শত দর্শক ভিড় জমিয়েছেন এখানে। ইচ্ছে হলো জোনাকি প্রেক্ষাগৃহের অবস্থা দেখার। তাই গাড়ি ঘুরিয়ে গেলাম সেদিকে উঁকি দিতে। এখানে চলছে 'প্রিয়া আমার জান'। এখানেও একই চিত্র। রাস্তা অবধি নেমে এসেছে দর্শকের সারি। ক্ষণে ক্ষণে বাড়ছে দর্শক। বরাবরের মতো এবারের ঈদেও ছবিপাড়া কাকরাইলে অবস্থিত রাজমণি প্রেক্ষাগৃহ ছিল কালোবাজারিদের দখলে। এখানে চলছে 'কিং খান'। ছবিটি দেখতে দর্শকের আগ্রহের কমতি ছিল না। কালোবাজারিদের দৌরাত্ম্য সহ্য করেও তারা ছবি দেখছেন। নিউমার্কেটের বলাকায় চলছে 'প্রজাপতি'। মৌসুমীর সঙ্গে টিভি নাটকের জনপ্রিয় দুই তারকা জাহিদ হাসান ও মোশাররফ করিমকে দেখতে দর্শকের উপস্থিতি ছিল লক্ষণীয়। অনেকদিন পর দেখলাম ঈদের ছবি দেখতে প্রেক্ষাগৃহে দর্শকের ঢল নেমেছে। হল মালিক ও বুকিং এজেন্টদের দেওয়া তথ্যে জেনেছি, ঈদের দিন থেকে এখনও সব ছবিই ভালো ব্যবসা করছে। ঈদের চতুর্থ দিন মুঠোফোনে মধুমিতার কর্ণধার ইফতেখার উদ্দিন নওশাদ আমাকে জানালেন, এবার ঈদে মুক্তি পাওয়া সব ছবিই দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছে। ঈদের দিন থেকে প্রতিটি প্রেক্ষাগৃহেই দর্শক সমাগম রয়েছে। এবার ঈদে শাকিব খান অভিনীত তিনটি, অপু বিশ্বাসের দুটি এবং ডিপজল ও মৌসুমীর একটি করে ছবি মুক্তি পেয়েছে। প্রতিবারের মতো এবারও একাধিক ছবি নিয়ে সফল হলেন শাকিব খান।
এবার ঈদে মুক্তি পাওয়া ছবিগুলো দর্শক গ্রহণ করেছে ঠিকই; তবে শিল্পীদের দুর্বল অভিনয় ও নিম্নমানের গল্পের জন্য প্রত্যাশা অনুযায়ী দর্শক কিন্তু প্রেক্ষাগৃহে আসছে না। তার ওপর হলের পরিবেশ তো যাচ্ছেতাই। এসব যদি ঠিক থাকত, তাহলে আরও দর্শক সমাগম ঘটত। আশা করছি ভবিষ্যতে আমাদের নির্মাতা ও হল মালিকরা এ বিষয়গুলো খেয়াল রাখবেন। তাহলে ইতিবাচক ফল পেতে খুব বেশি বেগ পেতে হবে না। এবার ঈদে যে প্রদীপটি জ্বালানো হয়েছে, সে প্রদীপটি যেন নিভে না যায় সে প্রত্যাশা আমাদের সবার।
প্রজাপতি :নাট্য পরিচালক মুহাম্মদ মোস্তফা কামাল রাজের প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাণে পদযাত্রা 'প্রজাপতি' দিয়ে। তার নিজস্ব চিন্তা থেকে চমৎকার চিত্রনাট্য, ধীবুদ্ধিসম্পন্ন মেধা আর মনন দিয়ে অভিনয়শিল্পীদের কাছ থেকে সর্বোচ্চটা আদায় করে নেওয়ার বন্ধুসুলভ কৌশল অবাক করেছে সমালোচকদের।
দেখা গেছে, পরিচালক হিসেবে প্রথম প্রয়াসে তিনি চেষ্টা করেছেন কলাকুশলীদের নিয়ে একটি টিম হয়ে কাজ করতে এবং এক্ষেত্রে তিনি সফলও। সফলতা ব্যবসায়িক বলব না, ওই মাপকাঠিতে মাপতে গেলে লোকসানের পাল্লা ভারী হবে। অভিনয়, নির্মাণ কৌশল, ক্যামেরা, স্থান নির্বাচন, মেকআপ ইত্যাদি নিয়েই তার সাফল্য।
তরুণ দর্শকদের কথা মাথায় রেখে হাবিব ওয়াহিদের পরিচ্ছন্ন সঙ্গীত আয়োজনে মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই। সঙ্গীতের সঙ্গে যোগ হয়েছে পুরো ছবির দর্শক-শ্রোতার মিশে যাওয়া, অনেক ক্ষেত্রে তন্ময় হয়ে এগিয়ে যাওয়া আবহ সঙ্গীত। এখানে আরেফিন রুমির কাজের স্বকীয়তা উল্লেখ করার মতো।
খায়ের খন্দকারের দৃশ্য ধারণ প্রথাগত দৃশ্য ধারণ থেকে যে আলাদা মানের হয়েছে সেটা বলার আপেক্ষা রাখে না। কোথাও কোথাও দুর্বলতা থাকলেও কাজের ক্ষেত্রে সাধারণ দর্শকদের ক্ষেত্রে মনোযোগ সেগুলো এড়িয়ে দিয়েছে। লাইটিং ভালো হয়েছে। দুর্বলতা ছিল, তবে গতানুগতিক ধারা থেকে ভিন্ন ছিল বলেই দৃষ্টিকটূ মনে হয়নি। আবার কোথাও কোথাও ভালোকেও ছাপিয়ে যাওয়ার চেষ্টা ছিল। পুরো ছবিটিতে একটি বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে; কিন্তু মানুষের জীবনে শত ঝঞ্ঝার মধ্যেও ভিন্নতা থাকে, সেখানে চেষ্টা থাকে হতাশা কাটিয়ে নতুনভাবে কিছু করার চেষ্টা; কিন্তু গল্পের শেষ দিকে এটার সমাপ্তি ঠিক সেরকম হয়নি। দেখা গেছে, ১০ বছর আগের স্মৃতি রোমন্থনে ২০১০ মডেলের গাড়ি দেখানো হয়েছে, আবার ১০ বছর পরেরটাও তাই। কিছুটা অসঙ্গতি আছে বৈকি।
মৌসুমীর অভিনয় দেখে তার প্রথম ছবির কথাই মনে পড়ে যায়। তরুণদের বুকে যেন ঘুরেফিরে ধাক্কা দিয়ে জানিয়ে দেওয়া, আমি মৌসুমী, তোমাদের মৌসুমী। এ ছাড়া জাহিদ হাসান, মোশাররফ করিম, সোহেল থেকে শুরু করে বাবর_ সবাই নিজ নিজ জায়গায় গল্প এবং চিত্রনাট্যের সঙ্গে মিশে যেতে পেরেছেন। খুব ভালো সম্পাদনা হয়েছে। সবকিছু মিলিয়ে 'প্রজাপতি' এগিয়ে যাওয়ার গল্প।
ছোট্ট সংসার :ছবিটির পরিচালক মনতাজুর রহমান আকবর ছবিটির নামকরণের সঙ্গে অনেক জায়গায় খেই হারিয়ে মূল গল্পকেই দুর্বল করে তুলেছেন।
ছবিটি ব্যবসায়িকভাবে মোটামুটি সফল। দুর্বল পরিচালনার ছাপ অধিক। যা প্রত্যাশা ছিল না। গল্প ভালো। মনে হয়েছে তাড়াহুড়া করে কোনো রকম ঈদকে ধরা। অভিনয়ের কথা বলতে গেলে ডিপজল ভালো একজন অভিনেতা সন্দেহ নেই।
কিন্তু তিনি তার গতানুগতিক অভিনয়ের ধারা থেকে বের হতে পারেননি অথবা পরিচালক তাকে সেভাবে ব্যবহার করতে পারেননি। ক্ষুদে অভিনয় শিল্পীরা ছবিটির গল্পে মিশে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। সে তুলনায় মারুফ বা তার সহশিল্পীর দুর্বল অভিনয় নজর এড়িয়ে গেছে। অন্যদিকে রেসিকে ভালোভাবে উপস্থাপনা করার সুযোগ ছিল।
ছবিতে রূপসজ্জার যত্রতত্র ব্যবহার ছিল বিরক্তিকর। পোশাক নির্বাচন বেশি বিরক্তিকর। ডিপজল ঠেলাগাড়িচালক হলেও তার পায়ে ইতালিয়ান জুতা ছিল সবসময়। চিত্রগ্রহণ ভালো হয়নি। একটি চমৎকার গল্পকে দর্শক হৃদয়ে গাঁথতে যা দরকার ছিল তার অনেক অসম্পূর্ণতার গল্প 'ছোট্ট সংসার'।
হ 'প্রজাপতি' ও 'ছোট্ট সংসার' ছবির পর্যালোচনা লিখেছেন আহমেদ তেপান্তর

No comments

Powered by Blogger.