বাংলাদেশে ‘নির্বাচিত একনায়কত্ব’ by মইনুল ইসলাম
২০১১ সালের ৪ নভেম্বর এই নিবন্ধটি লিখতে শুরু করেছি ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর তারিখকে স্মরণ করে, যেদিন বাংলাদেশের সংবিধানটি সংসদে গৃহীত হয়েছিল। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের ১০ মাস ১৯ দিনের মধ্যেই জাতিকে একটি গণতান্ত্রিক সংবিধান উপহার দিতে পারা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন সরকারের ঐতিহাসিক সাফল্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। কিন্তু আজকের নিবন্ধের শিরোনামেই আমি একটি কঠিন সত্য জাতির সামনে উপস্থাপন করতে চাইছি। তা হলো: ১৯৯১ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত দুই দশকের নির্বাচিত সংসদীয় গণতন্ত্রচর্চার বিশ্লেষণ থেকে আমার স্থির প্রতীতি জন্মেছে যে এই দুই দশকের শাসনপর্বে বাংলাদেশের প্রধান দুই দলের দুই শীর্ষ নেতার ‘নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্র’ বা ‘নির্বাচিত একনায়কত্বের’ কবলে বন্দী হয়ে গেছে জনগণ এবং এই জন্য প্রধানত দায়ী এ দেশের সংবিধান।
১৯৭২ সালের সংবিধান বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অলঙ্ঘনীয় রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করায় একটি আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার আদর্শ সংবিধান হিসেবে এটা বিশ্বখ্যাতি অর্জন করেছিল। কিন্তু গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সাংসদদের সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন যাতে রাজনৈতিক বেচাকেনার পণ্যে পর্যবসিত না হয়, সে জন্য এ সংবিধানের ৭০ ধারায় সাংসদদের দলীয় আনুগত্য পরিবর্তনকে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করার সাংবিধানিক ব্যবস্থা সন্নিবেশিত হয়েছে। বিশ শতকের পঞ্চাশের দশকের পূর্ব পাকিস্তান অ্যাসেম্বলির দুঃখজনক ইতিহাস যাঁদের জানা আছে, তাঁদের কাছে ৭০ ধারার যৌক্তিকতা ও আবশ্যকতা প্রশ্নাতীত বিবেচিত হলে তাঁদের দোষ দেওয়া যাবে না। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে ৭০ ধারার গুরুতর নেতিবাচক অভিঘাতটি ধরা না পড়লেও ১৯৯১-২০১১ পর্বের নির্বাচিত সরকারের শাসনকালে এখন সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। এই ৭০ ধারা বাংলাদেশের প্রধান দুই দলের দুই নেতার হাতে নিজ নিজ দলের একচ্ছত্র ক্ষমতা দিয়েছে। দুই নেতাই যেহেতু তাঁদের একাধিপত্যের এই হাতিয়ারটি সম্পর্কে পুরোপুরি ওয়াকিবহাল, তাই ৭০ ধারার কোনো ধরনের সংশোধন তাঁদের কেউই চাইছেন না—এই একটি ব্যাপারে তাঁদের মতৈক্য প্রশ্নাতীত বলা চলে। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর প্রস্তাব প্রণয়নের জন্য গঠিত সংসদীয় কমিটি দীর্ঘ আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ৭০ ধারার বজ্র আঁটুনি কিঞ্চিৎ শিথিল করার কতিপয় প্রস্তাব খসড়া আকারে শেখ হাসিনার বিবেচনার জন্য পেশ করার পর ওই প্রস্তাবগুলোর প্রায় সব কটিই তাঁর অনুমোদন পেতে ব্যর্থ হয়েছিল বলে পত্রপত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়েছে। আরও দুঃখজনক হলো, সংসদীয় কমিটি বেশ কয়েক মাস পরিশ্রম করে, নানা বিজ্ঞজনের ও নানা মহলের সঙ্গে মতবিনিময়ের মাধ্যমে সংবিধান সংশোধনের যে খসড়া প্রস্তাবমালা প্রস্তুত করেছিল, সেগুলোর বেশির ভাগ প্রস্তাবই শেখ হাসিনার একক পছন্দ-অপছন্দের কারণে কমিটির অধিকাংশ সদস্যের আপত্তি সত্ত্বেও পরিবর্তিত হয়ে গেছে। তার মানে দাঁড়িয়েছে, পঞ্চদশ সংশোধনীর যে ভাষ্যটা সংসদে পাস হয়েছে, তাতে অনেক বিষয়েই কমিটির বেশির ভাগ সদস্যেরই সায় নেই। অথচ, সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে প্রকাশ্যে এহেন অসম্মতি বা অসন্তোষ প্রকাশের কোনো সুযোগ ক্ষমতাসীন মহাজোটের কোনো সাংসদেরই নেই ।
একটি সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচিত সাংসদ থেকে শুরু করে মন্ত্রিসভার সদস্য, বিএনপি কিংবা আওয়ামী লীগের স্থায়ী কমিটি বা প্রেসিডিয়াম সদস্য—সবারই এই দুই দলের দুই নেত্রীর ইচ্ছা-অনিচ্ছা এবং পছন্দ-অপছন্দের কাছে অসহায় আত্মসমর্পণের যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি এ দেশে চালু হয়েছে, তার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হলো এই দুই নেত্রীর একাধিপত্যকে প্রশ্নাতীত স্বৈরতান্ত্রিক স্তরে উন্নীত করা। এই দুই দলে গণতন্ত্রের চর্চা নেই বলে আমরা যতই হা-হুতাশ করি না কেন, তাঁদের দুজনের সমালোচনা করে কিংবা ইচ্ছা-অনিচ্ছার বিরুদ্ধে অবস্থান নিলে পরিণতি কী হবে, এটা যেহেতু সবারই জানা হয়ে গেছে, তাই ওই ধরনের ভূমিকা কে পালন করবে? কেন পালন করবে?
গণতান্ত্রিক সংবিধানে রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গের মধ্যে সংসদীয় গণতন্ত্রে ক্ষমতার সুস্পষ্ট বিভাজন সুনির্দিষ্ট করার কথা। কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মূল কেন্দ্রে রেখে ১৯৭২ সালের সংবিধান রচনা করার কারণেই হয়তো বা আমাদের মূল সংবিধানের প্রণেতারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বিভাজনে প্রধানমন্ত্রীকে সাংবিধানিকভাবেই অনেক অতিরিক্ত নির্বাহী ক্ষমতা প্রদান করে ফেলেছিলেন। তারপর এই সংবিধানের ওপর সওয়ার হয়েছে চতুর্থ সংশোধনীর রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারব্যবস্থার বোঝা। তারপর তো শুরু হলো সামরিক প্রভুদের অসাংবিধানিক ক্ষমতা জবরদখলের রক্তাক্ত অধ্যায়। কিন্তু ১৯৯১ সালে যখন আবারও বাংলাদেশ সংসদীয় গণতন্ত্রে ফিরে এল, তখন সামরিক স্বৈরাচারী রাষ্ট্রপতির আদলেই খালেদা জিয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকাকে পুনর্বিন্যস্ত করে ফেলেছেন বিএনপির ধুরন্ধর ব্যারিস্টাররা। ১৯৭৫-৯১ পর্বের একচ্ছত্র ক্ষমতাধর রাষ্ট্রপতিরা তাঁদের সচিবালয়ের মাধ্যমে যেভাবে সব নির্বাহী ক্ষমতার প্রায় একচ্ছত্র প্রয়োগের ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন, ১৯৯১ সালে বেগম জিয়া তদানীন্তন অন্তর্বর্তী রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের কারণে অনিচ্ছা সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পদাবনতি মেনে নিলেও প্রধানমন্ত্রীর পদের ক্ষমতাকেই একনায়কত্বের পর্যায়ে রেখে দেওয়ার ব্যবস্থাটা সুপরিকল্পিতভাবে বহাল রাখলেন। এরপর তিন দফা নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনের সুযোগ পেয়েছেন বেগম খালেদা জিয়া (একবার অবশ্য মাস দেড়েকের জন্য), কিন্তু সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রতি তাঁর বিরাগ তিনি তাঁর আচরণে প্রমাণ করেছেন প্রতিবারই। সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার নির্বাহী শাখার প্রধান হয়েও কালেভদ্রে মাত্র কয়েকবার তিনি সংসদ অধিবেশনে যোগ দিয়েছেন, তা-ও বেশির ভাগ শেখানো-পড়ানো বক্তৃতা দেওয়ার প্রয়োজনে। এ ব্যাপারটাতে খালেদা জিয়া বিশ্বরেকর্ড সৃষ্টি করেছেন।
১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে শেখ হাসিনা সংসদের অধিবেশনে প্রায় নিয়মিত অংশগ্রহণ করেছেন। কিন্তু বিরোধী দলের বর্জনের কারণে একতরফা বাহাস যেহেতু ক্লান্তিকর হতে বাধ্য, তাই তাঁর উপস্থিতিতে বেশির ভাগ দলীয় সদস্য তাঁকে খুশি করার জন্য একদিকে তাঁকে এবং তাঁর সরকারকে প্রশংসার বন্যায় ভাসানো আর বিরোধীদলীয় নেতা ও বিরোধী দলকে উদ্দেশ করে অরুচিকর ও অশ্লীল গালাগাল দেওয়াটাকেই সংসদীয় সংস্কৃতি বানিয়ে ফেললেন। সংসদকে এভাবে খালি মাঠে একতরফা প্রশংসা ও খিস্তিখেউড়ের প্রদর্শনীস্থল বানিয়ে গত দুই দশকে আমরা এ দেশে সংসদীয় গণতন্ত্রকে শুধু পাঁচ বছর পরপর ভোটের মাধ্যমে বেগম জিয়া কিংবা শেখ হাসিনাকে পালাক্রমে এ দেশের ‘নির্বাচিত একনায়ক’ বানিয়েছি।
নির্বাচিত একনায়কতন্ত্রের ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করার জন্য দুই নেত্রীর প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য চাল ও পাল্টা চালের রাজনীতি ১৯৯৬-২০০৮ পর্যায়ের তিনটি নির্বাচনের মাঝামাঝি দুই মেয়াদে কতখানি প্রাতিষ্ঠানিকতা অর্জন করেছে, তা ওয়াকিবহাল মহলের মোটেও অজানা নয়। এই প্রক্রিয়ায় পুরো সিভিল প্রশাসন ও আমলাতন্ত্রকে দলীয়করণের পালাক্রমিক আয়োজন সুসম্পন্ন হয়েছে। রাষ্ট্রের সশস্ত্র বাহিনী এবং বিশেষত সেনাবাহিনীকে বারবার ছাঁটাই-পাল্টা ছাঁটাইয়ের মাধ্যমে তথাকথিত শুদ্ধিকরণের শিকার করা হয়েছে। রাষ্ট্রের পুলিশ বাহিনীকে পুরোপুরি দলীয় লাঠিয়াল বাহিনীতে রূপান্তরিত করে ফেলা হয়েছে। এমনকি, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডকে নবগঠিত এলিট ফোর্স র্যাবের প্রধান প্রাণঘাতী তৎপরতা হিসেবে নীরব অনুমোদন দিয়ে চলেছে এ দুটো ক্ষমতাসীন মহল। সর্বোপরি, দেশের বিচারব্যবস্থাকে সরকারি দলের স্বার্থের বিশ্বস্ত খাদেম বানানোর প্রয়াসকে খোলামেলা চাতুর্যের খেলায় পরিণত করে ফেলা হয়েছে। ২০০৬ সালের অক্টোবর থেকে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিনের মাধ্যমে বেগম জিয়া ও বিএনপি-জামায়াত জোটের রথী-মহারথীদের চালবাজির যে প্রদর্শনী দেখার দুর্ভাগ্য এ দেশের জনগণের হয়েছিল, তার পেছনে বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটের ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তনের ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং মরিয়া ভূমিকা পালন করেছিল—এটা এখন তো এ দেশের ইতিহাসের অন্যতম কালো অধ্যায় হিসেবে মানব জাতির ঐতিহ্যের অংশ হয়ে পড়েছে।
১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের সংসদীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল সামান্যই, কিন্তু ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটকে তিন-চতুর্থাংশেরও বেশি সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়ে জিতিয়ে দিয়েছে এ দেশের জনগণ। এই ভূমিধস বিজয় যতখানি না মহাজোটের প্রতি ইতিবাচক জনসমর্থনের স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ, তার চেয়েও বেশি ছিল বিএনপি-জামায়াত জোটকে জনগণের ঘৃণাভরা প্রত্যাখ্যানের প্রকাশ। ২০০১ সালের নির্বাচনের অব্যবহিত আগের ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগকে প্রায় একই ধরনের বিপর্যয়কর শিক্ষা দিয়েছিল জনগণ। কিন্তু ২০০১-২০০৬ মেয়াদের বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের দুর্নীতি, লুটপাট, দুঃশাসন, দলীয়করণ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী পাকিস্তানীকরণ ছিল একেবারেই বেলাগাম ও অসহনীয়। সঙ্গে যোগ হয়েছিল জামায়াত-শিবির ও তাদের বিভিন্ন নামধারী পকেট সংগঠনের ঘাতক ফ্যাসিবাদী ক্যাডারদের তালেবানি তাণ্ডব, বোমাবাজি ও মধ্যযুগীয় খুন-জখমের অপরাজনীতি। সর্বোপরি যোগ হয়েছিল তারেক রহমানকে খালেদা জিয়ার ‘রাজতান্ত্রিক উত্তরাধিকারী’ বানিয়ে দেশের ক্ষমতার মসনদে বসানোর অপতৎপরতা। খালেদা জিয়া এই সমস্যাসংকুল দেশের আয়েশি প্রধানমন্ত্রীর জীবনযাপন করতেই অভ্যস্ত, ক্যান্টনমেন্টের সুপরিসর বাসভবনে তাঁর বিলাসী জীবনযাত্রার কাহিনি বাংলাদেশের জন্য বড়ই বেমানান। কিন্তু তাঁর হাতেই বারবার নিরঙ্কুশ ক্ষমতা অর্পণ করছেন এ দেশের ভোটাররা। সে জন্যই প্রতিবার তাঁকে ঘিরে ক্ষমতার ঘেরাটোপ গড়ে তুলেছেন তাঁর কৃপাধন্য কিছু উপদেষ্টা, পরামর্শক, সহকারী কিংবা পারিবারিক সদস্য ও আত্মীয়স্বজন। অতএব, তারেক রহমান মায়ের উত্তরাধিকার হিসেবে পেয়ে যাবেন বিএনপির নেতৃত্ব এবং নির্বাচনী বিজয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রিত্ব—এটাই এখন বেগম জিয়ার রাজনৈতিক ধ্যানজ্ঞান।
কিন্তু পরিবারতন্ত্র এবার আরও বেশি সংক্রমিত হয়ে গেছে শেখ হাসিনার রাজনীতির সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডে—এটাই এক্ষণে এ দেশের প্রগতিশীল রাজনীতির জন্য ‘অশনিসংকেত’ বলে মনে করি আমি। ২০০৯-২০১১ পর্বের গত ৩৪ মাসের শেখ হাসিনার শাসনকালের ক্রমবিবর্তন বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, তাঁর সিদ্ধান্তগুলো প্রায়ই একক ও একতরফা হয়ে যাচ্ছে। আওয়ামী লীগের জনপ্রিয় অভিজ্ঞ নেতারা ক্রমেই হয়ে পড়েছেন কক্ষচ্যুত কিংবা অবহেলিত, দলের প্রেসিডিয়াম কিংবা মন্ত্রিসভা তাঁর একক ও খামখেয়ালি সিদ্ধান্তের শিকার হয়ে যাচ্ছে বারবার। এটাকে অনেকে ‘উপদেষ্টাশাসিত সরকার’ বলেই অভিহিত করছেন ইতিমধ্যেই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, এই সর্বনাশা পথ থেকে ফিরে আসুন।
মইনুল ইসলাম: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
১৯৭২ সালের সংবিধান বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অলঙ্ঘনীয় রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করায় একটি আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার আদর্শ সংবিধান হিসেবে এটা বিশ্বখ্যাতি অর্জন করেছিল। কিন্তু গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সাংসদদের সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন যাতে রাজনৈতিক বেচাকেনার পণ্যে পর্যবসিত না হয়, সে জন্য এ সংবিধানের ৭০ ধারায় সাংসদদের দলীয় আনুগত্য পরিবর্তনকে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করার সাংবিধানিক ব্যবস্থা সন্নিবেশিত হয়েছে। বিশ শতকের পঞ্চাশের দশকের পূর্ব পাকিস্তান অ্যাসেম্বলির দুঃখজনক ইতিহাস যাঁদের জানা আছে, তাঁদের কাছে ৭০ ধারার যৌক্তিকতা ও আবশ্যকতা প্রশ্নাতীত বিবেচিত হলে তাঁদের দোষ দেওয়া যাবে না। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে ৭০ ধারার গুরুতর নেতিবাচক অভিঘাতটি ধরা না পড়লেও ১৯৯১-২০১১ পর্বের নির্বাচিত সরকারের শাসনকালে এখন সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। এই ৭০ ধারা বাংলাদেশের প্রধান দুই দলের দুই নেতার হাতে নিজ নিজ দলের একচ্ছত্র ক্ষমতা দিয়েছে। দুই নেতাই যেহেতু তাঁদের একাধিপত্যের এই হাতিয়ারটি সম্পর্কে পুরোপুরি ওয়াকিবহাল, তাই ৭০ ধারার কোনো ধরনের সংশোধন তাঁদের কেউই চাইছেন না—এই একটি ব্যাপারে তাঁদের মতৈক্য প্রশ্নাতীত বলা চলে। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর প্রস্তাব প্রণয়নের জন্য গঠিত সংসদীয় কমিটি দীর্ঘ আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ৭০ ধারার বজ্র আঁটুনি কিঞ্চিৎ শিথিল করার কতিপয় প্রস্তাব খসড়া আকারে শেখ হাসিনার বিবেচনার জন্য পেশ করার পর ওই প্রস্তাবগুলোর প্রায় সব কটিই তাঁর অনুমোদন পেতে ব্যর্থ হয়েছিল বলে পত্রপত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়েছে। আরও দুঃখজনক হলো, সংসদীয় কমিটি বেশ কয়েক মাস পরিশ্রম করে, নানা বিজ্ঞজনের ও নানা মহলের সঙ্গে মতবিনিময়ের মাধ্যমে সংবিধান সংশোধনের যে খসড়া প্রস্তাবমালা প্রস্তুত করেছিল, সেগুলোর বেশির ভাগ প্রস্তাবই শেখ হাসিনার একক পছন্দ-অপছন্দের কারণে কমিটির অধিকাংশ সদস্যের আপত্তি সত্ত্বেও পরিবর্তিত হয়ে গেছে। তার মানে দাঁড়িয়েছে, পঞ্চদশ সংশোধনীর যে ভাষ্যটা সংসদে পাস হয়েছে, তাতে অনেক বিষয়েই কমিটির বেশির ভাগ সদস্যেরই সায় নেই। অথচ, সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে প্রকাশ্যে এহেন অসম্মতি বা অসন্তোষ প্রকাশের কোনো সুযোগ ক্ষমতাসীন মহাজোটের কোনো সাংসদেরই নেই ।
একটি সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচিত সাংসদ থেকে শুরু করে মন্ত্রিসভার সদস্য, বিএনপি কিংবা আওয়ামী লীগের স্থায়ী কমিটি বা প্রেসিডিয়াম সদস্য—সবারই এই দুই দলের দুই নেত্রীর ইচ্ছা-অনিচ্ছা এবং পছন্দ-অপছন্দের কাছে অসহায় আত্মসমর্পণের যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি এ দেশে চালু হয়েছে, তার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হলো এই দুই নেত্রীর একাধিপত্যকে প্রশ্নাতীত স্বৈরতান্ত্রিক স্তরে উন্নীত করা। এই দুই দলে গণতন্ত্রের চর্চা নেই বলে আমরা যতই হা-হুতাশ করি না কেন, তাঁদের দুজনের সমালোচনা করে কিংবা ইচ্ছা-অনিচ্ছার বিরুদ্ধে অবস্থান নিলে পরিণতি কী হবে, এটা যেহেতু সবারই জানা হয়ে গেছে, তাই ওই ধরনের ভূমিকা কে পালন করবে? কেন পালন করবে?
গণতান্ত্রিক সংবিধানে রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গের মধ্যে সংসদীয় গণতন্ত্রে ক্ষমতার সুস্পষ্ট বিভাজন সুনির্দিষ্ট করার কথা। কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মূল কেন্দ্রে রেখে ১৯৭২ সালের সংবিধান রচনা করার কারণেই হয়তো বা আমাদের মূল সংবিধানের প্রণেতারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বিভাজনে প্রধানমন্ত্রীকে সাংবিধানিকভাবেই অনেক অতিরিক্ত নির্বাহী ক্ষমতা প্রদান করে ফেলেছিলেন। তারপর এই সংবিধানের ওপর সওয়ার হয়েছে চতুর্থ সংশোধনীর রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারব্যবস্থার বোঝা। তারপর তো শুরু হলো সামরিক প্রভুদের অসাংবিধানিক ক্ষমতা জবরদখলের রক্তাক্ত অধ্যায়। কিন্তু ১৯৯১ সালে যখন আবারও বাংলাদেশ সংসদীয় গণতন্ত্রে ফিরে এল, তখন সামরিক স্বৈরাচারী রাষ্ট্রপতির আদলেই খালেদা জিয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকাকে পুনর্বিন্যস্ত করে ফেলেছেন বিএনপির ধুরন্ধর ব্যারিস্টাররা। ১৯৭৫-৯১ পর্বের একচ্ছত্র ক্ষমতাধর রাষ্ট্রপতিরা তাঁদের সচিবালয়ের মাধ্যমে যেভাবে সব নির্বাহী ক্ষমতার প্রায় একচ্ছত্র প্রয়োগের ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন, ১৯৯১ সালে বেগম জিয়া তদানীন্তন অন্তর্বর্তী রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের কারণে অনিচ্ছা সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পদাবনতি মেনে নিলেও প্রধানমন্ত্রীর পদের ক্ষমতাকেই একনায়কত্বের পর্যায়ে রেখে দেওয়ার ব্যবস্থাটা সুপরিকল্পিতভাবে বহাল রাখলেন। এরপর তিন দফা নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনের সুযোগ পেয়েছেন বেগম খালেদা জিয়া (একবার অবশ্য মাস দেড়েকের জন্য), কিন্তু সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রতি তাঁর বিরাগ তিনি তাঁর আচরণে প্রমাণ করেছেন প্রতিবারই। সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার নির্বাহী শাখার প্রধান হয়েও কালেভদ্রে মাত্র কয়েকবার তিনি সংসদ অধিবেশনে যোগ দিয়েছেন, তা-ও বেশির ভাগ শেখানো-পড়ানো বক্তৃতা দেওয়ার প্রয়োজনে। এ ব্যাপারটাতে খালেদা জিয়া বিশ্বরেকর্ড সৃষ্টি করেছেন।
১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে শেখ হাসিনা সংসদের অধিবেশনে প্রায় নিয়মিত অংশগ্রহণ করেছেন। কিন্তু বিরোধী দলের বর্জনের কারণে একতরফা বাহাস যেহেতু ক্লান্তিকর হতে বাধ্য, তাই তাঁর উপস্থিতিতে বেশির ভাগ দলীয় সদস্য তাঁকে খুশি করার জন্য একদিকে তাঁকে এবং তাঁর সরকারকে প্রশংসার বন্যায় ভাসানো আর বিরোধীদলীয় নেতা ও বিরোধী দলকে উদ্দেশ করে অরুচিকর ও অশ্লীল গালাগাল দেওয়াটাকেই সংসদীয় সংস্কৃতি বানিয়ে ফেললেন। সংসদকে এভাবে খালি মাঠে একতরফা প্রশংসা ও খিস্তিখেউড়ের প্রদর্শনীস্থল বানিয়ে গত দুই দশকে আমরা এ দেশে সংসদীয় গণতন্ত্রকে শুধু পাঁচ বছর পরপর ভোটের মাধ্যমে বেগম জিয়া কিংবা শেখ হাসিনাকে পালাক্রমে এ দেশের ‘নির্বাচিত একনায়ক’ বানিয়েছি।
নির্বাচিত একনায়কতন্ত্রের ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করার জন্য দুই নেত্রীর প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য চাল ও পাল্টা চালের রাজনীতি ১৯৯৬-২০০৮ পর্যায়ের তিনটি নির্বাচনের মাঝামাঝি দুই মেয়াদে কতখানি প্রাতিষ্ঠানিকতা অর্জন করেছে, তা ওয়াকিবহাল মহলের মোটেও অজানা নয়। এই প্রক্রিয়ায় পুরো সিভিল প্রশাসন ও আমলাতন্ত্রকে দলীয়করণের পালাক্রমিক আয়োজন সুসম্পন্ন হয়েছে। রাষ্ট্রের সশস্ত্র বাহিনী এবং বিশেষত সেনাবাহিনীকে বারবার ছাঁটাই-পাল্টা ছাঁটাইয়ের মাধ্যমে তথাকথিত শুদ্ধিকরণের শিকার করা হয়েছে। রাষ্ট্রের পুলিশ বাহিনীকে পুরোপুরি দলীয় লাঠিয়াল বাহিনীতে রূপান্তরিত করে ফেলা হয়েছে। এমনকি, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডকে নবগঠিত এলিট ফোর্স র্যাবের প্রধান প্রাণঘাতী তৎপরতা হিসেবে নীরব অনুমোদন দিয়ে চলেছে এ দুটো ক্ষমতাসীন মহল। সর্বোপরি, দেশের বিচারব্যবস্থাকে সরকারি দলের স্বার্থের বিশ্বস্ত খাদেম বানানোর প্রয়াসকে খোলামেলা চাতুর্যের খেলায় পরিণত করে ফেলা হয়েছে। ২০০৬ সালের অক্টোবর থেকে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিনের মাধ্যমে বেগম জিয়া ও বিএনপি-জামায়াত জোটের রথী-মহারথীদের চালবাজির যে প্রদর্শনী দেখার দুর্ভাগ্য এ দেশের জনগণের হয়েছিল, তার পেছনে বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটের ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তনের ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং মরিয়া ভূমিকা পালন করেছিল—এটা এখন তো এ দেশের ইতিহাসের অন্যতম কালো অধ্যায় হিসেবে মানব জাতির ঐতিহ্যের অংশ হয়ে পড়েছে।
১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের সংসদীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল সামান্যই, কিন্তু ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটকে তিন-চতুর্থাংশেরও বেশি সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়ে জিতিয়ে দিয়েছে এ দেশের জনগণ। এই ভূমিধস বিজয় যতখানি না মহাজোটের প্রতি ইতিবাচক জনসমর্থনের স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ, তার চেয়েও বেশি ছিল বিএনপি-জামায়াত জোটকে জনগণের ঘৃণাভরা প্রত্যাখ্যানের প্রকাশ। ২০০১ সালের নির্বাচনের অব্যবহিত আগের ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগকে প্রায় একই ধরনের বিপর্যয়কর শিক্ষা দিয়েছিল জনগণ। কিন্তু ২০০১-২০০৬ মেয়াদের বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের দুর্নীতি, লুটপাট, দুঃশাসন, দলীয়করণ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী পাকিস্তানীকরণ ছিল একেবারেই বেলাগাম ও অসহনীয়। সঙ্গে যোগ হয়েছিল জামায়াত-শিবির ও তাদের বিভিন্ন নামধারী পকেট সংগঠনের ঘাতক ফ্যাসিবাদী ক্যাডারদের তালেবানি তাণ্ডব, বোমাবাজি ও মধ্যযুগীয় খুন-জখমের অপরাজনীতি। সর্বোপরি যোগ হয়েছিল তারেক রহমানকে খালেদা জিয়ার ‘রাজতান্ত্রিক উত্তরাধিকারী’ বানিয়ে দেশের ক্ষমতার মসনদে বসানোর অপতৎপরতা। খালেদা জিয়া এই সমস্যাসংকুল দেশের আয়েশি প্রধানমন্ত্রীর জীবনযাপন করতেই অভ্যস্ত, ক্যান্টনমেন্টের সুপরিসর বাসভবনে তাঁর বিলাসী জীবনযাত্রার কাহিনি বাংলাদেশের জন্য বড়ই বেমানান। কিন্তু তাঁর হাতেই বারবার নিরঙ্কুশ ক্ষমতা অর্পণ করছেন এ দেশের ভোটাররা। সে জন্যই প্রতিবার তাঁকে ঘিরে ক্ষমতার ঘেরাটোপ গড়ে তুলেছেন তাঁর কৃপাধন্য কিছু উপদেষ্টা, পরামর্শক, সহকারী কিংবা পারিবারিক সদস্য ও আত্মীয়স্বজন। অতএব, তারেক রহমান মায়ের উত্তরাধিকার হিসেবে পেয়ে যাবেন বিএনপির নেতৃত্ব এবং নির্বাচনী বিজয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রিত্ব—এটাই এখন বেগম জিয়ার রাজনৈতিক ধ্যানজ্ঞান।
কিন্তু পরিবারতন্ত্র এবার আরও বেশি সংক্রমিত হয়ে গেছে শেখ হাসিনার রাজনীতির সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডে—এটাই এক্ষণে এ দেশের প্রগতিশীল রাজনীতির জন্য ‘অশনিসংকেত’ বলে মনে করি আমি। ২০০৯-২০১১ পর্বের গত ৩৪ মাসের শেখ হাসিনার শাসনকালের ক্রমবিবর্তন বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, তাঁর সিদ্ধান্তগুলো প্রায়ই একক ও একতরফা হয়ে যাচ্ছে। আওয়ামী লীগের জনপ্রিয় অভিজ্ঞ নেতারা ক্রমেই হয়ে পড়েছেন কক্ষচ্যুত কিংবা অবহেলিত, দলের প্রেসিডিয়াম কিংবা মন্ত্রিসভা তাঁর একক ও খামখেয়ালি সিদ্ধান্তের শিকার হয়ে যাচ্ছে বারবার। এটাকে অনেকে ‘উপদেষ্টাশাসিত সরকার’ বলেই অভিহিত করছেন ইতিমধ্যেই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, এই সর্বনাশা পথ থেকে ফিরে আসুন।
মইনুল ইসলাম: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments