প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও শেয়ার কিনছে না ব্যাংকগুলো by আনোয়ার ইব্রাহীম
ফের বিনিয়োগে ফেরার আশ্বাস দেওয়া সত্ত্বেও বেশিরভাগ বেসরকারি ব্যাংক এখন পর্যন্ত শেয়ারবাজারে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ করেনি। ঘোষণার পর গত মঙ্গলবার পর্যন্ত ব্যাংকগুলো সাকল্যে ১১৫ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে, যা এ সময়ে শেয়ারবাজারের মোট লেনদেনের মাত্র ৬ দশমিক ৪০ শতাংশ। বাজার সংশ্লিষ্ট ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও ব্যাংকগুলো শেয়ার কিনছে না।
ব্যাংকগুলোর এ নগণ্য বিনিয়োগ বাজারের দরপতন রোধে কোনো ভূমিকাই রাখছে না। ঘটা করে ঘোষণা দিয়ে বিনিয়োগ না করাকে 'প্রতারণা' হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন তারা। বিপরীতে বিনিয়োগে না ফেরার অজুহাত হিসেবে নগদ অর্থ সংকটকে দায়ী করছে ব্যাংকগুলো। প্রশ্ন উঠেছে, অর্থের সংকট থাকলে ব্যাংকগুলো কেন নতুন করে বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছিল।
প্রাপ্ত হিসাব অনুযায়ী, গত মঙ্গলবার সম্মিলিতভাবে ব্যাংকগুলো মোট ১২ কোটি ৫৫ লাখ টাকার শেয়ার কিনেছে। এর মধ্যে সর্বাধিক ব্র্যাক ব্যাংক সোয়া ৩ কোটি, ব্যাংক এশিয়া আড়াই কোটি, সাউথইস্ট ব্যাংক সোয়া ২ কোটি, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক দেড় কোটি এবং শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংক ১ কোটি টাকার শেয়ার কিনেছে। অপর কয়েকটি ব্যাংকের বিনিয়োগ ছিল ৫০ লাখ টাকার নিচে। মঙ্গলবার ডিএসইতে মোট ২৫২ কোটি ৮৬ লাখ টাকার শেয়ার কেনাবেচা হয়। এর আগে গত রোববার ব্যাংকগুলো মোট
১১ কোটি ৪০ লাখ টাকার শেয়ার কিনে, যা মোট লেনদেনের মাত্র ৫ দশমিক ১৫ শতাংশ। এছাড়া এদিন ব্যাংকগুলো ২ কোটি টাকার শেয়ার বিক্রি করে। গত সোমবার সম্মিলিতভাবে ব্যাংকগুলো ১৩ কোটি ৩০ লাখ টাকার শেয়ার কেনে, যা মোট লেনদেনের মাত্র সাড়ে ৫ শতাংশ।
টানা এক বছর দরপতন অব্যাহত থাকার প্রেক্ষাপটে গত ২০ অক্টোবর বেসরকারি ব্যাংকগুলোর শীর্ষ নির্বাহীদের সংগঠন এবিবি থেকে বিনিয়োগে ফেরার ঘোষণা দেওয়া হয়। বেসরকারি ব্যাংক মালিকদের সংগঠন বিএবিও একই ধরনের আশ্বাস দেয়। গত ২৫ অক্টোবর বিএবির সভাপতি ও এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার নিয়ন্ত্রক সংস্থা এসইসির সঙ্গে বৈঠক শেষে জানিয়েছিলেন, বর্তমানে ব্যাংকগুলোর ৪০ থেকে ৫০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করার সক্ষমতা রয়েছে। ব্যাংকের বিনিয়োগ বাড়ানোর মাধ্যমে শেয়ারবাজারের স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনারও প্রতিশ্রুতি দিয়ে তিনি বলেছিলেন, 'ব্যাংকগুলো আবার বিনিয়োগে ফিরেছে। কোনো চিন্তা করবেন না। বাজার ঠিক হয়ে যাবে।'
এবিবি সভাপতির বক্তব্য : ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ অবস্থান সম্পর্কে জানতে চেয়ে যোগাযোগ করা হলেও অনেক ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তারা এ বিষয়ে কথা বলতে চাননি। এবিবির সভাপতি ও দি সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কে মাহমুদ সাত্তার জানান, ব্যাংকগুলো সামর্থ্যের মধ্যে বিনিয়োগ করছে। তিনি বলেন, 'কেউ যদি মনে করে ব্যাংকগুলো হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে, তা সম্ভব নয়।' বিনিয়োগে ফেরার ঘোষণার পর মাত্র ৬ শতাংশ বিনিয়োগ বাজারে কোনো প্রভাব ফেলছে কি-না_ এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, ব্যাংকগুলোতে প্রচুর অর্থের সংকট রয়েছে। নিজেরাই যখন অর্থের সংকটে, তখন কীভাবে বিনিয়োগ করবে? তিনি আরও বলেন, 'দীর্ঘদিন ধরে ব্যাংকগুলো বিনিয়োগে ছিল না। এখন অল্প হলেও তো আসছে।' গতকাল বুধবার নিয়ন্ত্রক সংস্থা এসইসির সঙ্গে বৈঠকে এবিবি নেতৃবৃন্দ দাবি করেছেন, সরকার ব্যাংকিং খাত থেকে বিপুল পরিমাণ ঋণ নেওয়ায় ব্যাংকগুলো অর্থ সংকটে পড়েছে। এতে কাঙ্ক্ষিত বিনিয়োগ করতে পারছে না।
বেসরকারি ব্যাংকের বিনিয়োগ অবস্থান : নিজস্ব পোর্টফোলিও বা শেয়ারবাজারে অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানে ঋণ বিবেচনা করার পরও বেসরকারি ৩০টি ব্যাংকের মধ্যে ২৪টিরই যথেষ্ট পরিমাণ বিনিয়োগের সুযোগ রয়েছে। ব্যাংকগুলো আমানতের বিপরীতে ১০ শতাংশ পর্যন্ত শেয়ার ধারণ করতে পারে। গতকাল পর্যন্ত বাজারদর অনুযায়ী, আমানতের বিপরীতে শেয়ারবাজারে ১ শতাংশের নিচে বিনিয়োগ ছিল ইসলামী ব্যাংক ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংকের। ১ থেকে ২ শতাংশের মধ্যে ছিল_ উত্তরা (১.৫৮), এসআইবিএল (১.৭৭), আল-আরাফাহ (১.৯৭) ব্যাংকের। ২ থেকে ৫ শতাংশের মধ্যে ১২টি ব্যাংকের। এগুলো হলো_ স্ট্যান্ডার্ড (২.২৪), প্রাইম (২.৬৬), ইউসিবিএল (২.৬৮), ট্রাস্ট (২.৯৩), ঢাকা (৩), যমুনা (৩.১১), সাউথইস্ট (৩.১৪), এক্সিম (৩.২৯), ব্র্যাক (৩.৭৯), এবি (৪.৫১), শাহজালাল ইসলামী (৪.৯৩) এবং ব্যাংক এশিয়া (৪.৯৮)। এছাড়া ইস্টার্ন, প্রিমিয়ার, এনসিসি, মিউচুয়াল ট্রাস্ট, পূবালী, ওয়ান ও মার্কেন্টাইল ব্যাংকের এক্সপোজার রয়েছে ৫ থেকে ৬ শতাংশের মধ্যে। ৮ দশমিক ৩৪ থেকে ১০ দশমিক ৭১ শতাংশের মধ্যে রয়েছে ন্যাশনাল, আইএফআইসি ও দি সিটি ব্যাংকের।
সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, বেসরকারি ২৭ ব্যাংকের নিজস্ব পোর্টফোলিও বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ৭ হাজার ৫১ কোটি টাকা। এছাড়া সহযোগী মার্চেন্ট ব্যাংক বা ব্রোকারেজ হাউজসসহ অন্য কোনো মার্চেন্ট ব্যাংক বা ব্রোকারেজ হাউসে প্রদানকৃত ঋণের পরিমাণ ৬ হাজার ৯৯ কোটি টাকা। এ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, শেয়ারবাজারে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর বর্তমান সম্পৃক্ততা ১৩ হাজার ১৫০ কোটি টাকা প্রায়। বেসরকারি ব্যাংকগুলো মোট আমানতের পরিমাণ প্রায় ৩ লাখ ৯১ হাজার কোটি টাকা। এ হিসাবে ব্যাংকগুলো সর্বোচ্চ ৩৯ হাজার কোটি টাকার শেয়ার ধারণ করতে পারে।
শেয়ারবাজার সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ন্যাশনাল ব্যাংকের নিজস্ব পোর্টফোলিও বিনিয়োগের পরিমাণ সর্বাধিক ৬০৮ কোটি টাকা। টাকার অঙ্কে এরপরের অবস্থানে ছিল দি সিটি ৫৮৭ কোটি, পূবালী ৪৯০ কোটি, এক্সিম ২৯২ কোটি, ইউসিবিএল ২৭৪ কোটি, আইএফআইসি ২৬৮ কোটি, এবি ২২৭ কোটি, ইস্টার্ন ২২২ কোটি, ওয়ান ২০১ কোটি, ব্র্যাক ১৯০ কোটি, সাউথইস্ট ১৭৯ কোটি, মার্কেন্টাইল ১৫২ কোটি, প্রিমিয়ার ১১৬ কোটি টাকা।
পোর্টফোলিও বিনিয়োগের বাইরে ব্যাংকগুলোর সহযোগী মার্চেন্ট ব্যাংক, ব্রোকারেজ হাউস ও শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্ট অন্য প্রতিষ্ঠানেও ঋণ ছিল উল্লেখযোগ্য পরিমাণ। এর মধ্যে ন্যাশনাল ব্যাংকের সর্বাধিক ৪৯৬ কোটি, মার্কেন্টাইল ৪৮৩ কোটি, ব্যাংক এশিয়ার ৪১১ কোটি, আইএফআইসি ৩৯৫ কোটি, এবি ব্যাংকের ৩৮৬ কোটি, শাহজালাল ৩৭৮ কোটি, এনসিসি ব্যাংকের ৩৬৭ কোটি, প্রাইম ৩২৫ কোটি, দি সিটি ২৭৭ কোটি, মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ২৬১ কোটি, যমুনা ২৪০ কোটি, সাউথইস্ট ২৩৩ কোটি, ব্র্যাক ২৩০ কোটি, প্রিমিয়ার ২১৪ কোটি, ঢাকা ১৮২ কোটি, পূবালী ১৭০ কোটি, আল-আরাফাহ্ ১৭০ কোটি, ওয়ান ১৫৩ কোটি, স্ট্যান্ডার্ড ১৬৬ কোটি, ইউসিবিএল ১৪৫ কোটি, ট্রাস্ট ১১২ কোটি, ইস্টার্ন ব্যাংকের ৮৫ কোটি টাকা।
বিশেষজ্ঞদের অভিমত : ব্যাংকগুলো যৎসামান্য বিনিয়োগ দরপতন ঠেকাতে পারবে না বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। এছাড়া পরিস্থিতি উন্নয়নে ব্যাংকের বিনিয়োগ ছাড়া বিকল্প নেই বলে মনে করেন তারা। গত এক বছরে ব্যাংকগুলো প্রায় ২৬ হাজার কোটি টাকার শেয়ার বিক্রি করেছে_ এমন তথ্য দিয়ে তারা বলেন, ব্যাংকের বিনিয়োগ প্রত্যাহারের কারণে প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ের বিনিয়োগ শূন্যতায় আস্থার সংকট থেকে দরপতন আরও ত্বরান্বিত হয়েছে।
গত কয়েকদিনে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ তথ্য জেনে একে 'তামাশা' হিসেবে আখ্যায়িত করেন আবু আহমেদ। তিনি বলেন, আড়াইশ' কোটি টাকার লেনদেনে ১৩ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে কোনো ফল পাওয়া যাবে না। অর্থনৈতিক বেহাল অবস্থায় ব্যাংকগুলো যথেষ্ট বিনিয়োগ করতে পারবে কি-না_ সে বিষয়ে সন্দেহ পোষণ করেন তিনি। এসইসির সাবেক চেয়ারম্যান মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, গত বছর বাজার উত্থানের সময়ে দৈনিক লেনদেনে ব্যাংকগুলো প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ ছিল প্রায় ২০ শতাংশ আর পরোক্ষে আরও ৩৫ শতাংশ। ব্যাংকগুলো সরে দাঁড়ানোয় বিপুল পরিমাণ তারল্য সংকট সৃষ্টি হয়েছে। এ সংকট গত এক বছরেও দূর করা যায়নি। ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ প্রত্যাহারে সৃষ্ট তারল্য শূন্যতা অন্য কোনো প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ের বিনিয়োগকারীদের দ্বারা পূরণ সম্ভব নয় জানিয়ে তিনি আরও বলেন, 'লিজিং বা বীমা খাত ব্যাংকিং খাতের তুলনায় এখনও অনেক ছোট। মিউচুয়াল ফান্ডগুলোর কাছেও এ সংকট দূর করার মতো পর্যাপ্ত অর্থ নেই। বাজারের বৃহৎ বিনিয়োগ গোষ্ঠী নিষ্ক্রিয় হলে ছোট দলগুলো কৌশলগত কারণে নতুন বিনিয়োগ থেকে সরে দাঁড়িয়েছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে ব্যাংকগুলো ছাড়া হয়তো অন্য কারও এ সংকট উত্তরণে করণীয় কিছু নেই।'
প্রাপ্ত হিসাব অনুযায়ী, গত মঙ্গলবার সম্মিলিতভাবে ব্যাংকগুলো মোট ১২ কোটি ৫৫ লাখ টাকার শেয়ার কিনেছে। এর মধ্যে সর্বাধিক ব্র্যাক ব্যাংক সোয়া ৩ কোটি, ব্যাংক এশিয়া আড়াই কোটি, সাউথইস্ট ব্যাংক সোয়া ২ কোটি, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক দেড় কোটি এবং শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংক ১ কোটি টাকার শেয়ার কিনেছে। অপর কয়েকটি ব্যাংকের বিনিয়োগ ছিল ৫০ লাখ টাকার নিচে। মঙ্গলবার ডিএসইতে মোট ২৫২ কোটি ৮৬ লাখ টাকার শেয়ার কেনাবেচা হয়। এর আগে গত রোববার ব্যাংকগুলো মোট
১১ কোটি ৪০ লাখ টাকার শেয়ার কিনে, যা মোট লেনদেনের মাত্র ৫ দশমিক ১৫ শতাংশ। এছাড়া এদিন ব্যাংকগুলো ২ কোটি টাকার শেয়ার বিক্রি করে। গত সোমবার সম্মিলিতভাবে ব্যাংকগুলো ১৩ কোটি ৩০ লাখ টাকার শেয়ার কেনে, যা মোট লেনদেনের মাত্র সাড়ে ৫ শতাংশ।
টানা এক বছর দরপতন অব্যাহত থাকার প্রেক্ষাপটে গত ২০ অক্টোবর বেসরকারি ব্যাংকগুলোর শীর্ষ নির্বাহীদের সংগঠন এবিবি থেকে বিনিয়োগে ফেরার ঘোষণা দেওয়া হয়। বেসরকারি ব্যাংক মালিকদের সংগঠন বিএবিও একই ধরনের আশ্বাস দেয়। গত ২৫ অক্টোবর বিএবির সভাপতি ও এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার নিয়ন্ত্রক সংস্থা এসইসির সঙ্গে বৈঠক শেষে জানিয়েছিলেন, বর্তমানে ব্যাংকগুলোর ৪০ থেকে ৫০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করার সক্ষমতা রয়েছে। ব্যাংকের বিনিয়োগ বাড়ানোর মাধ্যমে শেয়ারবাজারের স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনারও প্রতিশ্রুতি দিয়ে তিনি বলেছিলেন, 'ব্যাংকগুলো আবার বিনিয়োগে ফিরেছে। কোনো চিন্তা করবেন না। বাজার ঠিক হয়ে যাবে।'
এবিবি সভাপতির বক্তব্য : ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ অবস্থান সম্পর্কে জানতে চেয়ে যোগাযোগ করা হলেও অনেক ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তারা এ বিষয়ে কথা বলতে চাননি। এবিবির সভাপতি ও দি সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কে মাহমুদ সাত্তার জানান, ব্যাংকগুলো সামর্থ্যের মধ্যে বিনিয়োগ করছে। তিনি বলেন, 'কেউ যদি মনে করে ব্যাংকগুলো হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে, তা সম্ভব নয়।' বিনিয়োগে ফেরার ঘোষণার পর মাত্র ৬ শতাংশ বিনিয়োগ বাজারে কোনো প্রভাব ফেলছে কি-না_ এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, ব্যাংকগুলোতে প্রচুর অর্থের সংকট রয়েছে। নিজেরাই যখন অর্থের সংকটে, তখন কীভাবে বিনিয়োগ করবে? তিনি আরও বলেন, 'দীর্ঘদিন ধরে ব্যাংকগুলো বিনিয়োগে ছিল না। এখন অল্প হলেও তো আসছে।' গতকাল বুধবার নিয়ন্ত্রক সংস্থা এসইসির সঙ্গে বৈঠকে এবিবি নেতৃবৃন্দ দাবি করেছেন, সরকার ব্যাংকিং খাত থেকে বিপুল পরিমাণ ঋণ নেওয়ায় ব্যাংকগুলো অর্থ সংকটে পড়েছে। এতে কাঙ্ক্ষিত বিনিয়োগ করতে পারছে না।
বেসরকারি ব্যাংকের বিনিয়োগ অবস্থান : নিজস্ব পোর্টফোলিও বা শেয়ারবাজারে অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানে ঋণ বিবেচনা করার পরও বেসরকারি ৩০টি ব্যাংকের মধ্যে ২৪টিরই যথেষ্ট পরিমাণ বিনিয়োগের সুযোগ রয়েছে। ব্যাংকগুলো আমানতের বিপরীতে ১০ শতাংশ পর্যন্ত শেয়ার ধারণ করতে পারে। গতকাল পর্যন্ত বাজারদর অনুযায়ী, আমানতের বিপরীতে শেয়ারবাজারে ১ শতাংশের নিচে বিনিয়োগ ছিল ইসলামী ব্যাংক ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংকের। ১ থেকে ২ শতাংশের মধ্যে ছিল_ উত্তরা (১.৫৮), এসআইবিএল (১.৭৭), আল-আরাফাহ (১.৯৭) ব্যাংকের। ২ থেকে ৫ শতাংশের মধ্যে ১২টি ব্যাংকের। এগুলো হলো_ স্ট্যান্ডার্ড (২.২৪), প্রাইম (২.৬৬), ইউসিবিএল (২.৬৮), ট্রাস্ট (২.৯৩), ঢাকা (৩), যমুনা (৩.১১), সাউথইস্ট (৩.১৪), এক্সিম (৩.২৯), ব্র্যাক (৩.৭৯), এবি (৪.৫১), শাহজালাল ইসলামী (৪.৯৩) এবং ব্যাংক এশিয়া (৪.৯৮)। এছাড়া ইস্টার্ন, প্রিমিয়ার, এনসিসি, মিউচুয়াল ট্রাস্ট, পূবালী, ওয়ান ও মার্কেন্টাইল ব্যাংকের এক্সপোজার রয়েছে ৫ থেকে ৬ শতাংশের মধ্যে। ৮ দশমিক ৩৪ থেকে ১০ দশমিক ৭১ শতাংশের মধ্যে রয়েছে ন্যাশনাল, আইএফআইসি ও দি সিটি ব্যাংকের।
সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, বেসরকারি ২৭ ব্যাংকের নিজস্ব পোর্টফোলিও বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ৭ হাজার ৫১ কোটি টাকা। এছাড়া সহযোগী মার্চেন্ট ব্যাংক বা ব্রোকারেজ হাউজসসহ অন্য কোনো মার্চেন্ট ব্যাংক বা ব্রোকারেজ হাউসে প্রদানকৃত ঋণের পরিমাণ ৬ হাজার ৯৯ কোটি টাকা। এ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, শেয়ারবাজারে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর বর্তমান সম্পৃক্ততা ১৩ হাজার ১৫০ কোটি টাকা প্রায়। বেসরকারি ব্যাংকগুলো মোট আমানতের পরিমাণ প্রায় ৩ লাখ ৯১ হাজার কোটি টাকা। এ হিসাবে ব্যাংকগুলো সর্বোচ্চ ৩৯ হাজার কোটি টাকার শেয়ার ধারণ করতে পারে।
শেয়ারবাজার সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ন্যাশনাল ব্যাংকের নিজস্ব পোর্টফোলিও বিনিয়োগের পরিমাণ সর্বাধিক ৬০৮ কোটি টাকা। টাকার অঙ্কে এরপরের অবস্থানে ছিল দি সিটি ৫৮৭ কোটি, পূবালী ৪৯০ কোটি, এক্সিম ২৯২ কোটি, ইউসিবিএল ২৭৪ কোটি, আইএফআইসি ২৬৮ কোটি, এবি ২২৭ কোটি, ইস্টার্ন ২২২ কোটি, ওয়ান ২০১ কোটি, ব্র্যাক ১৯০ কোটি, সাউথইস্ট ১৭৯ কোটি, মার্কেন্টাইল ১৫২ কোটি, প্রিমিয়ার ১১৬ কোটি টাকা।
পোর্টফোলিও বিনিয়োগের বাইরে ব্যাংকগুলোর সহযোগী মার্চেন্ট ব্যাংক, ব্রোকারেজ হাউস ও শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্ট অন্য প্রতিষ্ঠানেও ঋণ ছিল উল্লেখযোগ্য পরিমাণ। এর মধ্যে ন্যাশনাল ব্যাংকের সর্বাধিক ৪৯৬ কোটি, মার্কেন্টাইল ৪৮৩ কোটি, ব্যাংক এশিয়ার ৪১১ কোটি, আইএফআইসি ৩৯৫ কোটি, এবি ব্যাংকের ৩৮৬ কোটি, শাহজালাল ৩৭৮ কোটি, এনসিসি ব্যাংকের ৩৬৭ কোটি, প্রাইম ৩২৫ কোটি, দি সিটি ২৭৭ কোটি, মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ২৬১ কোটি, যমুনা ২৪০ কোটি, সাউথইস্ট ২৩৩ কোটি, ব্র্যাক ২৩০ কোটি, প্রিমিয়ার ২১৪ কোটি, ঢাকা ১৮২ কোটি, পূবালী ১৭০ কোটি, আল-আরাফাহ্ ১৭০ কোটি, ওয়ান ১৫৩ কোটি, স্ট্যান্ডার্ড ১৬৬ কোটি, ইউসিবিএল ১৪৫ কোটি, ট্রাস্ট ১১২ কোটি, ইস্টার্ন ব্যাংকের ৮৫ কোটি টাকা।
বিশেষজ্ঞদের অভিমত : ব্যাংকগুলো যৎসামান্য বিনিয়োগ দরপতন ঠেকাতে পারবে না বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। এছাড়া পরিস্থিতি উন্নয়নে ব্যাংকের বিনিয়োগ ছাড়া বিকল্প নেই বলে মনে করেন তারা। গত এক বছরে ব্যাংকগুলো প্রায় ২৬ হাজার কোটি টাকার শেয়ার বিক্রি করেছে_ এমন তথ্য দিয়ে তারা বলেন, ব্যাংকের বিনিয়োগ প্রত্যাহারের কারণে প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ের বিনিয়োগ শূন্যতায় আস্থার সংকট থেকে দরপতন আরও ত্বরান্বিত হয়েছে।
গত কয়েকদিনে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ তথ্য জেনে একে 'তামাশা' হিসেবে আখ্যায়িত করেন আবু আহমেদ। তিনি বলেন, আড়াইশ' কোটি টাকার লেনদেনে ১৩ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে কোনো ফল পাওয়া যাবে না। অর্থনৈতিক বেহাল অবস্থায় ব্যাংকগুলো যথেষ্ট বিনিয়োগ করতে পারবে কি-না_ সে বিষয়ে সন্দেহ পোষণ করেন তিনি। এসইসির সাবেক চেয়ারম্যান মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, গত বছর বাজার উত্থানের সময়ে দৈনিক লেনদেনে ব্যাংকগুলো প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ ছিল প্রায় ২০ শতাংশ আর পরোক্ষে আরও ৩৫ শতাংশ। ব্যাংকগুলো সরে দাঁড়ানোয় বিপুল পরিমাণ তারল্য সংকট সৃষ্টি হয়েছে। এ সংকট গত এক বছরেও দূর করা যায়নি। ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ প্রত্যাহারে সৃষ্ট তারল্য শূন্যতা অন্য কোনো প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ের বিনিয়োগকারীদের দ্বারা পূরণ সম্ভব নয় জানিয়ে তিনি আরও বলেন, 'লিজিং বা বীমা খাত ব্যাংকিং খাতের তুলনায় এখনও অনেক ছোট। মিউচুয়াল ফান্ডগুলোর কাছেও এ সংকট দূর করার মতো পর্যাপ্ত অর্থ নেই। বাজারের বৃহৎ বিনিয়োগ গোষ্ঠী নিষ্ক্রিয় হলে ছোট দলগুলো কৌশলগত কারণে নতুন বিনিয়োগ থেকে সরে দাঁড়িয়েছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে ব্যাংকগুলো ছাড়া হয়তো অন্য কারও এ সংকট উত্তরণে করণীয় কিছু নেই।'
No comments