ওরা ইতালিতে ভালো নেই by কাজী জহিরুল ইসলাম
ভূ-মধ্যসাগর যখন পূর্বে ক্রোয়েশিয়া আর পশ্চিমে ইতালিকে ঠেলে দিয়ে ঢুকে পড়ে স্লোভেনিয়া-ভেনিসের দিকে তখন এর নাম হয় অড্রিয়াটিক। অড্রিয়াটিকের বৈশিষ্ট্য হলো এর জল গ্রিক দেবীদের চোখের মতো নীল। আমরা এখন সেই নীলচোখজল অড্রিয়াটিকের পাড়ে, ইতালির এক ছোট্ট শহর ব্রিন্ডিসিতে। বন্দর শহর হিসেবে ব্রিন্ডিসির সুখ্যাতি সেই সুপ্রাচীনকাল থেকেই। সুখ্যাতির খেসারতও এ শহরকে কম দিতে হয়নি।
কখনও গ্রিক, কখনও অসিল্ট্রয়ান, কখনও রোমান আবার কখনও ফরাসিরা দখল করে নিয়েছে ব্রিন্ডিসি। এই দখল এবং পাল্টা দখলের ধারাবাহিকতায় ব্রিন্ডিসি হারিয়েছে তার চরিত্র, আজ তাই এখানে বারোয়ারী ইউরোপীয় সভ্যতার নিদর্শন চোখে পড়ে। দখলের ধারাবাহিকতায় ৬২৪ সালে লম্বার্ডরা ব্রিন্ডিসিকে পুরোপুরি ধ্বংস করে দেয়। ৮৩৬ সালে একদল জলদস্যুর আক্রমণে ব্রিন্ডিসির ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়। ১৩৪৮ সালে এক ভয়াবহ প্লেগ রোগ এসে কেড়ে নেয় ব্রিন্ডিসিবাসীর প্রাণ, ১৪৫৬ সালে ঘটে এক ভয়াবহ ভূমিকম্প। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে সেপ্টেম্বর ১৯৪৩ থেকে ফেব্রুয়ারি ১৯৪৪ পর্যন্ত ব্রিন্ডিসি ইতালির অস্থায়ী রাজধানী হিসেবেও কাজ করে। গ্রিক এপিক সাহিত্য থেকে জানা যায়, টাইডিয়াসের ছেলে ডিওমেডিস ব্রিন্ডিসি শহরের গোড়াপত্তন করেন। ডিওমেডিস গ্রিক দেবতা হিসেবে সুপরিচিত। এর কোনো সঠিক সন-তারিখ জানা না গেলেও অনুমান করা হয় যিশুখ্রিসেল্টর জন্মের তিন থেকে পাঁচ হাজার বছর আগের ঘটনা এটি। মিনোয়ান সভ্যতার সমসাময়িককালেই এই শহরের গোড়াপত্তন হয়। প্রাচীন রোমান সাহিত্যের বিখ্যাত ট্র্যাজেডি কবি মার্কুস পেকুভিউস এই শহরে জন্মগ্রহণ করেন ২২০ বিসিতে। এছাড়া রোমান ক্ল্যাসিক্যাল কবি পাবলিউস ভার্গিলিউস মার্কো ৭০ বিসিতে এই শহরেই মৃত্যুবরণ করেন। প্রাচীন ব্রিন্ডিসি কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীদের স্মৃতির মহিমায় প্রোজ্জ্বল হলেও বর্তমান ব্রিন্ডিসি মাফিয়াদের রাজত্ব হিসেবেই বেশি পরিচিত। কিন্তু ব্রিন্ডিসির অধিবাসীরা এই মাফিয়াদের খুব ভালোবাসেন। ভালোবাসেন এজন্য যে, মাফিয়ারাই এই শহরকে নানা অশুভ কর্মকাণ্ড থেকে রক্ষা করে আসছেন। ব্রিন্ডিসির অধিবাসীরা খুব আত্মবিশ্বাসের সঙ্গেই বলেন, এই শহর সামাজিক ও প্রাকৃতিক দূষণমুক্ত। বন্দর শহর হওয়া সত্ত্বেও ইতালির অন্যান্য শহরের মতো এখানে পতিতাবৃত্তি নেই, নাইট ক্লাব-বারগুলোতে কোনো হাঙ্গামা নেই, এমন কী বিবাহ বিচ্ছেদ বা দাম্পত্য কলহের হারও এই শহরে খুবই কম। এর কারণ কি? পাওলা জানাল, মাফিয়াদের ভয়ে কেউ কোনো অপরাধ করে না এই শহরে। সত্তরের দশকে আমরা ঢাকার বাড্ডায় জমি কিনে একটি ঘর তুলে বসবাস শুরু করি। এই নির্জন বিলের মধ্যে চারটি ছেলে-পুলে নিয়ে বসবাস করতে আমার আম্মা শঙ্কিত ছিলেন, সব সময় ভয়ে ভয়ে থাকতেন। আম্মার ভাষায়, কলিজা হাতে নিয়ে বসে থাকতাম। একদিন এক বৃদ্ধ মহিলা এসে আম্মাকে অভয় দিয়ে বলে গেলেন, ‘এইডা ঐলো করিম ডাহাইতের এলাকাগো সোনা, এইহানে চোর-ডাহাইতের ডর নাই।’ যতদিন আমরা ওই এলাকায় ছিলাম সেই বৃদ্ধার কথা যে সত্যি ছিল তারই প্রমাণ পেয়েছি। আজ ব্রিন্ডিসির মাফিয়াদের কথা শুনে সেই কথাই মনে পড়ছে। এখনও পুরোপুরি সন্ব্দ্যা হয়নি। পশ্চিমে, প্রাচীন দালান-কোঠার আড়ালে নেমে গেছে সূর্য। বেটি’স পিজারিয়া জমে উঠতে শুরু করেছে। অড্রিয়াটিকের দিকে মুখ ফেরানো, খোলা আকাশের নিচে চেয়ার-টেবিল পেতে খাবারের পসরা সাজিয়ে বসেছে বেটিস’র পিজারিয়া। পিজারিয়াতে শুধু পিজা পাওয়া যায় এ ধারণা করে থাকলে কিন্তু মারাত্মক ভুল করবেন। এখানে সব ধরনের খাবারই পাওয়া যায়। ইতালির অধিকাংশ খাবারের দোকানের নামই পিজারিয়া। মরক্কোতে যেমন দেখেছি সবই বুটিক। খাবারের দোকানও বুটিক, কাপড়ের দোকানও বুটিক, এমনকি ফোন-ফ্যাক্সের দোকানগুলোর নামও টেলিবুটিক। ত্রিশ বছরের এক যুবক অড্রিয়াটিকের নীলজল ছলকে ওঠা শুভ্র ঢেউয়ের ছোবলকে পেছনে ফেলে একগুচ্ছ তাজা গোলাপ নিয়ে আমাদের সামনে এসে দাঁড়াল। কোনো রকম সঙ্কোচ-সন্দেহ ছাড়াই সরাসরি বাংলায় কথা বলা শুরু করল যুবক—স্যার, আমার বাড়ি নোয়াখালী, গত দেড় বছর ধরে এই দেশে আছি এখনও কোনো কাজ পাইনি। ১৫ লাখ টাকা খরচ করে এসেছি, এখন পথে পথে থাকি, ফুল বেঁচি। আমাকে একটা কাজ জোগাড় করে দিতে পারবেন? তাহলে জানে বেঁচে যাই। খোঁজ নিয়ে জানতে পারি ছেলেটি শিক্ষিত, বাবা-মাকে সর্বস্বান্ত করে জমি-জমা বেঁচে পাড়ি জমিয়েছে স্বপেম্নর দেশ ইতালিতে। ব্রিন্ডিসিতে জাতিসংঘের লজিসিল্টক বেইজ, এখানে কাজ করেন একমাত্র বাংলাদেশী, আমার কসোভোর বন্ব্দু মোহাম্মদ আতিকুজ্জামান। জামান ভাইকে পেয়ে আমার সময়টা ভালোই কাটছে। রোজ কর্মশালা শেষে দু’জন বেরিয়ে পড়ি। কখনও পাহাড়ের চূড়োয় হীরের মতো অত্যুজ্জ্বল এক শহর, হোয়াইট সিটিখ্যাত অস্তুনিতে, কখনও আরেক বন্দর শহর বারির পথে, আবার কখনও ব্রিন্ডিসির হাজার বছরের পুরনো পেইভমেন্ট রাস্তাগুলোতে আমরা হাত-পা ছেড়ে হাঁটি, খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে দেখি রোমান সভ্যতার স্মৃতিচিহ্ন, হাজার বছরের পুরনো কোনো পায়ের ছাপ। রোমান সভ্যতা আর নীল অড্রিয়াটিকের কোলে বসে আমরা দু’জন যখন প্রাণের ভাষা বাংলায় মুখর, তখনই প্রকৃত বাংলা মায়ের মুখচ্ছবি সামনে এসে দাঁড়াল। আমি জামান ভাইকে অনুরোধ করলাম, যদি সম্ভব হয় তিনি যেন এই যুবকের জন্য কিছু করেন। পরদিন বেড়াতে যাই বারিতে। ওখানে গিয়ে দেখা আরও একদল বাঙালি যুবকের সঙ্গে, সবার একই দশা। চোখে-মুখে হতাশা, স্বপম্নভঙ্গের শঙ্কা। গত বছরও আমি এই শহরে এসেছি, তখন এত বাঙালি ছিল না। এসেছি আরও ৮ বছর আগেও। তখন খুঁজেও একজন বাঙালি পাইনি। প্রতিদিনই ইতালিতে বাঙালির সংখ্যা বাড়ছে। কিন্তু দুঃখের কথা হলো, এরা কেউই ভালো নেই। জামান ভাইয়ের সঙ্গে যখন এদের বিষয়ে কথা বলি, তিনি বলেন, জলপাই বাগানে কাজ পাওয়া যায়, কিন্তু ওরা করতে চায় না। কেন যে এত টাকা খরচ করে এখানে আসে? এই প্রশ্ন তো আমাদের সবারই, তারপর ভেতর থেকে স্বগতোক্তির মতো বেরিয়ে আসে, দেশে থেকেই বা কী করবে? এত মানুষ!
লেখক : কবি জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক কর্মকর্তা
লেখক : কবি জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক কর্মকর্তা
No comments