বাজারের ব্যাগ হাতে বিপন্ন নাগরিক by রেজোয়ান সিদ্দিকী
কাঁচাবাজারে এক গলির দু’পাশে তরকারির দোকানের সারি। শীতের সবজি উঠতে শুরু করেছে। শিম, ফুলকপি, পাতাকপি, বেগুন, চিচিঙ্গা, সবুজ কচি ঢেঁড়স, লাউশাক, লালশাক, মুলাশাক, পালংশাক, ডাঁটাশাক, লাউ, মিষ্টি কুমড়া, ধুন্দুল, কচুর লতি, কচুরমুখী, পটল-আলু, ওল, সাহেব আলু, গাইছা আলু—সবকিছুই সাজানো দোকানগুলোতে। একজন মাঝবয়সী মানুষ দাঁড়িয়ে আছেন সবজি বাজারের মুখে। স্থির।
পরিচ্ছন্ন জামা-কাপড়। হাতে ভাঁজ করা বাজারের ব্যাগ। ক্লিন শেভ। চিন্তাক্লিষ্ট চেহারা। দাঁড়িয়েই আছেন। কেন, জানি না, কৌতূহল হলো। তিনি কি কাঁচাবাজারে এসে আমারই মতো অসহায় ও বিপন্ন? ট্যাঁকের টাকার সঙ্গে তারও কি হিসাব মিলছে না? ভদ্রলোক প্রথম দোকানেই দাঁড়ালেন। ঢেঁড়স কত? চল্লিশ টাকা। চিচিঙ্গা? চল্লিশ টাকা। ধুন্দুল? ছত্রিশ টাকা। মিষ্টি কুমড়ার ফালি? লাউ? চল্লিশ টাকা পিচ। ফুলকপি? পঁচিশ টাকা। জালি? পঁয়ত্রিশ টাকা। বাঁধাকপি? পঁচিশ টাকা। বরবটি? চল্লিশ টাকা। কচুরমুখী? পঁয়ত্রিশ টাকা। আলু? বত্রিশ টাকা। শীম? ষাট টাকা। বেগুন এক কেজি নেবেন স্যার? দুই টাকা কমাইয়া রাখুম। ভদ্রলোক কোনো কথা বললেন না?। সামনে এগিয়ে গেলেন। পরের দোকানটির সামনে দাঁড়াতে গিয়েও দাঁড়ালেন না। তারপর দাঁড়ালেন শাকের দোকানের সামনে। তার দোকানে শুধু শাক। লালশাকের আঁটি কত? দশ টাকা। ডাঁটাশাক? দশ টাকা। মুলাশাক? আট টাকা। পালং? পনের টাকা। লাউ শাকের আঁটি? বিশ টাকা। ভদ্রলোক আরও সামনে এগিয়ে গেলেন। বিভ্রান্ত। কোন দোকানে দাঁড়াবেন, কী করবেন—ঠিক করতে পারছেন না। জলপাই? চল্লিশ টাকা। কাঁচা মরিচ? আড়াইশ’ গ্রাম বারো টাকা। ধনেপাতা? পঞ্চাশ গ্রাম দশ টাকা। ভদ্রলোক আবারও বাজারের মাথায় ফিরে এসে দাঁড়ালেন। দিশেহারা। কী করবেন কিছুই ঠিক করতে পারছেন না। হয়তো ঘরে ছোট সন্তান আছে। যে শীম-ফুলকপির ভাজি-তরকারি খেতে চেয়েছিল? স্ত্রী হয়তো দিয়েছেন মিষ্টি কুমড়া বা লাউয়ের অর্ডার। কন্যা হয়তো বলেছে, নুডুলস রাঁধতে তার দরকার বরবটি ও ক্যাপসিক্যাম। কাজের বুয়ার ফরমায়েশের তালিকা আরও দীর্ঘ। ছেলেটি হয়তো লাউশাক খুব পছন্দ করে। কী করবেন তিনি? পণ্যমূল্য যখন নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ে, তখন এভাবেই ধুঁকে মরে নগরীর মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষ। খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি উচ্চবিত্তকে কখনও স্পর্শ করে না। দেশের বিত্তবানদের প্রতিষ্ঠান এফবিসিসিআইয়ের এক নেতা কারওয়ানবাজার পরিদর্শনে গিয়ে বলেছিলেন, জিনিসপত্রের দাম তো এমন কিছু বাড়েনি। কেজিতে তিন-চার টাকা মাত্র বেড়েছে। এতে ওই মধ্যবিত্তরা তাকে প্রায় নাজেহাল করার দশায় ফেলেছিলেন তাদের কাছে কেজিতে তিন-চার টাকা বেশি তেমন কোনো বেশিই নয়; কিন্তু যে নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষটি স্থির আয়ের, যিনি বেতননির্ভর, তার কাছে কেজিতে তিন/চার টাকা বেশি অনেক টাকা। কারণ প্রতিদিন তার বাজেট ঘাটতি ঘটে শত টাকার ওপর। সেটাই তার জন্য এক বিরাট বোঝা।
এরাই আবার সংবাদপত্রের পাঠক। সরকারের বাকোয়াজি, অসত্য ভাষণ এরা খবরের কাগজে পড়েন, টেলিভিশনে দেখেন। আর নিজেকে আরও অসহায় মনে করেন। মাসের হিসাব মিলাতে গিয়ে হিমশিম খান। বাজারে গিয়ে ব্যাগ খুলতে দশবার চিন্তা করেন। কাঁচাবাজার না হয় করলেন, চাল-আটা-সয়াবিন, আদা-রসুন-মরিচ-পেঁয়াজের কী হবে? ছেলেমেয়েদের স্কুলিং, গ্যাস-বিদ্যুত্-পানির বিল, টেলিফোন-সেলফোন-যানজট-রিকশা-স্কুটার—এসব চিন্তা এই মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে কেবলই অসহায় করে তোলে। কেবলই ভেতর থেকে ভেঙে দেয়। এরা সহজে বিদ্রোহ করেন না; কিন্তু বস্ল ক্ষেত্রে বিদ্রোহ সংগঠিত করে। সরকার এবার এই শ্রেণীকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করছে। আমলেই নিচ্ছে না; কিন্তু সরকার বুঝতেই চাইছে না যে, এরাই চালিকাশক্তি। এরাই নিম্নবিত্তের অবলম্বন। সরকার সচেতন না হলে সামনে বিপদ।
দখল রোগের আতঙ্ক এই নগরীতে একেক সময় একেক রোগের আতঙ্ক ছড়িয়ে দেয়া হয়, কিংবা ছড়িয়ে পড়ে। বছর দুই আগে নগরীতে ভয়াবহ আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল ‘বার্ড ফ্লু’ নিয়ে। এ রোগের কথা আমরা আগে শুনিনি। সে রোগের প্রধান শিকার ছিল মোরগ-মুরগি। আর এর ফলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল মুরগির খামারের মালিকরা। কোথাও কোনো ফার্মে একটি মুরগি ঝিমিয়েছে। আর অমনি সরকারের বীরপুঙ্গব পাইক-পেয়াদারা সে খামারের হাজার হাজার মুরগি নিধনে নেমে পড়েছিল। স্লশিয়ার! ওই রোগ ছড়িয়ে পড়তে পারে মানবদেহেও। সরকারের একটা দায়িত্ব আছে না? ওই রোগ থেকে নাগরিকদের বাঁচানোর জন্য সরকার বিভিন্ন খামারের লাখ লাখ মুরগি হত্যা করে একেবারে সাত হাত মাটির নিচে পুুঁতে ফেলে। সে কি বিশাল কর্মযজ্ঞ! কথা ছিল, সরকার নিধনকৃত মুরগির জন্য ক্ষতিপূরণ দেবে; কিন্তু সে ক্ষতিপূরণ দিয়ে যাওয়ার সময় তারা পায়নি। খামারিরা সেই যে পথে বসেছে, এখনও উঠে দাঁড়াতে পারেনি। ওই অপগণ্ড শাসকদের তাণ্ডবে ধ্বংস হয়ে গেছে বিপুল সম্ভাবনাময় একটি শিল্প খাত। এই ধ্বংসযজ্ঞ সম্পন্ন হওয়ার পর সরকার ও চিকিত্সকরা ঘোষণা করলেন, মুরগি ঝিমালে তেমন কোনো বিপদ নেই। বরং ঝিমানো মুরগি বা ডিম ভালো করে সিদ্ধ করে খেলেও কোনো ক্ষতির আশঙ্কা নেই। সে পর্ব সাঙ্গ হয়ে গেছে। কয়েক মাস আগে নগরীতে নতুন করে আরেক রোগের আতঙ্ক ছড়িয়ে দেয়া হয়, তার নাম ‘সোয়াইন ফ্লু’। এ আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ার পর দেশের নামি-দামি স্কুল-কলেজগুলো শিক্ষার্থীদের ‘নিরাপত্তার স্বার্থে’ অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ব্দ ঘোষণা করে বসল। চিলে কান নিয়ে যাওয়ার ঘটনার মতো। কানে হাত দিয়ে কেউ দেখল না যে, চিলে সত্যি সত্যি কান নিয়ে গেছে কিনা? বরং চিলের পেছনে ছুট দিল সবাই। সরকারের মন্ত্রীরাও বুঝে-না বুঝে এ আতঙ্ক ছড়াতে শরিক হয়ে গেলেন। তবে এবার সবাই গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসালেন না। দেশের খ্যাতিমান বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকরা এগিয়ে এলেন। তারা মিডিয়ার সামনে বলতে থাকলেন, ‘সোয়াইন ফ্লু’ সাধারণ ফ্লু’র চেয়ে বেশি কিছু নয়। সাধারণ ফ্লু যেমন হাঁচি-কাশি-করমর্দন থেকে ছড়াতে পারে, সোয়াইন ফ্লুও তাই। সুতরাং কারও ফ্লু হলে সে যেন কয়েক দিন নিজেকে একটু বিচ্ছিন্ন করে রাখে। ব্যস! তবু শহরে-বন্দরে সাধারণ মানুষ মুখোশ এঁটে চলতে শুরু করল। মনে হলো গোটা দেশই যেন এক মুখোশের জনপদে পরিণত হয়েছে। তবে এখন সে আতঙ্কেরও অবসান ঘটেছে। সোয়াইন ফ্লু’র ফোবিয়া দূর হয়েছে। অর্থাৎ রোগ-জারি নিয়ে যেসব আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে, এক সময় তার অবসান ঘটে, মানুষ আতঙ্কমুক্ত হয়; কিন্তু এই নগরীর স্থায়ী ও ক্রমসম্প্রসারণ আতঙ্কের নাম দখল। এ আতঙ্ক সর্বগ্রাসী রূপ নিতে শুরু করেছে। সরকারি দলের সদস্যরা কিংবা তাদের ছত্রছায়ায় ছড়িয়ে পড়ছে এই দখল আতঙ্ক। প্রবাসীর বাড়ি বা জমি দখল, ঘাট দখল, টেন্ডার দখল, হিন্দু পরিবারকে আটকে রেখে তাদের বাড়ি-ঘর দখলের আতঙ্ক ক্রমেই বিস্তার লাভ করছে। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে। নগরীতে দখল আতঙ্কের সর্বশেষ ঘটনা ঘটেছে নীলক্ষেত এলাকায়। গত ২৬ অক্টোবর কাক-ডাকা ভোরে। নীলক্ষেতে বিশাল এলাকা জুড়ে ইসলামিয়া ও বাবুপুরা বই মার্কেট। এই দুই মার্কেটের শত শত বইয়ের দোকান রাজধানীর শিক্ষার্থীদের বইয়ের চাহিদা মেটায়। যুগের পর যুগ ধরে চলছে এই বই বাণিজ্য। ২৬ অক্টোবর ভোর ৫টার দিকে ৪ শতাধিক ছাত্রলীগ ও যুবলীগ নেতা-কর্মীকে নিয়ে খায়রুল হাসান খোকন নামে এক ব্যক্তি ওই মার্কেট দখল করতে যায়। খোকন দাবি করেছেন, ওই দুই মার্কেটের সমুদয় জমি তিনি খরিদ করে নিয়েছেন। হামলাকারী সরকারি দলের সমর্থকরা মার্কেটের সমিতি অফিস দখলে নিয়ে নেয়। তারা মার্কেটের সাইনবোর্ড নামিয়ে ‘খরিদ সূত্রে এই জমির মালিক খায়রুল হাসান খোকন’ লেখা সাইনবোর্ড টানিয়ে দেয়। খবর পেয়ে দোকানের মালিক-কর্মচারীরা ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন। তাদের সঙ্গে দখলদারদের হাতাহাতি শুরু হয়। সকাল সাড়ে ৮টার দিকে সেখানে আসেন ৫২নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জসীম ও সহ-সভাপতি বাবুল। ছাত্রলীগ নেতারা এ সময় ঘটনাস্থল ত্যাগ করে। আওয়ামী লীগ নেতারা আলোচনার প্রস্তাব দেন; কিন্তু দোকান মালিকরা আগে সাইনবোর্ড তোলার দাবি তোলেন। তখন দু’পক্ষে আবারও সংঘর্ষ শুরু হয়। ব্যবসায়ীদের মরিয়া মারের মুখে একপর্যায়ে দখলদাররা পিছু হটে। মার্কেটের সামনে শত শত পুলিশের উপস্থিতিতেই এ ঘটনা ঘটে। মার্কেট এখনও বন্ব্দ। ব্যবসায়ীরা পালা করে এলাকা পাহারা দিচ্ছে। তাদের নিশ্চিন্তে ব্যবসা চালিয়ে যাওয়ার আশ্বাস পাওয়া যায়নি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে। ব্যবসায়ী মহলে এখনও আতঙ্ক বিরাজমান। বার্ড ফ্লু’র আতঙ্ক দূর হয়েছে। সোয়াইন ফ্লু’র আতঙ্ক দূর হয়েছে; কিন্তু দখল ফ্লু’র আতঙ্ক থেকে নাগরিকদের মুক্তির কি কোনো পথই খোলা থাকবে না?
ফুটনোট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে হাকিম চত্বর এলাকায় বসে আড্ডা দিচ্ছিল একদল তরুণ। লাইব্রেরি ও ভাষা ইনসিল্টটিউট সীমানা প্রাচীরের দু’পাশে পা দিয়ে সাইকেল আরোহীর মতো বসেছিল এক যুবক। একটি মোটাসোটা কালো মেয়ে। সবুজ পাড়ের সাদা শাড়ি। ঢুকছিলেন ভাষা ইনসিল্টটিউটে। যুবকটি তাকে দ্যাখে। সে ডানে যায়। যুবকও ডানে ঘুরে বসে। মেয়েটি অস্বস্তিবোধ করে। শেষে ফিরে এসে চিৎকার করে বলে, ‘অসভ্য কোথাকার।’ ছেলেটি দু’হাত জোড় করে মেয়েটির কাছে গিয়ে বলে, ‘আর একবার আমাকে ওই গালিটা দেন না। বহুদিন ওই গালি শুনিনি।’
এরাই আবার সংবাদপত্রের পাঠক। সরকারের বাকোয়াজি, অসত্য ভাষণ এরা খবরের কাগজে পড়েন, টেলিভিশনে দেখেন। আর নিজেকে আরও অসহায় মনে করেন। মাসের হিসাব মিলাতে গিয়ে হিমশিম খান। বাজারে গিয়ে ব্যাগ খুলতে দশবার চিন্তা করেন। কাঁচাবাজার না হয় করলেন, চাল-আটা-সয়াবিন, আদা-রসুন-মরিচ-পেঁয়াজের কী হবে? ছেলেমেয়েদের স্কুলিং, গ্যাস-বিদ্যুত্-পানির বিল, টেলিফোন-সেলফোন-যানজট-রিকশা-স্কুটার—এসব চিন্তা এই মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে কেবলই অসহায় করে তোলে। কেবলই ভেতর থেকে ভেঙে দেয়। এরা সহজে বিদ্রোহ করেন না; কিন্তু বস্ল ক্ষেত্রে বিদ্রোহ সংগঠিত করে। সরকার এবার এই শ্রেণীকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করছে। আমলেই নিচ্ছে না; কিন্তু সরকার বুঝতেই চাইছে না যে, এরাই চালিকাশক্তি। এরাই নিম্নবিত্তের অবলম্বন। সরকার সচেতন না হলে সামনে বিপদ।
দখল রোগের আতঙ্ক এই নগরীতে একেক সময় একেক রোগের আতঙ্ক ছড়িয়ে দেয়া হয়, কিংবা ছড়িয়ে পড়ে। বছর দুই আগে নগরীতে ভয়াবহ আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল ‘বার্ড ফ্লু’ নিয়ে। এ রোগের কথা আমরা আগে শুনিনি। সে রোগের প্রধান শিকার ছিল মোরগ-মুরগি। আর এর ফলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল মুরগির খামারের মালিকরা। কোথাও কোনো ফার্মে একটি মুরগি ঝিমিয়েছে। আর অমনি সরকারের বীরপুঙ্গব পাইক-পেয়াদারা সে খামারের হাজার হাজার মুরগি নিধনে নেমে পড়েছিল। স্লশিয়ার! ওই রোগ ছড়িয়ে পড়তে পারে মানবদেহেও। সরকারের একটা দায়িত্ব আছে না? ওই রোগ থেকে নাগরিকদের বাঁচানোর জন্য সরকার বিভিন্ন খামারের লাখ লাখ মুরগি হত্যা করে একেবারে সাত হাত মাটির নিচে পুুঁতে ফেলে। সে কি বিশাল কর্মযজ্ঞ! কথা ছিল, সরকার নিধনকৃত মুরগির জন্য ক্ষতিপূরণ দেবে; কিন্তু সে ক্ষতিপূরণ দিয়ে যাওয়ার সময় তারা পায়নি। খামারিরা সেই যে পথে বসেছে, এখনও উঠে দাঁড়াতে পারেনি। ওই অপগণ্ড শাসকদের তাণ্ডবে ধ্বংস হয়ে গেছে বিপুল সম্ভাবনাময় একটি শিল্প খাত। এই ধ্বংসযজ্ঞ সম্পন্ন হওয়ার পর সরকার ও চিকিত্সকরা ঘোষণা করলেন, মুরগি ঝিমালে তেমন কোনো বিপদ নেই। বরং ঝিমানো মুরগি বা ডিম ভালো করে সিদ্ধ করে খেলেও কোনো ক্ষতির আশঙ্কা নেই। সে পর্ব সাঙ্গ হয়ে গেছে। কয়েক মাস আগে নগরীতে নতুন করে আরেক রোগের আতঙ্ক ছড়িয়ে দেয়া হয়, তার নাম ‘সোয়াইন ফ্লু’। এ আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ার পর দেশের নামি-দামি স্কুল-কলেজগুলো শিক্ষার্থীদের ‘নিরাপত্তার স্বার্থে’ অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ব্দ ঘোষণা করে বসল। চিলে কান নিয়ে যাওয়ার ঘটনার মতো। কানে হাত দিয়ে কেউ দেখল না যে, চিলে সত্যি সত্যি কান নিয়ে গেছে কিনা? বরং চিলের পেছনে ছুট দিল সবাই। সরকারের মন্ত্রীরাও বুঝে-না বুঝে এ আতঙ্ক ছড়াতে শরিক হয়ে গেলেন। তবে এবার সবাই গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসালেন না। দেশের খ্যাতিমান বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকরা এগিয়ে এলেন। তারা মিডিয়ার সামনে বলতে থাকলেন, ‘সোয়াইন ফ্লু’ সাধারণ ফ্লু’র চেয়ে বেশি কিছু নয়। সাধারণ ফ্লু যেমন হাঁচি-কাশি-করমর্দন থেকে ছড়াতে পারে, সোয়াইন ফ্লুও তাই। সুতরাং কারও ফ্লু হলে সে যেন কয়েক দিন নিজেকে একটু বিচ্ছিন্ন করে রাখে। ব্যস! তবু শহরে-বন্দরে সাধারণ মানুষ মুখোশ এঁটে চলতে শুরু করল। মনে হলো গোটা দেশই যেন এক মুখোশের জনপদে পরিণত হয়েছে। তবে এখন সে আতঙ্কেরও অবসান ঘটেছে। সোয়াইন ফ্লু’র ফোবিয়া দূর হয়েছে। অর্থাৎ রোগ-জারি নিয়ে যেসব আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে, এক সময় তার অবসান ঘটে, মানুষ আতঙ্কমুক্ত হয়; কিন্তু এই নগরীর স্থায়ী ও ক্রমসম্প্রসারণ আতঙ্কের নাম দখল। এ আতঙ্ক সর্বগ্রাসী রূপ নিতে শুরু করেছে। সরকারি দলের সদস্যরা কিংবা তাদের ছত্রছায়ায় ছড়িয়ে পড়ছে এই দখল আতঙ্ক। প্রবাসীর বাড়ি বা জমি দখল, ঘাট দখল, টেন্ডার দখল, হিন্দু পরিবারকে আটকে রেখে তাদের বাড়ি-ঘর দখলের আতঙ্ক ক্রমেই বিস্তার লাভ করছে। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে। নগরীতে দখল আতঙ্কের সর্বশেষ ঘটনা ঘটেছে নীলক্ষেত এলাকায়। গত ২৬ অক্টোবর কাক-ডাকা ভোরে। নীলক্ষেতে বিশাল এলাকা জুড়ে ইসলামিয়া ও বাবুপুরা বই মার্কেট। এই দুই মার্কেটের শত শত বইয়ের দোকান রাজধানীর শিক্ষার্থীদের বইয়ের চাহিদা মেটায়। যুগের পর যুগ ধরে চলছে এই বই বাণিজ্য। ২৬ অক্টোবর ভোর ৫টার দিকে ৪ শতাধিক ছাত্রলীগ ও যুবলীগ নেতা-কর্মীকে নিয়ে খায়রুল হাসান খোকন নামে এক ব্যক্তি ওই মার্কেট দখল করতে যায়। খোকন দাবি করেছেন, ওই দুই মার্কেটের সমুদয় জমি তিনি খরিদ করে নিয়েছেন। হামলাকারী সরকারি দলের সমর্থকরা মার্কেটের সমিতি অফিস দখলে নিয়ে নেয়। তারা মার্কেটের সাইনবোর্ড নামিয়ে ‘খরিদ সূত্রে এই জমির মালিক খায়রুল হাসান খোকন’ লেখা সাইনবোর্ড টানিয়ে দেয়। খবর পেয়ে দোকানের মালিক-কর্মচারীরা ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন। তাদের সঙ্গে দখলদারদের হাতাহাতি শুরু হয়। সকাল সাড়ে ৮টার দিকে সেখানে আসেন ৫২নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জসীম ও সহ-সভাপতি বাবুল। ছাত্রলীগ নেতারা এ সময় ঘটনাস্থল ত্যাগ করে। আওয়ামী লীগ নেতারা আলোচনার প্রস্তাব দেন; কিন্তু দোকান মালিকরা আগে সাইনবোর্ড তোলার দাবি তোলেন। তখন দু’পক্ষে আবারও সংঘর্ষ শুরু হয়। ব্যবসায়ীদের মরিয়া মারের মুখে একপর্যায়ে দখলদাররা পিছু হটে। মার্কেটের সামনে শত শত পুলিশের উপস্থিতিতেই এ ঘটনা ঘটে। মার্কেট এখনও বন্ব্দ। ব্যবসায়ীরা পালা করে এলাকা পাহারা দিচ্ছে। তাদের নিশ্চিন্তে ব্যবসা চালিয়ে যাওয়ার আশ্বাস পাওয়া যায়নি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে। ব্যবসায়ী মহলে এখনও আতঙ্ক বিরাজমান। বার্ড ফ্লু’র আতঙ্ক দূর হয়েছে। সোয়াইন ফ্লু’র আতঙ্ক দূর হয়েছে; কিন্তু দখল ফ্লু’র আতঙ্ক থেকে নাগরিকদের মুক্তির কি কোনো পথই খোলা থাকবে না?
ফুটনোট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে হাকিম চত্বর এলাকায় বসে আড্ডা দিচ্ছিল একদল তরুণ। লাইব্রেরি ও ভাষা ইনসিল্টটিউট সীমানা প্রাচীরের দু’পাশে পা দিয়ে সাইকেল আরোহীর মতো বসেছিল এক যুবক। একটি মোটাসোটা কালো মেয়ে। সবুজ পাড়ের সাদা শাড়ি। ঢুকছিলেন ভাষা ইনসিল্টটিউটে। যুবকটি তাকে দ্যাখে। সে ডানে যায়। যুবকও ডানে ঘুরে বসে। মেয়েটি অস্বস্তিবোধ করে। শেষে ফিরে এসে চিৎকার করে বলে, ‘অসভ্য কোথাকার।’ ছেলেটি দু’হাত জোড় করে মেয়েটির কাছে গিয়ে বলে, ‘আর একবার আমাকে ওই গালিটা দেন না। বহুদিন ওই গালি শুনিনি।’
No comments