সাংবাদিক দম্পতি হত্যারহস্য : আস্থা হারাচ্ছে সরকার by এ কে এম শাহনাওয়াজ

মুশকিল হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের লাগাম এতটাই হাতছাড়া হয়ে গেছে যে মনে হচ্ছে আত্মরক্ষায় এখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং তাদের নিয়ন্ত্রক স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রতিদিন যেন প্রত্যাশা করে আরো বড় কোনো অঘটনের।


তাতে অন্তত আগের ঘটনাটি ধামাচাপা পড়তে পারে। নতুনটি নিয়ে মাতামাতি হবে। আবার তা আরেকটি অঘটনের চাদরে ঢাকা পড়ে যাবে। একে বলা যায়, স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে পুলিশ-র‌্যাবের আত্মরক্ষা। সাম্প্রতিক সময়ের কথাই বলি। বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী গুমের পর একটি বড়সড় আলোড়ন তৈরি হয়েছিল। একসময় দেখা গেল, বিএনপি আর সরকার উভয় পক্ষ ফ্রন্টলাইন থেকে একটু একটু সরে আসছে। এরপর সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনির মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের পর যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। আবার এই হত্যাকাণ্ডের রহস্যের জট কোনোভাবেই খুলতে না পেরে যখন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিব্রত তখনই আশীর্বাদ হয়ে এলো রেলের অর্থ কেলেঙ্কারি ও রেলমন্ত্রী সংকট। এ থেকে পরিত্রাণের উপায় তৈরি করে দিল পদ্মা সেতু দুর্নীতি প্রসঙ্গ ও বিশ্বব্যাংকের অ্যাবাউট টার্ন। এর মাঝখানে খুন-খারাবি আর ছিনতাই-ডাকাতি তো আছেই। খুনের ঘটনা এত ঘটছে যে কোনটা বেশি চাঞ্চল্যকর তা নিরূপণ করাটাই কঠিন কাজ হয়ে যাচ্ছে।
অন্যসব ঘটনার কারণে সাগর-রুনির হত্যার উত্তাপও হয়তো শীতল হয়ে যেত যদি না সহকর্মীরা রুখে দাঁড়াতেন। শুধু রুখে দাঁড়ানো নয়, বাংলাদেশের জন্য একটি অভাবনীয় ঘটনাও তারা ঘটালেন। এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ জানাতে এবং বিচার দাবিতে তারা রাজনৈতিক বিভেদ কমিয়ে এক মঞ্চে জমায়েত হলেন। তাই সম্ভবত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের স্বস্তি খোঁজার সুযোগ রইল না।
যৌক্তিক নানা কারণে পুলিশের প্রতি আস্থা মানুষের কমে গেছে অনেক আগেই। ব্যতিক্রম বাদ দিলে বলা যায়, এ দেশের মানুষের বিপদ-আপদের আশ্রয় এখন আর পুলিশ নয়। পুলিশ অর্থের কথা শোনে। ক্ষমতাবান নেতা-নেত্রীর কথা শোনে। পুলিশ নিরপরাধ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রকে ডাকাতি মামলায় ধরে নির্যাতন করতে পারে। র‌্যাবের গুলিতে আহত লিমনের মামলার অভিযুক্তদের এক লহমায় ফাইনাল রিপোর্ট দিয়ে মুক্ত করে দেয়। নিজের ঘাড়ে মামলা নিয়ে পঙ্গু লিমনকে দিনের পর দিন আদালতে হাজিরা দিতে হয়। এ রকম শত উদাহরণ দিয়ে কষ্টের মালা গাঁথা যায়।
পুলিশেরও সীমাবদ্ধতা আছে। আছে অনেক কষ্টের অভিজ্ঞতা। একজন নন ক্যাডার পুলিশ অফিসারের চাকরি পেতে হয় নাকি অর্থনৈতিক সম্পর্কের মধ্য দিয়ে। সমাজে ধারণা আছে, লাখ লাখ টাকা ঘুষ-বাণিজ্য চলে। চাকরিতে যোগ দিয়ে দেখে স্বল্প বেতন আর ভাতা। তার ওপর ক্ষমতাসীন রাজনীতিকদের আদেশ মেনে চলতে হয়। তাই সততার পথে হেঁটে 'মানুষ' হয়ে জীবন চালানো অনেকের পক্ষেই কঠিন হয়ে যায়।
নতুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে প্রাজ্ঞ আমলা ও রাজনীতিক মহীউদ্দীন খান আলমগীর দায়িত্ব নিলে আবার নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হয়। আমাদের রাজনীতিক ও মন্ত্রীরা মাঝেমধ্যেই কথার বোমা ফাটান। এতে মানুষ ধাতস্থ হয়ে গেছে বলে এখন আর তেমন বিস্মিত হয় না। জনাব স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ফাটালেন। জানালেন, ১০ অক্টোবরের মধ্যে তদন্তের একটি ফলাফল তিনি জানাতে পারবেন।
অন্ধকারের তলদেশে যাওয়া মামলার এমন অভাবনীয় উন্নতির আভাসে সাংবাদিক নেতাদের সঙ্গে দেশবাসীও আশাবাদী হওয়ার বদলে কিছুটা বিচলিতই বোধ করল বলা যায়। কারণ এই মামলা নিয়ে অনেক নাটক দেখেছে মানুষ। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে রহস্যভেদের আশাবাদ আর পুলিশপ্রধানের 'প্রণিধানযোগ্য অগ্রগতি'র কথা তো সবার মনেই ছিল। তাই সিঁদুরে মেঘে ভয় পাওয়ার মতো করেই সাংবাদিক নেতারা নতুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহোদয়ের ১০ অক্টোবরের সম্ভাব্য ঘোষণায় নতুন ধূম্রজালের আশঙ্কাই করেছিলেন। তাই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কথা রাখতে ব্যর্থ হলে পরবর্তী কঠোর কর্মসূচির কথা ঘোষণা করে দিলেন।
দেখা গেল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহোদয়ও তাঁর কথা রাখতে বদ্ধপরিকর। ৯ অক্টোবর সন্ধ্যায়ই সাংবাদিকদের 'সাফল্যে'র কথা জানালেন। ডিএনএ রিপোর্ট অনুযায়ী হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে সাতজন আসামিকে গ্রেপ্তার করার কথা বললেন। রীতিমতো বিস্ময়কর সাফল্য। প্রায় অন্ধকারে চলে যাওয়া মামলা নতুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর হাতে এসেই যেন ভোজবাজির মতো ফল প্রদান করল। অনেক অসম্ভবই সম্ভব হতে পারে, তাই প্রাথমিকভাবে এই সাফল্যকে স্বাগত না জানানোর কোনো কারণ নেই।
কিন্তু সন্দেহ দূর করতে পারলেন না সাংবাদিক নেতারা এবং হতভাগ্য সাগর-রুনির পরিবার। ১১ অক্টোবরের অধিকাংশ জাতীয় দৈনিক আসামি গ্রেপ্তার নিয়ে চুলচেরা বিচার করল। ফলে পুরো বিষয়টিতে তৈরি হয়ে গেল একটি ধোঁয়াশা। উত্থাপিত যুক্তিগুলোও ফেলনা নয়। এসব বক্তব্য পাঠক অবহিত বলে আমি আর পুনরুল্লেখ করছি না। আমরা বিশ্বাস করতে চাই, মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহোদয়ের কথাই ঠিক। র‌্যাব ঠিক পথেই এগোচ্ছে। তবে এই যুক্তিও উড়িয়ে দেওয়া যায় না যে হত্যাকাণ্ডের কোনো মোটিভ শনাক্ত না হলেও অপেক্ষাকৃত দুর্বল যুক্তির ওপর ভর করে এত গ্রেপ্তার দেখানো কেন? আমার এক সহকর্মী রসিকতা করে বললেন, এ দেখি বাগে পাওয়া বাঘ। ডা. নারায়ণ চন্দ্র নিতাইয়ের হত্যাকারীদেরই হাতের কাছে পেয়ে তড়িঘড়ি বহু আলোচিত হত্যাকাণ্ডের হত্যাকারী হিসেবে চালিয়ে দেওয়া হলো না তো? কারণ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহোদয়ের হাতে সময় ছিল না। ১০ অক্টোবর সমাগত। তাঁকেও তো 'প্রণিধানযোগ্য' একটি জায়গায় দাঁড়াতে হবে।
অপরাজনীতি আর পুলিশের প্রতি আস্থাহীনতা থেকেই মানুষ কিন্তু সন্দেহবাতিকগ্রস্ত হয়ে উঠছে। আমরা দেখেছি পুলিশকে নানাভাবে ব্যবহার করতে গিয়ে তাদের কর্তব্যজ্ঞানও অনেক সময় ভোঁতা করে ফেলা হয়েছে। গত ১১ অক্টোবর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশাসনের উদ্যোগে রামু, টেকনাফ, উখিয়ার বৌদ্ধ বসতি ও বিহারে হামলার প্রতিবাদ ও নিপীড়িতদের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশে সব ধর্মের মানুষের এক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এই অনুষ্ঠানে এক আদিবাসী নেতা রামু থেকে পাওয়া তথ্যের আলোকে বললেন, রামুর এক পুলিশ কর্মকর্তা হামলার দিন নাকি হামলাকারীদের প্রতি সমর্থন জানিয়ে বলেছিলেন, 'যদি আমার গায়ে ইউনিফর্ম না থাকত, তবে আমিও ঝাঁপিয়ে পড়তাম।'
আমাদের ভ্রান্ত রাজনীতি আর বৈষম্যপূর্ণ সামাজিক, অর্থনৈতিক অবস্থা মূল্যবোধের জায়গাটিকে লাঞ্ছিত করছে প্রতিদিন। তাই আজ রাজনীতিক, মন্ত্রী, পুলিশ, র‌্যাব কারো বক্তব্যকেই সত্য ভেবে গ্রহণ করতে পারছে না কেউ। এ কারণে র‌্যাব সন্দেহভাজন সাত আসামি গ্রেপ্তার করার পরও নিহত সাগর সরোয়ারের মা স্বস্তি পাচ্ছেন না। সাংবাদিকদের সামনে অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে বলে যাচ্ছেন, তিনি নিশ্চিত হয়ে গেছেন যে বিচার পাবেন না। তিনি তাই বিচারের জন্য আল্লাহর দরবারেই শুধু প্রার্থনা জানাচ্ছেন।
এমন অবস্থা একটি গণতান্ত্রিক দেশে কাম্য নয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় হচ্ছে দায়িত্বপ্রাপ্ত। এই মন্ত্রণালয়ের প্রতি যদি মানুষের আস্থা কমে যায়, তবে দেশের ঘোর দুর্দিন। দলতন্ত্রের বলয়ে বন্দি গণবিচ্ছিন্ন সরকার ক্রমে অস্বস্তিকর অবস্থার জন্ম দেয়। এ দেশের প্রগতিবাদী মানুষ কি আওয়ামী লীগ সরকারকে অমন রূপে দেখতে চায়? সরকার পরিচালক মহাত্মনরা দয়া করে বিষয়টি একবার ভেবে দেখবেন।

লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.