চরাচর-ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শোক দিবস by পাভেল রহমান
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের এক হৃদয়বিদারক সময়ের সাক্ষী ১৫ অক্টোবর ১৯৮৫ সাল। সেদিন জগন্নাথ হলের একটা জরাজীর্ণ ভবনের ছাদ ভেঙে প্রাণ হারিয়েছিল ৩৯ জন ছাত্র-কর্মচারী ও অতিথি। মুক্তিযুদ্ধের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একসঙ্গে এত প্রাণহানির ঘটনা আর ঘটেনি।
মৃত্যুর মিছিলে সেদিন শোকস্তব্ধ হয়ে পড়েছিল পুরো বাংলাদেশের মানুষ। এ ঘটনার পর থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ প্রতিবছর ১৫ অক্টোবরকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শোক দিবস হিসেবে পালন করে আসছে। সেদিনের সেই মেধাবী নিহত শিক্ষার্থীদের স্মরণে একটি স্মৃতিস্তম্ভও নির্মাণ করা হয় জগন্নাথ হল প্রাঙ্গণে। শোকাহত সেই দিনটির স্মরণে জগন্নাথ হলের একটি নতুন ভবনের নামকরণ করা হয় অক্টোবর স্মৃতি ভবন নামে। এ ছাড়া গোবিন্দচন্দ্র ভবন, সন্তোষচন্দ্র ভট্টাচার্য ভবন, জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা ভবন নামে আরো তিনটি ভবন আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকালীন যে তিনটি আবাসিক হল নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল তার মধ্যে জগন্নাথ হল একটি। ঢাকার বলিয়াদীর জমিদার কিশোরীলাল চৌধুরীর বাবা জগন্নাথ রায়ের নামে হলটির নামকরণ করা হয়। জগন্নাথ হলের প্রথম প্রভোস্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন নরেশচন্দ্র গুপ্ত। পরবর্তী সময়ে সত্যেন্দ্রনাথ বসু, জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ, ড. গোবিন্দচন্দ্র দেবের মতো দেশের প্রথিতযশা বুদ্ধিজীবী এই হলটির পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেছেন বিভিন্ন সময়। জগন্নাথ হলই হচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সনাতন ধর্মাবলম্বী শিক্ষার্থীদের একমাত্র আবাসিক হল। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচীন এই হলটি অনেক ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সময়ের সাক্ষী। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের শুরুর সময় থেকেই পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর অন্যতম টার্গেটে পরিণত হয়েছিল জগন্নাথ হল। জগন্নাথ হলকে সুস্থ ছাত্ররাজনীতির সূতিকাগার বলা যায়। ২৫ মার্চের পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নারকীয় হত্যাযজ্ঞের অন্যতম স্থান ছিল জগন্নাথ হল। ফলে প্রাচীন এই হলটি আমাদের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে অত্যন্ত নিবিড়ভাবে। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে বয়সের ভারে জীর্ণদশাপ্রাপ্ত এই হলটির সঠিক সংস্কারের অভাবে তা হয়ে উঠেছিল বিপজ্জনক। সংস্কারের ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় আমাদের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের সাক্ষী জগন্নাথ হল ১৯৮৫ সালের ১৫ অক্টোবর প্রত্যক্ষ করে এক হৃদয়বিদারক ট্র্যাজেডি। ২৭ বছর ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শোক দিবস হিসেবে জগন্নাথ হল ট্র্যাজেডিকে স্মরণ করা হলেও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের আগ্রহ নেই পুরোনো এই হলটির সংস্কারের ব্যাপারে। এখনো এই হলের আবাসিক শিক্ষার্থীরা জীর্ণশীর্ণ ভবনটিতে ভয়ের মধ্যেই বসবাস করছেন। সঠিকভাবে সংস্কার করা না হলে আবার ১৯৮৫ সালের পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে যেকোনো সময়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন ঝুঁকিপূর্ণ একাধিক ভবন রয়েছে। তাই এখনই উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন আরো বড় কোনো দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য। বিভিন্ন আবাসিক হলের ভবনগুলোকে সংস্কারের মধ্য দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিরাপদ বাসস্থানের নিশ্চয়তা তৈরি হবে- এমনটাই প্রত্যাশা এবারের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শোক দিবসে।
No comments