৫৩.৫% এমপি অপরাধে জড়িত-শতকরা ৯৭ জন নেতিবাচক কাজে যুক্ত : টিআইবির প্রতিবেদন
নবম জাতীয় সংসদের ৯৭ শতাংশ সদস্য তাঁদের মূল কাজ আইন প্রণয়নের দিকে নজর না দিয়ে নানা ধরনের নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকেন। এমপিদের মধ্যে আবার শতকরা সাড়ে ৫৩ জন নিজেরাই বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে যুক্ত।
এসবের মধ্যে হত্যা, দখল, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ও প্রতারণার মতো গুরুতর অপরাধও রয়েছে। এমপিদের বিরুদ্ধে মামলাও রয়েছে প্রচুর, এমনকি ফৌজদারি মামলা দায়ের হয়েছে ২৪.১ শতাংশ এমপির নামে। নেতিবাচক কর্মকাণ্ডে জড়িত এমপিদের মধ্যে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরাও বাদ যান না।
এসব তথ্য উঠে এসেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) গবেষণা প্রতিবেদনে। গতকাল রবিবার রাজধানীর ব্র্যাক ইন সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির পক্ষ থেকে প্রতিবেদনটি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদনে সংসদ সদস্যরা কোন কোন ক্ষেত্রে নেতিবাচক কর্মকাণ্ড সংঘটিত করে থাকেন, এর ফিরিস্তিও তুলে ধরা হয়েছে।
টিআইবির প্রতিবেদন অনুযায়ী, যে ৯৭ শতাংশ এমপি নেতিবাচক কর্মকাণ্ডে যুক্ত, তাঁদের সবাই কোনো না কোনোভাবে অপরাধমূলক কাজে জড়িত থাকেন বা সমর্থন করেন। তাঁদের সঙ্গে স্থানীয় দলীয় নেতা-কর্মীরাও এসব অপরাধে জড়িয়ে পড়েন। আর যেসব এমপি এসব কাণ্ড ঘটান, তাঁদের বিরুদ্ধে ভুক্তভোগী বা সাধারণ মানুষ ক্ষুব্ধ হলেও ভয়ে কেউ মামলা করার সাহস পান না। মামলা করতে গেলেও থানা মামলা নেয় না। কারণ এসব থানায় মামলা নিতে হলে সংশ্লিষ্ট সংসদ সদস্যের অনুমতি লাগে পুলিশের। তবে প্রতিবেদনে এটাও বলা হয়েছে, শতকরা ৫৩ দশমিক ৭ জন এমপি কিছু ইতিবাচক কার্যক্রমের সঙ্গেও যুক্ত আছেন। তাঁদের মধ্যে কয়েকজন নারী এমপি, মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ও বিরোধী দলের এমপিও আছেন।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, টিআইবির পক্ষ থেকে দেশের ৪২টি জেলার ১৪৯টি আসনের সংসদ সদস্যদের গত পৌনে চার বছরের কার্যক্রমের ওপর গবেষণা কার্যক্রম চালিয়ে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়। এ ক্ষেত্রে পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত খবরের তথ্য-উপাত্তও আমলে নেওয়া হয়। যেসব এমপির কার্যক্রমের ওপর জরিপ চালানো হয়, তাঁদের মধ্যে ১৪১ জন পুরুষ এবং আটজন নারী। তাঁদের মধ্যে সরকারদলীয় এমপি ১৩৬ জন এবং বিরোধী দলের ১৩ জন। তাঁদের ২৭ জন আবার মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী পদমর্যাদার।
যে ১৪৯ জন এমপির ওপর গবেষণা চালানো হয়, তাঁদের মধ্যে বিরোধী দলের পাঁচজন এবং সরকারি দলের একজন নারী সদস্য ছাড়া সবার বিরুদ্ধেই নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত থাকার কথা টিআইবির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে স্পষ্ট হয়ে ওঠে, বিরোধী দল ও মহিলা সংসদ সদস্যরাও নেতিবাচক কার্যক্রমে পিছিয়ে নেই।
সংবাদ সম্মেলনের সময় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন টিআইবির সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার শাহজাদা এম আকরাম। এ সময় টিআইবির চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল ও ট্রাস্টি হাফিজ উদ্দিন খান উপস্থিত ছিলেন। টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, 'সংসদ সদস্যরা তাঁদের পদকে একটি লাভজনক আয়ের উৎস হিসেবে গণ্য করেন। ফলে তাঁদের মূল দায়িত্ব আইন প্রণয়নের বাইরে তাঁরা নেতিবাচক কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়ছেন।' তিনি জানান, প্রতিবেদনটি তৈরি করতে নবম সংসদের শুরু (জানুয়ারি ২০০৯) থেকে ২০১২ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সংসদ সদস্যদের কার্যক্রম পর্যালোচনা করা হয়েছে। এ সময় এমপিদের আইনবহির্ভূত বিভিন্ন কর্মকাণ্ড ও অনিয়মের ওপর গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদও বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল বলেন, 'আইনবহির্ভূত কর্মকাণ্ড, ক্ষমতার অপব্যবহার ও অনিয়মে জড়িয়ে পড়া এবং অনেক ক্ষেত্রে যথাযথ আইনি ব্যবস্থার অনুপস্থিতির কারণে সংসদ সদস্যদের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছে।'
সংবাদ সম্মেলনে শাহজাদা এম আকরাম বলেন, 'সংসদ সদস্যদের ওপর প্রচলিত ধারণা কিংবা গুজবের ভিত্তিতে নয়, বরং প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে তথ্য সংগ্রহ করে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে।'
নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের ধরন : টিআইবির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, এমপিদের অপরাধের ধরনের মধ্যে রয়েছে হত্যা, সরকারি খাসজমি-নদী-খাল-জলমহাল-পুকুর দখল, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, প্রতারণা প্রভৃতি। প্রতিবেদনে মোট ছয়টি ছকে নেতিবাচক কার্যক্রমের ধরন উল্লেখ করা হয়। এমপিদের অন্যান্য নেতিবাচক কাজের মধ্যে রয়েছে উন্নয়ন বরাদ্দের অপব্যবহার, উন্নয়ন বরাদ্দ তদারক না করা, পারিবারিক ও ব্যক্তিগত সুবিধা নেওয়া, উন্নয়ন বরাদ্দে দলীয় লোকদের প্রাধান্য দেওয়া, ভুয়া প্রকল্পের নামে বরাদ্দ নেওয়া, টিআর-কাবিখা-কাবিটা বিতরণ ও ত্রাণ কার্যক্রমে দুর্নীতি-অনিয়ম করা প্রভৃতি।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ৭৮.৭ শতাংশ সংসদ সদস্য স্থানীয় উন্নয়ন বরাদ্দ থেকে কমিশন নিয়ে থাকেন। এই কমিশনের হার কমপক্ষে ৫ শতাংশ। অস্তিত্বহীন বাঁধ, শিক্ষা-ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও রাস্তা পুনর্নির্মাণের নামে বরাদ্দ নিয়েও লুটপাটের ঘটনা ঘটান তাঁরা। অন্যদিকে ৭১.৭ শতাংশ এমপি নিজের বা ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজন বা অন্যের লাইসেন্স ব্যবহার করে ঠিকাদারি ব্যবসা পরিচালনা করেন। পৌরসভা, সিটি করপোরেশন, পানি উন্নয়ন বোর্ড, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর, সড়ক ও জনপথ, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন স্থানে তাঁরা ঠিকাদারি কাজ পরিচালনা করেন। রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করে দরপত্র কিনতে বাধার সৃষ্টি করান বা সমঝোতার মাধ্যমে কাজ বণ্টন করে থাকেন। অনেক ক্ষেত্রে কমিশনের বিনিময়েও ঠিকাদারি কাজের কার্যাদেশ দেওয়া হয়। এ ছাড়া এসব এমপি রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে প্রকল্প অনুমোদন করান। নিজে বা ঘনিষ্ঠজনকে দিয়ে ৮৯ শতাংশ প্রকল্পের বাস্তবায়নকাজ নিয়ন্ত্রণ করেন।
সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দলীয়ভাবে প্রার্থী মনোনয়নের বিধান না থাকলেও এমপিরা মৌখিকভাবে প্রার্থী মনোনয়ন দেন। এ মনোনয়নে অনেক ক্ষেত্রেই অর্থের লেনদেন হয়। যাঁদের মৌখিকভাবে সমর্থন বা মনোনয়ন দেন, নির্বাচনের সময়ও এমপিরা তাঁদের পক্ষে প্রভাব বিস্তার করেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, অনেক এমপিই মিথ্যা তথ্য দিয়ে বা তথ্য গোপন করে সরকারি প্লট বরাদ্দ নিয়েছেন। ঢাকা শহরে নিজের বা স্ত্রীর নামে এক বা একাধিক জমি বা ফ্ল্যাট থাকা সত্ত্বেও মিথ্যা হলফনামার ভিত্তিতে তাঁরা প্লট বরাদ্দ পেয়েছেন। উত্তরা সম্প্রসারিত তৃতীয় প্রকল্প ও পূর্বাচল উপশহর প্রকল্পেও এ রকম ঘটনা ঘটেছে।
এ ছাড়া এমপিরা স্থানীয় পর্যায়ের প্রশাসনিক কার্যক্রমে প্রভাব সৃষ্টি করেন। টাকার বিনিময়ে বা নিজস্ব ব্যক্তিকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ ও বদলির ঘটনা ঘটান। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কমিটি নিয়ন্ত্রণ, পছন্দের সদস্যকে কমিটিতে অন্তর্ভুক্তি, শিক্ষক নিয়োগ, কমিশনের বিনিময়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্তি এবং শিক্ষক লাঞ্ছনার মতো ঘটনাও এসব এমপি ঘটিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ৮১ শতাংশ এমপি প্রশাসনিক কাজে প্রভাব বিস্তার, ৭৭ শতাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ, ৭৫ শতাংশ উন্নয়ন বরাদ্দের অপব্যবহার, ৭০ শতাংশ অপরাধমূলক কার্যক্রম, ৬৯ শতাংশ সরকারি ক্রয়-সংক্রান্ত সিদ্ধান্তে প্রভাব বিস্তার, ৬২ শতাংশ নির্বাচনী আইন লঙ্ঘন ও ৮ শতাংশ মিথ্যা তথ্য দিয়ে প্লট বরাদ্দ নিয়েছেন।
প্রতিবেদনে সংসদ সদস্যদের কার্যক্রমে সন্তুষ্টির মাত্রাবিষয়ক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ৬৮ শতাংশ এমপির কার্যক্রমের সন্তুষ্টির স্কোর ৫-এর নিচে (সর্বনিম্ন ১ থেকে সর্বোচ্চ ১০ ধরে)। আর ৩.৩৬ শতাংশ সদস্যের এই স্কোর সাড়ে ৭-এর ওপরে।
এসবের কারণ হিসেবে গণতান্ত্রিক চর্চা না থাকা ও শাস্তি না হওয়ার সংস্কৃতিকে প্রতিবেদনে দায়ী করা হয়। কারণ নেতিবাচক কর্মকাণ্ডে জড়িত এমপিদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। দল থেকেও তিরস্কার বা বহিষ্কার করা হয় না। এ ছাড়া 'বিজয়ীরাই সব কিছু ভোগ করবে' মানসিকতা থাকাও এ অবস্থার অন্যতম কারণ হিসেবে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
প্রতিবেদনে কিছু সুপারিশও তুলে ধরা হয়। এর মধ্যে রয়েছে নেতিবাচক কার্যক্রমের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া, এমপিদের আর্থিক ও অন্যান্য তথ্য নিয়মিত প্রকাশ, স্থানীয় পর্যায়ে নিয়মিত জনগণের মুখোমুখি করা, সংসদে কার্যকর অংশগ্রহণ বাড়ানো, উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাস্তবায়নপ্রক্রিয়া থেকে তাঁদের সরিয়ে আনা, সংসদে একটানা সাত দিনের বেশি অনুপস্থিত থাকা নিষিদ্ধ করা ও বিরোধী দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা, ডেপুটি স্পিকার বিরোধী দল থেকে নির্বাচন করা, দলের বিপক্ষে ভোট দেওয়ার সুযোগ তৈরি করা এবং নিজ দল থেকে স্পিকারের পদত্যাগ করার বিধান থাকা ইত্যাদি।
টিআইবির এ প্রতিবেদন সম্পর্কে জানতে চাইলে জাতীয় সংসদের স্পিকার অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'এটা আমার কোনো বিষয় না। এ বিষয়ে আমি কোনো মন্তব্য করতে চাই না। আমার জেলায় ছয়জন সংসদ সদস্য আছেন। আমি জানি, তাঁরা প্রত্যেকেই ভালো।'
আর ডেপুটি স্পিকার কর্নেল (অব.) শওকত আলীর কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেছেন, 'টিআইবির প্রতিবেদনটি দেখার পর মন্তব্য করতে পারব।'
এসব তথ্য উঠে এসেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) গবেষণা প্রতিবেদনে। গতকাল রবিবার রাজধানীর ব্র্যাক ইন সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির পক্ষ থেকে প্রতিবেদনটি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদনে সংসদ সদস্যরা কোন কোন ক্ষেত্রে নেতিবাচক কর্মকাণ্ড সংঘটিত করে থাকেন, এর ফিরিস্তিও তুলে ধরা হয়েছে।
টিআইবির প্রতিবেদন অনুযায়ী, যে ৯৭ শতাংশ এমপি নেতিবাচক কর্মকাণ্ডে যুক্ত, তাঁদের সবাই কোনো না কোনোভাবে অপরাধমূলক কাজে জড়িত থাকেন বা সমর্থন করেন। তাঁদের সঙ্গে স্থানীয় দলীয় নেতা-কর্মীরাও এসব অপরাধে জড়িয়ে পড়েন। আর যেসব এমপি এসব কাণ্ড ঘটান, তাঁদের বিরুদ্ধে ভুক্তভোগী বা সাধারণ মানুষ ক্ষুব্ধ হলেও ভয়ে কেউ মামলা করার সাহস পান না। মামলা করতে গেলেও থানা মামলা নেয় না। কারণ এসব থানায় মামলা নিতে হলে সংশ্লিষ্ট সংসদ সদস্যের অনুমতি লাগে পুলিশের। তবে প্রতিবেদনে এটাও বলা হয়েছে, শতকরা ৫৩ দশমিক ৭ জন এমপি কিছু ইতিবাচক কার্যক্রমের সঙ্গেও যুক্ত আছেন। তাঁদের মধ্যে কয়েকজন নারী এমপি, মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ও বিরোধী দলের এমপিও আছেন।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, টিআইবির পক্ষ থেকে দেশের ৪২টি জেলার ১৪৯টি আসনের সংসদ সদস্যদের গত পৌনে চার বছরের কার্যক্রমের ওপর গবেষণা কার্যক্রম চালিয়ে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়। এ ক্ষেত্রে পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত খবরের তথ্য-উপাত্তও আমলে নেওয়া হয়। যেসব এমপির কার্যক্রমের ওপর জরিপ চালানো হয়, তাঁদের মধ্যে ১৪১ জন পুরুষ এবং আটজন নারী। তাঁদের মধ্যে সরকারদলীয় এমপি ১৩৬ জন এবং বিরোধী দলের ১৩ জন। তাঁদের ২৭ জন আবার মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী পদমর্যাদার।
যে ১৪৯ জন এমপির ওপর গবেষণা চালানো হয়, তাঁদের মধ্যে বিরোধী দলের পাঁচজন এবং সরকারি দলের একজন নারী সদস্য ছাড়া সবার বিরুদ্ধেই নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত থাকার কথা টিআইবির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে স্পষ্ট হয়ে ওঠে, বিরোধী দল ও মহিলা সংসদ সদস্যরাও নেতিবাচক কার্যক্রমে পিছিয়ে নেই।
সংবাদ সম্মেলনের সময় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন টিআইবির সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার শাহজাদা এম আকরাম। এ সময় টিআইবির চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল ও ট্রাস্টি হাফিজ উদ্দিন খান উপস্থিত ছিলেন। টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, 'সংসদ সদস্যরা তাঁদের পদকে একটি লাভজনক আয়ের উৎস হিসেবে গণ্য করেন। ফলে তাঁদের মূল দায়িত্ব আইন প্রণয়নের বাইরে তাঁরা নেতিবাচক কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়ছেন।' তিনি জানান, প্রতিবেদনটি তৈরি করতে নবম সংসদের শুরু (জানুয়ারি ২০০৯) থেকে ২০১২ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সংসদ সদস্যদের কার্যক্রম পর্যালোচনা করা হয়েছে। এ সময় এমপিদের আইনবহির্ভূত বিভিন্ন কর্মকাণ্ড ও অনিয়মের ওপর গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদও বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল বলেন, 'আইনবহির্ভূত কর্মকাণ্ড, ক্ষমতার অপব্যবহার ও অনিয়মে জড়িয়ে পড়া এবং অনেক ক্ষেত্রে যথাযথ আইনি ব্যবস্থার অনুপস্থিতির কারণে সংসদ সদস্যদের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছে।'
সংবাদ সম্মেলনে শাহজাদা এম আকরাম বলেন, 'সংসদ সদস্যদের ওপর প্রচলিত ধারণা কিংবা গুজবের ভিত্তিতে নয়, বরং প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে তথ্য সংগ্রহ করে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে।'
নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের ধরন : টিআইবির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, এমপিদের অপরাধের ধরনের মধ্যে রয়েছে হত্যা, সরকারি খাসজমি-নদী-খাল-জলমহাল-পুকুর দখল, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, প্রতারণা প্রভৃতি। প্রতিবেদনে মোট ছয়টি ছকে নেতিবাচক কার্যক্রমের ধরন উল্লেখ করা হয়। এমপিদের অন্যান্য নেতিবাচক কাজের মধ্যে রয়েছে উন্নয়ন বরাদ্দের অপব্যবহার, উন্নয়ন বরাদ্দ তদারক না করা, পারিবারিক ও ব্যক্তিগত সুবিধা নেওয়া, উন্নয়ন বরাদ্দে দলীয় লোকদের প্রাধান্য দেওয়া, ভুয়া প্রকল্পের নামে বরাদ্দ নেওয়া, টিআর-কাবিখা-কাবিটা বিতরণ ও ত্রাণ কার্যক্রমে দুর্নীতি-অনিয়ম করা প্রভৃতি।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ৭৮.৭ শতাংশ সংসদ সদস্য স্থানীয় উন্নয়ন বরাদ্দ থেকে কমিশন নিয়ে থাকেন। এই কমিশনের হার কমপক্ষে ৫ শতাংশ। অস্তিত্বহীন বাঁধ, শিক্ষা-ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও রাস্তা পুনর্নির্মাণের নামে বরাদ্দ নিয়েও লুটপাটের ঘটনা ঘটান তাঁরা। অন্যদিকে ৭১.৭ শতাংশ এমপি নিজের বা ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজন বা অন্যের লাইসেন্স ব্যবহার করে ঠিকাদারি ব্যবসা পরিচালনা করেন। পৌরসভা, সিটি করপোরেশন, পানি উন্নয়ন বোর্ড, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর, সড়ক ও জনপথ, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন স্থানে তাঁরা ঠিকাদারি কাজ পরিচালনা করেন। রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করে দরপত্র কিনতে বাধার সৃষ্টি করান বা সমঝোতার মাধ্যমে কাজ বণ্টন করে থাকেন। অনেক ক্ষেত্রে কমিশনের বিনিময়েও ঠিকাদারি কাজের কার্যাদেশ দেওয়া হয়। এ ছাড়া এসব এমপি রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে প্রকল্প অনুমোদন করান। নিজে বা ঘনিষ্ঠজনকে দিয়ে ৮৯ শতাংশ প্রকল্পের বাস্তবায়নকাজ নিয়ন্ত্রণ করেন।
সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দলীয়ভাবে প্রার্থী মনোনয়নের বিধান না থাকলেও এমপিরা মৌখিকভাবে প্রার্থী মনোনয়ন দেন। এ মনোনয়নে অনেক ক্ষেত্রেই অর্থের লেনদেন হয়। যাঁদের মৌখিকভাবে সমর্থন বা মনোনয়ন দেন, নির্বাচনের সময়ও এমপিরা তাঁদের পক্ষে প্রভাব বিস্তার করেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, অনেক এমপিই মিথ্যা তথ্য দিয়ে বা তথ্য গোপন করে সরকারি প্লট বরাদ্দ নিয়েছেন। ঢাকা শহরে নিজের বা স্ত্রীর নামে এক বা একাধিক জমি বা ফ্ল্যাট থাকা সত্ত্বেও মিথ্যা হলফনামার ভিত্তিতে তাঁরা প্লট বরাদ্দ পেয়েছেন। উত্তরা সম্প্রসারিত তৃতীয় প্রকল্প ও পূর্বাচল উপশহর প্রকল্পেও এ রকম ঘটনা ঘটেছে।
এ ছাড়া এমপিরা স্থানীয় পর্যায়ের প্রশাসনিক কার্যক্রমে প্রভাব সৃষ্টি করেন। টাকার বিনিময়ে বা নিজস্ব ব্যক্তিকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ ও বদলির ঘটনা ঘটান। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কমিটি নিয়ন্ত্রণ, পছন্দের সদস্যকে কমিটিতে অন্তর্ভুক্তি, শিক্ষক নিয়োগ, কমিশনের বিনিময়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্তি এবং শিক্ষক লাঞ্ছনার মতো ঘটনাও এসব এমপি ঘটিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ৮১ শতাংশ এমপি প্রশাসনিক কাজে প্রভাব বিস্তার, ৭৭ শতাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ, ৭৫ শতাংশ উন্নয়ন বরাদ্দের অপব্যবহার, ৭০ শতাংশ অপরাধমূলক কার্যক্রম, ৬৯ শতাংশ সরকারি ক্রয়-সংক্রান্ত সিদ্ধান্তে প্রভাব বিস্তার, ৬২ শতাংশ নির্বাচনী আইন লঙ্ঘন ও ৮ শতাংশ মিথ্যা তথ্য দিয়ে প্লট বরাদ্দ নিয়েছেন।
প্রতিবেদনে সংসদ সদস্যদের কার্যক্রমে সন্তুষ্টির মাত্রাবিষয়ক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ৬৮ শতাংশ এমপির কার্যক্রমের সন্তুষ্টির স্কোর ৫-এর নিচে (সর্বনিম্ন ১ থেকে সর্বোচ্চ ১০ ধরে)। আর ৩.৩৬ শতাংশ সদস্যের এই স্কোর সাড়ে ৭-এর ওপরে।
এসবের কারণ হিসেবে গণতান্ত্রিক চর্চা না থাকা ও শাস্তি না হওয়ার সংস্কৃতিকে প্রতিবেদনে দায়ী করা হয়। কারণ নেতিবাচক কর্মকাণ্ডে জড়িত এমপিদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। দল থেকেও তিরস্কার বা বহিষ্কার করা হয় না। এ ছাড়া 'বিজয়ীরাই সব কিছু ভোগ করবে' মানসিকতা থাকাও এ অবস্থার অন্যতম কারণ হিসেবে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
প্রতিবেদনে কিছু সুপারিশও তুলে ধরা হয়। এর মধ্যে রয়েছে নেতিবাচক কার্যক্রমের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া, এমপিদের আর্থিক ও অন্যান্য তথ্য নিয়মিত প্রকাশ, স্থানীয় পর্যায়ে নিয়মিত জনগণের মুখোমুখি করা, সংসদে কার্যকর অংশগ্রহণ বাড়ানো, উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাস্তবায়নপ্রক্রিয়া থেকে তাঁদের সরিয়ে আনা, সংসদে একটানা সাত দিনের বেশি অনুপস্থিত থাকা নিষিদ্ধ করা ও বিরোধী দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা, ডেপুটি স্পিকার বিরোধী দল থেকে নির্বাচন করা, দলের বিপক্ষে ভোট দেওয়ার সুযোগ তৈরি করা এবং নিজ দল থেকে স্পিকারের পদত্যাগ করার বিধান থাকা ইত্যাদি।
টিআইবির এ প্রতিবেদন সম্পর্কে জানতে চাইলে জাতীয় সংসদের স্পিকার অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'এটা আমার কোনো বিষয় না। এ বিষয়ে আমি কোনো মন্তব্য করতে চাই না। আমার জেলায় ছয়জন সংসদ সদস্য আছেন। আমি জানি, তাঁরা প্রত্যেকেই ভালো।'
আর ডেপুটি স্পিকার কর্নেল (অব.) শওকত আলীর কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেছেন, 'টিআইবির প্রতিবেদনটি দেখার পর মন্তব্য করতে পারব।'
No comments