শ্রদ্ধাঞ্জলি- মহীয়সী এক নারীর কথা by নীরু শামসুন্নাহার

আজ অধ্যাপক ডা. জোহরা বেগম কাজীর জন্মশতবার্ষিকী। ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ ভারতের মধ্য প্রদেশের রাজনানগাঁওয়ে ১৯১২ সালের ১৫ অক্টোবর তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর আদি পৈতৃক নিবাস বাংলাদেশের মাদারীপুর জেলার কালকিনি থানার গোপালপুর গ্রামে।


‘ব্রিটিশ খেদাও’ আন্দোলনের পুরো সময়টাতে মহাত্মা গান্ধী প্রতিষ্ঠিত সেবাশ্রম ‘সেবাগ্রাম’-এ মানবতাবাদী পিতা ডা. কাজী আব্দুস সাত্তারের কর্মস্থলে তাঁর শৈশব-কৈশোর কাটে। ডা. কাজী আব্দুস সাত্তার ছিলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনার অধিকারী একজন আধুনিক মানুষ। মা আঞ্জুমান নেসা ছিলেন খুব সাদাসিধে কর্মিষ্ঠ এক নারী। তিনি রায়পুর পৌরসভার প্রথম মহিলা কমিশনার নিযুক্ত হয়েছিলেন। ভারতবর্ষকে ভাগ করে পাকিস্তান নামক মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোর বিরোধী মৌলানা আবুল কালাম আজাদের আদর্শের প্রতি তাঁর পিতার পূর্ণ সমর্থন ছিল। মানুষে মানুষে ভেদাভেদের রাজনীতিতে তিনি বিশ্বাসী ছিলেন না। ফলে সমকালীন ধর্মনিরপেক্ষ মানবতাবাদী রাজনৈতিক মূল্যবোধ গ্রন্থিত হতে থাকে অসাধারণ বুদ্ধিদীপ্ত কিশোরী জোহরার মানবিক বোধ ও চেতনায়। ডা. জোহরা বেগম কাজীর মেধা-মননে ধীরে ধীরে রূপ পেতে থাকে ভবিষ্যতের আধুনিক চিন্তা-চেতনাসমৃদ্ধ কর্মিষ্ঠ এক চিকিৎসাবিজ্ঞানী। রাজনানগাঁওয়ের রানি সূর্যমুখী প্রতিষ্ঠিত মেয়েদের টোল ‘পুত্রিশালায়’ ডা. জোহরার হাতেখড়ি হয়। পড়ালেখায় ছিলেন খুব তুখোড়। ক্লাসে সব সময় প্রথম হতেন। ১৯২৯ সালে তিনি আলীগড় মুসলিম মহিলা মহাবিদ্যালয় থেকে কলেজের পড়া শেষ করেন। দিল্লির লেডি হার্ডিং মেডিকেল কলেজ ফর ওমেন থেকে প্রথম বাঙালি মুসলিম ছাত্রী হিসেবে ১৯৩৫ সালে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করে এমবিবিএস পাস করেন।
ব্রিটিশ খেদাও আন্দোলনের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে মহাত্মা গান্ধীর প্রত্যক্ষ স্নেহচ্ছায়ায় বেড়ে ওঠা জোহরা বেগম কাজীর চিকিৎসাশাস্ত্রে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ শেষে কর্মজীবনের সূত্রপাত হয় গান্ধী সেবাশ্রমে।
সাতচল্লিশ-পরবর্তী সময়কাল মানবকল্যাণমূলক সমাজ গঠন-প্রক্রিয়ার একটা উল্লেখযোগ্য সময়। এই কালপর্বটিকে বাংলাদেশের চিকিৎসাবিজ্ঞান শাস্ত্রের গঠনপর্ব বললে অত্যুক্তি হবে না। ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের রূপরেখা নির্মাণের সেই অসাধারণ কালপর্বে চিকিৎসাশাস্ত্রে বাঙালি নারী চিকিৎসকদের অগ্রপথিক মানবতাবাদী, সমাজ-সংস্কারক যেসব নারীর নাম সর্বাগ্রে সবার মানসপটে ভেসে ওঠে, তাঁদের মধ্যে জোহরা বেগম কাজী একজন। ১৯৪৮ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে যোগদান করেই স্ত্রীরোগ ও ধাত্রীবিদ্যা বিভাগটি গড়ে তোলেন। গর্ভবতী মায়েরা যাতে হাসপাতালে এসে চিকিৎসাসেবা নিতে পারেন, সে জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তিনিই প্রথম নারীদের পৃথকভাবে চিকিৎসা দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। মিটফোর্ড মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তিনি গাইনোকোলজি বিভাগের প্রধান ও অনারারি প্রফেসর ছিলেন।
পশ্চাৎপদ নারীসমাজের জাগরণে বিশেষ করে চিকিৎসাশাস্ত্রে নারীদের উচ্চশিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্র প্রস্তুত করার অনন্যসাধারণ ভূমিকা পালন করেন জোহরা বেগম কাজী। আজ ডা. কাজী প্রদর্শিত আদর্শের পথে অগ্রসর হয়ে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে অসংখ্য নারী তাঁদের অসাধারণ ভূমিকা পালন করে চলেছেন। জীবনের প্রাথমিক কালপর্ব থেকে শুরু করে সময়ের ধারাপাতে কর্মমুখর জীবনে মহাত্মা গান্ধী ও তাঁর পত্নী কন্তুরাবার অশেষ স্নেহধন্য জোহরা কাজী পরবর্তীকালে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, কবি কাজী নজরুল ইসলাম, কমরেড মুজাফ্ফর আহমদ, ডা. কাজীর অগ্রজ অধ্যাপক কাজী আশরাফ মাহমুদ, অনুজা ডা. শিরিন কাজী, অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেন, মহাত্মা গান্ধীর অনুসারী কংগ্রেসের অন্যতম কর্মী ডা. সুশীলা নায়ার প্রমুখ মানবতাবাদী সংগ্রামী মানুষের সান্নিধ্য লাভ করেছেন।
ভাষা আন্দোলনে তাঁর সক্রিয় ভূমিকা প্রমাণ করে যে তিনি শুধু একজন চিকিৎসকই ছিলেন না; মাতৃভূমি, মাতৃভাষার প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ সেই আগুনঝরা দিনগুলোর সক্রিয় আন্দোলনকারীদের একজন হিসেবেই নিজেকে যুক্ত করেছিলেন। একজন ইতিহাস-সচেতন মানুষ হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে গেছেন। তাঁর কাছে মহাত্মা গান্ধীর লেখা ব্যক্তিগত পত্র সুদীর্ঘ সময় ধরে অত্যন্ত সযতনে স্মৃতি-স্মারক হিসেবে রক্ষা করেছিলেন। বাংলাদেশের সামাজিক-সাংস্কৃতিক ইতিহাস বিনির্মাণে এটি একটি অত্যন্ত মূল্যবান দলিল। ২০০১ সালের ১১ জুলাই অধ্যাপক কাজী তাঁর কাছে গচ্ছিত মহাত্মা গান্ধীর ব্যক্তিগত ঐতিহাসিক পত্র, ভাইসরয় পদক, সনদসমূহ এবং আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্মৃতি-স্মারক জাতীয় জাদুঘরকে সংরক্ষণের জন্য উপহার হিসেবে দান করেন। জাদুঘর ও অধ্যাপক কাজীর মধ্যে যোগসূত্র হিসেবে ক্ষুদ্র ভূমিকা পালন করে নিজেকে ধন্য মনে করি।
বিভিন্ন সংগঠন তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়ে অসংখ্য পদকে ভূষিত করে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য রোকেয়া পদক, বিএমএ স্বর্ণপদক। ২০০৮ সালে সরকার জোহরা কাজীর আজীবন সামগ্রিক অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁকে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পদক একুশে পদক (মরণোত্তর, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০০৮) প্রদানে সম্মানিত করে।
২০০৭ সালের ৭ নভেম্বর ৯৫ বছর বয়সে এই মহাপ্রাণ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
নীরু শামসুন্নাহার

No comments

Powered by Blogger.