সংকট উন্মোচনে প্রশ্নের উৎপত্তি by এম আবদুল হাফিজ

রহস্যের জট খোলার পরিবর্তে তা আরও ঘনীভূত হওয়ার বাস্তবতাই প্রত্যক্ষ করতে হলো শেষ পর্যন্ত, যখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তার অনিচ্ছায় এবং অজান্তেই খুব সম্ভবত একজন নয়, কতিপয় জজ মিয়ার উৎপত্তি ঘটালেন ৯ অক্টোবর সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচনে আহূত সংবাদ সম্মেলনে।


উলি্লখিত সম্মেলনে সাংবাদিকদের সঙ্গে তার মিথস্ক্রিয়ায় মনে না হয়ে পারেনি যে, কোনো মহল থেকে তার ওপর যে ভার চাপানো হচ্ছিল তা থেকে মুক্ত হতে তিনি চেষ্টা করছেন। একটি গোঁজামিলের মধ্য দিয়ে সত্বর সম্মেলনটি শেষ করলেও তিনি পশ্চাতে রেখে গেলেন নতুন-পুরনো অনেক প্রশ্ন। আমাদের দেশের মাপকাঠিতে তিনি মেধাগতভাবে ও যোগ্যতায় একজন নক্ষত্র মন্ত্রী। কিন্তু যে কোনো সরকারেই যে কোনো মন্ত্রী বা রাজনীতিকের দলের ভালোমন্দ সব কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। এই সম্মিলিত কর্মকাণ্ডে বা নীতিতে তিনি বিচ্ছিন্নভাবে কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেন না_ তা ইতিবাচকই হোক বা নেতিবাচক। এটিই এ দেশের রাজনীতির ট্র্যাজেডি।
কে জানে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হয়তো নতুন কোনো ইস্যুতে সেই দক্ষতার পরিচয় দেবেন। কিন্তু সাগর-রুনি হত্যা রহস্য উন্মোচনে তার উদ্যোগ এ পর্যন্ত সফল হয়নি। তো কী হয়েছে?
কেউ তো কিছু করতে পারবে না বা করতেও যাচ্ছে না তার এই ব্যর্থতায়। কি-ইবা শক্তি আছে সাংবাদিক সম্প্রদায়ের জন্য এর কোনো বিহিত করতে। এর আগে গত আট মাসেও বা তারা কী করতে পেরেছে, প্রেস ক্লাবের সম্মুখে কিছু বক্তব্য-বিবৃতি দেওয়া ব্যতিরেকে। তাতে কিছু যায় আসে না স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বা সরকারের। হলমার্কের দুর্নীতি আছে, ডেসটিনির বিষফোঁড়া আছে, সর্বোপরি পদ্মা সেতুতে দুর্নীতি না হওয়া প্রমাণের অগি্নপরীক্ষা।
সাগর-রুনি এই নশ্বর পৃথিবী থেকে বিদায় হয়েছেন। তাদের তো কোনো পার্থিব শক্তি আর ফিরিয়ে আনতে পারবে না। কিন্তু সাগর-রুনির ভাগ্য তো অন্যকেও বরণ করতে হতে পারে। তাই সবার মধ্যেই একটি চাঞ্চল্য, একটি কৌতূহল যে, কোন অপরাধে একজনকে সাগর-রুনির ভাগ্য বরণ করতে হয়। এখানেই এই প্রয়াত সাংবাদিক দম্পতির প্রাসঙ্গিকতা। আর যদি সাধারণ মানুষের প্রসঙ্গ টানা যায়, সেখানেও রয়েছে এক প্রতিকারহীন অসহায়ত্ব। আর যদি নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসানোর কথা ভাবা হয়, এখানেও রয়েছে বিবেকের রক্তচক্ষু। এ জন্যই কি মনুষ্য জাতিকে সৃষ্টির সর্বশ্রেষ্ঠ অভিহিত করা হয়েছে? আমরা এখন কোন দিকে যাব?
জাতির জীবনে যখন আজকের মতো অন্ধকার ঘনিয়ে আসে, অনেক কিছুই দৈবের হাতে ছেড়ে দেওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। এক অদৃশ্য অলৌকিকতা নির্ধারণ করে যে, আমরা এখন কোন দিকে যাব। একটি হাল ভাঙা নৌকাও তো ভাসতে ভাসতে কূলে ভেড়ে। আমাদের এখন সেই দশা। নানা খাতে আমরা হয়তো আশাবাদ সঞ্চারে বিভিন্ন উপকরণের জন্ম দিতে পারি, কিছু অঞ্চলের বা কিছু পরিবারের বা কিছু ব্যক্তির দৈন্যদশা থেকে সৌভাগ্যে উপনীত হওয়া দেখিয়ে, কিন্তু সামষ্টিকভাবে তা কি আমাদের অগ্রাভিযাত্রায় সত্যিই কোনো সহায়তা করে? বিশেষ করে যেখানে জ্ঞাত-অজ্ঞাত দুর্নীতিবাজদের নানা আঙ্গিকে উপস্থিতি প্রকট। সেখানে কোনো ইতিবাচক অলৌকিকতার উদ্ভবও সুদূরপরাহত।
সংবাদপত্রেই দেখলাম, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রয়াত সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনিকে নিয়ে অস্পষ্টতা ও বিভ্রান্তিই ছড়ালেন, এড়িয়ে গেলেন অনেক প্রশ্ন এবং সেই প্রক্রিয়ায় সৃষ্টি হলো আধা ডজনের মতো জজ মিয়া। তাদের ভাগ্যে কী জুটবে? তাদের কোনো স্বজনের কি কিছু মাসোয়ারার ব্যবস্থা হবে? সাগর-রুনিদের পারিবারিক বন্ধু তানভীরের কী হবে, যাকে প্রয়াত সাংবাদিক দম্পতির স্বজনরা কেউ চেনে না বা দেখেনি।
যখন একটি জাতি একাধিক কারণে পচনের দিকে অগ্রসর হয়, জাতি চাইলে সম্মিলিতভাবে সেই পচন ঠেকাতে বিশোধনের যুদ্ধ ঘোষণা করতে পারে। ভালো হোক, মন্দ হোক_ তার এক ফলাফল দেখার আশা পূরণও হতে পারে। কিন্তু গোঁজামিলে তেমন কিছু অর্জিত হয় না। গোঁজামিল দিতে গিয়ে অনেক মিথ্যার আশ্রয় নেওয়া ছাড়াও অনেক কল্পকাহিনী তৈরিতে প্রয়াস পেতে হয়। ভালো হয় একটি নির্ভেজাল সত্যের উন্মোচন, তা সাময়িকভাবে সরকারের জন্য যতই নেতিবাচক হোক না কেন।
দেশের সর্বত্র দীর্ঘস্থায়ী ক্ষত এবং সেগুলো শুকানোর পরিবর্তে দীর্ঘায়িতই হবে। অন্তত এ দেশের নেতা-নেত্রীদের মেজাজে সেই প্রবণতাই লক্ষ্য করা যায়। সাগর-রুনি ইদানীং প্রায় হিমাগারে নিক্ষিপ্ত হওয়ার দশা হয়েছিল। মহীউদ্দীন খান আলমগীর সেই অবস্থা থেকে বহুল আলোচিত এই হত্যাকে আলোচনায় তুলে এনেছেন। সেভাবে দেখলে এটা তার কৃতিত্ব। সেই কৃতিত্ব আরও উজ্জ্বল হবে যদি তিনি তার মেধার বলে বিষয়টিকে আরও তদন্ত বা যেভাবেই হোক একটি পরিণতিতে পেঁৗছাতে সক্ষম হন।

ব্রিগেডিয়ার (অব.)এম আবদুল হাফিজ :সাবেক মহাপরিচালক বিআইআইএসএস ও কলাম লেখক
 

No comments

Powered by Blogger.