মোবাইল কোর্ট-সহজ বিচার, দ্রুত প্রতিকার by মোহাম্মাদ মুনীর চৌধুরী

মোবাইল কোর্ট এ দেশের বিচার প্রক্রিয়ার অবিচ্ছিন্ন অংশ। ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থার অপরিহার্য অংশ। সমাজে ঘটে যাওয়া অনেক অপরাধের প্রতিকার পেতে আদালতের দ্বারস্থ হওয়া সম্ভব হয় না। বাংলাদেশে আইন আছে প্রচুর, কিন্তু প্রয়োগ কম।


অনেক আইন আলোর মুখ দেখেছে মোবাইল কোর্টের ভূমিকায়। বিশেষ করে খাদ্যে ভেজাল ও দূষণ রোধে মোবাইল কোর্টের ভূমিকা বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করেছে। এ ছাড়া বেপরোয়া পরিবেশ দূষণ থামাতে প্রতিদিন হস্তক্ষেপ করছেন মোবাইল কোর্ট। বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানি চোরদের মোবাইল কোর্ট প্রতিনিয়ত শাস্তি দিচ্ছেন। নতুন অপরাধ জগৎ ইয়াবার আস্তানায় হানা দিচ্ছেন মোবাইল কোর্ট। সাগর ও নদীবক্ষে নির্বিচারে জাটকা ইলিশ নিধন বন্ধে সদাতৎপর মোবাইল কোর্ট। নদী দখলদারদের উচ্ছেদ করছেন মোবাইল কোর্ট। নিত্যপণ্যের বাজারে আকস্মিক হাজির হচ্ছেন মোবাইল কোর্ট। এভাবে সমাজজুড়ে নানা মাত্রার অপরাধ নির্মূলে মোবাইল কোর্টের ক্লান্তিহীন অভিযান চলছে।
নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের বিচার ক্ষমতা ও কার্যপরিধি অনেক সীমিত। তথাপি মোবাইল কোর্টের নিরবচ্ছিন্ন অভিযান আইনের শাসন নিশ্চিতকরণে ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে। অনেক সরকারি দফতরের কর্মকাণ্ডে গতি এসেছে মোবাইল কোর্টের কার্যকর ভূমিকায়। দৃষ্টান্তস্বরূপ, বিএসটিআইকে সক্রিয় ও জনমুখী করেছেন মোবাইল কোর্ট। খাদ্য ও আবশ্যকীয় পণ্যমান সম্পর্কিত আইনের প্রয়োগ ও প্রচার সম্ভব হয়েছে মোবাইল কোর্টের তৎপরতায়। এতে বিএসটিআইর সক্ষমতা বেড়েছে অনেক। একই পথ ধরে পিডিবি, ডেসা, পরিবেশ অধিদফতর, রেলওয়ে, রাজউক, সিটি করপোরেশন, ওয়াসা, বন্দর কর্তৃপক্ষ, তিতাস গ্যাস, বাখরাবাদ গ্যাসসহ সরকারের অনেক বিভাগ মোবাইল কোর্টের আইনি ছায়াতলে শক্তিশালী হয়েছে।
বাংলাদেশে মোবাইল কোর্টের প্রয়োগ শুরু হয়েছিল জেলা প্রশাসক বা জেলা ম্যাজিস্ট্রেটদের হাতেই। ৭০ থেকে ৯০-এর দশক পর্যন্ত মোবাইল কোর্টের কার্যক্রম ছিল অনেক সীমিত। কিন্তু নিত্যনতুন অপরাধ দমনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় মোবাইল কোর্টের কার্যক্রম বিস্তৃত হয় ২০০৫ সাল থেকে। মোবাইল কোর্ট অপরাধীর ত্রিমাত্রিক শাস্তি নিশ্চিত করে। আর্থিক (জরিমানায় অর্থনৈতিক ক্ষতি), শারীরিক (কারাদণ্ডে কষ্টভোগ) ও মনস্তাত্তি্বক (সামাজিক নিন্দায় মানসিক পীড়ন) শাস্তির মাধ্যমে মোবাইল কোর্টের বিচার প্রক্রিয়া অনন্য। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা প্রাকৃতিক দুর্যোগে (ঝড়, বন্যা ইত্যাদি), রাজনৈতিক দুর্যোগে (আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায়) এবং সামাজিক দুর্যোগে (খাদ্যে ভেজাল, জনদুর্ভোগ) উপস্থিত থাকেন জনগণের পাশেই। মোবাইল কোর্ট শুধু বিচার প্রক্রিয়া নয়; এখানে সুসমন্বয় ও দক্ষ ব্যবস্থাপনার বিষয়টিও অপরিহার্য। মোবাইল কোর্টে সমন্বিতভাবে কাজ করেন পুলিশ, র‌্যাব ও সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সরকারি দফতর। সবারই যৌথ তৎপরতা ও শ্রমের ফসল মোবাইল কোর্ট। কিন্তু অপরাধ আমলে এনে বিচারিক সিদ্ধান্ত প্রদানের কঠিন দায়িত্বটি পালন করেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা। বয়সে তরুণ হলেও বিচারিক, প্রশাসনিক জ্ঞান-বুদ্ধি ও কৌশল প্রয়োগে তারা অতি দক্ষ। পাইলট হিসেবে মোবাইল কোর্টের মূল কাণ্ডারি তারাই। সমাজের রল্প্রেব্দ রল্প্রেব্দ নানা অসঙ্গতি, অপরাধ ও অনৈতিকতার বিচিত্র ঘটনা এই তরুণ ম্যাজিস্ট্রেটরাই উদ্ঘাটন করেছেন। তাদের অভিযান অপরাধীদের ভীত করেছে, নাগরিকদের আশ্বস্ত করেছে এবং ভুক্তভোগীদের প্রশান্তি দিয়েছে। একদিকে জনসমক্ষে অপরাধ উদ্ঘাটন ও অপরাধীর প্রকাশ্য বিচার, অন্যদিকে অনুঘটক হয়ে অপরাধীর বিরুদ্ধে জনসচেতনতা সৃষ্টি_ এই ত্রিমাত্রিক ভূমিকা নিয়ে মোবাইল কোর্টের ম্যাজিস্ট্রেটরা রোল মডেল হিসেবে কাজ করায় দেশজুড়ে একটা সামাজিক আন্দোলন সৃষ্টি হয়েছে। যেমন খাবারে ভেজালের প্রকৃতি, মাত্রা, ভয়াবহতা এবং স্বাস্থ্যগত প্রভাব ও পরিণতি সম্পর্কে নাগরিকরা অনেক বেশি সতর্ক ও সচেতন হয়েছে। তবুও ম্যাজিস্ট্রেটরা থেমে নেই, বসে নেই, দমে নেই। নিজ দফতরে প্রশাসনিক কাজের চরম ব্যস্ততা, আবার মাঠে ক্লান্তিহীন অপরাধ দমন অভিযান। এভাবেই যুগপৎ প্রশাসনিক ও বিচারিক দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা অর্জন করে এ কর্মকর্তারা পরে রাষ্ট্রযন্ত্রের উচ্চতর সোপানে আরোহণ করেন। মানুষের খুব কাছে পেঁৗছে অনেক নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট জনগণের অসাধারণ ভালোবাসার পাত্রও হয়েছেন। জনমানুষের এ অফুরন্ত ভালোবাসা অর্জনই মোবাইল কোর্টের বড় প্রাপ্তি এবং সার্থকতা।
নাগরিক জীবনের অপরিহার্য অনুষঙ্গে পরিণত এ মোবাইল কোর্ট কয়েকটি কাজে এত জনপ্রিয় হয়েছেন যে, নাগরিকদের মুখে সতত দাবি উচ্চারিত হচ্ছে_ মোবাইল কোর্ট যেন বন্ধ না হয়। সমাজের রল্প্রেব্দ রল্প্রেব্দ ভেজাল, নকল, অপরাধ ও অনাচারের ঘটনাগুলো উদ্ঘাটিত এবং অনেক ক্ষেত্রে প্রশমিত হয়েছে মোবাইল কোর্টের শুদ্ধি অভিযানে। মোবাইল কোর্টে ধৃত অপরাধীরা অন্যায় আশ্রয় নিয়ে ম্যাজিস্ট্রেটকে প্রভাবিত বা বিচারকে প্রলম্বিত করার অবকাশ পায় না। সরকারি সেবা-সম্পদ উদ্ধার এবং রক্ষায়ত্ত মোবাইল কোর্টের ম্যাজিস্ট্রেটরা এগিয়ে এসেছেন সবসময়। ম্যাজিস্ট্রেটদের ঘাম ঝরানো শ্রমের বিনিময়ে রক্ষা পেয়েছে বহু মূল্যবান সরকারি সম্পদ ও উপযোগ। কাস্টমস, ভ্যাট বা আয়কর বিভাগের কর্মকর্তাদের জন্য রয়েছে রাজস্ব আদায়ের বিপরীতে আর্থিক পুরস্কার বা প্রণোদনা। কিন্তু মোবাইল কোর্টের ম্যাজিস্ট্রেটরা কোটি কোটি টাকা রাজস্ব ও জরিমানা আদায় করলেও এর বিনিময়ে কোনো আর্থিক প্রণোদনা নেই। যাদের অকৃত্রিম আন্তরিকতা ও কঠোর শ্রমে 'সুবিচার' ও 'সুশাসন' নিশ্চিত হয়, তাদের এ অন্ধ বিরোধিতা সর্বজনগ্রাহ্য বিচার প্রক্রিয়ার প্রতি অসম্মান নয় কি? নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের কাজের স্বীকৃতি দিতে কুণ্ঠিত কিংবা মোবাইল কোর্টের স্তুতি না করলেও মন-প্রাণ দিয়ে কর্তব্য পালনের এ ধারা তারা অব্যাহত রাখবেন যুগ থেকে যুগান্তরে।
আসুন, মোবাইল কোর্টকে আর শক্তিশালী ও কার্যপরিধিকে সুবিস্তৃত করে আমরা ইতালির সেই ৭ জন ম্যাজিস্ট্রেটের মতো দৃষ্টান্ত স্থাপন করি, যাদের শুদ্ধি অভিযানে ইতালীয় সমাজে মূল্যবোধ ও শৃঙ্খলা ফিরে এসেছিল।

মোহাম্মাদ মুনীর চৌধুরী :পরিচালক (এনফোর্সমেন্ট), পরিবেশ অধিদফতর
সাবেক ম্যাজিস্ট্রেট, চট্টগ্রাম বন্দর
mmunirc@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.