জবানবন্দিতে সাংবাদিক শাহীন রেজা নূর- মুজাহিদের তত্ত্বাবধানে ও নির্দেশনায় বুদ্ধিজীবী নিধনযজ্ঞ চলে

জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গতকাল রোববার জবানবন্দি দিয়েছেন একাত্তরে শহীদ বুদ্ধিজীবী ও সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনের ছেলে শাহীন রেজা নূর।


জবানবন্দিতে তিনি বলেন, একাত্তরে আলবদর বাহিনীর কমান্ডার মুজাহিদের তত্ত্বাবধানে, পরিচালনায় ও নির্দেশনায় বুদ্ধিজীবী নিধনযজ্ঞ চলে।
বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবীরের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২-এ শাহীন রেজা নূর রাষ্ট্রপক্ষের চতুর্থ সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি দেন। তিনি দৈনিক ইত্তেফাক-এর নির্বাহী সম্পাদক। তাঁর বাবা সিরাজুদ্দীন হোসেন একাত্তরে ইত্তেফাক-এর নির্বাহী সম্পাদক ছিলেন।
আসামির কাঠগড়ায় মুজাহিদের উপস্থিতিতে শাহীন রেজা নূর জবানবন্দিতে বলেন, তাঁর বাবা ছাত্র থাকাকালে দৈনিক আজাদ-এ সাংবাদিকতা করতেন। তিনি বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বাধীন উপদলের সঙ্গে সক্রিয় ছিলেন। এ ধারাটি অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ ছিল। ১৯৫৪ সালে তিনি ইত্তেফাক-এর বার্তা সম্পাদক পদে যোগ দেন। ইত্তেফাক সোহরাওয়ার্দীর ভাবধারার ধারক ও বাহক ছিল। তাই এ পত্রিকায় অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক ও প্রগতিবাদী চিন্তা-চেতনা প্রচারিত হতো। তাঁর বাবা এ ক্ষেত্রে বলিষ্ঠ ও মুখ্য ভূমিকা পালন করেন।
রাষ্ট্রপক্ষের এই সাক্ষী বলেন, একাত্তরের সেপ্টেম্বর মাসে তাঁর বাবা বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক নিবন্ধ লেখেন। এগুলোর মধ্যে ‘ঠগ বাছিতে গাঁ উজাড়’ নিবন্ধটিতে তিনি প্রকারান্তরে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী ও তাদের সমর্থকদের সমালোচনা করেন। ১৬ সেপ্টেম্বর জামায়াতের মুখপত্র দৈনিক সংগ্রাম-এ ‘অতএব ঠগ বাছিও না’ শিরোনামে একটি পাল্টা নিবন্ধ ছাপা হয়। এতে সিরাজুদ্দীন হোসেনকে ‘ভারতীয় দালাল’, ‘ব্রাহ্মণ্যবাদের দালাল’ প্রভৃতি শব্দ প্রয়োগ করে আক্রমণ করে রীতিমতো হুমকি দেওয়া হয়। সংগ্রাম -এ পরে ‘শিরোনামের কারচুপি’ শীর্ষক নিবন্ধে তাঁকে আবার হুমকি দেওয়া হয়।
শহীদ সিরাজুদ্দীন হোসেনের মেজ ছেলে আরও বলেন, ১০ ডিসেম্বর রাত ১২টার দিকে তাঁদের চামেলীবাগের বাসার দরজায় অনেক জোরে কড়া নাড়ার শব্দ হয়। ওই শব্দে ঘুম ভেঙে গেলে তাঁর বাবা টর্চ হাতে ঘর থেকে বের হন। কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর বাবা দরজা খুলে কাউকে দেখতে না পেয়ে দরজা বন্ধ করে দেন। পরে রাত তিনটা-সাড়ে তিনটার দিকে দরজায় আবারও কড়া নাড়ার শব্দ হয়। তিনি (সাক্ষী) জানতে চান, কে? এ সময় বাড়িওয়ালা চিকিৎসক শামসুল হুদা বলেন, ‘শাহীন, দরজা খোলো।’ তখন তাঁদের বাসায় টেলিফোন ছিল। তিনি মনে করেছিলেন, বাড়িওয়ালা হয়তো জরুরি ফোন করতে এসেছেন। তিনি দরজা খুলতেই মাঙ্কি ক্যাপ ও মাফলার দিয়ে মুখ ঢাকা পাঁচ-ছয়জন লোক বন্দুক নিয়ে ঘরে ঢুকে পড়ে। বন্দুক তাক করে তাঁরা ‘হ্যান্ডস আপ’ বললে তিনি হাত তোলেন।
শাহীন রেজা বলেন, হইচই শুনে তাঁর মা-বাবা ও অন্য ভাইদের ঘুম ভেঙে যায়। তাঁর বাবা এ সময় স্যান্ডো গেঞ্জি ও নীল লুঙ্গি পরা ছিলেন, হাতে ছিল টর্চ। বাবাকে পাঞ্জাবি দিতে মা হাত বাড়ালে ওই লোকেরা বলে ওঠে, ‘হ্যান্ডস আপ’। মায়ের হাত থেকে পাঞ্জাবি পড়ে যায়, বাবা হাত ওপরে তুলে দাঁড়ান। লোকগুলো ভাঙা উর্দুতে বাবার পরিচয় জানতে চাইলে তিনি পরিচয় দেন। তখন ওই লোকেরা তাঁর বাবাকে তাদের সঙ্গে যেতে বলে। তারা গামছা চাইলে মা একটি গামছা এনে দেন। এরপর তারা পিঠে বন্দুক ঠেকিয়ে বাবাকে নিয়ে যায়। তিনি (সাক্ষী) একটি গাড়ি চলে যাওয়ার শব্দ পান। এরপর তিনি টেলিফোনে এই ঘটনা ইত্তেফাক-এর তৎকালীন সম্পাদক মঈনুল হোসেনকে জানান। পরে মঈনুল হোসেন তাঁকে জানান, তিনি রাও ফরমান আলী, গভর্নর মালেকসহ অনেকের সঙ্গে কথা বলেছেন, কিন্তু কারা সিরাজুদ্দীন হোসেনকে অপহরণ করেছে, এ নিয়ে তাঁরা কিছু জানাতে পারেননি।
রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী বলেন, এরপর কয়েক দিন তাঁরা কয়েকজন বুদ্ধিজীবীকে ধরে নিয়ে যাওয়ার খবর পান। এঁদের মধ্যে ছিলেন সাংবাদিক নাজমুল হক, শহীদুল্লাহ কায়সার, আ ন ম গোলাম মোস্তফা, নিজামুদ্দীন আহমেদ, সেলিনা পারভীন, চিকিৎসক আবদুল আলীম চৌধুরী, ফজলে রাব্বী, অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিন আহমেদ, অধ্যাপক রাশিদুল হাসান প্রমুখ। ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের পরও অনেক খুঁজে বাবাকে পাননি। ১৮ ডিসেম্বর আমিনুল হক (সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল) তাঁকে রায়েরবাজারে যেতে বলেন, এ সময় তিনি কাঁদছিলেন। তিনি (সাক্ষী) ইত্তেফাক-এর আরও কয়েকজনের সঙ্গে রায়েরবাজারে গিয়ে বীভৎস দৃশ্য দেখেন। সেখানে সেলিনা পারভীন, ফজলে রাব্বীর লাশ গলিত অবস্থায় পাওয়া গেলেও তাঁর বাবার লাশ পাওয়া যায়নি। অনেক লাশের হাত ও চোখ গামছা দিয়ে বাঁধা ছিল।
জবানবন্দির শেষ পর্যায়ে শাহীন রেজা নূর বলেন, দেশের শীর্ষস্থানীয় কয়েকটি পত্রিকায় তখন ওয়াকিবহাল সূত্রের বরাত দিয়ে বুদ্ধিজীবীদের ঘাতকদের সংবাদ ও ছবি ছাপা হয়। বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের ‘অপারেশন ইনচার্জ’ ছিলেন আলবদর সদস্য চৌধুরী মুঈনুদ্দীন, যিনি পেশায় দৈনিক পূর্বদেশ-এর সাংবাদিক ছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে সহকর্মী আ ন ম গোলাম মোস্তফাকে অপহরণ ও হত্যার অভিযোগে মামলা হয়। আশরাফুজ্জামান খান ছিলেন মুঈনুদ্দীনের অন্যতম সহযোগী।
জবানবন্দি শেষে শাহীন রেজা নূরকে জেরা শুরু করেন আসামিপক্ষের আইনজীবী মুন্সি আহসান কবীর। পরে জেরা অসমাপ্ত অবস্থায় ১৬ অক্টোবর পর্যন্ত এ মামলার কার্যক্রম মুলতবি করা হয়।

No comments

Powered by Blogger.