বীর মুক্তিযোদ্ধা- তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না
৫৪১ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। মনির আহমেদ খান, বীর প্রতীক বীর যোদ্ধা মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে আখাউড়ার পতনের পর মনির আহমেদ খানসহ একদল মুক্তিযোদ্ধা অগ্রসর হন চান্দুরায়।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সরাইল থানার অন্তর্গত চান্দুরা। তাঁরা ছিলেন নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর এস ফোর্সের অধীন মুক্তিযোদ্ধা। এক ব্যাটালিয়ন শক্তির। তাঁদের অধিনায়ক ছিলেন ক্যাপ্টেন এ এস এম নাসিম (বীর বিক্রম)।
মুক্তিযোদ্ধাদের এ অগ্রাভিযানে সবার আগে ছিল ‘সি’ (চার্লি দল)। তাদের ওপর দায়িত্ব ছিল কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ শাহবাজপুর সেতু দ্রুত দখল করা। তাদের অনুসরণ করে ‘এ’ (আলফা) দল। সব শেষে ছিল ‘ডি’ (ডেলটা) দল। আর ‘বি’ (ব্রাভো) দল ছিল পেছনে। কাট অফ পার্টি হিসেবে তাদের ওপর দায়িত্ব ছিল অগ্রসরমাণ মুক্তিযোদ্ধাদের নিরাপত্তা বিধান করা।
এস ফোর্সের অধিনায়ক মেজর কে এম সফিউল্লাহও (বীর উত্তম, পরে সেনাপ্রধান, মেজর জেনারেল ও রাষ্ট্রদূত) সে দিন মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে ছিলেন। তিনি ছিলেন ডি দলের একাংশের সঙ্গে। তিনটি দলের মধ্যে কিছুটা দূরত্ব বিদ্যমান ছিল। মেজর সফিউল্লাহ যখন চান্দুরার কাছে ইসলামপুরে পৌঁছেন, তখন বড় ধরনের এক দুর্ঘটনা ঘটে। দুটি মিলিটারি ট্রাক হঠাৎ সেখানে উপস্থিত হয়। তাতে ছিল একদল পাকিস্তানি সেনা। এ ঘটনা ছিল অভাবিত।
এ সময় মেজর সফিউল্লাহ অগ্রসরমাণ সি দলের পেছনে খানিকটা দূরে ছিলেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন মাত্র কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা। ব্যাটালিয়ন অধিনায়ক নাসিম ছিলেন সি দলের একদম পশ্চাতে। মেজর সফিউল্লাহ তাৎক্ষণিক পাকিস্তানি সেনাদের আত্মসমর্পণের আদেশ দেন। পাকিস্তানি সেনারা হাত উঁচু করে ট্রাক থেকে নামতে থাকে। এরপর হঠাৎ তাদের কেউ কেউ দৌড় দেয় এবং বাকিরা গোলাগুলি শুরু করে। নিমেষে সেখানে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। একটু পর সেখানে হাজির হয় আরও কিছু পাকিস্তানি সেনা।
তখন মনির আহমেদ খান ও তাঁর দলের সহযোদ্ধারা ছিলেন বেশ এগিয়ে। তিনি ছিলেন সি দলে। তাঁরা ধর্মনগর-হরষপুর-পাইকপাড়া হয়ে অগ্রসর হচ্ছিলেন। তাঁরা দ্রুত পেছনে আসেন। পাকিস্তানি সেনারা প্রচণ্ড গতিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাঁদের ওপর। আক্রমণের প্রচণ্ডতায় তাঁর দলের মুক্তিযোদ্ধারা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। একটি প্লাটুন (উপদল) নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য পাশের তিতাস নদীর অপর পাড়ে চলে যায়। বাকি দুই প্লাটুনের একটি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। অক্ষত থাকে একটি প্লাটুন।
অক্ষত প্লাটুনে ছিলেন মনির আহমেদ খান। তাঁরা সাহসিকতার সঙ্গে পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণ প্রতিরোধ করেন। তাঁদের সাহস ও বীরত্বে বেঁচে যায় কে এম সফিউল্লাহর জীবন এবং শেষ পর্যন্ত পর্যুদস্ত হয় পাকিস্তানি সেনারা। সেদিন যুদ্ধে দুজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ এবং এ এস এম নাসিমসহ ১১ জন আহত হন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ২৫ জন নিহত ও ১৪ জন বন্দী হয়। এ ঘটনা ৬ ডিসেম্বর।
মনির আহমেদ খান চাকরি করতেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে। ১৯৭১ সালে প্রশিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন চট্টগ্রামের ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারে। তখন তাঁর পদবি ছিল হাবিলদার। ২৫ মার্চ রাতে নিরস্ত্র অবস্থায় আক্রান্ত হন। কৌশলে সেখান থেকে পালিয়ে যুদ্ধে যোগ দেন। চট্টগ্রামে প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে ভারতে যান। এরপর প্রথমে ৩ নম্বর সেক্টরের পঞ্চবটী সাবসেক্টরে পরে এস ফোর্সের (১১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট) অধীনে যুদ্ধ করেন।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য মনির আহমেদ খানকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ৮০।
মনির আহমেদ খান ১৯৮০ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে সুবেদার হিসেবে অবসর নেন। ২০১২ সালে মারা গেছেন। তাঁর পৈতৃক বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কসবা উপজেলার দেলী গ্রামে। তবে তিনি স্থায়ীভাবে বাস করতেন ঢাকার মিরপুরের ৩৫১ দক্ষিণ মনিপুরে (মোল্লাপাড়া)। তাঁর বাবার নাম আহমেদ খান, মা রহিমা বেগম। স্ত্রী বেনুআরা বেগম। তাঁদের এক ছেলে।
সূত্র: মেজর (অব.) ওয়াকার হাসান, বীর প্রতীক, ইমরান আহমেদ খান (মনির আহমেদ খান বীর প্রতীকের ছেলে) এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ ব্রিগেডভিত্তিক ইতিহাস।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
rashedtr@prothom-alo.info
মুক্তিযোদ্ধাদের এ অগ্রাভিযানে সবার আগে ছিল ‘সি’ (চার্লি দল)। তাদের ওপর দায়িত্ব ছিল কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ শাহবাজপুর সেতু দ্রুত দখল করা। তাদের অনুসরণ করে ‘এ’ (আলফা) দল। সব শেষে ছিল ‘ডি’ (ডেলটা) দল। আর ‘বি’ (ব্রাভো) দল ছিল পেছনে। কাট অফ পার্টি হিসেবে তাদের ওপর দায়িত্ব ছিল অগ্রসরমাণ মুক্তিযোদ্ধাদের নিরাপত্তা বিধান করা।
এস ফোর্সের অধিনায়ক মেজর কে এম সফিউল্লাহও (বীর উত্তম, পরে সেনাপ্রধান, মেজর জেনারেল ও রাষ্ট্রদূত) সে দিন মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে ছিলেন। তিনি ছিলেন ডি দলের একাংশের সঙ্গে। তিনটি দলের মধ্যে কিছুটা দূরত্ব বিদ্যমান ছিল। মেজর সফিউল্লাহ যখন চান্দুরার কাছে ইসলামপুরে পৌঁছেন, তখন বড় ধরনের এক দুর্ঘটনা ঘটে। দুটি মিলিটারি ট্রাক হঠাৎ সেখানে উপস্থিত হয়। তাতে ছিল একদল পাকিস্তানি সেনা। এ ঘটনা ছিল অভাবিত।
এ সময় মেজর সফিউল্লাহ অগ্রসরমাণ সি দলের পেছনে খানিকটা দূরে ছিলেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন মাত্র কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা। ব্যাটালিয়ন অধিনায়ক নাসিম ছিলেন সি দলের একদম পশ্চাতে। মেজর সফিউল্লাহ তাৎক্ষণিক পাকিস্তানি সেনাদের আত্মসমর্পণের আদেশ দেন। পাকিস্তানি সেনারা হাত উঁচু করে ট্রাক থেকে নামতে থাকে। এরপর হঠাৎ তাদের কেউ কেউ দৌড় দেয় এবং বাকিরা গোলাগুলি শুরু করে। নিমেষে সেখানে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। একটু পর সেখানে হাজির হয় আরও কিছু পাকিস্তানি সেনা।
তখন মনির আহমেদ খান ও তাঁর দলের সহযোদ্ধারা ছিলেন বেশ এগিয়ে। তিনি ছিলেন সি দলে। তাঁরা ধর্মনগর-হরষপুর-পাইকপাড়া হয়ে অগ্রসর হচ্ছিলেন। তাঁরা দ্রুত পেছনে আসেন। পাকিস্তানি সেনারা প্রচণ্ড গতিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাঁদের ওপর। আক্রমণের প্রচণ্ডতায় তাঁর দলের মুক্তিযোদ্ধারা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। একটি প্লাটুন (উপদল) নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য পাশের তিতাস নদীর অপর পাড়ে চলে যায়। বাকি দুই প্লাটুনের একটি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। অক্ষত থাকে একটি প্লাটুন।
অক্ষত প্লাটুনে ছিলেন মনির আহমেদ খান। তাঁরা সাহসিকতার সঙ্গে পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণ প্রতিরোধ করেন। তাঁদের সাহস ও বীরত্বে বেঁচে যায় কে এম সফিউল্লাহর জীবন এবং শেষ পর্যন্ত পর্যুদস্ত হয় পাকিস্তানি সেনারা। সেদিন যুদ্ধে দুজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ এবং এ এস এম নাসিমসহ ১১ জন আহত হন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ২৫ জন নিহত ও ১৪ জন বন্দী হয়। এ ঘটনা ৬ ডিসেম্বর।
মনির আহমেদ খান চাকরি করতেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে। ১৯৭১ সালে প্রশিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন চট্টগ্রামের ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারে। তখন তাঁর পদবি ছিল হাবিলদার। ২৫ মার্চ রাতে নিরস্ত্র অবস্থায় আক্রান্ত হন। কৌশলে সেখান থেকে পালিয়ে যুদ্ধে যোগ দেন। চট্টগ্রামে প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে ভারতে যান। এরপর প্রথমে ৩ নম্বর সেক্টরের পঞ্চবটী সাবসেক্টরে পরে এস ফোর্সের (১১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট) অধীনে যুদ্ধ করেন।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য মনির আহমেদ খানকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ৮০।
মনির আহমেদ খান ১৯৮০ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে সুবেদার হিসেবে অবসর নেন। ২০১২ সালে মারা গেছেন। তাঁর পৈতৃক বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কসবা উপজেলার দেলী গ্রামে। তবে তিনি স্থায়ীভাবে বাস করতেন ঢাকার মিরপুরের ৩৫১ দক্ষিণ মনিপুরে (মোল্লাপাড়া)। তাঁর বাবার নাম আহমেদ খান, মা রহিমা বেগম। স্ত্রী বেনুআরা বেগম। তাঁদের এক ছেলে।
সূত্র: মেজর (অব.) ওয়াকার হাসান, বীর প্রতীক, ইমরান আহমেদ খান (মনির আহমেদ খান বীর প্রতীকের ছেলে) এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ ব্রিগেডভিত্তিক ইতিহাস।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
rashedtr@prothom-alo.info
No comments