সড়ক দুর্ঘটনা : মুক্তি পাওয়ার জন্য কিছু প্রস্তাব by এম এ রশীদ

সড়ক দুর্ঘটনা এড়ানোই যখন মূল লক্ষ্য তখন প্রথমে দুর্ঘটনার কারণগুলো চিহ্নিত করতে হবে এবং সেগুলো সমাধানের উদ্যোগ নিতে হবে। দুর্ঘটনার মূল কারণ, চালকের অযোগ্যতা ও অবিমৃষ্যকারিতা। লাইসেন্স ইস্যুকারী কর্তৃপক্ষ তাদের গাড়ি চালনার যোগ্যতা কঠোরভাবে পরীক্ষা না করেই কোনো কোনো ক্ষেত্রে অর্থের বিনিময়ে লাইসেন্স প্রদান করে থাকে।


অর্থ ছাড়াও আছে চালকদের শক্তিশালী ট্রেড ইউনিয়নের কঠোর চাপ। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, চালক (ওদের ভাষায় 'ওস্তাদ') বসে বিশ্রাম নেয়, আর স্টিয়ারিং ধরিয়ে দেয় হেলপারের হাতে।
আসলে মূল সমস্যা পূর্বপরিকল্পনার অভাব। স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে সড়কপথে যাত্রীবাহী বাস, ট্রাক এবং অন্যান্য যানবাহন সংখ্যায় যে পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে, তার তুলনায় দক্ষ চালকের সংখ্যা বেড়েছে অনেক কম। এ জন্য প্রশিক্ষণের সুযোগ বাড়াতে হবে। বেসরকারি যেসব মোটর ড্রাইভিং স্কুল আছে, সেগুলোর প্রশিক্ষণকাজ তদারকি করার দায়িত্ব ইনটেনসিভ টেস্ট নিয়ে যোগ্যতা যাচাই করে তবেই লাইসেন্স ইস্যু করাটা কাম্য।
এত বিশাল কাজের দায়িত্ব সামলাতে হলে বিআরটিএকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে আরো শক্তিশালী করতে হবে। প্রয়োজনে এটাকে মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি বিভাগে উন্নীত করে বিভিন্ন কাজ সম্পাদনের জন্য ভিন্ন ভিন্ন ডিপার্টমেন্ট সৃষ্টির পর সঠিক প্রয়োজন নির্ণয় করে সুদক্ষ লোকবলের পদায়ন করা জরুরি হবে। মোটর ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ একাডেমী থাকবে ঢাকায়, অন্যান্য শহরে থাকবে ইনস্টিটিউট। বিআরটিএ বা প্রস্তাবিত বিভাগ ঢাকার একাডেমী তো পরিচালনা করবেই, ঢাকার বাইরের ইনস্টিটিউটগুলোও পরিচালনা করবে। আর বেসরকারি খাতের মোটর ড্রাইভিং স্কুলগুলোর কার্যক্রমও দক্ষভাবে সুপারভাইজ করবে।
এর পরও দুর্ঘটনা ঘটলে, তদন্তে চালক দায়ী প্রমাণিত হলে এবং দুর্ঘটনায় নিহত ও অধিকসংখ্যক আহতের ঘটনা ঘটলে তার সর্বনিম্ন শাস্তি হতে হবে আট বছর সশ্রম কারাদণ্ড। দুর্ঘটনা তদন্তে যদি প্রমাণ পাওয়া যায়, হেলপার গাড়ি চালাচ্ছিল কিংবা অনুমোদিত দ্রুততার চেয়ে অধিকতর বেগে চালাচ্ছিল কিংবা চালক প্রয়োজনীয় সময়ের বিশ্রাম না নিয়ে ঘুমকাতুরে অবস্থায় বা মাদক সেবন অবস্থায় বা মোবাইল ফোনে আলাপরত অবস্থায় গাড়ি চালাচ্ছিল কিংবা বাস বা ট্রাকটি ক্যাপাসিটির অতিরিক্ত মালামাল বা যাত্রী বহন করছিল, তাহলে সাজার মাত্রা আরো দুই বছর বৃদ্ধি করা যাবে। ইউনিয়ন থেকে যতই চাপ আসুক, সাজার মাত্রা লাঘব করা যাবে না। একদিকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষতা অর্জন, অন্যদিকে সম্ভাব্য শাস্তির ভয় চালককে দক্ষ ও সুশীল চালকে রূপান্তরিত করবে।
দুর্ঘটনার একটি মূল কারণ হলো বেপরোয়া গাড়ি চালানো। এই বেপরোয়া চালনা রোধ করার জন্য দেশব্যাপী প্রয়োজনীয় ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা কার্যকর করা সরকারের জন্য প্রশাসনিক ও আর্থিক- উভয় দিক দিয়ে ব্যয়বহুল হবে। তবু যতটা সম্ভব ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নিতে হবে। ফিটনেসবিহীন গাড়ি রাস্তায় নামালে চালকের লাইসেন্স এক মাসের জন্য স্থগিত রাখা হবে। একই সঙ্গে যানবাহনের মালিককে প্রয়োজন অনুপাতে জরিমানা করা হবে। ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলতে নিষেধাজ্ঞা বলবৎ করলে যানজটও কিছুটা হ্রাস পাবে।
শহরে দুর্ঘটনার মুখ্য একটি কারণ রাস্তায় লোকজনের অসতর্কভাবে চলাচল করা। বিভিন্ন রাস্তার সংযোগস্থলে কখন কোন দিক থেকে যানবাহন আসছে বা আসতে পারে, তা ভ্রুক্ষেপ না করেই অনেকে রাস্তা দিয়ে ইতস্তত চলাচল করে। উঠতি বয়সী কেউ কেউ মনে করে, আমার খুশিমতো রাস্তা দিয়ে চলব- ড্রাইভারের দায়িত্ব হলো ফাঁক দিয়ে গাড়ি চালিয়ে দুর্ঘটনার কবল থেকে সবাইকে রক্ষা করা। এ ব্যাপারেও কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে এবং সচেতনতা বাড়াতে হবে।
যানবাহন দুর্ঘটনার তৃতীয় প্রধান কারণ হচ্ছে সড়কপথের দুর্বলতা, ভঙ্গুরতা ও অমসৃণতা। এসব সড়ক নির্মাণকালে যানবাহনের সংখ্যা এত অধিক ছিল না। এখন যানবাহন এত বৃদ্ধি পেয়েছে যে দ্রুতবেগে গাড়ি চালালে বিদ্যমান সড়কগুলো অতি সরু মনে হয়। প্রয়োজন অনুপাতে সড়কগুলো প্রশস্ত না হওয়ায় যানবাহনের গতিবেগ বৃদ্ধি পেলে হয় 'সাইড বাই সাইড কলিশন' নতুবা মুখোমুখি সংঘর্ষ হতে দেখা যায়। এসব দুর্ঘটনার দায়িত্ব যতটা না চালকদের ওপর বর্তায়, তার চেয়ে বেশি বর্তায় রাস্তার অপ্রশস্ততা, ভঙ্গুরতা ও দুর্বলতার ওপর। কাজেই বেশির ভাগ সড়কই চার লেনে উন্নীত করা অত্যাবশ্যক। কিন্তু সেটা তো খুবই সময়সাপেক্ষ এবং ব্যয়বহুল। তবু সড়ক দুর্ঘটনার হাত থেকে নিস্তার পেতে চাইলে আমাদের ওই পথেই অগ্রসর হতে হবে।
ট্রাফিক সিগন্যাল চেকিং সিস্টেম যতটা সম্ভব দেশব্যাপী ছড়িয়ে দিতে হবে। এতে ঘুমন্ত অবস্থায় এবং হেলপার দিয়ে গাড়ি চালানো রোধ সম্ভব হবে। ট্রাফিক চেকিং ব্যবস্থা একই সঙ্গে চালকের লাইসেন্স, গাড়ির ফিটনেস, ওভারলোডিং, গাড়ির গতিবেগ নিয়ন্ত্রণ এবং লেন ও লাইন মেনে চলতে বাধ্য করতে সক্ষম হবে। খুব নিবিড় ট্রাফিক চেকিং করা হলে কিছু দুর্নীতি হতে পারে। দুর্নীতির আশঙ্কায় আমরা এই চেকিং ব্যবস্থাকে পরিহার করতে পারি না।

লেখক : সাবেক যুগ্ম সচিব ও কলামিস্ট

No comments

Powered by Blogger.