পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাজের পরিধি ছোট হচ্ছে! by রাহীদ এজাজ
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাজের পরিধি আবার সংকুচিত করার চেষ্টা চলছে। এবার বিদেশে বাংলাদেশের মিশনগুলোতে পাসপোর্ট ও ভিসা দেওয়ার কাজটি চলে যাচ্ছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হাতে। এ ছাড়া সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য খোলা হচ্ছে নতুন পাঁচটি সাংস্কৃতিক বিভাগ।
বিদেশে বাংলাদেশ মিশনগুলোতে শ্রম শাখার লোকবলও বাড়ছে দুই শতাধিক।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রশাসন অনুবিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সরকার পর্যায়ক্রমে ৬৬টি বৈদেশিক মিশনে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তথা বহিরাগমন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের বিভিন্ন শ্রেণীতে ৩৬৬টি পদ সৃষ্টির নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ ছাড়া নতুন ২১টি শ্রম শাখা চালুসহ আরও ২২৪টি পদ সৃষ্টি হচ্ছে, যেখানে জনবল নিয়োগ করবে প্রবাসীকল্যাণ ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়।
মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, পাসপোর্ট, ভিসা ও শ্রম শাখার কাজের জন্য আলাদাভাবে জনবল বাড়লেও সামগ্রিক কূটনৈতিক কর্মকাণ্ড সম্প্রসারণের জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দেওয়া জনবল বৃদ্ধির প্রস্তাবে অগ্রগতি নেই। ২০১০ সালের ২ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনুমোদিত ওই প্রস্তাবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জনবল ২৬২ থেকে বাড়িয়ে ৪৬০ করার কথা বলা হয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, কনস্যুলার, শ্রম ও সাংস্কৃতিক শাখায় নতুন পদ সৃষ্টি করা হচ্ছে। পরিবেশ কূটনীতি জোরদার করতে সম্প্রতি চারটি মিশনে পরিবেশ কাউন্সেলর নিয়োগের প্রস্তাব করেছে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়।
অনান্য মন্ত্রণালয় থেকে জনবল নিয়োগ, বিশেষ করে ভিসা ও পাসপোর্টের কাজে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাব সম্পর্কে ভিন্নমত পোষণ করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। গত ২০ সেপ্টেম্বর পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনির সভাপতিত্বে জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের এক বৈঠকে মন্ত্রণালয়ের খসড়া অবস্থানপত্র নিয়ে আলোচনা হয়। এতে বলা হয়েছে, ‘রুলস অব বিজনেস, ১৯৯৬’ ও ‘কনস্যুলার সম্পর্কবিষয়ক ভিয়েনা কনভেনশন, ১৯৬৩’ অনুসারে পাসপোর্ট ও ভিসার কাজটি কূটনৈতিক কাজেরই অংশ। তাই পাসপোর্ট ও ভিসার কাজে অতিরিক্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করা হলে তা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে করা উচিত।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওই অবস্থানপত্র সম্পর্কে ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। অন্য মন্ত্রণালয় থেকে নিয়োগ হলেও এতে যাতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ের দায়িত্ব থাকে, সে বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সম্মতি আদায়ের চেষ্টা চলছে বলে জানা গেছে।
তবে পাসপোর্ট ও ভিসার কাজে বিপুল জনবল নিয়োগের পাশাপাশি শ্রম শাখা সম্প্রসারণ নিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে যুগপৎ হতাশা ও ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। কর্মকর্তাদের মতে, আন্তর্জাতিক রীতি অনুযায়ী, পাসপোর্ট ও ভিসা দেওয়ার কাজটির সঙ্গে সেবা বা কনস্যুলারের বিষয়টি জড়িত। আর সামগ্রিকভাবে পেশাদার কূটনীতিকেরাই প্রতিটি দেশের পক্ষে কাজটি করে থাকেন। সে ক্ষেত্রে পেশাদার কূটনীতিক ছাড়া কাজটি করতে গিয়ে সমস্যা তৈরি হবে। এ ছাড়া দীর্ঘ চার দশক পরও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জনবল কাজের তুলনায় আনুপাতিক হারে বাড়েনি, বরং বিভিন্ন সময়ে অন্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা এসে কূটনীতিকদের পদগুলো দখল করেছেন। অন্য মন্ত্রণালয় থেকে লোকজন নিয়োগ এবং বিদেশ মিশনে কাজের তদারকি বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে হলে পেশাদার কূটনীতিক গড়ে তোলার কাজ ব্যাহত হবে। চূড়ান্তভাবে কূটনৈতিক দর-কষাকষিতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশ।
বর্তমানে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কর্মরত মাঝারি ও কনিষ্ঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে হতাশা রয়েছে। কারণ দেশের স্বার্থ সমুন্নত রেখে সাফল্য অর্জনের লক্ষ্যে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কোনো পেশাগত পরিকল্পনা নেই। এ ছাড়া অন্য মন্ত্রণালয় থেকে জনবল নিয়োগের মাধ্যমে কার্যত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে দুর্বল করা হচ্ছে। এসব পরিস্থিতি নিয়ে বিসিএস (পররাষ্ট্র) ক্যাডারের ২৮, ২৯ ও ৩০ ব্যাচের কর্মকর্তারা গত ৩ সেপ্টেম্বর রাতে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে অনুষ্ঠিত নৈশভোজের ফাঁকে পররাষ্ট্রসচিব মোহাম্মদ মিজারুল কায়েসের সঙ্গে কথা বলেন। মূলত নিজেদের পেশার ভবিষ্যৎ নিয়ে কনিষ্ঠ এসব কর্মকর্তা তাঁদের উদ্বেগের কথা পররাষ্ট্রসচিবকে জানান।
জানতে চাইলে সাবেক পররাষ্ট্রসচিব ফারুক সোবহান প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাংলাদেশ হচ্ছে একমাত্র দেশ, যেখানে পররাষ্ট্রনীতি মন্ত্রণালয়ের হাতে নয়, বাইরের হাতে থাকে। অন্য মন্ত্রণালয় থেকে যেসব জনবল নিয়োগ করা হয়, তাঁরা কিন্তু রাষ্ট্রদূত বা হাইকমিশনার নন, নিজ নিজ মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকেন। ফলে দূতাবাস একদিকে যায়, শাখা যায় অন্যদিকে। রাষ্ট্রদূত ও হাইকমিশনারের নিয়ন্ত্রণ এসব কর্মকর্তার ওপর থাকে না। তাই কাজে সমন্বয় হয় না।’
সাবেক পররাষ্ট্রসচিব ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বাইরে থেকে লোক নিয়োগ ও আলাদাভাবে কাজের তদারকির মাধ্যমে বিদেশে বাংলাদেশ দূতাবাসকে দুর্বল করা হয়। এই প্রবণতা থেকে বের হয়ে আসাটা জরুরি।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাব: বিদেশের বাংলাদেশ মিশনে ভিসা ও পাসপোর্টের কাজে লোকবল নিয়োগের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ২৪ জুন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি সারসংক্ষেপে সই করেন। এতে প্রবাসী আয়ের গুরুত্ব, যন্ত্রে পাঠযোগ্য পাসপোর্ট (এমআরপি) চালু, আন্তর্জাতিক বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (ইকাও) ও কূটনীতিকদের ওপর বাড়তি চাপের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়। প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ইকাওয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী, ২০১৫ সালের মার্চ মাসের মধ্যে বিদেশে বসবাসরত সব বাংলাদেশিকে এমআরপি দিতে হবে। তাই সংকট উত্তরণে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট অধিশাখা এবং বহিরাগমন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের কর্মকর্তা ও কর্মচারী, যাঁরা পাসপোর্ট ও ভিসা-সংক্রান্ত কাজে দক্ষ-অভিজ্ঞ, তাঁদের নিয়োজিত করা যায়। এ জন্য এমআরপি চালু করতে ৬৬টি বৈদেশিক মিশনে ৩৬৬টি পদ সৃষ্টির প্রস্তাব দেওয়া হয়।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবটি বাস্তবায়নে গত ৩০ আগস্ট জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে এক আন্তমন্ত্রণালয় বৈঠক হয়। এতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে কোন মিশনে কোন পদে কতজন কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ করা হবে, সেটি উত্থাপন করা হয়। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন সাপেক্ষে এসব জনবল নিয়োগের সিদ্ধান্ত হয়েছে।
এ ব্যাপারে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় খোঁড়া যুক্তি দিচ্ছে। কারণ ইকাওয়ের শর্তানুযায়ী, ২০১৫ সাল থেকে বিশ্বজুড়ে চালু হচ্ছে ই-পাসপোর্ট। তখন নতুন প্রযুক্তির মাধ্যমে আবার বিশেষায়িত এই পাসপোর্ট চালু হবে। সে ক্ষেত্রে এমআরপি ও ভিসা দেওয়ার জন্য নিয়োগ পাওয়া লোকজনের প্রয়োজনীয়তা থাকবে না। এই পরিস্থিতিতে মাত্র বছর দুয়েকের জন্য এত বিপুল পরিমাণ লোক নিয়োগের বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ।
২১ শ্রম শাখায় নতুন ২২৪ কর্মকর্তা: বাংলাদেশের মিশন রয়েছে এমন ২১টি দূতাবাস ও হাইকমিশনে শ্রম শাখা খোলার প্রস্তাব দিয়েছে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। গত ২৫ জুন এই প্রস্তাব নীতিগতভাবে অনুমোদনের পর এটি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে বিবেচনাধীন রয়েছে। ২১ মিশনের উল্লেখযোগ্য হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, রাশিয়া, জার্মানি, গ্রিস, স্পেন, সুইজারল্যান্ড, মরিশাস ও দক্ষিণ আফ্রিকা। ২১ শ্রম শাখায় ২২৪ জনবল কাঠামোর প্রস্তাব করেছে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়।
সাংস্কৃতিক শাখা খোলার অনুরোধ: সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, ইতালি ও মালয়েশিয়ায় তথ্য ও সাংস্কৃতিক শাখা এবং লন্ডন ও ওয়াশিংটনে সাংস্কৃতিক শাখা খোলার প্রস্তাব দিয়েছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি। গত বছরের ২৪ নভেম্বর সংস্কৃতিবিষয়কমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদকে লেখা চিঠিতে তিনি বলেন, বিদেশে বাংলাদেশ মিশনের কূটনৈতিক বা তথ্য শাখা তাদের নিয়মিত কাজের অংশ হিসেবে বিভিন্ন জাতীয় দিবস পালনসহ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। এতে নিয়মিত কাজের ব্যাঘাত ঘটে। কিন্তু বাংলাদেশের সংস্কৃতিকে তুলে ধরতে স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক বা তথ্য শাখা থাকা প্রয়োজন। তাঁর প্রস্তাবের আলোকে নিউইয়র্ক, লন্ডন, প্যারিস, দুবাই ও কলকাতায় সাংস্কৃতিক শাখা খোলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
সাবেক পররাষ্ট্রসচিব ফারুক সোবহান বলেন, ‘সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের লোকজন বাড়াতে হবে। কিন্তু সেটি করা উচিত পরিকল্পনা অনুযায়ী। এ জন্য পেশাগত পরিকল্পনা জরুরি। গুরুত্ব দিতে হবে ভাষা শিক্ষা, অঞ্চল ও বিষয়ভিত্তিক গুরুত্বের ভিত্তিতে সম্পর্ক উন্নয়নের ওপর।’
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রশাসন অনুবিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সরকার পর্যায়ক্রমে ৬৬টি বৈদেশিক মিশনে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তথা বহিরাগমন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের বিভিন্ন শ্রেণীতে ৩৬৬টি পদ সৃষ্টির নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ ছাড়া নতুন ২১টি শ্রম শাখা চালুসহ আরও ২২৪টি পদ সৃষ্টি হচ্ছে, যেখানে জনবল নিয়োগ করবে প্রবাসীকল্যাণ ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়।
মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, পাসপোর্ট, ভিসা ও শ্রম শাখার কাজের জন্য আলাদাভাবে জনবল বাড়লেও সামগ্রিক কূটনৈতিক কর্মকাণ্ড সম্প্রসারণের জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দেওয়া জনবল বৃদ্ধির প্রস্তাবে অগ্রগতি নেই। ২০১০ সালের ২ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনুমোদিত ওই প্রস্তাবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জনবল ২৬২ থেকে বাড়িয়ে ৪৬০ করার কথা বলা হয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, কনস্যুলার, শ্রম ও সাংস্কৃতিক শাখায় নতুন পদ সৃষ্টি করা হচ্ছে। পরিবেশ কূটনীতি জোরদার করতে সম্প্রতি চারটি মিশনে পরিবেশ কাউন্সেলর নিয়োগের প্রস্তাব করেছে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়।
অনান্য মন্ত্রণালয় থেকে জনবল নিয়োগ, বিশেষ করে ভিসা ও পাসপোর্টের কাজে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাব সম্পর্কে ভিন্নমত পোষণ করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। গত ২০ সেপ্টেম্বর পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনির সভাপতিত্বে জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের এক বৈঠকে মন্ত্রণালয়ের খসড়া অবস্থানপত্র নিয়ে আলোচনা হয়। এতে বলা হয়েছে, ‘রুলস অব বিজনেস, ১৯৯৬’ ও ‘কনস্যুলার সম্পর্কবিষয়ক ভিয়েনা কনভেনশন, ১৯৬৩’ অনুসারে পাসপোর্ট ও ভিসার কাজটি কূটনৈতিক কাজেরই অংশ। তাই পাসপোর্ট ও ভিসার কাজে অতিরিক্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করা হলে তা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে করা উচিত।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওই অবস্থানপত্র সম্পর্কে ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। অন্য মন্ত্রণালয় থেকে নিয়োগ হলেও এতে যাতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ের দায়িত্ব থাকে, সে বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সম্মতি আদায়ের চেষ্টা চলছে বলে জানা গেছে।
তবে পাসপোর্ট ও ভিসার কাজে বিপুল জনবল নিয়োগের পাশাপাশি শ্রম শাখা সম্প্রসারণ নিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে যুগপৎ হতাশা ও ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। কর্মকর্তাদের মতে, আন্তর্জাতিক রীতি অনুযায়ী, পাসপোর্ট ও ভিসা দেওয়ার কাজটির সঙ্গে সেবা বা কনস্যুলারের বিষয়টি জড়িত। আর সামগ্রিকভাবে পেশাদার কূটনীতিকেরাই প্রতিটি দেশের পক্ষে কাজটি করে থাকেন। সে ক্ষেত্রে পেশাদার কূটনীতিক ছাড়া কাজটি করতে গিয়ে সমস্যা তৈরি হবে। এ ছাড়া দীর্ঘ চার দশক পরও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জনবল কাজের তুলনায় আনুপাতিক হারে বাড়েনি, বরং বিভিন্ন সময়ে অন্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা এসে কূটনীতিকদের পদগুলো দখল করেছেন। অন্য মন্ত্রণালয় থেকে লোকজন নিয়োগ এবং বিদেশ মিশনে কাজের তদারকি বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে হলে পেশাদার কূটনীতিক গড়ে তোলার কাজ ব্যাহত হবে। চূড়ান্তভাবে কূটনৈতিক দর-কষাকষিতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশ।
বর্তমানে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কর্মরত মাঝারি ও কনিষ্ঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে হতাশা রয়েছে। কারণ দেশের স্বার্থ সমুন্নত রেখে সাফল্য অর্জনের লক্ষ্যে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কোনো পেশাগত পরিকল্পনা নেই। এ ছাড়া অন্য মন্ত্রণালয় থেকে জনবল নিয়োগের মাধ্যমে কার্যত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে দুর্বল করা হচ্ছে। এসব পরিস্থিতি নিয়ে বিসিএস (পররাষ্ট্র) ক্যাডারের ২৮, ২৯ ও ৩০ ব্যাচের কর্মকর্তারা গত ৩ সেপ্টেম্বর রাতে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে অনুষ্ঠিত নৈশভোজের ফাঁকে পররাষ্ট্রসচিব মোহাম্মদ মিজারুল কায়েসের সঙ্গে কথা বলেন। মূলত নিজেদের পেশার ভবিষ্যৎ নিয়ে কনিষ্ঠ এসব কর্মকর্তা তাঁদের উদ্বেগের কথা পররাষ্ট্রসচিবকে জানান।
জানতে চাইলে সাবেক পররাষ্ট্রসচিব ফারুক সোবহান প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাংলাদেশ হচ্ছে একমাত্র দেশ, যেখানে পররাষ্ট্রনীতি মন্ত্রণালয়ের হাতে নয়, বাইরের হাতে থাকে। অন্য মন্ত্রণালয় থেকে যেসব জনবল নিয়োগ করা হয়, তাঁরা কিন্তু রাষ্ট্রদূত বা হাইকমিশনার নন, নিজ নিজ মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকেন। ফলে দূতাবাস একদিকে যায়, শাখা যায় অন্যদিকে। রাষ্ট্রদূত ও হাইকমিশনারের নিয়ন্ত্রণ এসব কর্মকর্তার ওপর থাকে না। তাই কাজে সমন্বয় হয় না।’
সাবেক পররাষ্ট্রসচিব ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বাইরে থেকে লোক নিয়োগ ও আলাদাভাবে কাজের তদারকির মাধ্যমে বিদেশে বাংলাদেশ দূতাবাসকে দুর্বল করা হয়। এই প্রবণতা থেকে বের হয়ে আসাটা জরুরি।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাব: বিদেশের বাংলাদেশ মিশনে ভিসা ও পাসপোর্টের কাজে লোকবল নিয়োগের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ২৪ জুন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি সারসংক্ষেপে সই করেন। এতে প্রবাসী আয়ের গুরুত্ব, যন্ত্রে পাঠযোগ্য পাসপোর্ট (এমআরপি) চালু, আন্তর্জাতিক বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (ইকাও) ও কূটনীতিকদের ওপর বাড়তি চাপের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়। প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ইকাওয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী, ২০১৫ সালের মার্চ মাসের মধ্যে বিদেশে বসবাসরত সব বাংলাদেশিকে এমআরপি দিতে হবে। তাই সংকট উত্তরণে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট অধিশাখা এবং বহিরাগমন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের কর্মকর্তা ও কর্মচারী, যাঁরা পাসপোর্ট ও ভিসা-সংক্রান্ত কাজে দক্ষ-অভিজ্ঞ, তাঁদের নিয়োজিত করা যায়। এ জন্য এমআরপি চালু করতে ৬৬টি বৈদেশিক মিশনে ৩৬৬টি পদ সৃষ্টির প্রস্তাব দেওয়া হয়।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবটি বাস্তবায়নে গত ৩০ আগস্ট জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে এক আন্তমন্ত্রণালয় বৈঠক হয়। এতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে কোন মিশনে কোন পদে কতজন কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ করা হবে, সেটি উত্থাপন করা হয়। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন সাপেক্ষে এসব জনবল নিয়োগের সিদ্ধান্ত হয়েছে।
এ ব্যাপারে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় খোঁড়া যুক্তি দিচ্ছে। কারণ ইকাওয়ের শর্তানুযায়ী, ২০১৫ সাল থেকে বিশ্বজুড়ে চালু হচ্ছে ই-পাসপোর্ট। তখন নতুন প্রযুক্তির মাধ্যমে আবার বিশেষায়িত এই পাসপোর্ট চালু হবে। সে ক্ষেত্রে এমআরপি ও ভিসা দেওয়ার জন্য নিয়োগ পাওয়া লোকজনের প্রয়োজনীয়তা থাকবে না। এই পরিস্থিতিতে মাত্র বছর দুয়েকের জন্য এত বিপুল পরিমাণ লোক নিয়োগের বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ।
২১ শ্রম শাখায় নতুন ২২৪ কর্মকর্তা: বাংলাদেশের মিশন রয়েছে এমন ২১টি দূতাবাস ও হাইকমিশনে শ্রম শাখা খোলার প্রস্তাব দিয়েছে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। গত ২৫ জুন এই প্রস্তাব নীতিগতভাবে অনুমোদনের পর এটি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে বিবেচনাধীন রয়েছে। ২১ মিশনের উল্লেখযোগ্য হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, রাশিয়া, জার্মানি, গ্রিস, স্পেন, সুইজারল্যান্ড, মরিশাস ও দক্ষিণ আফ্রিকা। ২১ শ্রম শাখায় ২২৪ জনবল কাঠামোর প্রস্তাব করেছে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়।
সাংস্কৃতিক শাখা খোলার অনুরোধ: সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, ইতালি ও মালয়েশিয়ায় তথ্য ও সাংস্কৃতিক শাখা এবং লন্ডন ও ওয়াশিংটনে সাংস্কৃতিক শাখা খোলার প্রস্তাব দিয়েছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি। গত বছরের ২৪ নভেম্বর সংস্কৃতিবিষয়কমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদকে লেখা চিঠিতে তিনি বলেন, বিদেশে বাংলাদেশ মিশনের কূটনৈতিক বা তথ্য শাখা তাদের নিয়মিত কাজের অংশ হিসেবে বিভিন্ন জাতীয় দিবস পালনসহ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। এতে নিয়মিত কাজের ব্যাঘাত ঘটে। কিন্তু বাংলাদেশের সংস্কৃতিকে তুলে ধরতে স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক বা তথ্য শাখা থাকা প্রয়োজন। তাঁর প্রস্তাবের আলোকে নিউইয়র্ক, লন্ডন, প্যারিস, দুবাই ও কলকাতায় সাংস্কৃতিক শাখা খোলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
সাবেক পররাষ্ট্রসচিব ফারুক সোবহান বলেন, ‘সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের লোকজন বাড়াতে হবে। কিন্তু সেটি করা উচিত পরিকল্পনা অনুযায়ী। এ জন্য পেশাগত পরিকল্পনা জরুরি। গুরুত্ব দিতে হবে ভাষা শিক্ষা, অঞ্চল ও বিষয়ভিত্তিক গুরুত্বের ভিত্তিতে সম্পর্ক উন্নয়নের ওপর।’
No comments