পদ্মা সেতু প্রকল্প: দুদকে বিশ্বব্যাংকের বিশেষজ্ঞ দল- বাংলাদেশেও দুর্নীতির ষড়যন্ত্র করা অপরাধ

বিশ্বব্যাংকের আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ দল বাংলাদেশে এসে প্রথম যে প্রশ্নটির উত্তর জানতে চেয়েছে তা হলো, দুর্নীতির ষড়যন্ত্র করা হলে তা বাংলাদেশের আইনে অপরাধ কি না। এ বিষয়ে এখানে কোনো আইন আছে কি না। এর উত্তরও দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।


তাদের জানানো হয়েছে, দুর্নীতির জন্য ষড়যন্ত্র করা হলে তা বাংলাদেশের আইনেও বিচারযোগ্য হবে।
বিশ্বব্যাংক মূলত পদ্মা সেতু নিয়ে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রেরই অভিযোগ এনেছে। এ নিয়ে বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ বাংলাদেশকে দেওয়া হয়েছে বলে বিশ্বব্যাংক একাধিকবার বলেছে। কানাডায় এ নিয়ে বিচারও চলছে। যদিও দুদক এত দিন বলে আসছিল, দুর্নীতির ষড়যন্ত্র হলে কানাডায় তা অপরাধ, বাংলাদেশে নয়। ফলে পদ্মা সেতুর দুর্নীতি নিয়ে কিছু করা সহজ হবে না।
বিশ্বব্যাংকের বিশেষজ্ঞ দলটি গতকাল রোববার সকালে এসেছে বাংলাদেশে। আর দুদকের সঙ্গে বৈঠক হয় বেলা তিনটার পর। বৈঠকে বিশেষজ্ঞ দলের নেতৃত্বে ছিলেন আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) সাবেক প্রধান আইনজীবী লুই গ্যাব্রিয়েল মোরেনো ওকাম্পো। দলের অন্য দুই সদস্য হলেন হংকংয়ের দুর্নীতিবিরোধী স্বাধীন কমিশনের সাবেক কমিশনার টিমোথি টং এবং যুক্তরাজ্যের সিরিয়াস ফ্রড কার্যালয়ের সাবেক পরিচালক রিচার্ড অল্ডারম্যান। এ ছাড়া বৈঠকে আরও ছিলেন ওয়াশিংটন থেকে আসা দুর্নীতি প্রতিরোধসংক্রান্ত বিশ্বব্যাংকের ইন্টেগ্রিটি ভাইস প্রেসিডেন্সির একজন প্রতিনিধি স্টিভ জিমারম্যান, বাংলাদেশে বিশ্বব্যাংকের পরিচালক অ্যালেইন গোল্ডস্টেইন এবং প্রিয়ানি মালিক নামের দাতা সংস্থাটির আরেকজন কর্মকর্তা।
অন্যদিকে দুদকের পক্ষে ছিলেন সংস্থার চেয়ারম্যান গোলাম রহমান, কমিশনার (অনুসন্ধান) মো. বদিউজ্জামান, কমিশনার (তদন্ত) মো. সাহাবুদ্দিন এবং অনুসন্ধান দলের চার সদস্য: জ্যেষ্ঠ উপপরিচালক আবদুল্লাহ আল-জাহিদ, মীর মো. জয়নুল আবেদীন, গোলাম শাহরিয়ার চৌধুরী ও মির্জা জাহিদুল আলম এবং দুদকের আইন উপদেষ্টা আনিসুল হক।
প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টার ওই বৈঠকে বাংলাদেশের বিভিন্ন আইনি বিষয়েই মূল আলোচনা হয়। দুদকের পক্ষে সব ধরনের আইনের ব্যাখ্যা দেন দুদকের আইন উপদেষ্টা আনিসুল হক। বৈঠক সূত্র প্রথম আলোকে জানায়, বাংলাদেশে দুর্নীতি আইন কী ধরনের, কী কী বিষয় তাতে অন্তর্ভুক্ত—এসব বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সদস্যরা দুদকের কাছে জানতে চেয়েছেন। বিশেষ করে আগে পাঠানো বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী বিভিন্ন উচ্চপদস্থ ব্যক্তির ক্ষেত্রে ওঠা অভিযোগ নিয়েও তাঁরা আলোচনা করেন। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের আইনের প্রক্রিয়া ও দণ্ডবিধি নিয়ে জানতে চান তাঁরা। এ ছাড়া অন্যান্য দেশের আইনের সঙ্গে বাংলাদেশের আইনের কোনো পার্থক্য আছে কি না, তা-ও জানতে চাওয়া হয় বৈঠকে। সূত্র জানায়, বৈঠকে সব পক্ষই একমত হয়েছে যে বাংলাদেশের প্রচলিত আইনেই তদন্ত ও বিচার হবে।
বৈঠক শেষে আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেন, ‘বাংলাদেশের আইনে ষড়যন্ত্র করলে তা অপরাধ হবে কি না, এ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। বিশেষ করে আমাদের আইনের বিভিন্ন প্রক্রিয়া ও দণ্ডবিধি সম্পর্কে তাঁদের আগ্রহ ছিল।’
এ নিয়ে যোগাযোগ করা হলে আনিসুল হক গতকাল রাতে প্রথম আলোকে বলেন, কোনো অপরাধের জন্য ষড়যন্ত্র করাও একটা অপরাধ। দুর্নীতি একটা অপরাধ। সুতরাং, দুর্নীতির জন্য কেউ ষড়যন্ত্র করলে সেটাও অপরাধ। দণ্ডবিধির ১২০(এ)-এ এই বিষয়ে বলা আছে। ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে কোনো অপরাধ করা হলে ওই অপরাধের যা সাজা তা-ই হবে। তবে অপরাধ না হয়ে শুধু ষড়যন্ত্র হলে সে ক্ষেত্রে কমপক্ষে ছয় মাস কারাদণ্ডের বিধান আছে।
দুদকের চেয়ারম্যান গোলাম রহমান বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের বলেন, ‘বিশ্বব্যাংক তদন্তসম্পর্কিত বিষয়ে জানতে এসেছিল, আমরা ব্যাখ্যা দিয়েছি। মনে করি, তাদের প্রশ্নের সন্তোষজনক জবাব দিয়েছি আমরা।’
দুদকের অনুসন্ধান ও বিশ্বব্যাংকের অংশগ্রহণ প্রসঙ্গে দুদকের কমিশনার মো. সাহাবুদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, ‘বিশ্বব্যাংক দুদকের অনুসন্ধান দলের তদন্তের বিভিন্ন অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে আগ্রহ দেখিয়েছে। ওরা হয়তো এ বিষয়ে আমাদের তদন্ত দলকে উপযুক্ত পরামর্শ দেবে।’
প্রায় একই সুরে বিশ্বব্যাংকের পরিচালক অ্যালেইন গোল্ডস্টেইন বলেন, ‘দুদকের সঙ্গে আলোচনা ফলপ্রসূ ও আরও কার্যকর হবে বলে মনে করি। বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সদস্যরা দুদকের তদন্তের গতি-প্রকৃতি ও প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন।’
বিশেষজ্ঞ এই দলের সঙ্গে আজ আবারও বৈঠক হবে দুদকের। আর কাল মঙ্গলবার দলটি দেশে ফিরে যাবে। পরবর্তী সফরের সময়সূচি পরে জানানো হবে বলে বিশ্বব্যাংক সূত্র জানায়।
পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য বাংলাদেশের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে এবং বিশ্বব্যাংকের দেওয়া চার শর্ত পূরণের ব্যাপারে দুই পক্ষের সমঝোতার ভিত্তিতে এই আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ দলটি গঠন করে বিশ্বব্যাংক। এই দলটির ইতিবাচক প্রতিবেদন পেলে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থায়নে এগিয়ে আসবে। অর্থাৎ এই দল বাংলাদেশের দুদক পরিচালিত তদন্ত কার্যক্রম দেখভাল এবং পর্যালোচনা করে বিশ্বব্যাংকের কাছে এর বিশ্বাসযোগ্যতা সম্পর্কে প্রতিবেদন দেবে। তাদের প্রতিবেদনের ওপরই পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের প্রতিশ্রুত ১২০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণ-সহায়তা নির্ভর করছে।
উল্লেখ্য, দুর্নীতির অভিযোগ তুলে গত বছরের সেপ্টেম্বরে ঋণচুক্তি স্থগিত করে বিশ্বব্যাংক। ঋণ পেতে চারটি শর্ত পালন না করায় গত ২৯ জুন ঋণচুক্তিটি বাতিল করে দাতা সংস্থাটি। এরপর দুর্নীতির সন্দেহভাজন সাবেক মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের পদত্যাগ ও প্রধানমন্ত্রীর অর্থনীতিবিষয়ক উপদেষ্টা মসিউর রহমানকে ছুটিতে পাঠানোর পর গত ২০ সেপ্টেম্বর পদ্মা সেতু প্রকল্পে পুনরায় সম্পৃক্ত হওয়ার ঘোষণা দেয় বিশ্বব্যাংক। এরই অংশ হিসেবে বাংলাদেশে এসেছে বিশেষজ্ঞ দলটি।

No comments

Powered by Blogger.