ভিন্নমত-আপনার সন্তান আপনার শ্রেষ্ঠ সম্পদ by আবু আহমেদ

আপনারা কতজনই তো বিভিন্নভাবে আর্থিক সম্পদ জোগাড় করতে ব্যস্ত। কিন্তু একবারও কি চিন্তা করেছেন যে সৃষ্টিকর্তা আপনাকে সবচেয়ে বড় নিয়ামত বা দান দিয়েছেন আপনাদের সন্তানদের মাধ্যমে। দুনিয়ার আর্থিক সম্পদ প্রয়োজন আছে বটে; তবে একটা পর্যায় পর্যন্ত।


এই আর্থিক সম্পদ বোঝাও হতে পারে। আর বোঝা হলে সেই আর্থিক সম্পদই আপনার সুখশান্তি বিনষ্ট করার জন্য যথেষ্ট। কত লোকই একে অপরকে হত্যা করে ফেলছে শুধু আর্থিক সম্পদের জন্য। ছেলে বাবার শত্রু হয়েছে, সেও আর্থিক সম্পদের জন্য। সে জন্য একটা উপদেশ থাকল- আর্থিক সম্পদ ভালো, তবে সেটা অবশ্যই ন্যায্য পথে আপনার পরিশ্রমের মাধ্যমে আসতে হবে। ছেলেমেয়েকে আদর্শ শেখানোর অন্যতম উপায় হলো পরিবারের মধ্যে মা-বাবার আদর্শ হওয়া। আদর্শ হওয়া মানে সৎ ও পরিশ্রমী হওয়া। স্কুল-কলেজের প্রথাগত শিক্ষা অনেকের ভাগ্যে জোটে না। তাতে কি, তারা যদি সৎ ও পরিশ্রমী হয়, তাহলে এই সমাজে তাদেরও একটা ভালো জায়গা হবে। আমি অনেক অশিক্ষিত লোক দেখেছি, যারা কথিত শিক্ষিত লোকদের চেয়ে অনেক বেশি জ্ঞানী। জ্ঞান আসে পড়ালেখা থেকে, দেখা থেকে, ভাবা থেকে। যে স্কুল-কলেজে যেতে পারেনি, সে অন্য অনেক উপায়ে জ্ঞানী হতে পারে। আমাদের উচিত জ্ঞানী লোকদের সম্মান করা। তবে শিক্ষা মানবমনের সৃজনশীলতা ও সুপ্ত প্রতিভাকে সৃষ্টি ও জাগ্রত করতে সহায়তা করে। শিক্ষা মানুষকে বেশি উৎপাদনশীল হতে সহায়তা করে। শিক্ষা মানুষকে মানবিক হতেও সহায়তা করে। যে শিক্ষা মানুষকে মহৎ ও মানবিক হতে শিক্ষা দেয় না, সে শিক্ষা কোনো শিক্ষাই নয়। শিক্ষা মানে কাজের জন্য একটি যন্ত্র হওয়া নয়। যন্ত্র হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মানবিক মূল্যবোধের বিকাশ হতে হবে। শিক্ষিত লোকরা বেশি সুখী এমনও নয়। সুখী হওয়ার আরো অনেক উপাদান আছে। এর মধ্যে একটি হলো আল্লাহ বা সৃষ্টিকর্তার ওপর বিশ্বাস রাখতে হবে, অন্যটি হলো সবর বা ধৈর্য। এই দুটি শর্ত পূরণ না হলে পাওয়ার জন্য হাহাকার থেকেই যাবে। আর যারা হাহাকারের মধ্যে থাকে, তারা সুখী বলে আমার বিশ্বাস হয় না। আপনার সন্তানদের স্কুল-কলেজে পাঠাবেন। যথাসম্ভব উৎকৃষ্ট শিক্ষা তাদের দিতে চেষ্টা করবেন। মাধ্যম হিসেবে ইংরেজি অথবা বাংলা মাধ্যমের শিক্ষাও চয়ন করতে পারেন। অর্থের অভাবে ইংরেজি মাধ্যম চয়ন করতে না পারলে বাংলা মাধ্যমে দেবেন। বাংলা মাধ্যমে পড়লেও ক্ষতি নেই। এই মাধ্যমের ছেলেমেয়েরাও অনেক ভালো করছে। ইংরেজি শিক্ষার ব্যাপারটা পরে পুষিয়ে নিতে পারবে। তবে বেসিক ম্যাথ ও বিজ্ঞান শেখা আবশ্যক। বিদ্যা আসে লজিক বা যুক্তি থেকে। বেসিক ম্যাথ (basic math) ও বিজ্ঞান লজিক বা যুক্তি তুলে ধরে সুন্দরভাবে। সেই সঙ্গে শিক্ষা দিন নৈতিকতা। নৈতিকতার বড় উৎস হলো আপনার-আমার ধর্ম। এ জন্য স্কুল পর্যায়ে ধর্মীয় শিক্ষা বাধ্যতামূলক অন্য অনেক দেশেও। ধর্মবিবর্জিত নৈতিকতা একটা থাকতে পারে, তবে সেটা সবার ক্ষেত্রে টেকসই হয় না। আপনার সন্তানদের জন্য কিন্তু প্রথম প্রয়োজন তাদের স্বাস্থ্য। স্বাস্থ্যহীন শিক্ষার্থী যত প্রতিভাবানই হোক না কেন, পরে ভালো করতে পারে না। তাই আপনার ছেলেমেয়ের স্বাস্থ্য ঠিক আছে বা যাচ্ছে কি না সে ব্যাপারে যত্ন নিন। তাদের ভালো খাবার ও মন্দ খাবার সম্পর্কে বুঝিয়ে বলুন। বিভিন্ন কোমল-নরম পানীয় থেকে তাদের দূরে রাখতে পারলে ভালো হয়। কথিত ফাস্টফুড থেকেও দূরে রাখুন। তারা যাতে একটু মাছ, একটু সবজি খায় সেদিকে লক্ষ রাখুন। মনে রাখবেন, ক্লাসের শিক্ষক স্বাস্থ্য সম্পর্কে মোটেই বলবেন না। শিক্ষকরা কাজ হিসেবে ধরে নিয়েছেন মনোযোগ দিয়ে বোর্ডে অঙ্ক করানো আর লেখচিত্র অঙ্কন করে বিজ্ঞান শেখানো। স্কুল-কলেজে অনেক কিছুই শিক্ষা দেওয়া হয় না। কিন্তু সেসবের প্রতি আপনাকে লক্ষ রাখতে হবে। একজন ছাত্র ভালো এবং সুস্বাস্থ্যের অধিকারী। পরীক্ষায় মধ্যম ফল করলেও ক্ষতি নেই। সে কিন্তু বাস্তব জীবনে অনেক ভালো করবে। ছেলেমেয়ের প্রথম বিভাগ বা A+ পাওয়ার পেছনে ছোটাবেন না। ভালো ফল, মধ্যম ফল- এগুলো তুলনামূলক এবং প্রয়োজন একটা পর্যায় পর্যন্ত। অতি ভালো ফল করানোর জন্য তাদের চাপের মধ্যে রাখবেন না। সব সময় হাসিখুশি থাকতে দিন। দেখবেন, একদিন তারা এমনিতেই ভালো ফল করে ফেলছে। তারা অবসরে কাদের সঙ্গে মিশছে বা কম্পিউটারের সামনে বসে কী করছে, সেটাও একটু দেখবেন। ভালো সঙ্গে ভালো হবে, কম্পিউটার, ইন্টারনেট- এসব থেকে অনেক কিছু ভালো শেখা যায়। আবার চাইলে খারাপের দিকেও যাওয়া যায়। তবে তাদের ওপর আদর-সোহাগের মাধ্যমে মৃদু খবরদারি করতে হবে একটা পর্যায় পর্যন্ত। বয়স হলে তারা স্বাধীনভাবে কোনটা তাদের জন্য ভালো, কোনটা মন্দ- সেটা নিজেরাই বুঝবে। টিউটরের কাছে শিক্ষাটা যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলা ভালো। আমাদের সময়ে এই প্রাইভেট পড়ানোর সংস্কৃতিটা ছিল না। কোনো অঙ্ক বুঝতে অসুবিধা হলে পরের দিন এসে স্কুলের স্যারকে বললে তিনি সেটা স্কুলের ব্ল্যাকবোর্ডে লিখে বুঝিয়ে দিতেন। এখন নাকি সর্ব বিষয়ে টিউশনি হয়। নিজ ছাত্রকে নিজেই অর্থের বিনিময়ে টিউশনি করছে। এর চেয়ে অনৈতিক কাজ আর কিছু হতে পারে না। শিক্ষকদের মধ্যে লোভ আর অনৈতিকতার দ্রুত বিস্তার ঘটেছে। তাই সাবধান, কোন শিক্ষকের কাছে আপনি আপনার সন্তানকে পাঠাচ্ছেন, তা একবার ভালো করে খোঁজ নেবেন। ওই সব শিক্ষকের কাছে কখনো আপনার স্নেহের সন্তানকে পাঠাবেন না।
শেষকথা হচ্ছে, লোকে যেমন আর্থিক সম্পদ অর্জন করার জন্য অর্থ বিনিয়োগ করে, আপনাকেও কমবেশি আপনার এই শ্রেষ্ঠ সম্পদকে বাড়তে দিতে হলে বিনিয়োগ করতে হবে। খাওয়া-পরার খরচের পর বাকি অর্থ ব্যয় করার ক্ষেত্রে প্রাধান্য দিন আপনার ছেলেমেয়ের শিক্ষাকে। শিক্ষা মানুষে-মানুষে আর্থিক বৈষম্য অনেকটা ঘুচিয়ে দিতে পারে। তাই গরিব লোকদের জন্য এক অর্থে শিক্ষাটা আরো বেশি প্রয়োজন। আপনাদের শ্রেষ্ঠ সম্পদ শিক্ষিত, নৈতিক ও স্বাস্থ্যবান হচ্ছে কি না সেটাই আপনারা দেখুন। তারপর তাদের ভাগ্য তাদের ওপর ছেড়ে দিন।
লেখক : অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক,
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.