উচ্চশিক্ষা- বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অস্থির কার স্বার্থে? by কুদরাত-ই-খুদা

এই কিছুদিন আগেও উপাচার্য ও সহ-উপাচার্যের অপসারণ, নির্বাচন, খুনসহ বিভিন্ন ইস্যুতে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট), জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অস্থিরতা বিরাজ করছিল।


এর কিছুদিন পরই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ও খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থির অবস্থা দেখা দেয়। ২ অক্টোবর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় অস্থির হয়ে ওঠার কারণ হচ্ছে দীর্ঘদিন পর ক্যাম্পাসে নিজেদের আধিপত্য ফিরে পেতে ছাত্রশিবিরের মরিয়া হয়ে ওঠা, অপর দিকে এর বিরুদ্ধে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের অবস্থান। এর মাত্র এক সপ্তাহ পর ১০ অক্টোবর এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রজোটের নেতা-কর্মীদের পুলিশ লাঠিপেটা করার মাধ্যমে পক্ষপাতমূলক আচরণ করে। ওদিকে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী কর্তৃক এক ছাত্রকে লাঞ্ছিত করার ঘটনার জের ধরে চট্টগ্রাম প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ১২ নভেম্বর পর্যন্ত বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজেদের ‘পছন্দের’ ব্যক্তিদের চাকরি না হওয়ায় ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা সেখানে অচলাবস্থার সৃষ্টি করেছেন; আর খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের জমি বিক্রির ঘটনাকে কেন্দ্র করে ওই বিশ্ববিদ্যালয়েও শিক্ষকদের মধ্যে রীতিমতো স্নায়ুযুদ্ধ শুরু হয়। এ জন্য দোষারোপ করা হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে। ঘটনার সঙ্গে উপাচার্যের জড়িত থাকার বিষয়টি তদন্তসাপেক্ষ। কিন্তু এ কারণে চলতি শিক্ষাবর্ষে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ভর্তি পরীক্ষা স্থগিত করা কতটা যুক্তিযুক্ত?
বুয়েটের বর্তমান উপাচার্য ও সহ-উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে শিক্ষকদের ধারাবাহিক আন্দোলন ও গণপদত্যাগের হুমকি সবাইকে বিব্রত অবস্থায় ফেলে দিয়েছিল। পরে অবশ্য সহ-উপাচার্যের বিদায়ের মধ্য দিয়ে সমস্যার আপাতত সমাধান হয়েছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, ‘উপাচার্য’ নামের পদটিতে কেউ বেশি দিন সুখী থাকতে পারেন না। পদটির কাছ থেকে যে গ্রুপ সুবিধা পায়, তখন সেই গ্রুপের কাছে এটি হয়ে ওঠে মহামূল্যবান। যখন তা পাওয়া সম্ভব হয় না, তখনই কয়েকজন মিলে গ্রুপ করে উপাচার্যের পদত্যাগ দাবি করেন। এ যেন একটি রুটিন ওয়ার্ক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। সরকার যখন কাউকে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদে বসাচ্ছে, তখন তাঁকে সবাই মিলে মেনেও নিচ্ছেন। তা হলে কিছুদিন যেতে না-যেতেই তাঁকে ‘দুর্নীতিবাজ’ বলে গালাগাল শুনতে হচ্ছে কেন? এ সমস্যা কি শুধুই ওই ব্যক্তির কারণে? নাকি এটি নিয়োগ প্রক্রিয়ার সমস্যা? দল ও ব্যক্তিস্বার্থের জন্যই যে এ ধরনের অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে সৃষ্ট এসব অস্থিরতার কারণে ঠিক সময়ে শিক্ষার্থীরা তাঁদের শিক্ষাজীবন শেষ করতে পারবেন কি না, তা নিয়ে তাঁদের মনে সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে। এসব অস্থিরতার কারণে শিক্ষা ও গবেষণার স্বাভাবিক পরিবেশ যে মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে, তা বলাই বাহুল্য। স্বার্থকেন্দ্রিক রাজনীতি ও রাজনৈতিক সংস্কৃতির অভাবই যে এসব অস্থিরতার পেছনের মূল কারণ, তা সহজেই অনুমেয়। উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলোয় এখন জ্ঞান-গবেষণার চেয়ে আনুষঙ্গিক বিষয়গুলো নিয়েই তথাকথিক আন্দোলন বা অস্থিরতা প্রাধান্য পাচ্ছে; আর এটিই বাস্তব সত্য। দেশের জনগণের কষ্টার্জিত টাকায় পরিচালিত এসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক ও রাজনৈতিক সংগঠনের নেতা-কর্মীদের রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি ও ব্যক্তিস্বার্থের আন্দোলন দেশ-জাতির বৃহত্তর স্বার্থেই পরিহার করা উচিত। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যদি আন্দোলন করতেই হয়, তবে তা একাডেমিক স্বার্থের জন্য করা উচিত, রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি বা ব্যক্তিস্বার্থ উদ্ধারের জন্য নয়।
অপর দিকে দেখা যাচ্ছে, মেধাভিত্তিক ছাত্ররাজনীতির মাধ্যমে যেসব ছাত্রের দেশ, জাতি ও সমাজ গঠনে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করার কথা, তাঁরাই আজ টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, হানাহানি, খুনোখুনিসহ নানা ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছেন। গত তিন বছরে দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও প্রতিপক্ষের সঙ্গে সংঘর্ষে প্রাণ হারিয়েছেন ১৮ জন ছাত্র। আর গত ৪০ বছরে দেশের চারটি সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনৈতিক সংঘর্ষে প্রাণ হারিয়েছেন ১২৯ জন ছাত্র (প্রথম আলো, ১৮ মার্চ, ২০১২)। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এখন পর্যন্ত এসব হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়নি। রাজনৈতিক ক্ষমতার জোরে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করেও ‘ছাত্র’ নামধারী সন্ত্রাসীরা বারবার রেহাইও পেয়ে যাচ্ছে। ছাত্র নামধারী এসব সন্ত্রাসীর অপকর্মের জন্য দেশের উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলোয় অধ্যয়নরত হাজার হাজার সাধারণ শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন আজ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। লেখাপড়া করার পরিবর্তে কখন সংঘর্ষ বাধে—এই শঙ্কায় তাঁদের থাকতে হচ্ছে; পাশাপাশি বহন করতে হচ্ছে সেশনজটের বোঝা। সর্বোপরি বিঘ্নিত হচ্ছে লেখাপড়ার সুষ্ঠু পরিবেশ; নষ্ট হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপুল টাকার সম্পদ।
এখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, দেশের উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলোয় ধারাবাহিক ও চলমান এসব অস্থিরতা কিসের আলামত বহন করে এবং এর পেছনে স্বার্থ কী? শিক্ষাঙ্গনের এসব অস্থিরতার মাধ্যমে দেশ-জাতিকে মেধা ও নেতৃত্বশূন্য করার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে দেশি-বিদেশি কোনো অশুভ চক্রের যোগসূত্র রয়েছে কি না, তা সবাইকে ভালোভাবে খতিয়ে দেখতে হবে; পাশাপাশি উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলোয় অস্থিরতা বন্ধ করতে তথা ছাত্ররাজনীতির ব্যাপারে দেশের রাজনৈতিক সংগঠনগুলোকে নিজেদের স্বার্থেই সম্মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা উচিত। কারণ, এ কথা সব দলেরই স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে কোনো রাজনৈতিক দলের ছাত্রসংগঠন ক্যাম্পাসে বা কোথাও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঘটালে সেই সংগঠনের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয় এবং পরবর্তী সময়ে সরকার গঠনে বা নির্বাচনে এসব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের নেতিবাচক প্রভাব সরাসরি পড়ে। দেশ-জাতির বৃহত্তর স্বার্থে এবং শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করতে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের রাজনৈতিক পরিচয় বাদ দিয়ে তাঁদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া জরুরি; অন্যথায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিদ্যা অচিরেই ‘লয়’ (ধ্বংস) হওয়ার পাশাপাশি এর পরিণাম যে কী ভয়াবহ হবে, তা সময়মতোই টের পাওয়া যাবে।
কুদরাত-ই-খুদা, শিক্ষক, আইন বিভাগ, ইউআইটিএস।
kekbabu@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.