অনন্য চিকিৎসক জোহরা কাজী by লুৎফুর নাহার

সর্বজনশ্রদ্ধেয় শিক্ষক ডা. জোহরা বেগম কাজীর শততম জন্মবার্ষিকীতে তার প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধা। ডা. জোহরা বেগম কাজী ব্যতিক্রমধর্মী এক ব্যক্তিত্ব। তিনি ঠিকই বুঝেছিলেন, যদি প্রচলিত নিয়মের বাইরে না যাওয়া যায়, তাহলে নারীর স্বস্তি সম্ভব নয়।


তাই চিকিৎসক বাবার সাহচর্য থেকে তিনি সবসময় চিন্তা করতেন, যেখানে এত বড় বাঙালি মুসলিম সমাজগোষ্ঠী রয়েছে, সেখানে একজনও নারী ডাক্তার নেই। পুরুষেরা যদি চিকিৎসাশাস্ত্রে অধ্যয়ন করে জনকল্যাণে নিয়োজিত করতে পারে, তবে মহিলারা কেন পারবে না? বাবার আদর্শ জোহরা কাজীর মধ্যে ধীরে ধীরে সঞ্চায়িত হয়ে একজন আদর্শ চিকিৎসক হওয়ার প্রেরণা পেয়েছেন।
ডা. জোহরা বেগম কাজীর গ্রামের বাড়ি ছিল মাদারীপুর জেলার কালকিনি থানার গোপালপুর গ্রাম। তিনি ১৯১২ সালের ১৫ অক্টোবর ভারতের মধ্য প্রদেশের রাজনান গাঁওয়ে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশবে খ্রিস্টান স্কুলে লেখাপড়া করেন। ১৯৩৫ সালে দিলি্লতে অবস্থিত লেডি হাডিং মেডিকেল কলেজ ফর ওমেন থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে এমবিবিএস পাস করেন এবং সম্মানজনক ভাইসরয় পদকে তাকে ভূষিত করা হয়। মহাত্মা গান্ধীর ছেলে রামদাস গান্ধী ছিলেন তার বড় ভাই কবি কাজী আশরাফ মাহমুদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তাই গান্ধী পরিবারের সঙ্গে তাদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। তিনি ও তার বোন ডা. শিরিন কাজী মহাত্মা গান্ধীর সেবাগ্রামের সেবাশ্রমের (হাসপাতালে) অবৈতনিকভাবে কাজ করেন। গান্ধীজি ও তার স্ত্রী তাদের দুই বোনকে খুব স্নেহ করতেন।
১৯৪৯ সালে তিনি বাংলাদেশে ফিরে আসেন এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজে যোগ দেন। তিনি ছাত্রছাত্রীদের হাতেকলমে কাজ শিখিয়েছেন। তাদের আগ্রহ করে জটিল অপারেশন শিখিয়েছেন। ভুল হলে রাগ করতেন ঠিকই, কিন্তু পথদ্রষ্টা হিসেবে বিষয়টি বুঝিয়ে দিতেন। তিনি নিজেকে নিয়ে কোনো গৌরব করতেন না। তার ছাত্রছাত্রীরা তাকে শিক্ষিকা হিসেবে পেয়ে গৌরববোধ করত। তিনিই প্রথম ঢাকা মেডিকেলে স্ত্রীরোগ ও ধাত্রীবিদ্যা বিভাগ চালু করে পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেন। গাইনি বিভাগের প্রধান হিসেবে নিজের দায়িত্ব পালন করেও তিনি নিরলস পরিশ্রম করে বাড়ি বাড়ি গিয়ে নারী রোগীদের খুঁজে এনে এই বিভাগে ভর্তি করে চিকিৎসাসেবা দিতেন। তখন ঢাকা শহরে সবাই এক নামে তাকে লেডি ডাক্তার হিসেবে চিনতেন এবং জানতেন। স্ত্রীরোগ ও ধাত্রীবিদ্যা বিভাগ খোলার পর তিনি সকাল-বিকেল এবং মাঝে মধ্যে গভীর রাতেও রোগীদের খোঁজখবর নিতে হাসপাতালে যেতেন। নার্স ও ডাক্তার তাদের যথার্থ কর্তব্য পালন করতেন কি-না, তিনি নিজে প্রত্যক্ষ করতেন। তিনি সবসময়ই ছিলেন ব্যস্ত। অধিকাংশ সময় তিনি অপারেশন থিয়েটারে ব্যস্ত থাকতেন অথবা পড়াশোনা করে সময় কাটাতেন। কর্মময় জীবনে তিনি বহু গরিব ছাত্রছাত্রীকে লেখাপড়ার জন্য গোপনে সাহায্য করতেন।
সারাজীবন অতি সাধারণভাবে কাটিয়েছেন। অর্থ-প্রতিপত্তি, যশ, খ্যাতি ও স্বীকৃতি তিনি কখনও তোয়াক্কা করেননি। এ কারণেই বাংলাদেশের স্ত্রীরোগ ও ধাত্রীবিদ্যা আর ডা. জোহরা বেগম কাজী এক অবিচ্ছেদ্য সত্তা। এই নিঃস্বার্থ চিকিৎসাবিজ্ঞানীর নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে আমাদের ইতিহাসের পাতায়।

ডা. লুৎফুর নাহার : গাইনি বিশেষজ্ঞ

No comments

Powered by Blogger.