প্রবাসে আলোচনায় যুদ্ধাপরাধী মঈনুদ্দিন ও আশরাফুজ্জামান by সৈয়দ আনাস পাশা

লন্ডনে বসবাসরত যুদ্ধাপরাধী চৌধুরী মঈনুদ্দিন ও যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত আশরাফুজ্জামান খানকে নিয়ে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়েছে প্রবাসী মহলে। তাদের সম্পর্কে সংবাদ মাধ্যমগুলোরও বেশ আগ্রহ।

বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে ৭১-এ বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ের তাদের নামে অভিযোগ গঠন হচ্ছে, এমন খবর বিশ্বব্যাপী প্রচার হওয়ার পরই এই দুই যুদ্ধাপরাধী সম্পর্কে মানুষের আগ্রহ আরো বেড়েছে।
ব্রিটেনের মূলধারার সংবাদ মাধ্যমগুলো আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠনের অপেক্ষায় থাকলেও প্রভাবশালী পত্রিকা ‘ডেইলি মেইল’ চৌধুরী মঈনুদ্দিনকে নিয়ে রোববার একটি বিশেষ নিবন্ধ প্রকাশ করেছে। নিবন্ধে ব্রিটেনের স্বাস্থ্য বিভাগের একজন কর্মকর্তার বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ ওঠার পর চৌধুরী মঈনুদ্দিন ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের (এনএইচএস) মুসলিম স্পিরিচুয়াল কেয়ার (Head of Muslim spiritual care in the NHS) ও মাল্টিফেইথ গ্রুপ অব হেলথকেয়ার চ্যাপলেইনসির (Chair of the Multi-Faith Group for Healthcare Chaplaincy) প্রধানের পদ থেকে স্বেচ্ছায় সরে দাঁড়িয়েছেন। স্বাস্থ্য বিভাগের ওই কর্মকর্তা জানান, চৌধুরী মঈনুদ্দিন ব্রিটিশ স্বাস্থ্য বিভাগে বা ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের (এনএইচএস) নিয়োগপ্রাপ্ত কোনো কর্মকর্তা ছিলেন না।

তিনি ছিলেন মুসলিম স্পিরিচুয়াল কেয়ারের (Head of Muslim spiritual care in the NHS) প্রধান এবং মাল্টিফেইথ গ্রুপ অব হেলথকেয়ার চ্যাপলেইনসির চেয়ার। এই দুটো সংগঠনই স্বাস্থ্য বিভাগকে বিভিন্ন ধর্মবিশ্বাসীদের স্বাস্থসেবা বিষয়ে পরামর্শ দিয়ে থাকে। ওই কর্মকর্তা জানান, যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ ওঠার পর চৌধুরী মঈনুদ্দিন ইতোমধ্যে স্বেচ্ছায় পদগুলো থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন।

‘ডেইলি মেইল’-এর রিপোর্টে যুদ্ধাপরাধ প্রসিকিউসন টিমের পক্ষ থেকে চৌধুরী মঈনুদ্দিনের বিরুদ্ধে ১৮ জন বুদ্ধিজীবী হত্যার অভিযোগ উত্থাপনের কথা উল্লেখ করে বলা হয়, প্রসিকিউশনের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন কয়েকদিনের মধ্যেই আনুষ্ঠানিকভাবে ট্রাইব্যুনালে চৌধুরী মঈনুদ্দিনের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করা হবে। মেইলের নিবন্ধে স্বাধীনতার পর তৎকালীন দৈনিক পূর্বদেশে ছবিসহ চৌধুরী মঈনুদ্দিনকে ধরিয়ে দেবার সেই ঐতিহাসিক নিউজ কাটিং এবং ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ডেপুটি ডাইরেক্টর হিসেবে ২০০৩ সালে প্রকাশিত প্রিন্স চার্লসের সঙ্গে একটি ছবি প্রকাশ করা হয়।

 নিবন্ধে চৌধুরী মঈনুদ্দিনের বিরুদ্ধে নিহত বুদ্ধিজীবীদের স্বজনদের কিছু প্রতিক্রিয়াও উল্লেখ করা হয়। নিজের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ সম্পর্কে ‘ডেইলি মেইল’ এর কাছে কোনো প্রতিক্রিয়া জানাতে রাজি হননি চৌধুরী মঈনুদ্দিন।

নিবন্ধে মঈনুদ্দিনের আইনজীবী টবি ক্যাডমেনের বরাত দিয়ে বলা হয়, “চৌধরী মঈনুদ্দিন প্রথম থেকেই তার বিরুদ্ধে ওঠা এসব অভিযোগ দৃঢ়তার সঙ্গে অস্বীকার করে এসেছেন।” টবি ক্যাডমেন ‘ডেইলি মেইল’কে আনুষ্ঠানিক কোনো প্রতিক্রিয়া জানাতে অস্বীকার করে বলেন, “আনুষ্ঠানিক চার্জ গঠন না হওয়া পর্যন্ত কোনো প্রতিক্রিয়া জানানো ঠিক নয়।”

চৌধুরী মঈনুদ্দিনের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ প্রমাণিত হলে তার মৃত্যুদণ্ড হতে পারে এমন ইঙ্গিত করে আইনজীবী ক্যাডমেন মেইলকে বলেন, “মৃত্যুদণ্ড হতে পারে এমন ঝুঁকি থাকলে কোনো অভিযুক্তকে সংশ্লিষ্ট দেশে ফেরত পাঠানোর কোনো বিধান নেই ব্রিটেনের।”

বিশিষ্ট আইনজীবী ব্যারিষ্টার সারা হোসেনও চৌধুরী মঈনুদ্দিনকে বিচারের আওতায় নিয়ে আসতে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে মেইলকে বলেন, “ব্রিটেন ও বাংলাদেশের মধ্যে কোনো এক্সট্রাডিশন (বন্দি বিনিময়) চুক্তি নেই, যে চুক্তি এ বিষয়ে সহযোগিতা করতে পারে।”

মেইলের নিবন্ধে বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের স্বচ্ছতা নিয়ে উত্থাপিত বিভিন্ন বিতর্কের কথাও উল্লেখ করা হয়। এতে বলা হয়, যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিরোধীরা এই বিচার প্রক্রিয়াকে ইসলামি দল ও নেতাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক হয়রানি বলেই মনে করছেন।

চৌধুরী মঈনুদ্দিনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে চার্জ গঠনের পরই এ বিষয়ে বিস্তারিত নিউজ প্রকাশের ইচ্ছের কথা বাংলানিউজকে জানিয়েছে বিবিসি লন্ডন নিউজ। নিউজের একজন কর্মকর্তা বাংলানিউজকে বলেন, “আনুষ্ঠানিকভাবে চার্জ গঠনের খবর ঢাকা থেকে পাওয়ার পরই আমরা এ বিষয়ে একটি বিশেষ নিউজ প্রচারের পরিকল্পনা করছি।”

ব্রিটেনে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার ড. সাইদুর রহমান খান আশা প্রকাশ করে বলেছেন, “চৌধুরী মঈনুদ্দিনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক চার্জ গঠনের পর তাকে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে বিচারের আওতায় নেওয়া হবে।”

বাংলানিউজকে তিনি জানান, ব্রিটেন-বাংলাদেশের মধ্যে কোনো বন্দি বিনিময় চুক্তি না থাকলেও আনুষ্ঠানিক চার্জ গঠনের পর এ বিষয়ে ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যাবে। তিনি বলেন, “আমরা বিভিন্ন সময় ব্রিটিশ সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে এ বিষয়ে কথাবার্তা বলে আসছি। আমাদের তারা আশ্বস্ত করেছেন, আনুষ্ঠানিক চার্জ গঠনের পরই এ বিষয়ে একটি পন্থা বের করার চেষ্টা করা হবে।”

এনএইচএস-এর নির্ধারিত দায়িত্ব থেকে মঈনুদ্দিন সরে দাঁড়িয়েছেন, এমন খবর হাইকমিশনারকে দিলে বাংলানিউজকে তিনি বলেন, “মুসলিম এইডের সঙ্গেও বিভিন্ন সময় তার আলোচনা হয়েছে। তারা বলেছেন, চৌধুরী মঈনুদ্দিনকে এখন তারা তাদের আর কোনো কর্মকাণ্ডে ডাকেন না।”

হাইকমিশনার আশা প্রকাশ করে বলেন, “আনুষ্ঠানিক চার্জ গঠনের পর মুসলিম এইডের ট্রাস্টি বোর্ড থেকেও চৌধুরী মঈনুদ্দিন নিশ্চয়ই বাদ পড়বেন।

এদিকে, ডেইলি মেইলের নিবন্ধে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে গৃহযুদ্ধ উল্লেখ করার আবারও ক্ষুব্ধ হয়েছেন ব্রিটেনে বসবাসরত বাঙালিরা। এর আগে সানডে টাইমসে মুক্তিযুদ্ধকে গৃহযুদ্ধ উল্লেখ করায় তরুণ ব্লগার নিঝুম মজুমদার এর বিরুদ্ধে  ক্যাম্পেইন শুরু করেছিলেন। পরবর্তীতে সানডে টাইমস তাদের ভুল স্বীকার করে।

রোববার ডেইলি মেইলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে গৃহযুদ্ধ উল্লেখ করায় নিঝুম মজুমদার আবারও ফেইসবুক ক্যাম্পেইন শুরু করেছেন। এই ক্যাম্পেইনে সবাইকে শরিক হয়ে ডেইলি মেইলে প্রতিবাদ জানানোর জন্যে সবার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।

যুদ্ধাপরাধী আশরাফুজ্জামান
এ মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত বুদ্ধিজীবী হত্যার আরেক অভিযুক্ত নায়ক আশরাফুজ্জামানকে নিয়েও চলছে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপনের খবর প্রকাশের পর যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশি কমিউনিটি এখন সরগরম।

যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী ও কলামিস্ট জামাল হাসান বাংলানিউজকে জানান, দুই বছর আগে আশরাফুজ্জামানকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের একটি পত্রিকায় তিনি একটি ফিচার লিখলে মামলার হুমকি দেন আশরাফুজ্জামান। পরবর্তীতে পত্রিকাটি মামলা মোকাবেলা করার ঘোষণা দিলে রণে ভঙ্গ দেন ওই অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধী।

জামাল হাসান বলেন, ওয়ারক্রাইম ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন টিম আশরাফুজ্জামানের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপনের ঘোষণা দেওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশি কমিউনিটিতে ব্যাপক উৎসাহের সৃষ্টি হয়েছে। মূলধারার বিভিন্ন মিডিয়াও খোঁজখবর নেওয়া শুরু করেছে।

তিনি জানান, বছর দুয়েক আগে মার্কিন বিচার বিভাগের পক্ষ থেকে ৭১-এ আলবদর বাহিনীর সঙ্গে আশরাফুজ্জামানের সম্পৃক্ততার বিষয় তদন্তের উদ্যোগ নিলে এ বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে বিস্তারিত তথ্য আহবান করা হয় বাংলাদেশে মার্কিন দূতাবাসের মাধ্যমে। যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগের স্পেশাল ইনভেস্টিগেশনের চিফ এলি রোজেনবম তাদের দূতাবাসের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকুর কাছে লিখিত একটি চিঠিতে আশরাফুজ্জামানের বিষয়ে তদন্তে সহযোগিতার আহ্বান জানান। চিঠিতে এলি রোজেনবম লিখেছিলেন, “আশরাফুজ্জামান খান যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা ও পরবর্তীতে সিটিজেনশিপ আবেদনের সময় ৭১-এ আলবদর বাহিনীর সঙ্গে তার যোগসূত্রের বিষয়টি গোপন রেখেছিলেন। বিভিন্ন মাধ্যমে আলবদর বাহিনী ও বুদ্ধিজীবী হত্যার সঙ্গে আশরাফুজ্জামানের সম্পৃক্ততার বিষয়টি বেরিয়ে আসলে যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগ বিষয়টির তদন্ত করতে চায়। এ বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের সহযোগিতা চায় মার্কিন বিচার বিভাগ।”

মার্কিন বিচার বিভাগের এই চিঠির বিষয়টি মিডিয়ায় ফাঁস হয়ে গেলে বাংলাদেশের একটি জাতীয় দৈনিক এ বিষয়ে তখন একটি সংবাদ পরিবেশন করে। ওই সংবাদের ইংরেজি অনুবাদ করে ভার্জিনিয়া থেকে প্রকাশিত অনলাইন নিউজ ভার্সন ‘নিউজবাংলা’য় একটি নিবন্ধ লেখেন মানবাধিকার কর্মী জামাল হাসান। এই নিবন্ধ প্রকাশের পর আশরাফুজ্জামান ‘নিউজবাংলাকে’ সলিসিটর নোটিশ পাঠানো হয়।  ‘নিউজবাংলার’ পক্ষ থেকে এটি মোকাবেলার কথা জানিয়ে উত্তর দেওয়া হয় আশরাফুজ্জামানের আইনজীবীকে। নিউজবাংলার এই উত্তর পাওয়ার পর আশরাফুজ্জামান রণে ভঙ্গ দেন। আজ অব্দি তিনি এ বিষয়ে নীরব রয়েছেন বলে বাংলানিউজকে জানান জামাল হাসান।

আশরাফুজ্জামানের বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য মার্কিন বিচার বিভাগকে সরবরাহ করা হয়েছিল কি না বিষয়টি প্রবাসীরা জানতে চান, বাংলানিউজকে এমনটিই জানালেন জামাল হাসান।

No comments

Powered by Blogger.