চালচিত্র-মেশিনগানের সামনে গাই জুঁই ফুলের গান by শুভ রহমান

রাজপথের এক পাশ থেকে আরেক পাশ পর্যন্ত বিস্তৃত বিশাল এক কালো ব্যানারের ওপর বড় বড় সাদা অক্ষরে লেখা, 'মেশিনগানের সামনে গাই জুঁই ফুলের গান'। এর পেছনে বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের চলেছে দৃপ্ত পদক্ষেপে মৌন শোকমিছিল।


গেল শতকের বাষট্টির ঐতিহাসিক শিক্ষা আন্দোলনের সূচনা পর্বে ১৭ সেপ্টেম্বর পুলিশের গুলিতে কয়েকজন শহীদ হলে পরদিন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে ওই শোকমিছিল। নগ্নপদ শোকমিছিল। সে সময় পাকিস্তান অবজারভারের ফটোগ্রাফার প্রয়াত মোজাম্মেলের তোলা সারি সারি শুধু নগ্নপদসংবলিত অনবদ্য শৈল্পিক সংবাদচিত্রটি এ দেশের প্রেস ফটোগ্রাফিতে অমরত্বের দাবিদার। সৌন্দর্য ও নান্দনিকতার শক্তি বর্বর পশুশক্তির চেয়ে লাখো-কোটি গুণ বেশি; সেই সঙ্গে সেই ব্যানারের ভাষাও। আইয়ুবের স্বৈরশাহির পশুশক্তির বিরুদ্ধে ওই মৌন শোকমিছিলের প্রতিবাদী শক্তি ছিল অপরিসীম। অতি দ্রুত তা এ দেশের ঐতিহাসিক গণসংগ্রামের উল্লম্ফন ঘটিয়ে ছেষট্টির ছয় দফা ও ছাত্রসমাজের ১১ দফা আন্দোলন ঊনসত্তরের মহান গণ-অভ্যুত্থান ঘটিয়ে দুর্বার বেগে বাঙালির একাত্তরের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্যে ধাবিত হয়। অপ্রতিরোধ্য ছিল তার গতিবেগ। গোটা জাতিকে তা গ্রানাইট পাথরের মতোই দুর্ভেদ্য ঐক্যে আবদ্ধ করে ফেলে।
জুঁই ফুলের মতো কোমল-স্নিগ্ধ কিশোরী মালালা ইউসুফজাইয়ের অকুতোভয় দৃঢ় ও অদম্য প্রতিবাদ এবং তার ওপর নৃশংস-বর্বর হামলাকারী তালেবানি পশুদের বিরুদ্ধেও গোটা পাকিস্তানকে, শাসক-জাতি সবাইকেই লৌহদৃঢ় ঐক্যে আবদ্ধ করার সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থেকেও মালালা তার বাবাকে বরাভয় দিয়ে বলেছে, 'জয় আমাদেরই হবে।' পাঁচ বছর আগে ২০০৭ সালে তালেবান জঙ্গিরা পাকিস্তানের সোয়াত উপত্যকা দখল করার পরপরই রেডিওতে ঘোষণা দিয়ে মেয়েদের জন্য স্কুল নিষিদ্ধ করে দেয়, জানিয়ে দেয় ঘরের মেয়েদের শিক্ষার দরকার নেই, তারা ঘরের বাইরে যেতে পারবে না। এ ছাড়া প্রাত্যহিক জীবনেও তালেবানরা নানা রকম বিধিনিষেধ তৈরি করে। গান বাজানো নিষিদ্ধ করে। নিষিদ্ধ করে মেয়েদের রঙিন জামাকাপড় পরা। ঘরে ঘরে টিভি বন্ধ করার নির্দেশ দেওয়া হয়। হুমকির সুরে জানিয়ে দেওয়া হয়, নাটক, সিনেমা, ইন্টারনেট- এগুলো সব হারাম। লাইব্রেরিগুলো তারা বোমা মেরে উড়িয়ে দেয়। তখন মালালার বয়স মাত্র ১১ বছর। এর প্রতিবাদে গুল মাকাই ছদ্মনামে উর্দুতে বিবিসিতে ব্লগ লেখা শুরু করে এবং অল্প সময়েই দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করে। ২০০৯ সাল পর্যন্ত সোয়াত তালেবানদের দখলে থাকে, এরপর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তালেবানদের কবল থেকে সোয়াত মুক্ত করে। স্কুল-কলেজ আবার চালু হয় এবং ছেলেমেয়েরা আবার স্কুল-কলেজে যেতে শুরু করে। কিন্তু তালেবানি ফতোয়া থেকে মালালার মুক্তি হয়নি। তালেবানরা তাকে হত্যা করার জন্য বহুবার হুমকি দিয়েছে। সরকার মালালাকে বিশেষ নিরাপত্তা দেওয়ার প্রস্তাব করেছিল। কিন্তু মালালা, মালালার পরিবার নানা দিক বিবেচনা করে সেই প্রস্তাব গ্রহণ করেনি। মালালার গভীর শিক্ষানুরাগ এবং সে প্রশ্নে তার অনমনীয় ও অদম্য মনোভাব তাকে পাকিস্তানের রোকেয়া নামে অভিহিত হওয়ার গৌরব এনে দেয়। মালালাকে শেষ পর্যন্ত জঙ্গিরা হত্যা করার জন্য স্কুলের বাসের ভেতর ঢুকে গুলি চালায়। এতে মালালা মাথায় ও ঘাড়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে কোমায় চলে যায়। তার কয়েকজন সহপাঠীও আহত হয়। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে মালালাকে পেশোয়ারের সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে নেওয়া হয় এবং গুলি দুটি বের করা হয়। তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য রাওয়ালপিণ্ডিতে নেওয়া হয়েছে। তার বাঁচার সম্ভাবনা ডাক্তাররা মাত্র ৭০ শতাংশ বলে জানিয়েছেন।
মালালা ইতিমধ্যেই তার সাহসী ভূমিকার জন্য পাকিস্তানের সর্বোচ্চ বেসামরিক রাষ্ট্রীয় পুরস্কার পেয়েছে এবং আন্তর্জাতিক পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছে। এত কিছুর পরও তালেবান নেতারা চরম ধৃষ্টতা দেখিয়ে বলেছে, এবার বেঁচে গেলেও জঙ্গিরা আবার তাকে হত্যা করবে। তালেবানরা বলেছে, ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গির জন্যই তারা মালালার ওপর হামলা করেছে এবং তার বাবাকেও এখন তারা হত্যার হুমকি দিচ্ছে। পাকিস্তানের ৫০ প্রখ্যাত আলেম জঙ্গিদের এই বর্বর হামলার নিন্দা করেছেন এবং বলেছেন, ইসলামের সঙ্গে নারীশিক্ষা বন্ধ করার কোনো সম্পর্ক নেই। মালালার মতো এক শিশুকে এভাবে বর্বর হামলা চালিয়ে হত্যাচেষ্টার জন্য সারা বিশ্বে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে এবং যে পাকিস্তান রাজনৈতিক হানাহানি ও কলহে বিপর্যস্ত, সেই পাকিস্তানের সব দল এই একটি ইস্যুতে একাট্টা হয়ে এই হীন কার্যক্রমের নিন্দা জানিয়েছে এবং সংসদ, মসজিদসহ সর্বত্র তার জীবন রক্ষার জন্য দোয়া করেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামাসহ বিশ্ব নেতা ও মানবতাকর্মীরাও কঠোর নিন্দা জানিয়েছেন তালেবানি নৃশংসতার।
উল্লেখ্য, এর আগে আফগানিস্তানে তালেবানরা শেষ পর্যন্ত গান নিষিদ্ধ করে রাখতে পারেনি, নারীদের অবরোধ করেও রাখতে পারেনি। সে সময় (১৯৯৪) তালেবান গবেষক ড. জন বেলি তাঁর এক বইয়ে লিখেছিলেন 'ক্যান ইউ স্টপ দ্য বার্ড সিংয়িং? (পাখির গান কি বন্ধ করা যায়?)। পৃথিবীর সব দেশের মানুষের একটাই প্রাণের কথা, পাখির গান, ফুলের জন্য ভালোবাসা, মানুষের নির্ভয়ে স্বাধীনভাবে জীবন-জীবিকা ও চলাফেরার অধিকার আকাশের মতোই অবারিত। কখনোই তা চিরতরে হরণ করা যায় না। সে কথাই সোয়াতে মালালার সহপাঠী রহিম বলেছে, তালেবানরা একটা মালালাকে মারলে কী? সোয়াতে মালালার মতো হাজারো সাহসী মেয়ে আছে, ওরা তাদের মুখ বন্ধ করবে কিভাবে।
মৌলবাদের ভ্রূণ সৃষ্টি হয়েছে পাকিস্তানের বিভিন্ন মাদ্রাসারূপী অস্ত্র প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে। পরে আফগানিস্তানেও তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে বিদেশি সাময়িকী ফরেন অ্যাফেয়ার্সের ভলিউম ৭৮, সংখ্যা ৬-এ তালেবানবিষয়ক বিশেষজ্ঞ সাংবাদিক আহমেদ রশিদের তথ্যসমৃদ্ধ নিবন্ধটিতে আছে : 'দ্য ক্যাম্পাস ইন পাকিস্তান অ্যান্ড আফগানিস্তান, হোয়ার দে ট্রেন্ড, বিকেম ভার্চুয়াল ইউনিভার্সিটিজ ফর প্রমোটিং ম্যান ইসলামিক রেসিয়ালিজম ইন আলজিরিয়া, ইজিপ্ট, ইয়েমেন, সুদান, জর্ডান, দ্য ফিলিপিন্স অ্যান্ড বাংলাদেশ।
অর্থাৎ পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের যেসব ক্যাম্পে তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে সেগুলো কার্যত আলজিরিয়া, মিসর, ইয়েমেন, সুদান, জর্দান, ফিলিপাইন ও বাংলাদেশের প্যান ইসলামিক রেসিয়ালিজম কায়েম করায় বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে দাঁড়ায়।)
এরই পরিণামে আমরা দেখছি, এ দেশে গণতান্ত্রিক সরকার ও সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব বিপর্যস্ত করার জন্য বারবার জঙ্গি হামলা ও হুমকি চালিত হয়ে আসছে। এ দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সুপ্রাচীন ঐতিহ্যকে বারবার বিনষ্ট করার এবং সেই সঙ্গে দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ধ্বংস করার চেষ্টারও বিরাম নেই।
সর্বশেষ আমরা গভীর বেদনা ও উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করলাম, রামু, উখিয়া প্রভৃতি স্থানের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের অহিংস ও শান্তিপ্রিয় জীবনকে, তাদের নয়নাভিরাম সব উপাসনালয়, বসতিতে সহিংস আক্রমণ চালিয়ে, বুদ্ধমূর্তিসহ বহু সাংস্কৃতিক নিদর্শন ভাঙচুর-অগি্নসংযোগের মাধ্যমে সুপরিকল্পিতভাবে বিনাশের চেষ্টা চালানো হয়েছে। এ বেদনা ও লজ্জা রাখার কোনো স্থান নেই। এ ক্ষেত্রে প্রকৃত অপরাধীরা এখন পর্যন্ত অচিহ্নিত ও ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে গেলেও এ দেশ ও সারা বিশ্বের মানুষই মনে করে এও এ দেশের গণতন্ত্র, স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও ধর্মনিরপেক্ষতার বিরুদ্ধে নেপথ্য পশুশক্তির ভয়াবহ ও চরম ন্যক্কারজনক হামলা।
অবশ্য প্রকাশিত খবর অনুযায়ী এ হামলায় অংশ নিয়েছে শত শত রোহিঙ্গা ও মাদ্রাসার ছাত্র, যাদের গাড়ি করে আনা হয়েছিল ঘটনাস্থলে।
জাতি এ ঘটনার ব্যাপারে সরকারি ও বিরোধী দলের মধ্যে কোনো করম ব্লেম গেম বা দোষারোপের খেলা দেখতে চায় না। সত্যিকার অপরাধীদের শনাক্ত করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হবে এটাই জাতির কাম্য।
পাকিস্তানে যেখানে মালালার ওপর হামলাকে কেন্দ্র করে গোটা জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়েছে, সেখানে মুক্তিযুদ্ধে জয়ী একটি জাতি হয়েও আমরা কেন এত বড় বিপর্যয়ে দলমত-নির্বিশেষে একাত্ম হতে পারব না? আজকের তরুণ প্রজন্মের এটাই জিজ্ঞাসা।
১৪.১০.২০১২

No comments

Powered by Blogger.